অনুবাদ কবিতা : রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

এলিজাবেথ উইলিস, রোজ হবার্ট ও জোসেফ কর্নেল

এলিজাবেথ উইলিস, রোজ হবার্ট ও জোসেফ কর্নেল-তিন ব্যক্তিত্ব তিন ভিন্ন ক্ষেত্রে- কবিতা, অভিনয় ও চলচ্চিত্র পরিচালনা। অথচ কী এক অভূতপূর্ব রসায়নে এই তিনটি বিষয়ের ঐক্যতান শোনা যায় মার্কিন কবি এলিজাবেথ উইলিসের কবিতায়। শব্দে, ইমেজে, সংগীতে এক সম্মেলন এক সাংস্কৃতিক যোগাযোগ সেতু যা কবিতাকে নিয়ে যায় বাস্তব ও রহস্যের মধ্যে দিয়ে এক নতুন অভিযানের পথে, রচনা করে বিশ্বের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার এক চলমান সম্পর্ক। সমস্ত কবির পায়ে পায়ে এক চিরন্তন প্রশ্ন জড়িয়ে থাকে, কবি কি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ নাকি তার নিজের প্রতি? উইলিস মনে করেন, কবি তাঁর নিজের ও সমাজের দুজনের জন্যই দায়বদ্ধ এবং মানুষের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর পরিবেশের প্রতি যেখানে তিনি বাস করেন। তিনি সেই কাব্যিক জগতে বিশ্বাসী যেখানে একজনের সিদ্ধান্তগুলো নান্দনিকতা ও নৈতিকতার সাপেক্ষে অবিচ্ছিন্ন থাকে। যাদের সঙ্গে আমরা পরিবেশ ভাগ করে নিই, সেই অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন সিদ্ধান্তগুলো্র বাস্তব প্রভাব থাকে। আর সেই প্রভাবগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তাদের সঙ্গে আপোসগুলো বুঝে নেওয়া আমাদের সম্পূর্ণভাবে বেঁচে থাকার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক বলেই কবি মনে করেন। কবিতা নির্মাণের স্বার্থ ছাড়িয়ে সমস্ত বিশ্বের প্রতি সচেতন হয়েই তাঁর এই কবিতাযাত্রা।

