যেখানে দেখিবে ছাই……সম-ভাবনা থেকে সম্ভাবনায় : ধ্রুব চক্রবর্তী
সম্ভাবনার শরীরেই কি সম-ভাবনাগুলো লীন হয়ে থাকে, বহুবীজ ফলের মত? বহু সম-ভাবনার বীজ থেকেই কি কোনো বিশেষ সম্ভাবনার উন্মেষ? কিংবা সম ঋদ্ধি থেকেই সমৃদ্ধির সূচনা? যা যা আমাদের প্রতিপালন দান করে সেইসব ‘পদ’ এর সম অন্বয়ই কি সম্পদ?এইসব ঔৎসুক্যের সম অন্তরালে বহুত্বের ভাবনাটিও সম-উচ্চারিত হতে থাকে মননে,গভীরতর বোধে।প্রেক্ষিত বদলে যায়, পারম্পর্য টিকে থাকে। নতুন চেহারায় নতুন ভঙ্গিমায় সমতার বিকাশ ও প্রকাশ ঘটে। আমরা যারা এহেন সম অজত্বের (সমাজের) একজন হয়ে বেঁচেবর্তে থাকি তারা টেরও পাই না কিভাবে সমাপতিত হতে হতে ঘটনাক্রম আমাদেরকে সৃষ্টিধারায় নিযুক্ত করে। এই নিযুক্তির রসায়নে লিপ্ত আমাদের জীবনযাপন, লিপ্ত হওয়াই আমাদের একমাত্র চর্যা, আ-চরণ অভিব্যক্তির অভিমুখ।
মানবসভ্যতার তথাকথিত অগ্রগমনের মূলমন্ত্র -পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলা।এই একমুখী প্রতিজ্ঞার লক্ষণা এবং ব্যঞ্জনা, অন্তর ও বাহির সম্পর্কে অনুপুঙ্খ ধারণা লাভের সদিচ্ছাই আমাদের পৌঁছে দেয় উপরিলিখিত জিজ্ঞাসার বিবর্তে। আসলে, আমাদের পৃথিবী যে অখণ্ড মণ্ডলাকার বিশ্বপ্রকৃতির অসংখ্য উপাদানের অন্যতম মাত্র, যা আমরা প্রকাশ্যত স্বীকার করি না অথচ ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস করি।সভ্য মানুষের এমত দ্বিচারিতার ফলশ্রুতি হল, পৃথিবীকে কেবলমাত্র মানুষেরই বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে নিতে বিগত কয়েক হাজার বছরের কর্মকাণ্ড। সার সত্যটি হল, অখণ্ড মণ্ডলাকার বিশ্বপ্রকৃতির একটি নিরতিশয় ক্ষুদ্র অংশ পৃথিবী, যাকিনা সর্বতোভাবেই পারস্পরিক নির্ভরতার ভিত্তিতে বিশ্বপ্রকৃতির অন্যান্য অংশের সঙ্গে যুক্ত অবস্থানে বর্তমান। সুতরাং পার্থিব অস্তিত্ব অনস্তিত্বের যাবতীয় সম্ভাবনাও ঐ অখণ্ডতার অন্যতম পরিপূরক সত্তা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
সম্ভাবনা = সম + ভাবনা
কোনো বিষয়কে ‘সম’ এই বিশেষণে বিশেষিত করার তাৎপর্য হল ঐ একই প্রকার আরো একাধিক বিষয়ের উপস্থিতিকে স্বীকার করে নেওয়া। সুতরাং সম-ভাবনাগুলোর পারস্পরিক অবস্থানের বাস্তবতাই সম্ভাবনার জাতক হিসাবে ক্রিয়াশীল। কিন্তু যখন সম-ভাবনাগুলো ‘সম্ভাবনা’য় পরিণত তখন যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির(ম্ভ) এহেন মাত্রাবৃদ্ধি (ম এর এক মাত্রা, ভ এর একমাত্ৰা, ম্ভ এর দুই মাত্রা) ধ্বনি সংশ্লিষ্ট ধারণারও প্রসারতা নির্দেশ করে, কারণ যা ধারণা বহন করে তাই ধ্বনি। শুধু তাই নয়, প্রকৃতপক্ষে ধ্বনিকে/ধারণাকে/ভাবকে বরণ করে বলেই বর্ণ। আর বর্ণকে অবলম্বন করে যেহেতু শব্দের নির্মাণ অতএব শব্দ নিজেই ভাবের আধার বা ভাবনা। সুতরাং এক্ষেত্রে ম ব্যঞ্জনধ্বনি ও ভ ব্যঞ্জনধ্বনির বাহক যথাক্রমে সম ও ভাবনা এই দুই শব্দেরও ভাবগত প্রসারতা নিশ্চিত। কাজেই, সম্ভাবনা শব্দটি সম-ভাবনার প্রসারিত গুচ্ছকে বহন করছে একথা স্বীকার্য।
সংস্কৃত ভূ ধাতু থেকে উৎপন্ন ‘ভাবনা’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল, ‘ভাবন’এর আধার ,‘হওয়া’ ক্রিয়াকে যা চলমান রাখে বা রাখছে। অর্থাৎ ভাবনার মধ্যে অন্তর্লীন থাকে বিশ্বপ্রকৃতিতে যা কিছু ‘হয়’ তার কার্যকারণ সম্পর্কের আলোচনা। এক একটি পৃথক ভাবনা স্বাভাবিক নিজস্বতা বজায় রেখেও পারস্পরিক নিরন্তর এক ভাবনা স্রোতের প্রবাহ নির্মাণ করে চলতে থাকে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অসংখ্য ভাবের কণা (particle) সমন্বিত ভাবনা প্রবাহে তাই বিশ্বপ্রকৃতির সৃষ্টি ও স্থিতির আন্তরিক দ্বৈরাজ্য (duality), যেখানে সুপ্ত থাকে গুপ্ত থাকে বস্তু থেকে ভাবে বা ভাব থেকে বস্তুতে উপনীত হওয়ার যাবতীয় দিশা সংকেত। আধুনিক পদার্থবিদ্যা একেই disorder বা chaos নামে অভিহিত করেছে। প্রকৃতপক্ষে এই chaos অবস্থাই সম-ভাবনার অনুকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতি, বিজ্ঞানের ভাষায় necessary & sufficient condition। আমরা যারা বস্তু পৃথিবীর বাহ্যিক পরিচয়টুকু মাত্র সম্বল করে জীবনযাপনে অভ্যস্ত তাদের সাধারণ তথ্য নির্ভর জ্ঞানে ভাবজগতের ঐ disorder বা chaos আপাতভাবে বিচ্ছিন্ন বা বিযুক্ত চেহারায় ধরা পড়ে এবং শিক্ষিত দক্ষতায় আমরা আলু-পটল বাছাবাছির মত করে আমাদের জ্ঞাত তথ্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ভাবনাটিকে গ্রহণ করি বাদবাকি অমূলক বিচারে বর্জন করে থাকি। এহেন ডিটারমিনিস্টিক ছুঁৎমার্গ আধুনিক সভ্যতাকে বহিরঙ্গে প্রভূত স্মার্ট ঝকঝকে করেছে ঠিকই কিন্তু তার ভাবনার ক্ষেত্রটি সংকুচিত হয়ে বসে আছে। নিকট অতীতের বলিউডি ছায়াছবিতে শোনা একটি সংলাপ এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য, সংলাপটি এরকম ছিল যে, বৃদ্ধ পিতা তাঁর অতি উচ্চাশী পুত্রকে দুনিয়াদারি শেখাতে গিয়ে বলছেন ‘নজদিকি ফয়দা ছোড়কে দূর কি লোকসান কি বারে মেঁ শোচনা চাহিয়ে’।
‘নজদিকি ফয়দা’ বা আশু লাভের লক্ষ্যে statistical data ভিত্তিক যে টুকরো টুকরো ভাবনা তা সম-ভাবনার probabilistic field এর সাপেক্ষে নিতান্তই infinitesimal, অথচ এহেন পদ্ধতির সাহায্যেই আগামীর সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ফলত কোনো সম্ভাবনা সময়কালে অনুপযুক্ত এবং পরিত্যক্ত ঘোষিত হলেও কিন্তু তার শেকড়ে লেগে থাকে সম-ভাবনার probabilistic field, অতএব ‘দূর কি লোকসান’ই অনিবার্য পরিণতি। আসলে, এই বিশ্বসংসারে যা কিছু ‘হয়’ সেসব যা কিছুই ‘হয়েছে’ তার রূপভেদ মাত্র এবং যা কিছু ‘হবে’ তার আকর। সুতরাং, ভাবনামাত্রেই বহুমাত্রিক ও সমসত্ত্বরূপে বর্তমান,যা স্বভাবতই ভবিষ্যের যাবতীয় সম্ভাবনার জাতক।
(বিশ্ববিধির একটা নিয়ম এই দেখিতেছি যে, যেটা আসন্ন, যেটা উপস্থিত, তাহাকে সে খর্ব করিতে দেয় না। তাহাকে একথা জানিতে দেয়না যে, সে একটা সোপান পরম্পরার অঙ্গ। তাহাকে বুঝাইয়া দেয় যে, সে আপনাতে আপনি পর্যাপ্ত। ফুল যখন ফুটিয়া ওঠে তখন মনে হয়, ফুলই যেন গাছের একমাত্র লক্ষ্য – এমনই তাহার সৌন্দৰ্য্য, এমনি তাহার সুগন্ধ যে, মনে হয় যেন সে বনলক্ষ্মীর সাধনার চরম ধন। কিন্তু সে যে ফল ফলাইবার উপলক্ষ মাত্র সে কথা গোপনে থাকে – বর্তমানের গৌরবেই সে প্রফুল্ল, ভবিষ্যৎ তাহাকে অভিভূত করিয়া দেয় না। আবার ফলকে দেখিলে মনে হয়, সেই যেন সফলতার চূড়ান্ত কিন্তু ভাবী তরুর জন্য সে যে বীজকে গর্ভের মধ্যে পরিণত করিয়া তুলিতেছে, এ কথা অন্তরালেই থাকিয়া যায়। এমনি করিয়া প্রকৃতি ফুলের মধ্যে ফুলের চরমতা, ফলের মধ্যে ফলের চরমতা রক্ষা করিয়াও তাহাদের অতীত একটি পরিণামকে অলক্ষ্যে অগ্রসর করিয়া দিতেছে।
