ছোট ছোট সান্তা : মণিদীপা সেন

পশমি কম্বলে রোদ্দুরের গন্ধ জমিয়ে রেখেছিলাম। রাত হলেই আজকাল তা বারুদের মত ঝাঁঝালো হয়ে উঠছে। পাঁচ মাসের মাথায় আমার পাঁচটা কুকুর বাচ্চা মরে গেল সেদিন। দেড় দিন ধরে ভুগতে ভুগতে যখন রক্তবমি করল, প্রার্থনা করলাম। ওদের মৃত্যুর। সবচেয়ে প্রিয় কুকুর বাচ্চাটা সবার শেষে মরেছিল। অত্যন্ত ধীরে মাথাটা পেছনদিকে হেলে গেল, শরীরটা সোজা হয়ে গেল। বাইরে শোরগোল। নাগরিকত্ব দেওয়া নেওয়া ইত্যাদি। একটা বস্তায় ওদের নরম শরীরগুলো ভরছিল বাবা। কোনোকিছু যা প্রিয়, তার মৃতদেহের ভার আমি সেদিন বুঝলাম। বিকেলে সিঁড়ির তলাটা পরিপাটি, ওদের রেক্সিন শিট, জলের জায়গা, খাবারের প্লেট, গায়ের চাপা কিচ্ছু নেই। যা ছিল, তা ‘আর নেই’-এর শূন্যতার চাপ, সেদিন বুঝলাম।

শেষ সময়ে জলের কাছে গিয়ে মুখ খুলতে পারছিল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে জলটা দেখছিল। পা চুবিয়ে অনুভব করছিল। বাঁচানোর চেষ্টায় চামচ, সিরিঞ্জ দিয়ে জল দেওয়া হচ্ছিল। রাখতে পারছিল না যদিও। কিছুক্ষণ পরেই বমি।

আমিও রাখতে পারলাম না। আমরা রাখতে পারলাম না বা পারছি না, যা ছিল। যা আছে। সবটাই মরতে বসেছে। আমরা কেউ কেউ জোর করে জল খাওয়াতে চেষ্টা করছি মাত্র।
ঠিক এইসময় সম্পাদক জানালেন, থিম হচ্ছে “সান্তা আসছে”। কিন্তু আমি লিখতে বসে কি লিখব? উড়ান থামিয়ে খাঁচা বিক্রি করার মত অপারগ সময়ে দাঁড়িয়ে একটা কেন , হাজারো ডিসেম্বর ২৫ শেষ হয়ে যেতে বসছে । যে শহরটা আলোর জেহাদি আজ, দিনরাত রকমারি বয়স মিছিলে হাঁটছে, সোচ্চার ” না” বলছে সেখানে কতটা উন্মুখ হবে কেকের গন্ধ? সন্দেহ হয় বা আশংকা, সান্তা সত্যি আসবে তো?
কিছু প্রবোধের ঘটনা মনে পরে। কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় দুমাস ভর্তি। বাচ্চাদের ওয়ার্ডটা দুভাগে ভাগ করা ছিল। একদিকে জেনারেল বেড অন্যদিকে তিনটে জেনারেলসহ চারটে কেবিন। আমি ছিলাম দ্বিতীয় ভাগে। পুজোর পর ভর্তি হওয়া থেকে পলকা হেমন্ত চলে গেছে। হাসপাতালের দুধে চকোলেট গুঁড়ো মিশিয়ে খেতে গেলে সেটাও ওষুধের মত লাগে। তার চেয়ে নাইট শিফট নার্স আন্টিদের সাথে চায়ে মুড়ি ভিজিয়ে খাওয়াটা বেশি ভালো লাগত। এরকমই সময়ে একটু করে বেড়ে উঠছিল একটা ২৫শে ডিসেম্বর। তখনকার বাচ্চারা সান্তা সম্পর্কে এত ওয়াকিবহাল ছিল না। শুধু লাল জামা লাল টুপি সাদা দাড়ি পিঠে ঝোলা এক বুড়ো এইসময় গ্রিটিংস কার্ডে নির্মল হাসত। এটুকুই। তা ক্রিস্টমাসের আগের দিন বাচ্চাদের ওয়ার্ড সাজানো শুরু হল। শেষও হল। কিন্তু আমাদের দিকটা বাদ পড়ে গেল। হয়ত আয়তনে আমরা কম ছিলাম বলেই। কাচের পার্টিশনের এপার থেকে দেখছি রঙিন পার্থক্য । পরের দিন মেট্রন আন্টি এলেন। সবার বেড ভিসিট করলেন। তার পোশাকের সাদা যেন অন্যান্য নার্সদের থেকে আলাদা, বড় বেশি নিভাঁজ৷ আমার বেডে আসলে আমি কথা বলি না রাগ করে। উনি জানতে চাইলে আমিও জানতে চেয়েছিলাম সেদিন কেন এই বিভাজন? আমাদের দিকটা সাজানো হল না কেন? একটুও সময় না নিয়ে তিনি দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন। তারপর নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের ২৫…তখন মনে হয়েছিল সান্তার লাল জামা কখনও সাদাও হয়, কিন্তু তাতে সান্তা, সান্তাই থাকে। আসলে পোশাকের পার্থক্যে কীইবা আসে যায়!
যেমন কীইবা আসে যায় যদি মন্দিরে বিগ্রহ না থেকে একটা গাঢ় উজ্জ্বল গোলাপি রঙের স্টার ঝোলে? মানুষ ঈশ্বরকে চাক্ষুষ করতে না চেয়ে বিশ্বাসকে বিশ্বাস করতে শেখে? এই হরতালের দেশে, কিছু নোংরা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিটা মানুষ যদি চার্চের মত নিস্তব্ধ শান্তি নিয়ে দাঁড়ায় তাহলে কি হবে জানেন? “দ্য লিটল ম্যাচ গার্ল” গল্পের ওই বাচ্চা মেয়েটার মত ঠাণ্ডা রাস্তায় সকলের উৎসব যাপনের মাঝে ভারতবর্ষটাকে মরতে হবে না। আগামীর প্রতিটা ডিসেম্বরে সান্তা তার জাদু-মানচিত্রে দেখবে এমন একটা দেশ, যেখানে তুষারপাত হয় না কিন্তু ক্রিস্টমাসের রাতে ভাষা- পোশাক- আচারবিচার নির্বিশেষে কিছু মানুষ মাথার পাশে একটা করে মোজা রেখে শোয়।

Facebook Comments

1 thought on “ছোট ছোট সান্তা : মণিদীপা সেন Leave a comment

Leave a Reply