তারিখ বিহীন ডাইরির ছেঁড়া পাতা : তপতী দত্ত

“ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে দু’টি ডিটেনশন সেন্টার তৈরি করা হচ্ছে। ফৌজদারী অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া বিদেশিদের জন্য এই ডিটেনশন সেন্টার তৈরি হবে।” কাগজের পাতায় খবরটা নজরে আসার পর থেকে শরীরে অতিরিক্ত রক্ত প্রবাহের দাপাদাপি হঠাৎই মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসমের ঘটনার তীব্র যন্ত্রণার রেশ এখনো দগ্ধ করে চলেছে। এ কোথায় চলেছি আমরা! যে আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সারাটাজীবন ধরে লড়াই করে আজ যখন একটু থিতু হয়ে বসার কথা ভাবছি ঠিক তখনই আবার এই সংবাদে কি শান্ত রাখা যায় নিজেকে। চোখ বন্ধ করলেই নাটকের প্রেক্ষাপটগুলো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে।
আমি  বিজয়া। দুগ্গা ঠাকুর বিসর্জনের দিন এই পৃথিবীতে এসেছিলাম বলেই এই নাম। আজ জীবনের অর্ধেকটাই পার করে ফেলেছি নিজের জন্য বেঁচে । বাকি সময়টা মেয়ের জন্য বাঁচবো বলে ঠিক করেছি। আমার মেয়ে তিতলি। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এই প্রজন্মটা বড্ড দ্রুত ছুটছে। তিতলি আজ ষোলর দরজায় দাঁড়িয়ে সতেরোতে কড়া নাড়ছে। আর বছরখানেক পরেই ভোট দেওয়ার জন্য এখন থেকেই লাফালাফি শুরু করেছে । অথচ এই তো সেদিনই হ্যাঁ সেদিনই তো — অপারেশন থিয়েটারে দুজন অ্যানাসথেটিস্ট দুজন ডাক্তার দুজন নার্স একজন পেডিয়াট্রিশিয়ান সাথে ওয়ার্মার মেশিন, অক্সিজেন সিলিন্ডার সমৃদ্ধ এক নিরাপদ বলয়ে জন্ম নেওয়া এক শিশু। শুধু কি তাই,জন্মটাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য শিলমোহর লাগানো সরকারি একখানা কাগজ। প্রমানিত অথেন্টিক তথ্যসমৃদ্ধ।
আজ সেই শিশু হাঁটি হাঁটিটি পা পা করতে করতে বালুকা বেলার বুড়ি ছুঁয়ে, কিশোরীবেলার প্রগলভতা ছাড়িয়ে, যুবতীবেলার দিকে পায়ে পায়ে অনেকখানি এগিয়ে গেল। আমি দুচোখ ভরে দেখে আর আগলে রাখার চেষ্টা করি,কোথাও যেন হোঁচট না খায়। আহা রে, পড়ে গেলে যে বড্ড লাগে। রক্তাক্ত ক্ষত বড় যন্ত্রণাদায়ক। ঝাপসা চোখে পরিস্কার দেখতে পাই সেদিনের কিশোরীবেলা — মেয়েটি প্রাণপণে ছুটে চলেছে । ইতিমধ্যেই দুবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে দুটো হাটুই ছড়ে গিয়ে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ব্যথা বা যন্ত্রণা বুঝতে ঠিক পারছেনা, তবে খুব জ্বালা করছে। একটা এবড়ো খেবড়ো ঝুরো পাথর বিছানো সর্পিল সরু রাস্তা। একধারে ঘনজঙ্গল সোজা খাড়া হয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে গেছে, অপরদিকেও জঙ্গল তবে সেটা ক্রমশ সমতলের দিকে গেছে। রাস্তার সমান্তরাল এক পাহাড়ি নদী একইরকম এঁকে বেঁকে ধীর লয়ে চলেছে । বছর নয়েকের মেয়েটির সাথে পাল্লা দিয়ে সেও ছুটছে একইরকম ভাবে। মেয়েটি