– আত্মপরিচয় ১, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কম্পিউটার এবং মোবাইল ফোন যন্ত্রের উপর আধুনিক মানুষের নির্ভরতা সর্বজনবিদিত। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী মাধ্যমে তাদের উৎপাদনের গুণপনা এবং কাৰ্য্যকারিতা প্রচারে তৎপর, উদ্দেশ্য একটাই, যেভাবে হোক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়িয়ে তোলা। কিন্তু একথাতো ঠিক যে, নির্মাতার পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপিত তথ্যগুলো sample survey-জাত statistical data মাত্র। যে সমস্ত যন্ত্রের accessibility শুধুমাত্র দুই কিংবা তিন মাত্রিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ, তাদের বিষয়ে হয়তো নির্মাতার দেওয়া তথ্যাবলী ব্যবহারকারীকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ/পরিচালন করতে সক্ষম, কিন্তু কম্পিউটার এবং মোবাইল ফোন জাতীয় যন্ত্র, মহাশূন্যের বহুমাত্রিক স্পেস যাদের অবলম্বন এবং অধিকরণ তাদের ক্ষেত্রে জ্ঞাতব্য তথ্যাকারে দেওয়া user manual নিছক হাতেখড়ি। তাই একজন ইন্টারনেট বা সেল ফোন ব্যবহারকারী খুব অল্পদিনের মধ্যেই হাতেখড়ির পাঠ চুকিয়ে নিজের ভাবনাকে ত্রিমাত্রিকতার গণ্ডী ছাড়িয়ে সম-ভাবনার রিম্যানিয়ান স্পেসে নিয়ে গিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়। যা কেবল অনুভবে আছে তাকে প্রত্যক্ষে পাওয়ার এহেন প্রচেষ্টা এতকাল অবদমিত অপরিচিত ভাবজগতের দরজা খুলে ধরতে থাকে আর ব্যাপক পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে গুণোত্তর প্রগতিতে সম-ভাবনার মাত্রাগত বৃদ্ধি ঘটেই চলে। মুশকিলটা হল, এভাবে ভাবনার সমীকরণের ফলে নিত্যনতুন যেসব সম্ভাবনার ক্ষেত্র উন্মোচিত হতে থাকে, নির্মাতা কিংবা রাষ্ট্র অথবা সমাজ-সভ্যতার অভ্যাসিত তথ্যভাণ্ডার তাকে জানতে-চিনতে পারে না। কারণ, ক্রমাগত যোগসাধনের ফলে dynamic probabilistic field এর প্রতিটি ভাবনাই mutually exclusive অতএব প্রত্যেকটি সম্ভাবনাই equally likely এবং এমত বিশালায়তনকে বিচার-বিশ্লেষণ করার সামর্থ্য সমাজ-সভ্যতার নেই। এই জানতে-চিনতে পারার অক্ষমতাই আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আশঙ্কিত আতঙ্কিত করে তোলে, অতএব বিভিন্ন আইন প্রণীত হয় যা আদতে ঐসব যন্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে একধরণের ডিটারমিনিস্টিক ছুঁৎমার্গ। অর্থাৎ, যে আধুনিক সমাজ-সভ্যতা একাধারে কম্পিউটার savvy প্রজন্ম তৈরী করতে যারপরনাই তৎপর, অপরদিকে তাকেই মোবাইল বা ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্র সীমিত করে তোলার ব্যবস্থা নিতে হয়। কিন্তু উপভোক্তা বা ব্যবহারকারী যে নামেই ডাকা হোক না কেন তার ভাবনা জগতে ঐসব ছুঁৎমার্গ কোনো প্রভাবই ফেলতে পারে না, তাদের সম-ভাবনার ক্ষেত্র ক্রমশই বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর হয়ে চলে।
যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি নামক তথাকথিত উন্নত ব্যবস্থা প্রয়োগ ও প্রসারের সূচনায় যে গুরুত্বপূর্ণ ভ্রান্তি থেকে গেছে আর সেটাই যে এহেন আত্মপ্রবঞ্চনার কারণ, একথা অনস্বীকার্য। প্রবক্তারা অযথা ডিটারমিনিস্টিক হতে গিয়ে মানুষ নামক জীবপ্রজাতির ভাবনার ক্ষমতাকেই বিবেচনায় রাখেননি, ফলে মানুষের স্বাভাবিক উদ্ভাবনার ক্ষেত্রটিও আড়ালেই থেকে গেছে। আর এই উদ্ভাবনার কারণেই প্রতিনিয়ত সম-ভাবনার যোগ বন্ধন ঘটে চলেছে এবং তার self-generative স্বরূপটি আধুনিক প্রবক্তাদের পরিকল্পনায় ধরা পড়েনি। সুতরাং, অত্যাধুনিক ক্যামেরা সমন্বিত মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনে লাস্যময়ী ভঙ্গিমায় চটুল নারী দেহের প্রদর্শন একদিকে যেমন ঐ যন্ত্রের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়িয়েছে, তেমনই বিজ্ঞাপিত সামগ্রীটির সাথে সাথে ঐ নারীশরীরটিও উপভোক্তার কাছে একটি পণ্য বা ভোগ্যবস্তু হিসাবে পরিবেশিত হচ্ছে। ফলত প্রলুব্ধ ব্যবহারকারীদের বদান্যতায় যথেচ্ছ নারী শরীরের বা গভীর ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবিও সহজেই sms/mms/whats app এর মাধ্যমে চারিয়ে যাচ্ছে ছড়িয়ে যাচ্ছে আকৈশোরযুব মননে।
এতে অসীম অনন্ত ভাবজগতের প্রতিসাম্য ঠিকই বজায় থাকছে, শুধু পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের রোজকার আটপৌরে সামাজিকতার মানচিত্র। আর এই মানচিত্রকে অটুট রাখার দায় যাদের তারা অর্থাৎ রাষ্ট্র বা সমাজ যেন ইঁদুর-বিড়াল খেলায় নেমে পড়েছে। আপনাকে, আমাকে নানাবিধ শাসনের গণ্ডীতে চলাফেরা করতে হচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকা মোবাইল ফোনটি যে আতঙ্কবাদীর হাতিয়ার নয় তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না, অথচ একটি নামী শোরুম থেকে আপনি যে মোবাইল ফোনটি এইমাত্র কিনে বেরোলেন সেটি সম্পর্কে এরকম কোনো অনিশ্চিতির বিধান নেই। দোকানের মালিক বা যে কর্মচারীটি নির্মাতার দেওয়া সামান্যটুকু তথ্যের সাহায্যেই আপনার/ক্রেতার বিশ্বাস(?)অর্জন করে যন্ত্রটি বিক্রি করছে, সম-ভাবনার পরিমণ্ডলে তার এবং ক্রেতার অবস্থান একই বিন্দুতে নয় কি? উভয়েই ফেসিলিটি নামক বস্তুবাদী প্যারাডক্সে আচ্ছন্ন, উভয়েরই স্বাভাবিক বিচারবোধ একদেশদর্শীতায় আক্রান্ত। প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকা মোবাইল ফোনটির যদি আতঙ্কবাদীর হাতিয়ার হওয়ার সম্ভাবনা থেকে থাকে তবে একটি শোরুমে বা গোডাউনে প্যাকেটবন্দী যত হাজার হাজার মোবাইল বা কম্পিউটার যন্ত্র পড়ে আছে, সম-ভাবনার এক্তিয়ারে সেগুলোও তো পড়ে। সুতরাং আতঙ্ক(!) থেকেই যাচ্ছে, আইনের প্রবক্তারা যেহেতু statistical data ভিত্তিক ঘটনাকেই গ্রাহ্য করায় অভ্যস্ত অতএব উপভোক্তা মাত্রই ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’র ফাঁসে আবদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে, পাঠক, সম-ভাবনার পরম্পরাকে সম্যক অনুধাবন না করেই যদি সম্ভাবনা নিরূপণ করা হয় তবে এই বিচ্ছিন্নতা বা বিশিষ্টতা অবশ্যম্ভাবী, যা কালক্রমে জনক সত্তাটিকেই অর্থাৎ সম-ভাবনার পরম্পরাকেই অপরিচয়ের অন্ধকারে ঠেলে দেয়, আর অন্ধকার মানেই আতঙ্ক, যা জানিনা যাকে চিনিনা সেইতো অসম্ভব। তাই, সম্ভাবনা এবং সম-ভাবনার মধ্যে এক দুরপনেয় দূরত্বের প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়।
(Heraclitus says: ‘There is one wisdom, to understand the intelligent will by which all things are governed through all’. Essentially this is a characteristic feature of nature, individualities emerge from the global. A town emerges from the countryside, in which it is embedded. This is against the idea that evolution is independent of the environment. Life needs air and water all the time. We have “life” interacting with “no-life” all the time. – IS FUTURE GIVEN? By ILYA PRIGOGINE, Nobel Laureate in Chemistry, 1977, Copyright 2003 by World Scientific Publishing Co. Pte. Ltd. Singapore 596224.)
