পাঠপ্রতিক্রিয়া : প্রশান্ত গুহমজুমদার
‘অন্তর্বতী রেখা ; আলোঅন্ধকারসহ আশ্চর্য ব্যাপ্তির সন্ধান
প্রিয়বরেষু,
আপনার নতুন বই ‘অন্তবর্তী রেখা’ পড়তে পড়তে তাৎক্ষণিক যা মনে হয়েছে, জানাই? এইসব শব্দের ব্যবহারে বিনীত অভিমত যেমন রয়েছে, তৃপ্তিও রয়েছে সমানুপাতে।
কবিবন্ধুর কাছে এ সবই সামান্য নিবেদন, আমার মুগ্ধতার, ভালবাসার।
‘অন্তর্বতী রেখা। ‘পুস্তানি থেকেই শুরু নাটমঞ্চ’ এবং ‘দিগন্ত হাতপাখা হাতে দূরের রেখায়’ কবি দেখলেন। বিস্মায়াপন্ন আমি। যেন তাবৎ মঞ্চে এই রেখাটাই অন্তবর্তী চাবিকাঠি। যে রেখা সচরাচর দৃশ্যমান নয়। কেবল মাঝেমধ্যে আভাসটুকু। তার আলোঅন্ধকারসহ আশ্চর্য ব্যাপ্তির সন্ধান কবি সমীরণ ঘোষ পেয়েছেন। পূর্বের দর্শনের প্রাপ্তিসব (যা ইতিমধ্যে প্রকাশিত ১১টি গ্রন্থে সঙ্কলিত) থেকে বেশ কিছুটা অন্তরে তিনি বোধ করছেন ‘আমার ভাষাও এক মরুভ্রম’। এ এমন এক আবিষ্কার, যা কখনোই সমষ্টিগত কোন কর্মকান্ড নয়। এই গ্রন্থে বিষয় নয়, ভাবনা তাড়না করেছে কবিকে প্রতিনিয়ত।
প্রসঙ্গত কয়েকটি বিক্ষিপ্ত পংক্তি পাঠ করা যেতে পারে:
১] রোসো রোসো, লাস্ট সিনে ছোকরা নাচবে। সূত্রধর এক কোণে লম্বা করছে/কলকের টান।
২] শ্যাওলা সরাই আর বর্ণ থেকে অশ্রুগাঢ স্তন্য ঝরে যায়
৩] রাস্তা দুদিক থেকে বিদ্যুৎগতিতে এসে মাঝখানে দাঁড়িয়ে / যেন বরফের গাছে এত শীতের ফোয়ারা/ আকাশ সেরকমই এক ধুলোভরা হাড়ের উদ্যান/ পথের যেটুকু খুন ঘাসের শীর্ষে আর বরফে চমকায়
৪] কেন বেগুনি আলো-ই তুমি পছন্দ করবে! ভাবি/ কেন বেগুনি আলোয় তুমি প্রেতরাত্রি খুলবে বার বার।
এ রকম আরো বহুবার দেখি এমন গঠন।
৪৪টি কবিতাসমৃদ্ধ ‘অন্তবর্তী রেখা’ এমন সব অপূর্ব তুলে আনে আমাদের জন্য। দেখি, ‘… ইস্পাতের ডায়েরি কাঁধে নেমে আসছে/ মড়কের তীব্রতম গান’। মড়ক আসছে। আপামর মৃত্যু। অথচ এক আশ্চর্য সঙ্গীত বাহিত! যুদ্ধের স্মৃতি, যুদ্ধের সর্বনাশ, যুদ্ধের বজ্রে জ্বলে যায় তাবৎ নশ্বরতা এবং অবশ্যই মানুষ। সেই অকাল মৃত্যুই আহরণযোগ্য কেবল, আর কিছুই নয়। নৌকো ডুবে যায়। যাপন আর স্বপ্নসাধের অলীক ব্যালকনি থেকে ভয়ংকর নাশ-এর এই রক্তরেখা আপনিই দেখতে সক্ষম হ’ন। সমীরণ, আপনি কবি, সেই দেওয়াল লিখন পাঠ করতে পারেন। অনুবাদ করেন অননুকরণীয় ভাষায়, প্রকরণে। জানান ‘…বাইশ কুঠুরি থেকে দিনভর/ কান্না আর ঝুমুর বাজছে’ আর ‘ খয়াটে পৃষ্ঠা থেকে শ্বাস তোলে মৃতের বয়ান’। তিনি দেখতে পান, অবশ্যই নির্জন অভিমানে, অনুভবে ‘…সানাই বাজিয়ে কেউ মগডালে বিবাহ ডাকছে, বিবাহের ছ্যাকড়া ডাকছে/ পিলপিল বেড়িয়ে আসছে সাপ। মনসা স্বয়ং আজ মুজরো করবেন বাসর প্রস্তুত।…আঁশ ঝরছে, চিকচিক করছে বৃশ্চিক-ভরতি টানা পথ। নীল মহাকাব্যের দিকে কীভাবে পৌঁছোয় তুমি বলো?…’। কবি সবিশেষ সংশয়ে, পাঠকও পরিত্রাণ পান না। তবু প্রকৃত গ্রন্থের অপেক্ষায় থাকি। কবি পরীক্ষাগারে জেগে থাকেন। তিনি যে জেনেছেন, ‘…ওই তো শেখের তহসিল, কোণে কাকতাড়ুয়ার/ ক্লাশ, চাঁদ জ্বেলে বসে আছে সন্ধ্যেলাগা মাঠ। বর্ণমালা দুলে যায় আদিগন্ত/ খেতের চূড়ায়…’। হায়! কে আর কবে জেগে উঠেছে এই দগ্ধ পৃথিবীতে! আমরা দেখি না, শুনতেও চাই না। রঙীন দেয়ালে অন্ধ আমরা, বধির আমরা ফুটিয়ে তুলতে চাইছি এক অন্য পথের পাঁচালি। মনস্ক পাঠক, তিনি দর্শকও, অবশ্যই দেখতে থাকেন ‘ঘটনা ঠেলছে আর দুলে যাচ্ছে সম্পর্কের রেখা’, ‘পিয়ানো বাজছে। চুয়ে আসা লহু কি বাজছে না!’