প্রাণভয়ে ছুটে চলেছে, জঙ্গল থেকে যে কোনও মুহূর্তে ভাল্লুক বা হাতি বেরিয়ে আসতে পারে অথবা কোন বিষাক্ত সাপ। হাতে একটা স্লেট ,দুটো ছেঁড়া বই আর একটা পেনসিল হাফ প্যান্টের পকেটে। গায়ে একটা হাতে সেলাই করা টেপজামা। সে স্কুলে যাচ্ছে পাশের গ্রামে। অন্যদিন গ্রামের সব ছেলেমেয়েরা একসাথে যায়, আজ ওর অনেকটা দেরি হয়ে গেছে ঘুম থেকে উঠতে। বাবা ততক্ষণে পাহাড় কাটার কাজে চলে গেছে। মা নিজেও বেরিয়ে গেছে শুকনো ডালপালার খোঁজে রান্নার জ্বালানির জন্য । দু’ বছরের বোনটা এখনও ঘুমোচ্ছে। কিছুই খাওয়া জোটেনি সকালে। একগ্লাস জল খেয়েই বেরিয়ে পড়েছে। বোন ঘুম থেকে ওঠার আগেই মা ফিরে  আসবে জানে। ওদের গ্রামের নামটি সারদাগুড়া। ও চলেছে কয়লাপাড়ি গ্রামের স্কুলে। পড়ে ক্লাস থ্রি-তে। বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি মাত্র দুটো ঘরের ছোট্ট স্কুলবাড়ি। ও শুনেছে এই পুরো জায়গাটাকে দণ্ডকারণ্যের মালকানগিরি বলে। চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে জঙ্গলে যায় কেন্দুয়া ফল আর আমলকি কুড়োতে। এর আগে ওরা ছিল মানা ক্যাম্পে। তার আগে কুরুৎ ক্যাম্পে। তারও আগে বিহারের রেল লাইনের ধারে। আর তারও আগে ওদের একটা দেশ ছিল। একটা টিনের চালের অনেক বড় বাড়ি ছিল, অনেক গুলো গরু ছিল, অনেক জমি, পুকুর আর অনেক ফলের গাছ ছিল আর একটা নদী ছিল। এসব কথা বাবার কাছে শোনা। একদিন ঠাকুরদা রাতের অন্ধকারে ওকে বাবা মায়ের সাথে নদীতে নৌকায় তুলে দিয়ে বলেছিল , “তোরা যা আমিও খুব তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা করে চলে আসবো।” না, ঠাকুরদা আর আসতে পারেনি। আমরা যখন বিহারের রেললাইনের ধারে থাকতাম তখন একদিন সকালে মা জোরে জোরে কাঁদছিল আর বাবা চুপ করে বসেছিল। কয়েকদিন পরে আমরা গয়ায় গিয়ে পিন্ড দিয়েছিলাম। তখন শুনেছিলাম ঠাকুরদাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। তারপর থেকেই আমরা ক্যাম্পে থাকি।
কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার পরিবার বিভিন্ন ক্যাম্পে বাস করে। না ভুল বললাম বাস করে নয় একসাথে বেঁধে বেঁধে থাকে। শিকড় থেকে উপড়ে আসা মানুষগুলো এমনই থাকতে ভালোবাসে। ঝগড়া ঝাঁটি মারামারি কান্নাকাটির পরেও চুপি চুপি একে অন্যের ঘরের খবর নেয় রাতের রান্নাটা হয়েছে কি না। নাহলে নিজের ঘরের জলঢালা ভাতের হাড়িটা নিয়ে এসে নুন কাঁচা লঙ্কা দিয়ে একসাথে চোখের জলে নাকের জলে মাখামাখি করে খায়। ফরিদপুর, বরিশাল, চিটাগাং, নোয়াখালী, ঢাকা, খুলনার শিকড় উপড়ানো মানুষগুলো একসাথে এক পরিবার হয়ে যায়। সুনীল ওঝা, বাণী কান্ত, অমল মিদ্যে, রমজান চাচা, অসিত বৈরাগী, সাবির মিঞা, সিন্ধু বৈদ্যরা সবাই একই পরিবারের সদস্য মনে করে নিজেদের। একসময়ে সেই পরিবার থেকেও উপড়ে ফেলা  হয় মানুষগুলোকে। অনেকগুলো বছর একসাথে কাটানোর পরেও শুধুমাত্র পায়ের নীচের মাটিকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরার জন্য এই মানুষগুলো এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে জীবিকার ধান্ধায়। বিভিন্ন জায়গার মাটি গাছ ফল ফুল বাজার হাঁট ক্ষেত খামার আর সাথে ভাতের গন্ধ পেতে।
