গল্প : শুভদীপ মৈত্র

কলম আলী দেশে ফিরতে চাইছিল

দিদি, আমায় রেলগাড়ি দেখাবি, দিদি… কলমের তন্দ্রা মতো এসেছিল তা চটকে গেল, সেই পরিচিত দৃশ্য তার চোখের সামনে কখন ভেসে উঠেছিল তা বুঝতেও পারেনি। জানলার ধারের একটা আসন সে পেয়েছে এবং শহর ছাড়িয়ে যখন মফঃস্বল এবং তারও অনেকটা পেরিয়ে বড় বড় ঘাসের ঝোপ ও সবুজ ক্ষেত তখন তার চোখ লেগে এসেছিল এবং সেই সবুজের ছবি কী করে শাদা কালো হয়ে বিখ্যাত দৃশ্যতে রূপান্তরিত হল তা তার বোধগম্য হয়নি। বিন্দু বিন্দু ঘাম তার গলায় সে রুমাল বের করে মোছার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল পকেটে সে বস্তুটি নেই। দু’টো পকেট এবং পিছ পকেট আবার হাতড়ালো।

চাবি, চিরুনি, চ্যাপটানো দেশলাই বাক্স, সিগারেটের প্যাকেট, ফোন, ওয়ালেট, খুচরো কয়েন, এটিএম-এর দোমড়ানো স্লিপ, যা বলছে অ্যাকাউন্টে তিনশ সত্তর টাকা শুধুমাত্র সেইটুকু সম্বল ছিল কলমের।

এই সামান্যটুকু নিয়ে সে দেশের বাড়ি ফিরতে চায় বলে এই ট্রেনে। অন্তত সে তেমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে যে বেরিয়েছিল একথা আমাদের সে বলেছিল বটে এবং আমরা এই কলকাতা শহরে থাকা কলম আলীর যে কোনও দেশ থাকতে পারে তা কল্পনাও করিনি, সেও নেহাত শহরের ছেলে আর পাঁচ জনের মতো ভাসমান অথবা উদ্বাস্তু আর আমরাও ধরে নিয়েছিলাম তাকে শহরেই মানায় ভালো তাই কাজে কাজেই…

কতদিন পর সে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছে মনে নেই। কোন স্মৃতির তাড়নায় এই বাড়ি ফেরার ব্যাপারটা, তাও স্পষ্ট নয় তার কাছে। তবু সে ফিরছিল বা অন্তত ফেরা নামের একটা যাত্রায় সে ছিল।

নদীয়ার দিকে কোথাও তার বাড়ি, স্টেশনটার নাম মেহেরপুর বা অমন একটা কিছু সে আমাদের বলেছিল। বহুদিনের অনভ্যাসে তার এই ট্রেনযাত্রায় একইসঙ্গে খানিক উদ্বেগের ও খানিক একটু ভ্রমণ-ভ্রমণ গন্ধ লেগেছিল। শেয়ালদা স্টেশন থেকে সে দুপুরের দিকে ট্রেনে ওঠে। মামুলি লোকাল ট্রেন যেমন হয় আর কি, সেই দুপুরের একটা অলস ভিড়, কিন্তু বসার জায়গা পাওয়া যায়, সেও একটা বই বের করে তা পড়ায় মন দেয়। আধা ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট পরে তার মুড়িওলার ডাকে মনে হল খিদে পেয়েছে, দুপুরে সে খেয়েছে বেশ আগে এবং নারকোলের টুকরো দেওয়া মুড়ির লোভ এড়াতে পারেনি। ঠোঙা শেষ করে তা দলা পাকিয়ে জানলা দিয়ে সে ফেলতে গেল যখন মনে পড়ল এই কামরাটা পুরনো দিনের। সে ছোটবেলায় যখন ট্রেনে চড়ত তেমন, খয়েরি অপ্রশস্ত সিট, ধরে দাঁড়ানোর হাতলগুলোর কাঠ গিয়ে রড বের করা কঙ্কাল, জানলার একটা দুটো শিক ভাঙা।

তখন থেকেই কলমের মন কুডাক ডাকছিল। এমন নয় সে কুসংস্কারে বিশ্বাস করে – কিন্তু ওই একটা মনের ভিতর খিঁচ খিঁচ থাকে না, সেটা হয়েছিল। তবে তাতে বেশিক্ষণ সে আমন দেয়নি। বরং জানলার বাইরে তাকাতে তার মন ভালো হয়ে যায় – শরত এসে গেছে, সবুজের আস্তরণ যেন, চারদিকে একটা চিত্র বিচিত্র কাঁথা কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে, যেমন তার নানী গায়ে দিত। যদিও আগে যেমন দেখা যেত শেষ না হওয়া প্রান্তর ভ্রম হত যে ট্রেনটা বোধহয় চলছেই না – তেমন আর নেই – মধ্যে মধ্যেই বাড়ি, ঘর, দোকানের অবয়ব সে দৃশ্যকে ভেঙে দিচ্ছিল। তবু যেটুকু আছে তা দেখতে দেখতে চোখ লেগে গেছিল কলমের।

