ক্যালানো ছাড়া কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি : তুষ্টি ভট্টাচার্য

আমার সহকারিণী বেশ আপ টু ডেট রাখে নিজেকে। ‘ছিন্তিটিক’ শাড়ি সে পরে না, সুন্দর ও পরিষ্কার সুতি বা তাঁতের শাড়ি পরে আসে। পায়ে বেশ মোটা নূপুর, যার ঝুনঝুন আওয়াজে আমার ছোটবেলা মনে পড়ে যায় রোজ। নামটিও তার খাসা। অশোকা। মাসে একবার অশোকা ভুরু ‘পেলাক’ করতে ‘বিটি পাল্লারে’ যায় আর পুজোর আগে ফেসিয়াল করে, চুল ছাঁটায়। তার স্বামী ওয়াটার লাইনে পাইপ বসানোর কাজ করে, ছেলে ট্যুর অপেরেটরদের সঙ্গে রান্নার কাজে যুক্ত। ফলে অভাব খুব একটা সংসারে নেই তাদের। কালার টিভি, গ্যাস, সহ নিজেদের বাড়ি, ফ্রিজ কেনার চিন্তাভাবনা করছে তারা। সম্প্রতি মেঝে পাকা করেছে লাল রঙে। অশোকার ছেলের নাম গণশা। ছেলে থাকলে সপ্তাহে তিনদিন মুরগির মাংস হয়, সপ্তাহে দুতিনদিন মাছ, ডিম তো আছেই। বর মাসকাবারি মুদি সদাই করে রাখে। ফলে দিন আনি দিন খাই গোছের মোটেই নয় তারা। এহেন আমার বয়সী এক মহিলাকে একদিন আমি সটান জিজ্ঞেস করে ফেলি, ‘হ্যাঁ গো! এন আর সি কি জান?’ জবাবে সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘গণশার বাবা বলছিল সেদিন…এনসি না কী যেন বললে…সেই নিয়ে। তা আমাদের কোন চিন্তা নেই। আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড, র‍্যাশন কার্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সবই আছে আমাদের। আর গণশার বাবারা তো এখানকার পুরনো বাসিন্দা। তাড়াবে কেন আমাদের?’ ‘তাও যদি ধর, তাড়াতে আসে! তুমি তো দিয়ারার মেয়ে। তোমাকেই যদি বলে দেখাও সব কাগজপত্তর। নইলে চলে যাও এখান থেকে। কী করবে তখন?’ রাগে ফুঁসে উঠল অগ্নিকন্যা। ‘অ্যাঁ! বললেই হল নাকি! তাড়াক দেখি, কেমন পারে! গণশার বাপও বলছিল, তাড়াক দেখি! আসুক দেখি কেউ সামনে! অ্যামন ক্যালাব না……আর বাড়ি ফিরতে হবে না তাকে!’ কী সর্বনাশ ভাবুন দেখি! আমি আর ঘাঁটাইনি ওকে এরপরে।