মেয়েটি আজও ছুটে চলেছে। জীবনের পথে ছুটে চলাটাই জীবন। শৈশব পার করে কিশোরী হতে সময় লাগেনি বিশেষ। আবার কখন যে কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে গেল, সে খবর নিজেও রাখেনি কখনো। একটা নাম মনে পড়ে শুধু। যে বলেছিল “তোর পায়ে পদ্মকাঁটা আছে। আমি তোকে পদ্মপাতা এনে দেবো। পদ্মপাতায় ভাত খেলে পদ্মকাঁটা ভালো হয়ে যাবে দেখিস।” আর মনে আছে সরস্বতী পুজোয় ঠাকুর দেখতে গিয়ে আমার হাওয়াই চটির ফিতে ছিঁড়ে গিয়েছিল। সে তার নিজের চটিটা আমায় পরতে দিয়ে সারাটা রাস্তা আমার চটিটা হাতে নিয়ে ঘুরেছিল। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে ঘুরতে ঘুরতে কবে যে কোথায় হারিয়ে গেল সেটা আর জানা হল না। আর আমি এক চোখ স্বপ্ন নিয়ে ঘোরতর সংসারী হয়ে মেয়েকে মানুষ করে গড়ে তোলবার দায়ভার কাঁধে তুলে নিলাম স্বেচ্ছায়।
আচ্ছা, তিতলি তো এদেশের অথেন্টিক নাগরিক। কারণ তার কাছে তার জন্মের একটা বৈধ পরিচয় পত্র আছে। কিন্তু সেকি আমার মতো করে এই দেশটাকে চেনে? আমি যেভাবে এই দেশের রূপ রস গন্ধ চিনেছি। বিভিন্ন জায়গার মাটির রঙে নিজের রঙ মিশিয়েছি। এই দেশের ধুলো কাদায় আবির খেলেছি। এখানকার মাটিতেই বসে অক্ষর চিনেছি। যেখানে বিনয় মাস্টার বলেছিলেন, “আমার কাছে রোজ বিকেলে এসে এ বি সি ডি লিখবি।” আমি মুখ নীচু করে বলেছিলাম “বাবা টাকা দিতে পারবেনা।”  উনি কাছে এসে মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, “লেখাপড়া শিখতে গেলে টাকা লাগেনা , ইচ্ছে লাগে। তোকে ওসব ভাবতে হবে না।” চোখগুলো আজকাল বড্ড ঝাপসা লাগে। তারপর তো কত দিন-রাত পেরিয়ে গেল হিসেব রাখা হলো না। রাতের পর রাত কাটিয়েছি কত কত কালো শব্দগুলোর সাথে তার ইয়ত্তা নেই। রাতের আকাশের অসংখ্য তারাদের সাক্ষী রেখেছি রাতজাগার। তিতলি কি এমন করে চেনে এই আকাশটাকে? ওতো এই আকাশের নীচেই বাস করে। কিন্তু আমি জানি , আমার মতো করে ও চেনেই না। আমার মতো করে চেনা সম্ভব নয়। আমিই তাকে সেই সুযোগ তৈরি হওয়ার অবকাশ দিইনি। যতটা সম্ভব নিরাপত্তা দিয়ে আগলে রেখেছি।
কিন্তু আমি কি আজ সত্যিই নিরাপদ? আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে কেন? অসহায়ত্ব ভর করছে আমার অস্তিত্বে। কিন্তু কেন ? কি প্রমাণ দিতে হবে আমাকে যে আমি এই দেশেরই  মেয়ে ? কিন্তু কেন দেবো ?এতগুলো বছর ধরে আমার বেঁচে থাকার জন্য এই লড়াই সব মিথ্যে? আমার মেয়ে এই দেশের অধিবাসী অথচ আমি নই ? এমন বিদঘুটে প্রশ্ন তৈরি হয় কিভাবে ? প্রতিটা দিনের ঘটনা জ্বলন্ত সত্য হয়ে চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় অহরহ।