সমীরণের উচ্চারণ কখনোই উচ্চকিত নয়। তিনি তো নিজেকেই কেবল শোনাতে চান তাঁর অনুভব, তাঁর দেখা, তাঁর আবিষ্কার। মৃদু স্বরে কবি নিজেকেই উন্মোচন করে চলেন। ঘটনাক্রমে সে নিভৃত উচ্চারণ আমরা শুনে ফেলি। বাইরের মাটিতে বসে শুনি সেই আত্মগীতি। তিনি বলে চলেন ‘সাধুবাংলার থেকেও তুমি ব্যাপ্ত আর স্তিমিত নিশান/ তীরে বসে সূর্যাস্তনিঝুম ওই দূরের নৌকো ঠেলে যাও’, ‘ফিরে আসা অনেক শতাব্দীর শ্রম/ জলের সমাধি শুধু অবিনাশ সূত্র রেখে যায়’, ‘আমি কি প্রস্তুত! সেই প্রশ্নে উথলে উঠছে চুলা/ একটি প্রদীপ শুধু কেঁপে কেঁপে রাত্রিকে ধারালো করছে।
তাঁর সেই একান্ত বয়নপ্রণালীর স্বরূপ দেখে যাই। একদা কবি বলেছিলেন, ‘আমি ওই ফল ভেঙে, বল্কল, বাৎসরিক চক্র-সমাহার / তুলে আনি কবিতানামক স্পর্ধাভার সামান্য খাতায়’। কবিতা তখন স্পর্ধাভার, এমন মনে হয়েছিল। ক্রমে সহজ তিনি নিজের সঙ্গে। ক্রমে তাঁর মনোনিবেশ আপাত-অসামান্যে। তিনি আহরণ করেন সে দৃশ্য ‘এখন আকাশ রোদের অসামান্য সুরে/ ধুয়ে দিচ্ছে গেরস্থের আঁশ/করতলে ভুবন দোলানো মেয়ে ইঙ্গিত করছে/ শেখো…’। সময়ের অনুষঙ্গে তাঁর প্রতীতি হয় ‘…হত্যার স্বরলিপি সন্ধ্যে ছড়াচ্ছে ভাঙা চাঁদে / জ্যোৎস্না সহাস্যে খোলে লাশের বিপুল পটভূমি।‘ তিনি অনলস ভ্রমণে অবগত হন, ‘… শেষ অব্দি আরও এক অন্ধকারেই হয়তো পৌঁছলাম, সন্ত বললেন,/ কিন্তু এই যাত্রাও তো মিথ্যে নয়, যা ভেতর শলাকার মতোই/একবিন্দু খোঁজ বিঁধেছিল…/ টেনে তোলা কাঁটা, রক্তলেপা সূচিমুখ, আর লম্বা আরাম’।
সমীরণের কবিতা আমাকে স্বস্তি দেয় না। জাগিয়ে তোলে। ঘুমোতে চাই আমি, পরিত্রাণ চাই নিজস্ব্ব এক গোলকের মধ্যে। হয় না। আমাকে টেনে রাখে এই কবির দেখা, প্রকাশ, ভাবনা, দর্শন। নিবিড় বর্ষণের রাত্রে আমি টের পাই, এই যে অনর্থক বেঁচে থাকা এবং দিনাতিপাতের লোভ, আকাঙ্খা, সে দুইয়ের মধ্যেও আরেক সম্ভাবনার রেখা এই মেরুগ্রামে রয়েছে কোথাও। ধাবমান অশ্বকে, অনিশ্চিত দৌড়কে তখন বলতেই হয়, ‘…ঘোড়াকে থামাও, আর তোমার সংশয় তাকে ব্যক্ত করো’, নজর করো, নিজেকেই শোনাই ‘…এসবই দৃশ্যমাত্র। প্রকৃত গ্রন্থ খোলে। পশ্চাতে পোড়া ঘর, পোড়া গবাদি তৈজস/ আর দ্বন্দ্বক্ষত গ্রামের সুবাস।‘
‘অন্তর্বতী রেখা’ আমাকে আরো বহুদূরে নিয়ে যায়। আমাকে যেতে হয়। আর নিজের এই অকিঞ্চিৎ জীবনকে দিয়ে যেতে থাকি অদ্ভুত এক কুটিল সময়, নপুংসকের ক্রোধ, দুর্বলের গ্লানি এবং পুনরাধুনিক আনন্দ।
কবিতার জন্য ভালোবাসা, না কি ভালোবাসার জন্য কবিতা- এমন টানাপোড়েনেই সমীরণের সাম্প্রতিক প্রকাশ ‘অন্তর্বতীরেখা’ এতদূর নিয়ে আসে আমাকে।
আমার এই পাঠে অসামান্য প্রচ্ছদ-ও হয়ে থাকে অনিবার্য এবং অন্যতম অনুপ্রাণনা।
কাব্যগ্রন্থ: অন্তর্বতীরেখা
লেখক: সমীরণ ঘোষ
Posted in: Criticism, December 2019