প্রসঙ্গ:বৈজ্ঞানিক ভাবনা –
তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার
করিয়া দিয়েছ সোজা,
আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি
সকলি হয়েছে বোঝা।
এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু, নামাও –
ভারের বেগেতে চলেছি, আমার
এ যাত্রা তুমি থামাও।
(ভার-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খেয়া কাব্যগ্রন্থ)
যতদিন মানুষের জ্ঞানান্বেষণ প্রাকৃতিক অস্তিত্বের পরিধিতে ছিল অর্থাৎ বিজ্ঞানের পরিভাষায় physical ছিল ততদিন বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ অর্থাৎ দৈহিক প্রকৃতি ও মানসিক প্রকৃতিকে বিশ্বপ্রকৃতির প্রেক্ষিতে স্থাপন করে মানুষ তার নিজের অবস্থান ও ভূমিকা নিরূপণ করতে চেয়েছে, আর এই চাওয়ারই অন্যতম প্রধান ফসল বিজ্ঞান বা physical science। (The etymological origin of the word `physical’ is GREEK phusika means `natural things’ from phusis means nature) বুঝতে অসুবিধা নেই যে মানুষের এহেন চাওয়ার পথে সম-ভাবনাগুলোই পাথেয়, যে যা জানছে ভাবছে সেসবকিছুকে সম-মিলিত(সম্মিলিত), সম-অন্বিত করে করে একএকটি ধারণার রেখাচিত্র এঁকেছে মানুষ। কিন্তু নিত্যনতুন ধারণার ধারক হয়ে ওঠার ফলে কোথায় যেন অতিসূক্ষ্মভাবে প্রয়োগবাদী হয়ে ওঠার ঝোঁক এড়ানো গেল না,আর গোল বাঁধল সেখানেই। মানুষ নিজে বিশ্বপ্রকৃতির অতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র, তার অর্জিত ধারণার ভাণ্ডারটিও স্বভাবতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, কিন্তু তাকেই অবলম্বন করে বিকল্প নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হল। বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গের যোগসূত্র সম্যক অনুভব না করে, সম-ভাবনার অনন্ত ব্যাপ্তিকে যথাযথ অনুসরণ না করে বিকল্পের এমত সম্ভাবনা বস্তুত মানুষ ও বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে এক প্রতিযোগিতামূলক দ্বান্দ্বিক আবহের সূত্রপাত করেছে। আর প্রকৃতি যেহেতু নিরাকার সদা ব্যাপ্ত, তা মানুষের ভিতরে আছে স্বভাব হয়ে, বাইরে আছে প্রভাব হয়ে, তাই প্রয়োগবাদী ধারণার বশবর্তী হয়ে সাময়িক প্রয়োজনের নিরিখে বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশে যেসব কৃত্রিম পরিবর্তন করা হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অন্তর্প্রকৃতিও সমান সাযুজ্যে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। জীবনযাপনে প্রগতি সঞ্চার করতে গিয়ে, Fast life এ অভ্যস্ত হয়ে পড়ার দরুন Fast food habit অর্জন করতে হয়েছে। অথচ ফাস্ট ফুড মানেই obesity, মানে স্থূলতা-শ্লথতা। প্রকৃতপক্ষে বৈজ্ঞানিক ভাবনার নামে যা চর্চিত হয়েছে তা হল বস্তুবাদী যৌক্তিকতার চর্চা। আর যুক্তির পরিকাঠামোয় যা ধরা দেয় সেটুকুই ক্রমাগত অনুশীলন করার ফলে সামগ্রিকতার ভাব-প্রেক্ষিত থেকে বিযুক্ত হয়েছে সভ্য মানুষ। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত বস্তুনির্ভরতার কারণেই প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক বিষয়কে খণ্ডবিখণ্ড করে শুরু হয়েছে বিশিষ্টতার চর্চা, আর এভাবে নানান বিচ্ছিন্ন শাখায় বিভক্ত ভাবনা যারা প্রত্যেকেই নিজস্ব যুক্তিসম্মত পদ্ধতিতে আপনাপন শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য একে অপরকে অযৌক্তিক অপাংক্তেয় ভাবতেও দ্বিধা করছে না।
(Thus, living in harmony with nature doesn’t mean only your personal nature, but also the nature of the universe, or, as Zeno writes, the “nature of the all-pervading World-Reason, which is law to all things.” Living a life guided by reason isn’t only in accordance with human nature, but, as Hauskeller concludes, in harmony with the nature of the cosmos. – Loather Schäfer – Infinite Potential page 190, Deepak Chopra books 2013)
কিন্তু এ তো গেল বহিরঙ্গের খবর, অন্তরঙ্গেও একই ঘটনা, বস্তুবাদী বিশিষ্টতার চর্চার ফলে প্রায় প্রতিটি ব্যক্তি মানুষ নিজের অন্তর্জগতে ক্রিয়াশীল বিচিত্র অনুভবের সম্যক রসাস্বাদনে বঞ্চিত। হিয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকা ‘তুমি’কে দেখতে না পাওয়ায় আত্মপ্রবঞ্চিত মানুষ সম-ভাবনার প্রাকৃত বৈজ্ঞানিক সত্তাটিকেই খুইয়ে বসে আছে।অন্তরাত্মার বহুমাত্রিক অনুভব থেকে বিচ্যুত মানুষ আজ এটা বুঝতে পারে না যে, বিজ্ঞান – ইতিহাস – ভূগোল – সাহিত্য – দর্শন ইত্যাকার Fragmentation আদতে অস্তিত্বের পুরোটাকেই অখণ্ড স্বরূপে উপলব্ধির উপজাত ফল, একটাকে বাদ দিয়ে বা গৌণ করে অন্যটার গৌরব নেই।
পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছোবার তাগিদে প্রয়োগবাদী বৈজ্ঞানিক ভাবনা নগণ্য (negligible) বা নেতিবাচক (negative) বিচারে অপনয়ন পদ্ধতির অবলম্বন করে থাকে। এই পদ্ধতির সাহায্যে নির্দিষ্ট সময়কালের সাপেক্ষে সম-ভাবনার বহুমাত্রিক domainটিকে সংক্ষেপিত বা সংকুচিত করে নেওয়ার ফলে খুব সহজেই অতিদূর কিংবা বিপ্রতীপ ভাবনাসমূহকে উপেক্ষণীয় করে সংখ্যালঘিষ্ঠের স্তরে ফেলা যায়। যে কোনো সম্ভাবনাকে এইভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেখার বা দেখানোর অভ্যাসিত দক্ষতা আধুনিক মানুষকে প্রতিদিন নতুন নতুন সমস্যার সামনে দাঁড় করাচ্ছে, যাদের সমাধানও হচ্ছে নেহাতই সাময়িকভাবে, অথচ তাকেই স্থায়ী সমাধান হিসাবে বাজারে চালাতে হচ্ছে। আসলে সম-ভাবনার অখণ্ডতাকে উপেক্ষা করা হলে প্রতিটি পৃথক পৃথক ভাবনার অনুষঙ্গে সময় বা কালের যে যোগসূত্র রয়েছে, তাকে মেপে-বুঝে নেওয়ার কাজ বিঘ্নিত হয়।আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, নগণ্য (negligible) বা নেতিবাচক (negative) বিচারে যে সমস্ত ভাবনা বা সম-ভাবনাকে অপনীত করা হয়েছে তাদের অবস্থান কিন্তু একই প্রাকৃতিক domainএর ভিতরে, ফলে স্ব স্ব প্রকৃতিতেই তারা একে অপরের স্বাভাবিক পরিপূরক হিসাবে শক্তির আদানপ্রদানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার কাজে যুক্ত থাকে। অপনীত বিষয়গুলোর এই সম-মিলিত প্রাকৃতিক শক্তির পরিমাণ খুব স্বাভাবিকভাবেই খণ্ডিত/বিচ্ছিন্ন প্রয়োগবাদী বিষয়ভাবনার তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশী। সুতরাং প্রয়োগবাদী ভাবনার পথে যতই এগোনো হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-‘আপনি যে দুখ ডেকে আনি সে যে/জ্বালায় বজ্রানলে -/অঙ্গার করে রেখে যায়, সেথা কোনো ফল নাহি ফলে’ (ভার /খেয়া কাব্যগ্রন্থ)।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আধুনিক বিজ্ঞান স্পষ্টতই দুটি স্তরে বিভাজিত হয়ে পড়েছে। যার একটি হল প্রযুক্তিভিত্তিক স্তর, যাকিনা বস্তুপৃথিবীর বহিরঙ্গে প্রয়োগবাদী ভূমিকায় ক্রিয়াশীল আর অপরটি হল ধারণা-অনুভবের কোয়ান্টাম স্তর, যেখানে কেবলমাত্র সময়ের প্রভাবে আদি কণাসমূহ অভিব্যক্ত (Transient and Mutable) হয়ে চলেছে, তরঙ্গের মত। বস্তুত এই দুই স্তরেই বিজ্ঞানের আদি ভিত্তি গঠিত হয়েছিল, কোয়ান্টাম স্তরটিকে কারণ এবং প্রযুক্তির প্রয়োগবাদী স্তরটিকে কার্য হিসাবে ভাবা গেলে বোঝা যায় যে, আন্তর্সম্পর্কের বিষয়টিকে যথাযথ মান্যতা এবং গুরুত্ব দিয়েই আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত।সময়ের সাপেক্ষে বিচার করা হলে দেখা যায়, ‘কারণ’ ‘কার্য’এর পূর্বসূরি,কারণ ঘটলেই কার্য সম-ঘটিত(সংঘটিত) হয় অর্থাৎ কারণ হল কার্যের ইতিহাস। সুতরাং বিজ্ঞানচর্চার যাবতীয় উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই নিরন্তর বিজ্ঞানচর্চার ফলে যে সমস্ত ধারণা, তত্ত্ব কিংবা তথ্যভাণ্ডার নির্মিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে তার সবকিছুই ইতিহাসের সঞ্চয়কে পুষ্ট করে চলেছে। আজকের ছাত্রটি যত যত ধারণা, তত্ত্ব কিংবা তথ্য বিজ্ঞান পাঠ্যক্রমের তালিকাভুক্ত হিসাবে শিখছে পড়ছে, আদতে সে কিন্তু নিজের অজান্তেই ঢুকে পড়ছে ‘ইতিহাস’ নামক একটি অপরিসীম domainএর ভিতরে। প্রকৃতপক্ষে মানবজাতির গোটা ইতিহাসটাই সম-ভাবনার ক্ষেত্র থেকে সম্ভাবনার fractal geometry, আকর থেকেই তো আকারের উদ্ভব, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। অথচ বিদ্যালয়ের আধুনিক পাঠ্যক্রমে ‘ইতিহাস’ এবং ‘বিজ্ঞান’ দুটি বিচ্ছিন্ন বিষয় এবং এতটাই ভিন্নতার সঙ্গে উপস্থাপিত যে ঐতিহাসিক বিষয়ের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষিত বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কোনো ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত যে থাকতে পারে সেটা একজন ছাত্রের জানা-বোঝার কোনো অবকাশ নেই, বরঞ্চ প্রচার করা হয়ে থাকে যে, কেবলমাত্র মেধাবী ছাত্ররাই বিজ্ঞান বিষয়ে পঠনপাঠনের উপযুক্ত আর অপেক্ষাকৃত কম মেধাসম্পন্ন ‘কলা’ (arts) বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা ইতিহাস-টিতিহাস নিয়ে পড়বে। এহেন ভ্রান্তি যা প্রকৃতপক্ষে সম-ভাবনার ক্ষেত্রকেই বিভ্রান্ত করে তোলে তা বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করছে কি? যে সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা তথাকথিত মেধাবী বিচারে বিজ্ঞান বিষয়ে পঠনপাঠনের উপযুক্ত হিসাবে ঘোষিত তারা প্রকৃত ইতিহাস বিচ্ছিন্ন বিজ্ঞান পড়ছেন আর এই পড়া কতটা পঠন আর কতটা পতন তার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর এই যে আজকের বিজ্ঞান ক্রমশঃ প্রত্যক্ষভাবে প্রযুক্তির দাস আর পরোক্ষে মুনাফাখোর বৃহৎ পুঁজির বিক্রয়যোগ্য পণ্য হয়ে উঠেছে। তাহলে প্রশ্নটা দাঁড়ায় এই যে, মেধাবী বিচারে যাকে বিজ্ঞানপঠনের যোগ্য ভাবা হয়েছিল তার তথাকথিত মেধা কি তাহলে কোনো আন্তর্জাতিক পুঁজিপতির লাভ বা লোভ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যয়িত হবে? আর যারা ইতিহাস পড়ছেন, মানবসভ্যতার বিবিধ অভিব্যক্তির পরম্পরাগত বিস্তার ও বিভিন্নতার খোঁজখবর রাখছেন তাদের শ্রম ও সামর্থ্যকে উপেক্ষা করা হবে? প্রসঙ্গতঃ, ল্যাটিন ভাষায় arts শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ to fit , অর্থাৎ ভাববিশ্ব (aesthetic world) এবং বস্তুবিশ্ব (practical world) এর সমন্বয়সাধন। আর কে না জানে মহাবিজ্ঞানী নিউটনের ভাবনায় যদি মহাবিশ্বের অজানা রহস্য ধরা না দিত তবে আজকের অত্যাধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তিকে আমরা হাতের মুঠোয় পেতাম না। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, বিশ্বপ্রকৃতিকে জানা-বোঝার জন্য যে যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে আজো আমরা ভিত্তি হিসাবে গণ্য করে থাকি, তার প্রায় সবগুলিই ব্যক্তিবিশেষের ভাবগত অর্জন। সম-ভাবনার অনন্ত পরিসরে সাবলীল ভেসে বেড়াতে বেড়াতে অনুভবের মধ্য দিয়ে উপলব্ধির স্তরে পৌঁছানোর ফলসমূহই আধুনিক প্রযুক্তিবিজ্ঞানের আকর। ছোটো থেকে বড় যেকোনো যন্ত্রের কথাই ধরুন না কেন, তার সামগ্রিক জ্যামিতিক গঠনগত রূপটি কোনো না কোনো ভাবে সেই অরূপেরই প্রতিকৃতি। তাই যেকোনো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিমাত্রেরই ব্যবহারিক রূপটি হল বি-কল্প (এখানে বি অর্থে বিশেষ ও বিপরীত দুইই বোঝায়) ব্যবস্থা, মূলানুগ, মূল নয়।
কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভাবনার অর্থ তো এই নয় যে, যাকে হাতের মুঠোয় পাওয়া যাবে তাকেই অমোঘ বা চূড়ান্ত হিসাবে ভাবা এবং অন্যান্য সবকিছুকেই অবৈজ্ঞানিক বিবেচনায় বাতিল বা অপাংক্তেয় করে তোলা। অথচ আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তির হাত ধরে এই পথেই নিজেকে পরিচালিত করছে। বৈজ্ঞানিক ভাবনার স্বরূপটি হল, কার্য থেকে কারণের বিশ্লেষণে যাওয়া। কার্য হল বর্তমানতা, অর্থাৎ যা হচ্ছে, ‘যা হচ্ছে’ থেকে ‘কেন হচ্ছে বা কিভাবে হচ্ছে’র অনুসন্ধানই বিজ্ঞান অর্থাৎ বর্তমান থেকে অতীতে যাওয়া। আর প্রতিটি ঘটনা যেহেতু কাল-নিরপেক্ষ নয়, অতএব একজন অনুসন্ধিৎসু গবেষককে কার্যকারণ বিশ্লেষণের সূক্ষ্মতম স্তরে অনিবার্যভাবে time & space এর অবিভাজ্যতাকে স্বীকার করতেই হয়। ফলতঃ কার্যটি ও কারণটির মধ্যকার সময়ের ব্যবধান মুছে যায়। ধরা যাক এই মুহূর্তে X ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে নিকটতম অতীতে a সময় আগেকার b ঘটনাটিকে পাওয়া গেল আবার b ঘটনার কারণস্বরূপ c সময়কাল আগের d ঘটনাটিকে পাওয়া গেল, আবার d ঘটনার কারণস্বরূপ e সময়কাল আগের f ঘটনাটিকে পাওয়া গেল, এইভাবে বিশ্লেষণের পর্যায় চলতে থাকে। এইভাবে চলতে চলতে যত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম(quantum) Y স্তরে পৌঁছানো যাবে ততই a, c,e…….ইত্যাকার সময়ভেদগুলি ক্রমশঃ লুপ্ত হয়ে time & space এর নিরবচ্ছিন্ন ধারায় পরিণত হয়। সুতরাং সিদ্ধান্ত করা যেতেই পারে যে, বর্তমানের X ঘটনাটি অতিদূর অতীতের Y ঘটনার প্রতিরূপ মাত্র, আর এটাতো সত্যি যে, কোনো একটি বিশেষ ঘটনার সংঘটন সমসাময়িক পারিপার্শ্বিকতার উপর নির্ভরশীল, অতএব আজকের সমগ্রতা সুদূর অতীতের সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহেরই নিরবিচ্ছিন্নতার দ্যোতক। কাজেকাজেই তথাকথিত ‘আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ভাবনা’ শিরোনামে প্রচার, বাস্তবতার নিরিখে গ্রাহ্য হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে অবৈজ্ঞানিক কারণ এতাবৎ আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে – প্রাগৈতিহাসিকতার গভীরেই গুণগত ও মাত্রাগত দুই ভাবেই সুপ্ত থাকে গুপ্ত(embedded) থাকে আধুনিকতার যাবতীয় সম্ভাবনা।অথচ,বৈজ্ঞানিক ভাবনার বকলমে প্রযুক্তি বা প্রযুক্তিনির্ভর তন্ত্রসমূহ (systems) নিজেদের আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক প্রমাণের তাগিদে সময়কালের নিরবচ্ছিন্নতা (continuity)কে ক্রমশঃ অস্বীকার ও উপেক্ষা করেই চলেছে। ফলত ইতিহাসবিচ্ছিন্নতার বিকার থেকে ইতিহাসহীনতার বিকৃতি তার নিত্যসঙ্গী। আর এইসব বিকৃত ভাবনাসকল যখন বিক্রীত পণ্য হিসাবে মানবসমাজকে প্রভাবিত এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে প্ররোচিত করতে পরস্পর পরস্পরের প্রতিযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, তখন তো সম-ভাবনা থেকে সম্ভাবনার উন্মেষ কষ্টকল্পনা মাত্র। পুনরাবৃত্তিমুলক দক্ষতা (repetitive precision) যখন সমাজের দিশারী ও পরিচালক তখন যাবতীয় মৌলিক ভাবনাকে আবর্জনার স্তূপে ফেলে রাখা হবে, এতো স্বাভাবিক।
মানবসভ্যতার যথার্থ বিকাশ যদি বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য ও বিধেয় হয় তবে সভ্যতার সামগ্রিক চেহারাটাকে অনুপুঙ্খ জানা-বোঝার দায়িত্বও বিজ্ঞানের উপরেই বর্তায়। আর যেকোনো সমগ্রতাই যেহেতু নিরাকার, তাই সমগ্রতার মাত্রা (dimension) নিরূপণ করতে যাওয়াতেই বিভ্রান্তির সূত্রপাত। অথচ আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিজ্ঞান নির্দিষ্ট মাত্রা ভিত্তিক বিচার ধারায় (dimensional parameter) অভ্যস্ত। প্রিয় পাঠক, ইংরাজী integer শব্দের অর্থ whole number, যেমন 3, 4, 77…প্রভৃতি। বোঝার বিষয় হল, integer শব্দের ল্যাটিন ব্যুৎপত্তি in (expressing negation, not) + tangere (to touch), গোদা বাংলায় যার অর্থ হল – যাকে ধরাছোঁয়া যায় না বা ভেঙে-চুরে দেখা যায় না। অতএব সমগ্রতার integral মাত্রই অবিচ্ছেদ্য, অবিভাজ্য, যাকে কোনোরকম dimensional parameter এর সাপেক্ষে জেনে-বুঝে এবং তার ভিত্তিতে কোনো তত্ত্ব খাড়া করা হলে তা যথার্থ বৈজ্ঞানিক হয় কি?