এই তো সেদিন — কত আর বয়স সঠিক মনে নেই। রেল লাইনের ধারে যখন ছিলাম, রোজ সকালে একটা বড় বাটি আর একটা কাগজ নিয়ে হালুয়া নেওয়ার লাইনে দাঁড়াতাম। কারা দিত অথবা কি দিয়ে সেই হালুয়া তৈরি হতে জানা নেই। কিন্তু কি যে অসাধারণ খেতে লাগত, সে যে না খেয়েছে সে কখনোই জানবে না। সেই স্বাদ কি শুধুই ক্ষিদের জন্য ? যারা সেই খাবারটা দিতো তারা খুব যত্ন করে দিতো এটুকু মনে আছে। বারবার বলতো, “যেন পড়ে না যায়, সাবধানে যাবি।” আরও একটা খাবার আমার খুব প্রিয় ছিল। অনেকেই তার নামই শোনেননি হয়তো। ডুটি’- আটা দিয়ে তৈরি করা হত। আমরা তখন মানা ক্যাম্পে থাকি। নতুন করে বাঁচার জন্য বাবা তখন ধান চালের ব্যবসা শুরু করেছিল। রোজ মাঝরাতে সাইকেল নিয়ে অনেক দূরে আদিবাসী গ্রামে যেত ধান কিনতে। ভোরের দিকে ফিরতো। মা সেই ভোরেই বিশাল একটা মাটির হাড়িতে সেই ধান সিদ্ধ করতো কাঠের জ্বাল দেওয়া উনুনে। রোজ সেই ধান সিদ্ধর গন্ধে আমার ঘুম ভাঙতো । সারাদিন সেই ধান রোদে মেলে দিয়ে শুকনো করা হতো। সে এক মজার খেলা ছিল আমার কাছে। কিছুক্ষণ ছাড়া ছাড়া ধানগুলোকে উল্টে দিতে হত। দুদিকে দুটো পা ছড়িয়ে দিয়ে গোল গোল করে ঘুরতাম। মাঝে মাঝে পা ছড়ে যেত তবুও মজা লাগত। সেই ধান শুকিয়ে গেলে তাকে মেশিনে ভাঙিয়ে চাল তৈরি করে ঝাড়তে হোত। বাবা সেই চাল নিয়ে বাজারে গিয়ে বিক্রি করতো। সেও এক মজার জীবন ছিল। ডুটি’র কথায় আসি– সকালে ধান সিদ্ধ করা হয়ে গেলে মা সেই হাঁড়িতে জল গরম বসাতো। আর একটা থালায় কিছুটা আটা নিয়ে তাতে নুন আর চিনি দিয়ে অল্প অল্প করে জল ছিটিয়ে মেশাতো আর অদ্ভুত রকম ছোট ছোট শুকনো দানা তৈরী হয়ে যেত এভাবেই। তারপর সেই থালাটাকে একটা বড় কাপড় দিয়ে বেঁধে গরম জলের হাঁড়ির উপর উপুড় করে বসিয়ে দিত। যেমন করে পুলি পিঠে সিদ্ধ করে ঠিক সেইভাবে। সিদ্ধ হয়ে গেলে গরম গরম খেতাম। ওটাই ছিল সকালের খাবার। কি ভালো যে লাগতো খেতে।
তারপর তো আর জীবন থেমে থাকেনি কোথাও— একান্ত কাছের মানুষগুলো জীবিকার সন্ধানে ছড়িয়ে গেছে এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আর কখনো সেই মানুষগুলোর সাথে দেখা হয়নি। দেখা হলেও আর চিনে নেওয়া সম্ভব হোতনা বোধহয়। বোনটাতো সেই কবেই মরে গেছে দাস্ত হয়ে। বাবা সেবার কয়েকদিনের জন্য কোথাও একটা গেছিল যেন। হঠাৎ করেই বোনের বমি পায়খানা শুরু হলো। ওষুধ পত্র খাওয়ানোর সুযোগ হয়নি, রাতেই শেষ। রমজান চাচা কোলে করে নিয়ে গিয়ে মাটিতে পুঁতে দিয়ে এসেছিল। মা কয়েকদিন খুব কান্নাকাটি করেছিল। সেই ক’দিন রাবেয়া দিদি মায়ের সাথে সাথে থাকতো সবসময়। বাবা বাড়ি ফিরে সবকিছু শোনার পর কিছু বলেনি। খুব যে কষ্ট পেয়েছিল সেটা মনে হয়নি আমার। মা ও আস্তে আস্তে নিজেকে ভুলিয়ে নিয়েছে। কিন্তু মায়েরা কি সত্যিই ভোলে !