প্রিয় পাঠক, গত মাসের অপরজন পত্রিকায় আপনি মেই-মেই বারসেনব্রাগির গোলাপকাহিনি শুনেছেন আমার এই অনুবাদ সিরিজে। এমাসে সান্তা এল আর ফুল থাকবে না, তাই কি হয়! তাই আবার গোলাপ। এবারে মার্কিন কবি এলিজাবেথ উইলিসের গোলাপ। তবে এ দুই গোলাপ ভিন্ন মাত্রার ভিন্ন বোধের। বারসেনব্রাগির গোলাপ নির্বিরোধে মৌন আর উইলিসের গোলাপ প্রতিবাদে মুখর। বারসেনব্রাগির টুকরিতে ছিল নিউ মেক্সিকোর ল্যান্ডস্কেপে সাদা ক্যাবেজ গোলাপের সন্ধ্যাযাপন, ম্যাডাম হার্ডি গোলাপের মসৃণ ফুটে ওঠা, বর্বন গোলাপে্র সুগন্ধসমাহার, যেখানে উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের সত্তার নিঃশব্দ যোগাযোগ ঘটে শুশ্রূষায়, ভালোবাসায়; এমন এক কোয়ান্টাম বন্ধন যেন এক মহাজাগতিক সুর, যা কোনো সময়ের বন্ধনে বাঁধা পড়ে না বরং খোঁজ করে সেই সচেতনতা, যা সভ্যতা ও বিশ্বের সমস্ত জীবের মধ্যে গড়ে তোলে যোগাযোগ সেতু। আর এলিজাবেথ উইলিসের গোলাপ রুপোলি পর্দার। নাম রোজ হবার্ট। আমেরিকার বিংশ শতাব্দীর চলচ্চিত্র ও মঞ্চ জগতের এক প্রবাদপ্রতীম অভিনেতা। তিনি যদি ল্যান্ডস্কেপে ফুটে থাকা গোলাপের মতো অভিনয়ের মঞ্চে কেবলমাত্র পিছন থেকে প্রম্পট করা সংলাপটুকু বলে যেতে পারতেন সারাজীবন, তবে হলিউড বলিউড আজও উপচে যেত তাঁর খ্যাতিতে, গ্ল্যামারে। কিন্তু এ জগতে কিছু কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা কেবল নিজের জন্য বাঁচার কথা ভাবেন না, সমাজের বেঁধে দেওয়া গণ্ডি মানতে পারেন না। তাই যখন তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে বিরাজ করছেন, তখন চলচ্চিত্র শিল্পীদের কর্মক্ষেত্রের উন্নতিকল্পে শুরু করলেন আন্দোলন, যা তাঁর অভিনয় জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। ফলত ধীরে ধীরে এই প্রতিবাদী নারিটি হারিয়ে গেলেন তাঁর খ্যাতির আসন থেকে, রুপোলি পর্দার ঝলক থেকে। তারপর ১৯৩৬ সালে এলেন বিখ্যাত সুররিয়ালিস্ট চলচ্চিত্র পরিচালক জোসেফ কর্নেল। এই রোজ হবার্টকে নিয়ে ইউনিভার্সাল ফিল্ম East of Borneo থেকে নিজস্ব সম্পাদনায় তৈরি করলেন এক আলোড়নকারী পরীক্ষামূলক কোলাজ ফিল্ম Rose Hobart. রুপোলি পর্দায় হারিয়ে যাওয়া প্রতিবাদী নারিটি আবার একবার বিখ্যাত হয়ে উঠলেন জোসেফ কর্নেলের সিনেমায়। তারপর ২০১৫ সালে এই অভিনেতা রোজ হবার্ট আর পরিচালক জোসেফ কর্নেল ধরা দিলেন এলিজাবেথ উইলিসের কবিতায়; রচিত হলো প্রতিবাদ, ফিল্ম ও কাব্যের এক অসাধারণ ভাবনার আবহ; যেখানে রোজের[1] সিনেমা জগতের সঙ্গে তাঁর নিজস্ব মানবিকতার দ্বন্দ্ব এবং ফিল্ম পরিচালকের সুররিয়্যালিস্টিক কাব্যিক ভাবনা একসূত্রে বাঁধা পড়েছে।

রোজ হবার্ট শেষজীবনে তাঁর আত্মজীবনী প্রকাশ করেন Steady Digression to a Fixed Point নামে, যা এলিজাবেথ উইলিসের সাম্প্রতিকতম কবিতার সংকলন Alive, New and Selected Poems বইটিতে রোজ হবার্ট ও জোসেফ কর্নেলের নামে উৎসর্গিত একটি কবিতা। এলিজাবেথ মনে করেন কবিতা কোনো প্রকাশের ভঙ্গি নয় বরং ভাবনার এক প্রক্রিয়া। কাব্যিক ভাষা ও শব্দের শরীরী ভাষার মধ্যে যে সম্পর্ক, তাকে এলিজাবেথ যে কেবল স্বীকার করেছেন তাই নয়, তাঁর এই কবিতায় এদের দুজনকে আলাদা করা যায় না। সমস্ত শব্দেরই এক লিরিক ও শব্দার্থিক উপাদান থাকে। আর সেই শব্দনির্মিত কবিতার শরীরী ভাষাকে তিনি এক গভীর আকার হিসেবে নিয়েছেন, যা তৈরি করে এক ভাষাগত তল, যার ওপর নির্মিত হয়েছে কবিতা। আর সেই কবিতার শরীরী ভাষার ভেতর আত্মগোপন করে থাকে কবির অনুভবের ও বোধের অণুরেণুগুলো, রূপকের আড়ালে, নিরাকারের ভঙ্গিমায়। ভাবনা ও অনুভব আর পৃথক অবস্থানে নেই। মূর্তকে বিমূর্ত করে অর্থাৎ বস্তু থেকে ভাবকে আলাদা করে বস্তুর জ্ঞান ও তাদের মধ্যের সম্পর্কের জ্ঞান দিয়ে কবি তাকে উপস্থাপিত করেছেন। আসুন পাঠক, এবারে পড়া যাক রোজ হবার্ট ও জোসেফ কর্নেলের সিনেমা নিয়ে তাঁর কবিতার অনুবাদ।