সুতরাং সম-ভাবনার সমগ্রতাকে সুনির্দিষ্ট ত্রিমাত্রিক structureএ সীমায়িত করে নেওয়া এবং তদনুসারে যাবতীয় সম্ভাবনার কথা ভাবা, এমত প্রক্রিয়ায় বড় ধরণের অসঙ্গতি থেকেই যায়, যা কালক্রমে বাড়তে বাড়তে গোটা structureটাকেই গ্রাস করে, ভঙ্গুর ক্ষয়িষ্ণু করে তোলে। সুতরাং বৈজ্ঞানিক মনন মাত্রেই সামগ্রিকতার সঙ্গে ক্রিয়াভিত্তিক সম্পর্কে যুক্ত বা সংশ্লিষ্ট থাকাটাই কাম্য। এটা অনস্বীকার্য যে, মানবমন তার চারপাশের নিরন্তর গতিময় অস্তিত্বকে নিজের ভিতরেই সুপ্ত (enfolded) রাখতে সক্ষম এবং প্রয়োজনমত মুক্ত (unfolded)করে যথার্থ ক্রিয়াশীল সত্তা হিসাবে আত্মপ্রকাশেও পারদর্শী। বস্তুত, এ দু’প্রকারের আচরণ মানবমনের স্বধর্ম। কে জানে, পরমাপ্রকৃতির নির্দেশে মানুষ ব্যতীত অন্যান্য জীব বা জড়প্রজাতির এহেন enfolded এবং unfolded সত্তা আছে কি না, থাকাটা অস্বাভাবিক নয় কারণ সৃষ্টির আদি প্রতিসাম্য থেকেই অনুমান করা যায় যে, একক ও সমগ্র আলাদা কিছু নয় বরং সমগ্রতাই একক (unit), এককটিই সমগ্র।
ক্ল্যাসিকাল থেকে কোয়ান্টাম পর্যায়ে পৌঁছে আধুনিক পদার্থবিদ্যা যেসব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে তার অন্যতম হল, বস্তুবিশ্বের ভিত্তি নির্দিষ্ট নয় অর্থাৎ দুধ থেকে যেমন ছানা হয় তেমনভাবে নির্দিষ্ট করে কোনো সাকার সসীম উৎসজাত হিসাবে আমাদের চারপাশের বস্তুবিশ্বকে চিহ্নিত করা যায় না অথচ এহেন উৎসটি কিন্তু অস্তিত্ববান (real) এবং আমাদের সামগ্রিক সত্তার উপর ক্রিয়াশীল। কোয়ান্টাম তাত্ত্বিকরা এই উৎসটিকে সম্ভাবনা (probability wave) হিসাবেই চিহ্নিত করে থাকেন। আরও গভীরে গেলে দেখা যাচ্ছে যে সম্ভাবনা বা probability প্রকৃতপক্ষে দুটি সংখ্যার অনুপাত, সংখ্যার কোনো ভর নেই তথাকথিত শক্তি বা energy নেই, অথচ এহেন ভরহীন শক্তিহীন অনুপাত আমাদের বস্তুবিশ্বের নিয়ামক।তাহলে দাঁড়ায় যে,আমাদের চারপাশের বস্তুবিশ্ব যাকিনা পরীক্ষিত সত্যস্বরূপে বিদিত, পরিগণিত, তারই উৎস মূলে ক্রিয়াশীল মাত্রাহীন অপরিমেয় অস্তিত্ব, আর এ দুয়ে মিলেই আমাদের অনবচ্ছিন্ন সমগ্রতা (undivided wholeness)। বিষয়টিকে আরো সহজভাবে বুঝতে হলে প্রিয় পাঠক, আপনার মোবাইল ফোন কিংবা ইন্টারনেট সম্বলিত কম্পিউটারটিকে দেখুন। অত্যন্ত স্পষ্ট ও সাকার ঐ দুই যন্ত্রের মাধ্যমে আপনি বস্তুবিশ্বের খোঁজখবর পেয়ে থাকেন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে থাকেন অথচ আপাত সাকাররূপে যা আপনাকে বস্তুবিশ্বের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে তা কিন্তু আদতে ইলেকট্রন কণার প্রবাহ বা probability wave নামেই সুবিদিত। সুতরাং, পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষায় – সাকারও সত্য নিরাকারও সত্য, যা কোয়ান্টাম বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যথাক্রমে, visible actuality এবং invisible potentiality। বুঝতে অসুবিধা নেই যে invisible potentiality আক্ষরিক অর্থেই অগণিত সম-ভাবনার বিস্তীর্ণ পরিমণ্ডল যেখানে প্রতিটি সম্ভাবনার বীজ enfolded অবস্থায় আছে।
কিন্তু প্রযুক্তি লালিত আধুনিক বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, সে তার চারপাশের সবকিছুকেই পরীক্ষাগারের সীমিত চৌহদ্দিতে মেপে-বুঝে নিতে চায়। তার এহেন চাহিদা যে একান্তই সময়োপযোগী এবং বাস্তব সে বিষয়ে দ্বিমত নেই, আর সমস্যাটা সেখানেই। কারণ, পরীক্ষাগারের চৌহদ্দি অর্থাৎ কিনা empirical partটুকুই তো আর পুরো বিশ্বজগৎটা নয়, এর বাইরে একটা অতিবৃহৎ non-empirical and non-material partওতো রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই নন্-এম্পিরিক্যাল সত্তাটিই হল আধার যা invisible কিন্তু potential, আর visible actuality হল আধেয়। আধার ব্যতীত আধেয়কে যেমন চেনা যায় না তেমনভাবেই আধারটিকে সম্যকভাবে জেনে-বুঝে নিতে আধেয়টিকে একান্ত প্রয়োজন। গ্লাসে জল রাখা যায় বলেই গ্লাসের সঙ্গে আমাদের সম্যক ভাব বিনিময় ঘটে আবার জল পানের মাধ্যমে আমাদের তৃষ্ণা নিবারণেরও উপায় হয়। অর্থাৎ গ্লাস এবং জলের আন্তর্সম্পর্কের বিষয়টি আমাদের তৃষ্ণা নামক non-empirical and non-material সত্তাটির পরিপূরক। অতএব তৃষ্ণাই হল কারণ (invisible potentiality) যা গ্লাস ও জলের সম-অন্বয় ঘটিয়ে জনৈক তৃষ্ণার্তের তৃপ্তি/সন্তুষ্টি (undivided wholeness) ঘটাচ্ছে। সত্যিটা হল এই যে, পরীক্ষাগারে গ্লাস বা জলের সংযোগ ঘটানো গেলেও তৃষ্ণার শান্তি দান করা যায় না। সংক্ষেপে গোটা বিষয়টা এইরকম যে, জড়বিজ্ঞান (matter based science) মানবসভ্যতাকে প্রত্যক্ষে যন্ত্রপ্রযুক্তির সুবিধাভোগী করতে চেয়ে পরোক্ষে deterministically control করতে চেয়েছে, আর কোয়ান্টাম পর্যায়ে এসে ঐ জড়বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা যতই প্রকট হচ্ছে ততই প্রাসঙ্গিকতা লোপ হওয়ার আশংকায় মানবসভ্যতাকে exploit করাও শুরু হয়ে গেছে।
প্রসঙ্গ: সমাজ–সংস্কৃতি–সম্ভাবনা
(Society is the total network of relations between human beings. The components of society are thus not human beings but relations between them.
Arnold Joseph Toynbee – Historian 1869-1975)
মানব প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে প্রাকৃতিক সম্পদকে ভোগদখল এবং ব্যবহারের তাগিদেই সমাজ সৃষ্টি করা হয়েছিলো। ‘অজ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, যা জন্মায়নি বা জন্মায় না, জাত বা নির্মিত নয়, সৃষ্ট বা স্বয়ম্ভূ। অর্থাৎ নামকরণের মধ্যেই স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে যে সমাজ(সম+অজ) এমন একটি ব্যবস্থা যা প্রতিনিয়ত নিজের উৎসের সঙ্গে সমতা বিধান করে অস্তিত্ব বজায় রাখে বা রাখার চেষ্টা করে। কারণ প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের উপাদানস্বরূপ যে সমস্ত সত্তা সক্রিয়, মানবসমাজ গঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রেও সেই সমস্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম উপাদানসমূহই ক্রিয়াশীল। কিন্তু এ তো গেল গোড়ার কথা, পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি প্রাচীন সাহিত্য কীর্তি যার সাক্ষ্য বহন করে। অথচ মানবসভ্যতা যত যত আধুনিক(!) হয়ে উঠেছে, স্পষ্টতই মানবসমাজ তার অস্তিত্ব রক্ষাকারী উপাদানসমূহের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে তুলেছে, ফলস্বরূপ সমাজ শরীরে তার প্রাকৃতিক ধর্মের (natural property) দৈন্য লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠেছে। এই সার্বিক দীনতার প্রকোপে বহুমাত্রিক মানবসমাজ ক্রমশঃ সৃজনশীল বৈশিষ্ট্যের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে আর বিচ্ছিন্ন হয়েছে বলেই পুনরাবৃত্তিমূলক নিয়মতান্ত্রিক দক্ষতার কুক্ষিগত নেহাতই এক শাসনযন্ত্রে/শোষণযন্ত্রে পরিণত হয়েছে।
(…যেখানে অন্তঃকরণের যোগধারা কৃশ হয়ে ওঠে সেখানে নিয়ম হয়ে ওঠে একেশ্বর। সেখানে সৃষ্টিপরতার জায়গায় নির্মাণপরতা আধিপত্য স্থাপন করে। ক্রমশই সেখানে যন্ত্রীর যন্ত্র কবির কাব্যকে অবজ্ঞা করিবার অধিকার পায়। –আত্মপরিচয় ৫, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।)
(To live in a creative way requires extreme and sensitive perception of the orders and structures of relationship to individuals, society, and nature. In such cases, creativity may flower. It is only when creativity is made subservient to external goals, which are implied by the seeking of rewards that the whole activity begins to wither and degenerate.
