আমার সান্তা : দিশারী মুখোপাধ্যায়

সান্তা বলে কেউ কখনো আমাদের কাছে আসেনি। প্রায় দিনই আসত পাঁচু বাউরি।

তখন ছিল নতুন আলু ওঠার সময়। মাটির তলা থেকে উঠে আসছে বস্তা বস্তা ঝকঝকে হাসি। মোজার ভেতর থেকে চকলেট পাওয়ার গল্প তখনও শুনিনি। সত্যি বলতে মোজাই চোখে দেখিনি তখনো। পরে যখন মোজা পরতে গিয়ে পায়ের ফাটা চামড়ায় আটকে গিয়ে চড়চড় করে লাগত তখনও ভেবে কূলকিনারা করতে পারিনি কীকরে মোজার ভেতর থেকে উপহার পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু গল্পটা যখন শুনেছি এবং স্কুলের আঁকার খাতায় সেটাকে ধ্যাড়িয়েছি তখন মাঠের সেই আলগা মাটির তলা থেকে উঠে আসা নতুন আলুর কথাই মনে এসেছে।

মাঠ থেকে এক ঝুড়ি দাগি আলু নিয়ে ফিরছিল পাঁচু বাউরি। সেই ঝুড়ি থেকে একটা আলু গড়িয়ে পড়ে গেল আমাদের বাড়ির সামনে। আমার সামনে। আমি সেটা দেখতে পেয়েই খপ।
উঠোনে মাটির তৈরি ত্রিনয়নী উনোনে (একালে হলে লোকে বলত থ্রি জি) প্রায় দিনের মতই শুকনো বাঁশ পাতার জ্বালে ধান সেদ্ধ করছিল মা। সেই হাঁড়ির তলায় ভুসোকালি উপর্যুপরি ঘন স্তর। ভেতরে ধানের মধ্যে আলুটা ফেলে দিয়ে উনোনে শুকনো বাঁশপাতা গুঁজতে লাগলাম আর আড় চোখে চোখে হাঁড়ির দিকে লোভাতুর আমি। সেদ্ধর কাজ সম্পূর্ণ হলে ধানের মধ্য দিয়ে হাঁড়ির মুখ থেকে ভাপ উঠতো।
দুহাতে হাঁড়ির পেটের কাছটা, দু’টুকরো ন্যাকড়া দিয়ে, কায়দা করে ধরে সেই হাঁড়ি উঠোনে উপুড় করল মা। আমি একটা কঞ্চি দিয়ে সেই ধানের মধ্যে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুঁজতে লাগলাম। আপনাদের বুঝতে সুবিধা করার মত করে বললে ওটাই সান্তা ক্লজের উপহার।
উবুজ্বলন্ত সেই সেদ্ধ আলু দুহাতের তালুতে ভেঙে আলগোছে মুখে। জিভে ছ্যাঁকা লাগছে। লাগুক।

আজও মোজা পরতে গেলেই সেই আলুসেদ্ধর কথা মনে পড়ে। আর স্পষ্ট দেখতে পাই পাঁচু বাউরিকে। সেই-ই আমার সান্তা। তার ঝুড়িটা (মোজা) হয়তো ইচ্ছে করেই একটু কাত করে একটা আলু ফেলে দিয়ে গিয়েছিল আমাকে উপহার দিতে চেয়ে।

তেমন সান্তার অপেক্ষায় থাকে এখনও গ্রাম বাংলার, বস্তি বাংলার অসংখ্য ছেলেমেয়ে।

Facebook Comments

Leave a Reply