রোমেল রহমান-এর কবিতা
মানুষের দেশ!
এই মাটি জল আঙিনার মরা রোদ, গাছ নদী ফুল পাহাড়ের সোনাচূড়া;
আকাশে বাতাসে ডানা মেলা চিৎকার, সব তুই-আমি মাটিমাটি একাকার!
আঙিনাতে আজ গুঞ্জন আচানক, মুখগুলো চেনা রোজ দেখি পথেঘাটে;
এক নদী ভেঙে পারাপার প্রতিদিন, এক হাটে করি নিয়মিত কেনাবেচা,
সেই মুখে আজ উদ্ভট বোলচাল!
মানুষের মাঝে হিন্দু-মুসলমান:
খুঁড়ে খুঁজে চলে শেকড়ের সন্ধান, কারা খাঁটি আর কারা আছে জালিয়াত!
এই মাটি-জলে তুই আর আমি রোজ, একাকার হয়ে দুলেছি বটের শাঁখে
ভুলে গেলি কেন নাটমণ্ডপ থেকে স্মৃতিশঙ্খ আজানের সুরে কাঁদে।
মাটি ভেঙে চিরে কাঁটাতার টেনে দিয়ে মানুষকে যারা করে যায় ফালাফালা
সেই অন্ধের জাগরণ পুনরায়? নাকি ভুল ছিল একজলে বাঁচাবাঁচি?!
যেই চারাগাছ আমরা দুজন মিলে রোপণ করেছি দুজনার মমতায়
তাকে ছেড়ে যাবো? তোকে ছেড়ে যাবো আমি? কেন যাবো বল? যেতে কেন দিবি তুই?
মেনে নেবো কেন এই কালো চুরমার?
মাটি তো আমার গন্ধে জড়ানো তোর মতো অধিকার।
‘পৃথিবী সবার’ শেষ হোক কাঁটাতার; সব তুই-আমি মাটিমাটি একাকার।
মানুষকে ভাগ করলে কি শেষ হয়? মানুষের খাঁটি, মানুষে কিসের খাঁদ?
এমন খঞ্জ দিনে
সেই রাত্রির কথা ইতিহাস আসমানে জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের মতো চিহ্নিত হয়ে থাক। আমাদের অপরাধ স্থায়ী ক্ষতের মতো স্পষ্ট হয়ে থাক। নক্ষত্রের বিরাম চিহ্নে প্রশ্নবোধক জেগে থাক। তারায় তারায় আঁকা হোক ক্রন্দন। আরজ করি হে, …মানুষে মানুষে আজ অবিশ্বাস স্থায়ী হোক, … মানুষে মানুষে আজ বিভাজন অম্লান হোক, … অজর হোক নিরাপত্তাহীনতা, … জয় হোক হায়েনার চোয়ালের… জয় হোক ঘাতকের শিশ্নের; … মাটি ফালাফালা হয়ে যাক ধর্ষকের উন্মাদনায়, …বন্ধ্যা হয়ে যাক সব নদী… অন্ধ হয়ে যাক সব কুঁড়ি… নষ্ট হয়ে যাক সব ডিমের কুসম! মাকালের ফল আজ আরাধ্য ফলন। এই উজ্জ্বল অধুনার দিনে আন্ধার দিকে দিকে তুমুল নিকষ। টের যে পায় সে পায়, টের যে পায় না তার চোখে চশমা দিলেও টাল খেয়ে ঘোলাঘোলা দেখে। চারিদিকে কৌশল ঘুরঘুর করে, কে যে ভালো কে যে খাঁটি, আসলে যে কে আসল বোঝা বড় দায়। মুখোশে মুখোশে ছয়লাব। জয় শুধু অন্ধকারের, লোভী আর ফেরেপবাজের। জয় শুধু গায়ে যার জোর আছে তার। যে চাটে তার জয়… চাটায় যে তারই বিজয়… চাটাতে যে জানে সে ই মহাজন! এই যে এখন আজ খুব ভয়ানক দালাল দালাল উল্লাসে চারিদিকে সোনালী রুপালী চকমকি। নেতার ন্যাকড়াবাজ চারিদিকে আজ পিলপিল। ঘেন্না করি আমি এইসব, ঘেন্না করা চাই আজ; ঘেন্না করা খুব দরকার। আমিই হারামজাদা ধিক্কার আমারে জানাই। যে আমি নিশ্চুপ থাকি এমন খঞ্জ দিনে। যে আমি নিশ্চুপ থাকি এমন পাষাণ দিনে। সেই আমি অমানুষ অধম তুমুল। সেই আমি আমারেই থুঃথুঃ দেই দর্পণে ফেলে এই মুখ।
যেই রাত্রে পিলসুজে দপ্ করে ওঠে এক ভয়, …যেই রাত্রে আগানে বাগানে ফিসফাস হয়, …যেই রাত্রে পিশাচের দল নেমে আসে, …এই মাটি জল জবা বাতাসের গন্ধ সব তছনছ হয় যেই রাত্রে। পংখের নকশায় আঁকা হয় ধর্ষণের চিৎকার। বাতাস যে হাহাকার বয়ে নিয়ে নতজানু হয়। যেই রাত্রে এইখানে এইসব ঘটে। এইখানে এইখানে এই মৃত্তিকায় নারীর শরীর ঘিরে পিশাচের উল্লাস চলে যেই রাত্রে। আমি সেই রাত্রির সাক্ষী চাঁদ, …।ঝিঁঝিঁ, …নক্ষত্র, …নদী কিংবা …পেঁচা। এই যে হাওয়া গুংগায়, এই যে মৃত্তিকা চৌচির হয় বেদনায়, নদীর সকল জল রক্তের লাল হয়ে নিজেরে জানায়, এইদেশে ফুল ফোটা নিষিদ্ধ হোক আমি চাই, …নিষিদ্ধ হোক সব সুন্দরের কৃষি। মানুষ যেখানে ভীতু মানুষের ভয়ে, সেইখানে সুন্দরের জন্ম দেয়া পাপ। নারী যেইখানে হায়েনার চোয়ালে খাবার, সেইখানে মানুষ কোথায়? কোথায় মানুষের সম্মিলিত চিৎকার?
এই সেই মাটি, যেইখানে আজ… কান পাতলেই ‘বাঁচাও বাঁচাও…’ শুনি! এই সেই মাটি যেইখানে হাত রাখলেই আত্মজার ফোঁপানির গমক টের পাই! এই সেই মাটি যার গন্ধে এখন যন্ত্রণা। আমি তারে কি দিবো নিদান? কে আমারে দিবে সান্তনা? কে দিবে একখান চান্দের রাইত ঝকঝকা? হায় হায়… জারি করে কান্দা চাই আজ…দামামা বাজায়ে কান্দা চাই আজ! নিজেরে নিজের মুখে থুঃথুঃ দেয়া চাই আজ! ঘেন্না করা চাই আজ… ঘেন্না করা খুব প্রয়োজন এখন ভীষণ। কানুনের চোখে চোখ রেখে তর্জনী তোলা চাই আজ। কোথায় মানুষ আজ? কোথায় মানুষের সম্মিলিত চিৎকার? কে বলবে প্রথম, ‘…আমি আজ এইখানে এসেছি বিচার তুলে নিতে। ’
Related posts:
Posted in: December 2019, Poetry