এরপর ভাবলাম আরেকজনকে জিজ্ঞেস করে দেখি। নর্দমা সাফাই করতে আসে দুই মূর্তিমতী চণ্ডালিকা! আগে একজন পুরুষ থাকত। সে আর নেই। একজনের বয়স বছর পঞ্চান্ন, পেটানো চেহারা। সবুজ আর গোলাপির প্রাধান্য থাকে ওদের ছাপা শাড়িতে। সামনে আঁচল করে কোমরে বাঁধা, হাতে বুরুশ, বালতি আর ঝাঁটা। দ্বিতীয়জন একটু বয়স্ক মহিলা। প্রথমজনের শাশুড়ি তিনি। তাঁর দায়িত্বে থাকা ঝাঁটা বুলনো আর ‘পানি মারা’র কাজ। আগে বুরুশ টানত যে লোকটি সে ছিল প্রথমজনের স্বামী। একদিন তাকে আসতে না দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী গো, তোমার লোক কই আজ?’ সপাটে জবাব এলো, ‘মরে গ্যাচে!’ ‘সে কী গো?’ ‘তা মরবে না তো কী করবে? রাদ্দিন মদ গিলে গিলে লিভার পচ্চে গেচিল, মরে গেল একদিন’। কোথাও কোন দুঃখ নেই, অভাব ছিল না ওর স্বরে। যেন ওর মরদের মরে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। শাশুড়ি, বৌমা মিলে আবার পেটের ধান্দায় বেরিয়ে পড়েছে। ওর একটা ছেলেও আছে, সে অন্য কিছু ধান্দা করে, ‘ডিরেন’এর কাজ করবে না। নাতিকেও নিয়ে এসেছিল একদিন। আমার ছেলের বয়সীই হবে বোধহয়। সেও ওই দু’একদিনের বেশি আসেনি। কয়েকঘরের ডিরেন সাফ করে দুইজনে আমার বাড়ির সামনে উবু হয়ে বসে চা বিস্কুট খায়। এটা আমার অলিখিত বাধ্যতামূলক কর্ম। সেই চায়ে চারগুণ বেশি চিনি দিতে হয়। আর ঘন, মোটা দুধও। সঙ্গে টোস্ট বিস্কুট না হলে ওদের আবার মন ভরে না। সে যাই হোক, এরা হিন্দিভাষী হলেও, উড়িষ্যা থেকে নাকি এখানে এসেছিল অনেক আগে। তাই ওদের চা-পানের সময়ে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘এন আর সি কী জান? যদি তাড়িয়ে দেয় তোমাদের ঘাড় ধরে? আদপে তো তোমরা উড়িষ্যার লোক’। স্প্রিং-এর মতো লাফ দিয়ে উঠল বউমা। ক্যাঁক করে পারলে আমারই টুঁটি টিপে ধরে আর কী! রীতিমতো তেড়েফুঁড়ে উঠে বলল, ‘তাড়াবে ক্যানো? কী করিচি আমরা? এইখানে বিশ সাল কাটিয়ে দিলাম। আর আজ আমাদের তাড়াবে? ভগমান আচে! সব দেকচে!’ আমি তাও মিনমিন করে বলি, ‘যদি তাও আসে ওরা? কাগজ ধরিয়ে বলে, চলে যাও এখান থেকে! কী করবে শুনি?’ এবার বুড়িও উঠে পড়েছে উত্তেজনায়। দুজনে রেরে করে চিৎকার শুরু করল, ‘কে তাড়াবে? কার ইত্তা বড়া ছাতি আচে শুনি? মুখে তার বুরুশ ঘষে দেব। তারপর অ্যায়সান ক্যালাবো যে…জানে মেরে দেব একদম!’ ব্যাপারটা ক্রমশ ভায়োলেন্স ঘেঁষা হয়ে যাচ্ছে দেখে আমি ওদের ঠাণ্ডা করে মানে মানে বিদেয় করি।