প্রমিত প্রসঙ্গান্তর এক স্থির বিন্দুর দিকে (Steady Digression to a Fixed Point)
                                                        (রোজ হবার্ট ও জোসেফ কর্নেলের উদ্দেশ্যে)

একটা গোলাপ বিশ্ব পরিবর্তন করতে পারে না, শুধু মুক্ত বা বদ্ধ করতে পারে।

একটা গোলাপ বিশাল গিয়ারের মতো বিশ্বকে পরিচালিত করে।

জাহাজকে ঠেলে দেয় বোর্নিওর পুবদিকে।

একটা শরীর পুনর্বিন্যস্ত হলে একসূত্রে বাঁধা পড়ে একটা গোলাপের সঙ্গে।

গোলাপ এক অস্ত্র, এক পথপ্রদর্শক, এক কম্পাস, যা নীল রক্তাক্ত বিদারণের এক প্রত্নতাত্ত্বিক অতীতকে দেখাতে কাচ ভেঙে ফেলে। আর এভাবেই আমরা জানতে পারি আমরা এক ট্র্যাজেডির সম্মুখিন।

তোমার এমন হওয়া উচিত ছিল না। তোমার এমন হতে পারে না। তুমি করেছিলে। তুমিই।

আমরা পরিণামের টুকরোগুলো জড়ো করি।

‘তুমিই’ সে, যেভাবে আমরা কথা বলি নিজেদের সঙ্গে। “আমরা” হলাম আমি, যে নিজেকেই দেখে অন্যদের ভেতর। আমিদের একত্র করেই “আমরা”।

শিল্পসম্মিলন এক শরীর যার জন্য কোনো অব্যাহতি নেই।

এক সপ্তর্ষিমণ্ডল, এক মীন, অন্ধকারে ঘোরা এক সম্ভাবনা।

একটা লোক মেয়েটাকে স্টেজে তুলে দিল। কোন যাদুতে সে শুধুমাত্র শিল্পীদের জন্য নিজেকে দ্বিখণ্ডিত করে পুনর্বিন্যস্ত করল আমাদের চোখের সামনে?

শরীর এক প্রথাগত বাধা। যার একটাই জীবন অনন্ত গড়ার জন্য।

আকার, শিল্পের আকার আমাদের নিজেদেরই প্রতিমূর্তি।

বাঁধন খোলো, বিলম্বিত করো, গোলাপিত করো।

আমি তোমার নাম লিখছি এক বাগানে, এক ক্যামেরাবক্সে।

অতীতের সবকিছু, পটভূমির সবকিছুই অনিশ্চিত। ঘরবাড়ি জঙ্গল বিলাসবহুল খোদিত দেয়াল।

রোজ শত্রুর মুখ অস্ত্রহীন করে। এমনকি রত্নখোচিত রাজপুত্রও বশীভূত হয় ফুলেল বিকাশে।

রোজের নিসর্গে সবকিছুই ছিল অথচ মুছে দেওয়া হয়েছিল অন্তরমহলের মানচিত্র দেখাতে।

রোজ উদ্বিগ্ন। রোজ পানীয় গ্রহণ করে। রোজ বানরটাকে শিশুর মতো কোলে করে।

রোজ একটা লোকের বাহুতে ধরা দেয়। রোজ অস্পষ্টভাবে দাসত্বের ইঙ্গিতে পোষাকিত হয় আর স্যুটবুটে নিজেকে সাজায়।

রোজ কী করবে ভাবতে গিয়ে সামনে না দেখে ভেতর দেখে। নিজস্ব প্রতিফলন নিয়েই তার সংগ্রাম। রোজ মুক্তির জন্য সেজে ওঠে।

রোজ নতুন বিবাহীত মেয়ের মতো টেবিলক্লথ সামলায় অস্থিরভাবে।

রোজ সূর্যকে মিনতি করে।

রোজ জুতো পরেই ঘুমোয়। এই রূপের জন্যই জমকালো পোষাকের রাজপুত্রও তার প্রেমে পড়ে।

মঞ্চের ওপর বিছানা যা দ্বীপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রকাশ্য।

রোজ বিপদের সামনে কিন্তু সংগীত ভেদ করে তার স্বর শোনা যায় না।

নিউইয়র্ক অস্পষ্ট হতে থাকে, সরে যায় বহুদূর।

সে জেগে থাকে সারারাত, অদৃশ্য হতে থাকে।

গ্রহণের C, O

রোজ যখন জঙ্গল থেকে দূরে সরে যায়, পার্টিতে থাকে না, সে তখন চেষ্টা করে তারকাদের সংগঠিত করার।

রোজ কোন রাষ্ট্রের শত্রু?