…Creativity is nevertheless a major need of each human being and the blockage of this creativity eventually threatens civilization with ultimate destruction.
– Science, order and creativity: David Bohm-F. David Peat)
বিষয়টা তাহলে দাঁড়িয়েছে যে, মানব প্রজাতিকে সংরক্ষণ ও প্রতিপালনের জন্য সৃষ্ট সমাজ দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত। মানব প্রজাতির এই অসুখটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, auto immune disease, কিন্তু মুশকিলটা হয়েছে কি, এহেন ব্যাধির প্রকোপ থেকে নিস্তার পেতে গেলে যা করা দরকার মানুষকে তা করতে হচ্ছে এই ব্যাধিগ্রস্ত সমাজদেহের আচার-বিচার-উপচার সম্বল করেই। ফলত, ব্যাধির চিকিৎসাগুলোই(remedial measures) নিত্যনতুন ব্যাধি হিসাবে প্রকট হয়ে উঠছে আর সঙ্গত কারণেই ব্যাধিগ্রস্ততার পরিধি বেড়েই চলেছে।
সুপ্রাচীন কাল থেকেই মানবসমাজের প্রতিটি শাখা-উপশাখায় নানাবিধ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়ে থাকে, যাদের বলা হয় উৎসব – উৎস বহন করে যাহা। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে এই সমস্ত আয়োজনের উদ্দেশ্য নিছক বিনোদন নয়,সমাজ সদস্যদের প্রত্যেক প্রকার বৈশিষ্ট্য ও জীবনচর্যার বৈচিত্র্য সম্বলিত এই সব উৎসব অনুষ্ঠানের প্রাসঙ্গিকতা একথাই প্রমাণ করে যে মানবসমাজ প্রজাতিগতভাবেই নিজের সঙ্গে অপরের, এমনকি মানবেতর জীব,জড় ও উদ্ভিদ প্রজাতির সঙ্গে যথাযথ সমন্বয় সাধন করেই বিশ্বপ্রকৃতির লীলায় সামিল হতে চেয়েছে। এই সমস্ত উৎসব-অনুষ্ঠানের পরম্পরা বহন করে চলার কাজে নেতৃত্ব দিতেন মূলতঃ ধর্মপ্ৰবক্তারা বা আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠানসমূহ। প্রশ্ন হল, আধুনিক সমাজ যাকিনা প্রকৃতপক্ষে আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় শাসন-শোষণের অবিচার-অনাচারের পরিসর থেকে সমাজ সদস্যদের মুক্ত করতেই চিন্তাজগতে আধুনিক বিজ্ঞান থেকে অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছিল এবং যথেষ্ট ভাবে সফল হয়েছে বলেই মনে করা হয়, সেই বিজ্ঞানসম্মতভাবে দীর্ঘকাল পথচলার পরেও তাকে কেন আজ শেকড় বিচ্ছিন্নতার অসুখে ভুগতে হচ্ছে? কেন আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজের প্রতিবিম্বকেও অচেনা লাগছে? আসলে সৃজনশীলতা ও সংস্কৃতি পরস্পরের পরিপূরক, মানুষ এক ঝোঁকা হয়ে পড়লে তা সে ধর্মতন্ত্রের পথেই হোক কি আধুনিক প্রযুক্তিতন্ত্রের empirical পথেই হোক ……..যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে…, অতএব মুক্তচিন্তার ধারা শুকিয়ে আসে, repetitive precision এর ঘোরে যন্ত্রবৎ আচরণ করে। আর এই যান্ত্রিকতাই আরো এক তান্ত্রিকতার জন্ম দেয় সহজ পরিভাষায় যা fanaticism নামে অভিহিত। যে মানুষটা বা মানুষজন পাথরে পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাতে শিখেছিল সে বা তারা সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝেছিল যে এই আগুন তাদের পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়ার ক্ষমতাও রাখে, আর তাই ভয়ে কিংবা ভক্তিতে তারা অগ্নির উপাসক হয়েছিল এবং গেয়ে উঠেছিল – আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে/এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে, একটা সংস্কৃতি জন্ম ও প্রসার লাভ করেছিল। মুশকিল হল অনেক পরে, যখন আমরা এই পবিত্র গভীর স্বতঃস্ফূর্ত উৎসব থেকে সরে এলাম, আগুন ও তার দাহক সত্তাকে বিশ্লেষণ করে আলাদাভাবে চিনলাম ও ব্যবহার করতে শুরু করলাম, যান্ত্রিক ও তান্ত্রিক হলাম (mechanical and systematic) তখন স্বভাবতই এহেন বিচ্ছিন্নতা আমাদের সৃজনশীল সংস্কৃতিকে প্ৰকোপিত করে তুলল আর আমরা সেই অমোঘ আত্মোপলব্ধিময় উচ্চারণে পৌঁছতেই পারলাম না – আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব/ সারারাত ফোটাক তারা নব নব/ নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো/ যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো। যার ফলে দৃষ্টি থেকে কালো ঘুচল না, আলোও পড়ল না, মানবসমাজ বাহ্যত ধনী কিন্তু ভেতরে ভেতরে দেউলিয়া হয়ে পড়ল, worship রয়ে গেল কিন্তু worthy কেউ নেই। ভাষা তাত্ত্বিকেরা জানেন যে worship এবং worthy শব্দদ্বয়ের ল্যাটিন ব্যুৎপত্তিগত অর্থ একই আর তা হল, act of giving a very high value আর হাইয়েস্ট ভ্যালুয়েবল্-টি হল সমগ্র বস্তুজগতের কারণ বা মহাকারণ। সুতরাং, যিনি বা যাঁরা সেই মহাভাবের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে অদৃশ্য অথচ সম্ভাবনাময় সত্তাটিকে(invisible potentiality) জানতে বুঝতে পারঙ্গম তিনি বা তাঁরাই দৃশ্যজগতের সংস্কৃতির ধারাটিকে(visible actuality) নিরন্তর চলমান রাখতে পারেন। এই সংযুক্তি বা connectivity-ই সংস্কৃতির মূলকথা, ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে যা যুগ যুগ ধরে অনুশীলিত বা অনুসৃত হয়েছে আবিশ্ব মানবসমাজের প্রতিটি শাখাপ্রশাখায়। বিশুদ্ধ জ্ঞানবাদী মুনিঋষি, সাধুসন্ত, আউলিয়া, পীর, দরবেশ, তীর্থঙ্কর প্রভৃতি অসংখ্য চরিত্র ইতিহাসের পাতায় এ কারণেই অমর হয়ে আছেন।
আর এটাতো ঠিক যে, সংস্কৃতি বিষয়টিই এক ও অখণ্ড, আলাদা আলাদা করে ধর্মীয় সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, পারিবারিক সংস্কৃতি… বলে কিছু হয় না। এগুলো সবই জড়বস্তু নির্ভর mechanical and systematic মানবসভ্যতার সংকীর্ণ চিন্তনের ক্ষয়িষ্ণু ফসল। আজকের কোয়ান্টাম দর্শন যাকে বলছে,
(What appears to be empty space contains an immense ‘zero point energy’ coming from all the quantum fields that are contained in this space. Matter is then a relatively small wave or disturbance on top of this “ocean” of energy. Using reasonable assumptions, the energy of one cubic centimeter of space is far greater than would be available from the nuclear disintegration of all the matter in the known universe! Matter is therefore a “small ripple” on this ocean of energy. But since us, too, are constituted of this matter, we no more see the “ocean” than probably does a fish swimming in the ocean see the water. -Science, order and creativity- David Bohm and F. David Peat)
সুতরাং সমাজ ও সংস্কৃতি এ দুয়ের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব মানবসভ্যতার চিরকালীন সমস্যা, যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে, বুঝতে গিয়ে বারবার একই প্রশ্নে হোঁচট খেতে হয় যে, সমাজ সংস্কৃতির জাতক নাকি সংস্কৃতি সমাজের? এ প্রসঙ্গে, বানর থেকে মানুষ হয়ে ওঠার ক্রমপর্যায়গুলিকে বিচার বিশ্লেষণ করে মনে হয় যে সমাজ গঠনের বা সমাজ ভুক্ত হয়ে, সামাজিক ভাবে একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে থাকার প্রয়োজনবোধ করাটাই, মানব সংস্কৃতির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন। আর এমত ধারণাকে ভিত্তি করে পূর্বের উদ্ধৃতিটিকে পুনর্লিখন করলে দাঁড়ায়:-
What appears to be ‘culture’ contains an immense ‘zero point energy’, coming from the entire quantum fields that are contained in this ‘culture’. ‘Society’ is then a relatively small wave or disturbance on top of this ‘ocean’ of culture.