শংকরের চায়ের দোকান খুব বিখ্যাত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেটলিতে চা ফুটতেই থাকত একসময়ে। শংকর বুড়ো হয়ে মারা যাওয়ার পরে তার ছেলে চায়ের দোকানের দায়িত্ব নিল। প্রথম প্রথম চলছিল ঠিকই। কিন্তু সে এতই নেশা করা শুরু করল যে, সারাদিন ঝিম মেরে বসে থাকত বা উল্টে পড়ে থাকত। ফলে খদ্দের চলে যেতে থাকল একটু একটু করে। এর মাঝে কাগজের কাপ ও স্টিলের ড্রাম শোভিত ঝকঝকে চেহারার কয়েকটা টি স্টল গজিয়ে উঠেছে। কয়লার উনুনের আঁচে আর মাটির ভাঁড়ের স্তূপে শংকরের চায়ের দোকান ক্রমশ লাটে উঠতে শুরু করেছিল। এর কিছুদিন পরে দেখি, শংকরের ছেলে আবার দোকান খুলে বসেছে। সম্ভবত নেশা করাও কমিয়েছে একটু। চলছে টুকটাক ওর দোকান আবার। জাতিতে ওরাও বিহারি। যদিও এখন তাদের দেখলে বাঙালি বলেই মনে হয়। কী চেহারায়, কী ভাষার টানে। ওর ছেলেমেয়ে দুটোও বাংলা খিচুড়ি স্কুলে পড়ে। শংকরের ছেলের নাম একটা নিশ্চই আছে। আমার মতো অনেকেই ওর নাম জানে না আজও। শংকরের ছেলেই ওর পরিচয়। সেদিন এক ভাঁড় চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম ওকে, ‘কী গো এন আর সি কী জান? যদি তাড়িয়ে দেয়, কী করবে তখন?’ শংকর ঘোলা চোখ মেলে তাকাল আমার দিকে। যেন আমার কথা বুঝতেই পারেনি। শিক দিয়ে উনুনের আগুনটা উস্কে দিতে দিতে বলল, ‘আমি মরে যাইনি এখনও’। ‘তো কী? বেঁচে থাকাটাই কিন্তু এন আর সি বাদ দিয়ে বেঁচে যাওয়া নয়’। উনুনের গণগণে আঁচ ওর দুচোখে ছায়া ফেলেছে। জ্বলজ্বল করে উঠেছে ওর ঘোলা চোখ। সেই চোখে যতটা সম্ভব বিতৃষ্ণা নিয়ে আমায় বলল, ‘কোন মাই কা লাল আছে দেখি আমাদের তাড়ায়! আজ পঞ্চাশ বছরের বেশি আছি এখানে আমরা। আমার মরা বাপ সাক্ষী। সেও এসেছিল পাঁচ বছর বয়সে এখানে’। ‘বুঝেছি, বুঝেছি। কিন্তু তোমার কথার প্রমাণ আছে তো?’ ‘প্রমাণ মানে? কাগজ?’ একটু থেমে নিজেই বলতে থাকল, ‘সব, সব আছে। কেন থাকবে না? এই চায়ের দোকান করে আমার বাপ দোতলা বাড়ি বানিয়েছে এখানে। আমি এখানে ছার কেলাস পর্যন্ত পড়িচি। বাংলা কাগজ পড়তে পারি এট্টু আদটু। আমার ছেলেমেয়েও বাংলা পড়ছে। আমরা কি কম বাঙালি নাকি তোমাদের থেকে?’ আমি বুঝতে পারছিলাম ওর ক্ষোভ, ওর জ্বালা। নরম গলায় বললাম, ‘আমি তো বুঝছি। কিন্তু সরকারী লোক এসে যদি চলে যেতে বলে? তখন?’ এবার আগুনে যেন ঘি পড়ল। দাউদাউ করে বলে উঠল শংকরের ছেলে, ‘আসুক না! আসুক দেখি! এমন ক্যালাব না! কয়লার আগুন ছুড়ে দেব গায়ে’। আমি শিউরে উঠে মানে মানে পালিয়ে এলাম ওখান থেকে।