তার মুখ থেকে নাম বের করতে পারে না তারা।

আহা, অমার্কিনি সৌন্দর্য্য গোলাপ, বাধাকে বাতাসে ভাসিয়ে আরোহণ করো যতক্ষণ না সবকিছু শূন্য হয়ে যায়।

গোলাপিত ভবিষ্যতের কোনো সাক্ষী থাকে না।

ক্যামেরাবক্সের বিশুদ্ধ বিশৃঙ্খলায় এক গোলাপ বাগান যা আমাদের বলে না মৃত্যুর সময় নিয়ে কীভাবে চিন্তা করবো, বরং এর ভেতর একটা যথেষ্ট বড় গর্ত তৈরি করতে চায়, যার ভেতর দিয়ে সূত্রটাকে নিয়ে যাওয়া যায়, এক নারীকে তার গোলকধাঁধা থেকে বের করে আনার জন্য যথেষ্ট লম্বা করতে চায়।

আমরা একটা কথোপকথনের জন্য চেষ্টা করছি। তুমি যেসব শব্দ বলেছিলে সেগুলো সব লিখে রাখতে চেষ্টা করছি আমি। কিন্তু সবকিছুই পণ্ড হল।

রোজ হবার্ট সিনেমা তোমার প্রতি তাঁর ভালোবাসা।

এটা গোলাপদের মৃত্যু নিয়ে লেখা একটা কবিতা। একটা চলচ্চিত্র যা গোলাপেই বিকশিত।

এক ‘আমি’ এক ভিন্ন সমুদ্রপ্রান্ত থেকে দেখছে এক প্রাচ্যজগৎ। রানিদের নিয়ে এই কবিতা।

বোর্নিওর পুবদিকে এক নদীর ওপর আমরা আছি। আমরা এক দ্বীপের পুবদিক যেমন রানিরা ম্যানহ্যাটনের পুবদিক।

আমরা তারকাদের উপত্যকায় আছি।

পরম্পরার বাইরে থাকা রোজ। খাদের ধারে থাকা রোজ। বাগানে থাকা এক ছুরি।

একটা দৃশ্যগ্রহণের শেষপ্রান্তে কাট। একটা দৃশ্য। একটা রিল। একটা সিনেমা।

ঔপনিবেশিকতার শেষ নিয়ে এই সিনেমা।

রোজ প্রবাহিত হতে পারে লিভারপুল থেকে নিউ অরল্যান্সের দিকে, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কালিম্যানটন পর্যন্ত। কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পুজিত হয়েছে। কলমিত হয়েছে। জাহাজে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অন্বেষণের এখানেই শেষ। স্থানীয় সংবাদদাতার কাছ থেকে অন্বেষণকারীর উদ্ধারের জন্য সুসজ্জিত স্ত্রী আসছে।

সিনেমা নিয়ে এটা এক ফিল্ম। সিনেমাটা ঘুরছে এক নক্ষত্রের চারিদিকে।

সূর্য আমাদের নক্ষত্র। রোজ হবার্টের নক্ষত্র।

আমরা সূর্যের মৃত্যু দেখছি, এক নক্ষত্র অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আলোটা নিভে এল। এক শরীর একটা সিনেমার ভেতর একটা কৌটোর ভেতর জীবন্ত কবরস্থ হল।

শেষটা পর্দার পিছনে, তার হাতব্যাগের ভেতর, ভেসে উঠছে উপরিতলে।

সিনেমা অন্ধকার হয়ে আসে, ক্যামেরা বন্ধ হয়ে যায়।

সিনেমাটা এক নৈঃশব্দ্যের। তোমার চোখ দিয়ে কথা বলা নিয়ে। হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয় যখন সে ঘরের ভেতর হেঁটে যায় দীর্ঘ পদক্ষেপে।