একান্তই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ মানুষের জন্ম, সে কারণেই তার আচার আচরণের ভেতরে প্রকৃতিদত্ত গুণাবলী আজীবন সুপ্ত অবস্থায় থেকেই যায়। নারী শরীর থেকে শুরু করে নদ-নদী, অরণ্য-বনানী, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর ইত্যাকার উন্মুক্ত প্রকৃতিতে যা কিছু দৃশ্যত সুন্দর, মনোলোভা সেসবকিছুতেই বৈষম্যের, বৈসাদৃশ্যের, বঙ্কিমতার অবাধ অনুশীলন।সর্বত্রই হরণ ও পূরণের যুগপৎ অবস্থিতির মাধ্যমেই সুন্দরের রূপ প্রকাশিত, অতএব এই বিসমতামণ্ডিত সুন্দরের প্রকাশ মানবমনের স্বাভাবিক সৃজনশীলতায় ব্যক্ত বা অভিব্যক্ত হবে এতে আর আশ্চৰ্য্য কি? আর সমস্যাটা হচ্ছে সেখানেই। মানবমনের এই বহুমাত্রিক সৃজনশীল ধর্মকে উপেক্ষা করলে নতুনতর সৃষ্টি হয় না আবার স্বীকার করে নিলে mechanical and systematic সমাজ নির্মাণ করা যায় না। ফলে হল কি, যে সমাজ গঠিত হল তার বাইরেটা মসৃণ ঝাঁ চকচকে কিন্তু ভেতরে বিকার থেকেই গেল। সমাজীকরণ ঘটার কারণে মানুষের অখণ্ড সাংস্কৃতিক চেতনাকে খণ্ডিত, নিয়ন্ত্রিত করে বিভিন্ন আচার-উপচার সম্বলিত বস্তু সর্বস্ব প্রাতিষ্ঠানিক বিনোদনের আয়োজন করা হল যাতে সমাজেরই সব সদস্যদের যোগদানের অধিকার বা সামর্থ্য নেই। এককথায় সামাজিক দাদাগিরির প্রতাপে বা প্রকোপে harmony’র সংস্কৃতির পরিবর্তে hegemony’র সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ‘সমাজ’ আর ‘সম’+’অজ’ নয়, ‘সৃষ্টিপরতার’ জায়গায় ‘নির্মাণপরতা’ রীতিমত আধিপত্য বিস্তার করেছে আর করেছে বলেই সমাজ ও সংস্কৃতির অন্তঃকরণের যোগধারা ক্রমশই কৃশ থেকে কৃশতর আর সম-ভাবনাও সঙ্গতকারণেই সুদূরপরাহত।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ‘সমাজ’ তো আর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, সময়ের সঙ্গে অনিবার্যভাবেই তার অন্তরঙ্গে-বহিরঙ্গে বহুবিধ পরিবর্তন ঘটেছে বইকি, অথচ পরিতাপের বিষয় হল যে এসব পরিবর্তন যতটা আকৃতিগত ততটা প্রকৃতিগত নয়। তাহলে,দেখা যাক আকার ও প্রকারের এহেন অসামঞ্জস্যের মূলে কি বা কোন ভূমিকা সক্রিয়। আলোচনার শুরুতে ঐতিহাসিক টয়েনবির যে উদ্ধৃতি রয়েছে তাতে relations শব্দটি সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য আর এই রিলেশন শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রিলেটিভ বা আপেক্ষিকতার প্রসঙ্গটিও। যে কোনো সমাজে, তা মানবসমাজ হোক কি পশুসমাজ হোক, সমাজের আকৃতিগত ও প্রকৃতিগত বিন্যাসটি কিন্তু সম্পূর্ণতই সমাজভুক্ত যাবতীয় বিষয়ের সাপেক্ষেই নির্ধারিত ও পরিচালিত হওয়াটাই স্বাভাবিক ধর্ম। কৃত্রিমভাবে যে কোনো পদ্ধতি-প্রকরণ অনুশীলন বা অনুসরণ করাটা যদিও বা সমাজদেহের বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না সেইসব নিয়মকানুন, যতই তা কার্যকরী হোক না কেন, সমাজের অন্তঃকরণ অর্থাৎ সমাজভুক্ত প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সমমেলিত(harmonised) হচ্ছে বা হওয়ার চেষ্টা করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে সমস্ত পদ্ধতি প্রকরণ নিছক আচার ছাড়া অন্যকিছু নয়।
আসলে সমাজ ও সংস্কৃতির আন্তর্সম্পর্ক অনেকটা নারীত্ব এবং মাতৃত্বের অনুরূপ, নারীত্বের পূর্ণতা যেমন মাতৃত্বে আবার মাতৃত্ব থেকেই নারীত্ব যেমন ভাবে নতুনতর বিকাশমাধুৰ্য্য, গতিশীলতার দিশা ও দর্শনলাভে সমর্থ হয়, ঠিক তেমনভাবেই সমাজ বা সামাজিকতাও যথার্থ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকেই তার পূর্ণতা, বিকাশ ও গতিশীলতার প্রকৃত ধারাকে অনুভব এবং অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। বলা দরকার যে এখানে মাতৃত্ব বলতে শুধুমাত্র শারীরিক মাতৃত্বের কথা বলা হচ্ছে না। যে কোনো প্রকার নারীত্বের গভীরে সুপ্তভাবে গুপ্তভাবে(embedded) থাকে যে মাতৃত্বের পরম সত্তাটি এখানে তারই উল্লেখ করা হয়েছে,যে মাতৃত্বের অভাবে যে কোনো সমাজ তা সে মানুষের হোক বা অন্য কোনো প্রজাতির হোক, একটি ক্রমক্ষয়িষ্ণু নিষ্প্রাণ কাঠামোয় পর্যবসিত হয়। পাঠকের স্মরণে থাকার কথা, ভিয়েতনামে আমেরিকান আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে সেই বিখ্যাত গান –sometimes I feel like a motherless child.
মানুষের কাজের দুটো ক্ষেত্র আছে—একটা প্রয়োজনের, আর–একটা লীলার। প্রয়োজনের তাগিদ সমস্তই বাইরের থেকে, অভাবের থেকে ; লীলার তাগিদ ভিতর থেকে ভাবের থেকে। বাইরের ফরমাশে এই প্রয়োজনের আসর সরগরম হয়ে ওঠে, ভিতরের ফরমাশে লীলার আসর জমে…. জনসাধারণ বলতে যে প্রকাণ্ড জীবকে বোঝায় স্বভাবতই তার প্রয়োজন প্রবল এবং প্রভূত। এইজন্য স্বভাবতই প্রয়োজনসাধনের দাম তার কাছে অনেক বেশি, লীলাকে সে অবজ্ঞা করে। ক্ষুধার সময় বকুলের চেয়ে বার্তাকুর দাম বেশি হয়। সেজন্য ক্ষুধাতুরকে দোষ দিই নে; কিন্তু বকুলকে যখন বার্তাকুর পদ গ্রহণ করবার জন্য ফরমাশ আসে তখন সে ফরমাশকেই দোষ দিই। বিধাতা ক্ষুধাতুরের দেশেও বকুল ফুটিয়েছেন, এতে বকুলের কোনো হাত নেই। তার একটিমাত্র দায়িত্ব আছে এই যে, যেখানে যা–ই ঘটুক, তাকে কারো দরকার থাক বা না থাক তাকে বকুল হয়ে উঠতেই হবে ; ঝরে পড়ে তো পড়বে, মালায় গাঁথা হয়তো তা–ই সই। (পশ্চিম–যাত্রীর ডায়ারি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
সংস্কৃত ভূ ধাতু থেকে জাত ‘ভাব’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল- যা কিছু হয় তাকে যে বহন করে। অর্থাৎ ভাবের ঘরেই বিশ্বপ্রকৃতি লীলায়িত হয়ে চলেছে।তাই যাবতীয় সম-কৃতির (সংস্কৃতির) সম-ভাবনাও এই ভাবজগতেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ,আর বস্তু হল ভাবলীলার ক্ষণস্থায়ী ফল মাত্র। অতএব বস্তু মাত্রেই ভাবের বিকৃতি বা খণ্ডীকরণ, একইভাবে সত্য থেকে বাস্তবতার অবতারণাও একধরণের বিভ্রান্তি/বিকৃতি (distortion, reduction, fragmentation) এবং স্বভাবতই সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ‘harmony’র পরিপন্থী। অতএব,শুধুমাত্র বাস্তবতাকে ভিত্তি করে সমাজ-সংস্কৃতি-সম্ভাবনার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের প্রচেষ্টা গোটা মানব প্রজাতিকেই যে অসূয়া দীর্ণ করে তুলবে এতে আর আশ্চর্য্য কি! কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার বিচারে যাবতীয় বস্তুর আদি সত্তাটি কণা (Particle) এবং তরঙ্গ (Wave) এই দুই অবস্থাতেই থাকতে পারে, তরঙ্গের মধ্যে কণার অস্তিত্ব বা অবস্থানটি শুধু একটি অদৃশ্য সম্ভাবনা মাত্র (embedded invisible probability), প্রয়োজনের তাগিদ বা যোগসাধনের তাগিদ তাকে দৃশ্যমান (visible) করে। সংস্কৃতিও এমনই অদৃশ্য সম্ভাবনাময় নিরন্তর বহমান একটি ক্ষেত্র, আবিশ্বচরাচর যার লীলায় ছন্দিত-স্পন্দিত-নন্দিত, আর এই ক্ষেত্র থেকেই যোগসাধনের বা প্রয়োজনসাধনের তাগিদে সৃষ্ট বিচ্ছিন্ন কণা সমষ্টি হল সমাজ। অতএব সমাজ কাঠামোর যাবতীয় ক্রিয়াশীলতা-স্থিতিশীলতা গুণগত ও মাত্রাগত ভাবে ঐ মূল ক্ষেত্রের(সংস্কৃতির) দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
(The details of how the ETs (we will simply use the abbreviation ET to denote the elementary units of existence at the foundation of things, leaving it open whether we mean elementary thoughts (waves), elementary things (particles), or unspecified entities.) evolve in their wave-states are still a matter of research. For our purposes it is sufficient to realize that they can do it and do it spontaneously. As it turns out, all microphysical material objects behave like that. When they are isolated, the observable phenomena suggest that they dissolve spontaneously in extended fields of waves. In interactions with objects in their environment, these fields can contract abruptly to a point, which then appears to us as a material particle. So the Greeks, Parmenides, and Newton didn’t get it right: Matter isn’t enduring and lasting; it is a fleeting state, a shifty character, always ready to transform into waves. – Loather Schäfer, Infinite Potential, 2013.)