সামান্য একটা কাঁটা তারের বেড়ার কি অসীম ক্ষমতা। একটা মানুষের আজন্ম লালিত স্বপ্ন, ভালোবাসাকে তছনছ করে দিতে পারে। বাবা মায়ের নীরব কথোপকথন আমি আমার সত্বায় আজও উপলব্ধি করতে পারি। আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি সময় অনেককিছুই কেড়ে নিলেও ভেতরের অনুভূতির কাছে সে কত অসহায়। সেই ক্যাম্পের জীবনযাপনের সাথে আজ এই তথাকথিত ভদ্রস্থ যাপনের পার্থক্যটা বড় প্রকট আমার কাছে। আজ কোনো সংকটই আমাকে আর টলাতে পারবে না। নিজের সীমাবদ্ধতা এবং ব্যাপ্তি দুটোতেই আমি মানসিক দৃঢ়তাকে ধরে রাখতে শিখে গেছি। জীবন আমাকে শিখিয়েছে, আমার বেঁচে থাকার লড়াই আমাকে শিখিয়েছে, কি করে পায়ের নীচের মাটিকে শিথিল হতে দিতে নেই। তাইতো নিজের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এ দেশের মানুষের কাছে দান করার অঙ্গীকার করে রেখেছি লিপিবদ্ধভাবে। কোনও আইন আমার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবেনা কখনো। আমি নিজেকে উৎসর্গ করেছি মানুষের জন্য মানুষেরই কাজে।
পাকিস্তানের উর্দু ভাষার একজন বিখ্যাত ছোটগল্পকার সাদাত হোসেন মান্টো’র একটি বিখ্যাত গল্পের কিছুটা অংশ অনুভূতিটাকে তছনছ করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট — “ভারত, পাকিস্তান স্বাধীনতা ও দেশভাগের দুই তিন বছর পরে দুই দেশের সরকার সিদ্ধান্ত নেয় পাগলদেরও ভাগাভাগি হবে। অর্থাৎ হিন্দু পাগলদের ভারত এবং মুসলিম পাগলদের পাকিস্তানে পাঠানো হবে। লাহোরের মানসিক হাসপাতালে থাকা একজন পাগল বিষান সিং বাকি সহবন্দীদের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। যেহেতু সে একজন হিন্দু তাই ভারতে চলে যাওয়ার হুকুম হয়। কিন্তু তার বাড়ি পাকিস্তানের টোবা টেক সিং এ। সে শুধুমাত্র টোবা টেক সিং নামক গ্রামটিতেই যেতে চায়। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের নীতি যদিও তা অনুমোদন করেনা। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় দুই দেশের সীমানায়, কাঁটাতারের দুপাশে দুই পা রেখে বিষান সিং মারা যায়। মৃত্যুর আগে সেই জায়গাটাই বিষান সিং এর কাছে হয়ে যায় টোবা টেক সিং।”
জীবন কাহিনীর শুরু বা শেষ বলে কিছু হয়না বোধহয়। সময়ের সাথে পথচলাটা নদীর স্রোতের মতোই প্রবহমান।
Facebook Comments

Leave a Reply