কবিতাটা এক আগ্নেয়গিরি নিয়ে, সিনেমাটা এক অন্তরমহলের।

বসার ঘরে যা আঁকা হয়। নিচতলায় যা জড়ো করা হয়। টেবিলের ওপর যা আলাদা করা হয়।

এক শরীরের নির্মাণ সারবাঁধা বর্জনের ভেতর দিয়ে।

স্টুডিও সিস্টেমের হিংস্রতা। ক্যালিফোর্নিয়ার সূর্য। হলিউডের তামাটে তুষারিত ক্যাথোড আলো যেমন দেখা যায় টিভিতে।

কবিতাটা এক নক্ষত্রলোক ও তার প্রাচীন আকাশচারীদের নিয়ে। এক কবির সম্পর্কে যে শহরের বাইরে বসে তাকিয়ে আছে ওপরের দিকে। সার্চলাইটের মতো একটা ইমেজ ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে আকাশে।

এক শৃগালের কবিতা, এক কুমীরের, অস্থানে রাখা ব্যাকলটের প্রাণীদের।

গভীর বেগুনিবর্ণ থকথকে জঙ্গলের পিছনে থাকা আলোর খোঁজ নিয়ে এই কবিতা। গভীরতার কবিতা।

বছরের দীর্ঘতম রাতের ওপর বিশ্রামরত তারকারা। শীতকালীন প্রাসাদ। গোলাপ প্রাসাদ।

এ এক অতিক্রমণ, গেটের বাইরে খড়ের ছাউনিতে ধরা পড়া নিয়ে। নেকড়ের মতো।

আকাঙ্ক্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা যতক্ষণ না সে পলক ফেলছে।

প্রিয় পাওলো, আমি স্বপ্ন দেখেছি আমি এটা লিখতে পারি। আমি স্বপ্ন দেখেছি বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহরের মাঝখানে আমার মুখ থেকে এ গোলাপ বেরিয়ে আসছে। যাদুঘরে খুলে রাখা এক গোলাপের ইমেজ স্বপ্নে দেখেছি। ক্যামেরাবক্সের ভেতর সে এমন ঘুরে যায় যেন জীবন্ত কবরস্থ এক মেয়ে।

রোজ এই নীল আলোর ভেতর ঘুরে বেড়ায়। সে নেমে আসছে। এক উজ্জ্বল ডিস্কের ওপর সে স্কেটিং করছে। তোমার লেন্সের পৃষ্ঠতলে সে উল্টোভাবে হেঁটে যায়।

প্রিয় রোজ, আমি সর্বদা চেয়েছি দৃষ্টি আচ্ছন্ন করা সাদা পর্দার ওপর নক্ষত্রের মতো প্রদর্শিত হতে। এক আগ্নেয়গিরির দ্বীপের মতো নিজেকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার। ক্যালিফোর্নিয়ার বাতাসের মধ্যে বয়ে যেতে চেয়েছি এমন, যেন এক কাল্পনিক জঙ্গলের ফিল্টার করা আলোর ভেতর বসবাস আমার। চন্দ্রিমায় হেঁটে যাওয়ার জন্য আমাকে দেওয়া হয়েছে পাতলা রত্নখচিত গাউন যাতে তার কণ্টকিত ঝলক অনুভব করতে পারি।

দৃশ্যের মাঝখানে রোজ পর্দাটা সরিয়ে দেয় ও এক বাধা অতিক্রম করে। সে বস্তু থেকে বিষয়ের নদী অতিক্রম করে যায়।

শিল্পী মেয়েটির দিকে নির্দেশ করে ঘটনার এক নীরব আর্কাইভের মতো।

মেয়েটি সিনেমার একমাত্র শব্দে পরিণত হতে যাচ্ছে।

সে মেয়েটির শরীরকে ঘোরাচ্ছে তার চোখ থেকে তোমার দিকে।

সে বলছে এই সিনেমা এক আয়নাও বটে যেমন সমস্ত আকাঙ্ক্ষাই একরকমের আয়না।

সে বলছে “আমিও নীরব থাকি”। “আমার বিষয় বাকি রাখি”।

এখন আমরা একে অপরের।

ডার্করুমের ভেতর। একটা চোখের পলকের ভেতর। জলযুদ্ধের মুহূর্তে।

বেড়া টপকাও রোজ, ‘কাট’ এর ওপর দিয়ে লাফাও।

এই ফিল্ম কোনো সিনেমার মৃত্যুকাহিনি নয়। এ এক চিরন্তন জীবনের কবিতা।

সে কোনো কামানের গোলা নয়। সে কোনো আগ্নেয়গিরি নয়।

সে এক মুক্তো। এক ফোঁটা দুধ। এক পরমাণু বোমা।

বর্তমান শব্দপূর্ণ। আমাদের চারপাশে সময় বয়ে যায়। কবরে ধরা আছে সেই শরীর যার শব্দ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, একটা ক্যামেরাবক্স যেখানে ছবিগুলো রাখা আছে।