লক্ষণীয়,মানবসমাজের উদ্ভব-বিকাশ-বিলোপসাধনের ধারা বিশ্বপ্রকৃতির স্বাভাবিক (natural order) ধারার অনুরূপ, অর্থাৎ কিনা কোনো একটি সমাজ বিশেষের বিলোপসাধনের মাধ্যমেই প্রকৃতপক্ষে অপর একটি সমাজোৎপত্তির উর্বর সম্ভাবনার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে থাকে।সুতরাং একথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, গোটা বিষয়টাই সংস্কৃতির/সৃষ্টিশীলতার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ যাতে সমস্তরকম সম্ভাবনার দিকগুলো সদাসর্বদা উন্মুক্ত থাকে। আগেই বলা হয়েছে যে সংস্কৃতি আদতে সম-ভাবনাময় ধারা প্রবাহের অনবচ্ছিন্ন ক্ষেত্র। অতএব যে সমাজ সভ্যতা তার আন্তর্কাঠামোটিতে সাংস্কৃতিক বিকাশের অনুকূল পর্যাপ্ত ফাঁকফোকরের(reluctancy) ব্যবস্থা রাখতে পেরেছে তারা অন্যান্য সমাজব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশী স্থায়ী হয়েছে, ইতিহাসবিদেরা সেকথা জানেন। আসলে এই ফাঁকফোকরের যথাযথ ব্যবস্থাই হল ‘বকুল’কে ‘বকুল’ হতে দেওয়া, তাকে ক্ষুধাতুরের খাদ্য ‘বার্তাকু’ হয়ে ওঠবার ফরমাশ না দেওয়া বা ‘বার্তাকু’ বানিয়ে তুলতে সচেষ্ট না হওয়া। শকহুণদল পাঠান-মোগল ‘এক দেহে লীন’ হওয়ার মতন যথেষ্ট উদারতা (space) ছিল বলেই মহাভারতীয় সমাজব্যবস্থা তার যাবতীয় দৈন্য-দুর্দশা নিয়ে আজও বর্তমান। অর্থাৎ কিনা আপাত প্রয়োজনের তাৎক্ষণিকের দাবিকে এতটুকুও গৌণ বা খাটো না করেও সার্বিকের গুরুত্বকে বজায় রাখা গেলেই অথবা এ দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করে এমন কোনো পন্থা অভ্যাসিত হলেই সমাজে বকুল ও বার্তাকু উভয়ের যথাযথ সম্মাননা হয়, এমনটাই সংস্কৃতি, যা সমাজের পক্ষে স্বাস্থ্যকর সম্ভাবনার পরিবেশ সৃষ্টি করে।এবিষয়ে কোনো মহলেই কোনো দ্বিমত নেই যে মানবসভ্যতার এতাবৎ অর্জিত জ্ঞানভাণ্ডারটি অজানিত অধ্যায়ের তুলনায় নিতান্তই সীমিত, আর মজার ব্যাপার হল যে যত যত জ্ঞান অর্জিত হচ্ছে ততই এই সীমাবদ্ধতাও প্রকট হচ্ছে কারণ নতুন কিছু জানার সাথে সাথে আমরা এটাও জানছি যে আমরা এখনও কি কি জানিনা বা বুঝিনা।এমত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমরা কি করে জোরের সঙ্গে বলি যে, ক্ষুৎপীড়িতের দেশে বকুলের কোনো প্রয়োজন নেই বা নান্দনিকের আঙিনায় বার্তাকু বড়ই বেমানান।ধর্মের দোহাই পেড়ে যারা আবিশ্ব মানবতার উৎকর্ষসাধনে নিরন্তর ব্যস্ত, তারা কিভাবে ‘মুসলমান সমাজ’ বা ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ কিংবা শিখ কম্যুনিটি ইত্যাকার শব্দবন্ধ প্রয়োগ করেন? রাষ্ট্র,সমাজ,কম্যুনিটি প্রভৃতি শব্দ খুব সুনির্দিষ্ট করে নেহাতই ক্ষুদ্র সাকারবিশেষ (tiny structure)কেই বোঝায় আর হিন্দু, মুসলমান,শিখ,বৌদ্ধ, প্রভৃতি সংস্কৃতি হল অখণ্ড উপলব্ধির বহুমাত্রিক রূপভেদ,এগুলো প্রকৃতপক্ষে ‘যত মত তত পথ’ এই ধারণার পরিচায়ক। রাষ্ট্র বা সমাজের খণ্ডবাদী নীতি, সংস্কৃতির সুবিশাল ব্যাপ্তিকে ক্ষুণ্ণ, সংকীর্ণ করে মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে যে, হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ প্রভৃতি অতিবৃহৎ ধারণাকে রাষ্ট্র, সমাজ ইত্যাকার অতিক্ষুদ্র গণ্ডিতে সীমায়িত করা যায় এবং পরিণতিতে সমগ্র মানবতাই আক্রান্ত, ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে identity crisis’এ ভুগতে শুরু করে। মানুষের সামাজিক বিকাশের পর্যায়গুলি স্পষ্টতই ইঙ্গিত করে যে, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, দল, সমাজ, রাষ্ট্র এহেন বিবর্তন আসলে অখণ্ড মানবিক সংস্কৃতির প্রাকৃত ধারাটি থেকে ক্রম বিচ্ছিন্নতার বস্তুবাদী ফসল। আর বিচ্ছিন্ন বলেই, এর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত রয়েছে ‘আমাদেরটিই শ্রেষ্ঠ বা সর্বোত্তম’ এমত গোঁড়ামির/অনমনীয়তার/স্বার্থান্ধতার কঠোর মনোবৃত্তি। ফলত তাপগতিবিদ্যার সূত্রানুসারে এসকল প্রতিষ্ঠানসমূহ এক একটি isolated system যাদের স্বাভাবিক পরিণতি, maximization of entropy, from dissociation to dissipation, আধুনিক পৃথিবীতে যার চেহারাই হল সবধরণের রাষ্ট্রিক, সামাজিক কাঠামোর ভেতরেই ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার, ধর্মীয় জেহাদি ভাবনার হিংসাত্মক বহিঃপ্রকাশ, আর হবে না-ই বা কেন? অখণ্ডতার সাংস্কৃতিক শেকড় বিচ্ছিন্ন মানুষ তো বুঝতেই পারছে না যে, যে সমাজে বা রাষ্ট্রে বা ইংরাজী পরিভাষায় territoryতে সে বাস করে সেখানে তার অবস্থানটি কোথায় এবং ভূমিকাটিই বা কি? তাই কোনো না কোনো ভাবে খণ্ডিত সংস্কৃতির অতিখণ্ডিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যক্ষ প্রভাবে সে বা তারা নিজের শেকড়টিকেই ওপড়াতে সক্রিয় হয়ে পড়েছে। অতএব, সমাজের দায়িত্ব এই ফাঁক ভরাট করা এবং সংস্কৃতির অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনের ক্ষেত্রটিকে লীলার ক্ষেত্রের সাপেক্ষে পুনর্বিন্যাস করা, কারণ সম্ভাবনাময় সম-ভাবনাগুলি লীলার সময়োত্তীর্ণ ক্ষেত্রেই অবস্থান করে, প্রয়োজনের ক্ষেত্রটি জাগতিক বিষয়সমূহের অবলম্বন মাত্র যা একান্তভাবেই সাময়িক।
সমাজ প্রকৃতপক্ষে এক প্রকারের সংগঠন, অর্থাৎ সমভাবে গঠিত সত্তা। আর এই সমত্বের গঠন বা গঠনের সমত্ব সমাজকে দুই ধরণের কাঠামো দেয়; দৃশ্যত বাহ্যিক পরিকাঠামো এবং অদৃশ্য অন্তর্লীন আন্তর্কাঠামো। এই আন্তর্কাঠামোটি আদতে সমাজ সদস্যদের মানসিক ও মানবিক ভাব বিনিময়ের অবাধ ও উদার ক্ষেত্র যেখানে পরিপূরকতার পরম্পরা মেনে সুবিস্তৃত সম-অন্বয় প্রচারিত এবং প্রসারিত হয়ে চলেছে, যা জীবনেরই এক আন্তরিক রূপলক্ষণ। বাইরেকার কাঠামোর স্থায়িত্ব ভিতরকার এহেন গতিবিধির আধার মাত্র, অন্তর্লীন সজীবতাকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা এবং নির্ভরতা দেওয়াই তার উদ্দেশ্য,যাতে সমাজ সংগঠনের ভেতরে ক্রিয়াশীল ঐ সমন্বিত বিন্যাস থেকে সম্ভাবনার উদ্ভব ব্যাহত না হয়;ব্যাহত হলেই ঐ প্রকাশ্য কাঠামোর স্থায়িত্ব এবং কার্যকারিতা নিশ্চিতভাবেই বিপন্ন হয়ে উঠবে। সংস্কৃতি হল মানবসমাজের গভীরে প্রবহমান ঐ ভাবধারা-উপধারাসমূহের নিরবচ্ছিন্ন যোগসাধনের অপ্রত্যক্ষ ফল, তাই যথার্থ সমাজ সংগঠকের দায়িত্ব ও কর্তব্য ঐ অবাক ফসলের সুলুকসন্ধান, নিজের সামর্থ্য দিয়ে আরো অনেককে সমর্থ করে তোলা…….’যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই’।
Posted in: December 2019, Prose