নিজেকে সে বলে কপিল দেব এসেছি। নাম তার কপিলই বটে। তার মতো রসিক মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। বয়স তার ষাট পেরিয়েছে। একটা সাইকেলে কাপড়ের বান্ডিল বেঁধে ঘুরে ঘুরে তার এ জীবন কেটে গেল প্রায়। খাস পাটনার লোক আদপে। একসময়ে অন্তত ছটের সময়ে দেশে যেত। এখন আর যায় না। এখানেই ছট সারে। কপিলের মতো মুখে মুখে হিসেব রাখতে আমি কাউকে দেখিনি। প্রায় এক থেকে দেড়শ বাড়ির জামাকাপড় ইস্ত্রি করে সে। নিয়ে যায় আবার দিয়ে যায় বাড়িতে। কার কটা কাপড় যাচ্ছে আর আসছে তার নখদর্পনে। কোনদিন অন্যের জামাকাপড়ের সঙ্গে আমাদের জামাকাপড় গুলোতে দেখিনি ওকে। বা হিসেব ভুল হতেও দেখিনি। সত্যি বলতে কী, আমি নিজেই হিসেব ভুলে যাই কখনও কখনও। ওর কম্পিউটার ব্রেন, ভুল হয় না। তার বাড়িতে দুই জোয়ান ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী। ছেলেমেয়েরা সবাই পড়াশুনো করেছে। বাপের পেশাতেই পুরো পরিবার যুক্ত। মেয়ে শুধু বিউটিশিয়ানের কাজ করে। নিজের পাকা বাড়ি বানিয়েছে তাও কমপক্ষে পনেরো বছর আগে। পরিষ্কার বাংলা বলে তার পুরো পরিবার। এহেন কপিল দেবের বোলিং-এর সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়া যে আমার কাজ নয়, সে আমি বিলক্ষণ জানতাম। তবুও একদিন ভয়ে ভয়ে ওকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। ‘কী গো কপিল! এন আর সি জান তো? কী হবে এবার?’ তার মুখে সব সময়ে একটা ফিচেল হাসি লেগে থাকে। স্বভাবে সে যেন বালকপ্রায়। আর রসিকতা তো তার স্বভাবসিদ্ধ। তার মধ্যে একটা দুটো কমন্‌। যেমন সে যখন এসে ডাক দেয়, তার কাছে কাপড়ের বান্ডিল নিয়ে গেলেই প্রথমে বলবে, ‘এত বেলা অবধি ঘুমোচ্ছিলেন!’ বা ‘এই ঘুম ভাঙলো!’ এরপর সাইকেল দেখিয়ে বলবে, ‘আমি যে তেল পুড়িয়ে সেই হিল্লি দিল্লি ঘুরে এসে আপনাদের বাড়ি চলে এলাম, আর আপনি এখনও ঘুমোচ্ছেন!’ এসব কথার আমরা কেউই উত্তর দিই না। যেমন পয়সা ফেরত দেবার সময়ে সে বলবেই, ‘একটা দু’টাকার কয়েন, আর একটা তিন টাকার কয়েন আছে দেখে নিন’, আর কাপড় গুণবার পরে বলবে, এই সাড়ে সাতখানা হল’, মানে আটটা গুণতিতে আসলে। তো প্রশ্ন শুনে সেই রকম ভাবেই বলল, ‘কী আর হবে? রেট বেড়ে যাবে আমার’। ‘মানে? এন আর সি’র সঙ্গে তোমার রেট বাড়ার কী সম্পর্ক?’ ‘সম্পক্ক নেই বলছ? এই যে ধর, সরকারি বাবুরা আসবে আমাদের খাতিরদারি করতে, আমাদের মান ইজ্জত কত বেড়ে যাবে বুঝতে পারছ?’ আমি তো হাঁ! এ ব্যাটা বলে কী! ‘তোমার কি মাথাটা গেছে নাকি? খাতির দারি নয়, একেবারে এই মুল্লুক থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে আসবে ওরা। তখন দেখবে কত ধানে কত চাল হয়!’ ‘আরে ওরা কি জানে কত গমে কত আটা হয়? আর কত ছোলায় কত ছাতু? আমিও শিখিয়ে দেব ওদের!’ ‘দেখ, কপিল, ইয়ার্কি কর না এসব নিয়ে। ব্যাপারটা কিন্তু সিরিয়াস। সব কাগজপত্র আছে তো তোমাদের? না থাকলে করিয়ে রাখ’। আমি আন্তরিক ভাবেই বলতে চেষ্টা করলাম। যদিও হিতে বিপরীত হল এর। অমন শান্ত, নিরীহ কপিল সত্যি সত্যিই কপিল দেবের ফাস্ট বোলিং-এর মতো ঝলসে উঠল। গর্তে লুকিয়ে থাকা তার দুই চোখ কেমন যেন হিংস্র দেখাচ্ছে…দু গালের চোয়াল শক্ত। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল, ‘আমরাও ছাতু খাওয়া জাত। আমাদের তাড়াবে দেখি কোন মাই কা লাল! কেলিয়ে তাদেরই এ বাংলা পার করে দেব’। আমি স্তম্ভিত মুখে চুপ করে গেলাম। ভাবছিলাম—এরা সবাই কেন এত ফুঁসে উঠছে!