নদীর মতো বয়ে যায় মন যেন সেখানে কিছু ধরার আছে, অথচ নদী শুধু এরকমই।

যখন আলো জ্বলে উঠবে তুমি ভুলে যাবে আমাকে কখনও দেখেছিলে বলে। এ সমস্তই অদৃশ্য হয়ে যাবে।

রোজ হবার্টের শরীর ঘিরে ফেঁপে ওঠা নৈঃশব্দ্যে ভরে উঠবে ঘর, শব্দ অতিক্রান্ত এক উপলক্ষ নিয়ে।

সকল নারী ও পুরুষেরা শুনুন, আমি আপনাদের দিই রোজ। হবার্ট।
———–

কবি পরিচিতি:

মার্কিন কবি এলিজাবেথ উইলিস, ফিল্ড ভূতত্ত্ববিদ ও পিয়ানো শিক্ষকের কন্যা, যাঁর কাছে তাঁর ভিন্নপাঠের হাতেখড়ি। বাহরানে কেটেছে তাঁর জীবনের প্রথম কিছু বছর। যদিও তিনি কবিতা শিক্ষক তবু তিনি সেইসব বিষয়েই আগ্রহী যেখানে শিল্পনৈপুণ্যতা ভেঙে দেয় কবিতার সীমানা এবং সেইসব উপায় যেখানে একটু মনোযোগ সাধারণ কর্মকাণ্ডকে শিল্পে রূপান্তরিত করতে পারে। এলিজাবেথের বহুল চর্চিত বই Alive: New and Selected Poems, ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় New York Review Books থেকে। বইটি ২০১৬ সালে Pulitzer Prize এর জন্য মনোনয়ন পায়। ২০১১ সালে Wesleyan University Press থেকে প্রকাশিত Address এর জন্য তিনি PEN New England/L. L. Winship পুরস্কার পান। ১৯৯৫ সালে Penguin থেকে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় বই The Human Abstract নির্বাচিত হয় National Poetry Series এ। তাঁর অন্যান্য বইগুলোর মধ্যে আছে ২০০৬ সালে Wesleyan থেকে প্রকাশিত Meteoric Flowers, ২০০৩ সালে Burning Deck থেকে প্রকাশিত Turneresque, ১৯৯৩ সালে Avenue B থেকে প্রকাশিত Second Law. তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে American Reader, BOMB, Boston Review, Chicago Review, Colorado Review, Hambone, Harper’s, The Nation, The New Yorker, Poetry, A Public Space ইত্যাদি ম্যাগাজিনে। এলিজাবেথ Radical Vernacular: Lorine Niedecker এবং Poetics of Place নামে দুটি গদ্য সংকলনের সম্পাদনা করেন যা Iowa University Press থেকে ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি কবিতা, শিল্প, শ্রমিক ও পরিবেশের সম্পর্ক নিয়ে লেখালিখি করেছেন। তিনি কবিতায় ফেলোশিপ করেন Guggenheim Foundation, California Arts Council, এবং Howard Foundation থেকে এবং Brown University, University of Denver, Naropa University, Paris X University ও Centre International de Poésie, Marseille এর রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে যোগদান করেন। এলিজাবেথ সম্প্রতি Iowa Writers’ Workshop এর ফ্যাকাল্টি মেমবার।

____________________________________________

[1] রোজ-কবিতায় এক একেকটি বাক্যে ব্যবহৃত ‘রোজ’ শব্দটি ‘Rose’ নামের প্রতিবর্ণীকরণ।

Facebook Comments

1 thought on “অনুবাদ কবিতা : রুণা বন্দ্যোপাধ্যায় Leave a comment

  1. Thank you swapanda. Elizabeth is really unique. Her bridging between social cultural and literal world with words always fascinated me.

Leave a Reply