আরেক শিখ সিংদাকে চিনি অনেকদিন। বৃদ্ধ হয়েছেন এখন তিনি। আগে ওঁর বেশ কয়েকখানা লরি’র কারবার ছিল। লরি ব্যবসায়ে অনেক ঝামেলা, আজকাল তাই গোটা চারেক বড় গাড়ি ভাড়া খাটায়। আর সাত/আটখানা গাড়ি রাখার গ্যারেজও আছে তাঁর। সেখানেও গাড়ি থাকে ভাড়ায়। এত দশ চাকা, আট চাকা, চার চাকার গাড়ি থাকতেও তিনি এখনও নিজে একটি পুরনো ভেস্পা স্কুটারে চাপেন। সেদিন ফট্‌ফট্‌ করতে করতে তাঁর যানটি এসে থামতেই তাঁকে পাকড়ালাম। ‘কী গো সিংদা, এবারে যদি চলে যেতে হয় তোমাদের? এন আর সি হয়েছে তো?’ সিংদা’র ভাষায় বেশ হিন্দি/পাঞ্জাবি টান আছে। স্কুটারটিকে যত্ন করে স্ট্যান্ড মেরে দাঁড়ালেন তিনি। দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিলেন একবার। ঘন দাড়িগোঁফের জঙ্গল থেকে এক চিলতে হাসির আভাস দেখলাম কি? বুঝলাম না ঠিক। ভাঙা ভাঙা গলায় বৃদ্ধ বললেন, ‘দেখ মা! আমার তো বয়স কম হল না। অনেক দেখলাম এ জীবনে। এই বাংলায় এসেছিলাম আঠারা বরষ বয়সে। আজ হামার সেভেনটি আপ বয়স হল। এখানেই ব্যবসা করে খাচ্ছি। কত সরকার এলো আর গেলো। আমাদের তাড়াতে এসেছে কেউ? না পেরেছে?’ আমি চুপ করে রইলাম। তারপর আবার বললাম, ‘কিন্তু এবার মনে হয় ব্যাপারটা একটু সিরিয়াস। ভেবে দেখ’। শান্ত, ভালোমানুষ সিংদা এই শুনে যেন ক্ষেপে গেল। অমন রাগী চেহারায় তাঁকে কখনও দেখিনি আগে। কোমরের কৃপাণে হাত ছুঁয়ে বললেন, ‘কসম নিচ্ছি, যেই আসুক, জানে মেরে দেব। তবে তার আগে এই পাঞ্জা দেখেছ? এই হাতের ক্যালানি তাকে খেতেই হবে, তারপর অন্য ব্যবস্থা’। আমি সিরিয়াসলি ভয় পেলাম এবার। এবং দেখলাম সিংদার চলে যাওয়া ভেস্পা স্কুটার যেন এক টগবগে যোদ্ধার ঘোড়ার চেহারা নিয়েছে। আর তার ওপরে বসে আছে যোদ্ধার বেশে এক যুবক—আমাদের সিংদা।

সকলের কাছেই এমন রাগী প্রক্রিয়া পেয়ে ভাবছিলাম, কী এমন হল যে, এরা সকলেই এমন মারমুখী হয়ে পড়ল! এমন ক্ষেপে উঠল। এদের প্রত্যেকেরই কমবেশি কাগজপত্র ঠিক আছে। এন আর সি’র কবলে পড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেইই প্রায়। তা, সব জেনেশুনে কেন এরা এত ক্ষেপে উঠল হঠাৎ? আমি বা আমার পরিবারের এন আর সি’র আওতায় পড়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই, এটুকু নিশ্চিত। তার ওপর আমরা হলাম গিয়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। যাকে বলে, ভদ্রলোক। আমাদের তাড়াবে কে? ভূমিহারা হবার ভয় আমাদের নেই। তাই কি আমি ওদের ক্ষেপে ওঠার কারণ বুঝতে পারছি না? আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে…পারে কেন, হতেই তো পারে! ওরে বাবা! ভাবতেও বুক কেঁপে উঠছে। আমার নিজের দাদু/দিদা/ঠাকুমা, মানে বাবা-মা দুই তরফের মানুষগুলোই তো এক সময়ে ওপার বাংলায় থাকতেন। দেশ ভাগ হওয়ার আগে বা পরে তাঁরা এসে এই রাজ্যে বসবাস শুরু করেছেন বলেই শুনেছি। এইবার যদি আমাকেও বলে—মানে মান্নে কেটে পড় দেখি! ওরে বাবা রে! আমার কী হবে গো…বলে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠতে গেলাম। তারপরেই ভাবলাম, যাঃ! এসব কী মেলোড্রামা হচ্ছে! যাবই বা কেন শুনি? আমরা এতদিন ধরে এখানে রয়েছি, ওপার বাংলা চোখে দেখিনি আজ পর্যন্ত! আমার বাবা-মাও কবে দেখেছে, ভুলে গেছে। তাহলে? বললেই হল? তাড়াবে? ইয়ার্কি পায়া হ্যায়! তাড়াক দেখি! আমিও দেখে নেব। এমন ক্যা… না……

বিশ্বাস করুন, এই এন আর সি সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। খায় না মাথায় দেয়? আরেকটু ক্লিয়ার করে বলি তবে! বিশোয়াস করুন, হামি কুছু জানে না সর্কার! আপনারা কিছু জানেন?

Facebook Comments

Leave a Reply