তার ওই আধো ঘুম বা তন্দ্রা যাই হোক না কেন সেটা কাটে একটা স্টেশন ঢুকতে। আর আধো ঘুমে দেখা স্বপ্নর থেকে বেরনো সহজ নয়, তাকে বেশ কিছুক্ষণ সত্যি বলে ঠাওর হয়। তবে কলম সচকিত হয় দ্রুত। আসলে তার ঘুম ভেঙেছে একটা শোরগোলে। শোরগোল নয় কতগুলো ছেলে উঠেছে ট্রেনে জয় শ্রী রাম জয় শ্রী রাম বলে চেঁচাতে চেঁচাতে। নিজেদের মধ্যেই তারা এই হাঁক পাড়ছিল এবং সিটি দিচ্ছিল – নেহাত খেলার ছলে, যেভাবে ফুটবল ডার্বির দিন মোহন-ইস্ট সমর্থকরা করে থাকে। তবু সে সতর্ক হল এ কলকাতা নয়। কলকাতাতেও যে ছুটকো ছাটকা এমন শোনেনি তা নয় তবুও চেনা পরিসর আর অচেনায় ফারাক থাকে। তাছাড়া কলকাতার কতটুকুই বা তার আওতায় পড়ে? সে নেহাত নন্দন চত্বর, দু-একটা মাল্টিপ্লেক্স, কফি হাউজ বা পার্ক স্ট্রিট-লিন্ডসে। তার বাইরের কলকাতাও কী সে চেনে, তবুও ওই একটা স্বস্তি যে না এটা কলকাতা।

আশপাশের লোকজনের দিকে সে তাকাল। কেউই খুব আমল দিয়েছে তা নয় নিজেদের মধ্যে গল্প করছে, কেউ ফোন ঘাঁটছে, কেউ কেউ ঢুলে পড়ছে – ট্রেনের স্বাভাবিক দৃশ্য। কলম ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে পড়ার চেষ্টা করল। পান – পান – চাই পান। সে চোখ তুলল। একটা মাঝবয়সী লোক, গালে কাঁচা পাকা দাড়ি গলায় কার্ড-বোর্ডের একটা বাক্স মতো ঝুলিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে। কলম অবাক হল এমন বাক্স নিয়ে ট্রেনে উঠতে সে ছেলেবেলায় দেখেছে – এখনো এমন ওঠে নাকি। ওই বাক্সের কোণের দিকে সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই, লাল ভিজে কাপড়ের টুকরো দিয়ে পানের পাতাগুলো ঢাকা। এ তো দেখাই যায় না এখন, লোকটা এল কোত্থেকে? কলমের ইচ্ছে হল একটা পান কেনে তার থেকে – সে একমনে সামনের ধুতি শার্ট পরা লোকটার জন্য পান সাজছিল। কলম তার চোখের দিকে চাইল, হেসে একটা পান চাইতে গেল – লোকটার কোনো রকম প্রতিক্রিয়া হল না – যেন কলম সেখানে বসে নেই, যেন সে অদৃশ্য, যেন সে এই ট্রেনের কোনো প্যাসেঞ্জারই নয়।

মেজাজ খিঁচরে গেল কলমের। লোকটা তাকে পাত্তাই দিল না! অথচ এই ট্রেন এই যাতায়াত পথ তার জীবনের একটা বড় অংশ ছিল আর আজ যেন সে কেউ নয়। এমনকি এই যে তার সহযাত্রীরা একটা সময় তো ছিল প্রায় অনেকেই চেনা – ট্রেনে উঠলে পরিচিত প্রতিবেশী নিদেন চেনা মুখ যাদের চোখের দৃষ্টি তাকে মেনে নিত এক ধরনের পরিচিতিতে। তবে কি সে আদৌ আর ফিরছে – এই গল্পটা তার আর ফেরার গল্প থাকছে না?

কলম নিজেও জানে না যে স্টেশনে সে যাবে সেটা তার মনের মধ্যে যে চেহারায় রয়েছে আর বাস্তবে এই মুহূর্তে আদৌ সে স্টেশন সেই মেহেরপুর একই রকম কি না। টিকিট কাটার সময় তাড়াহুড়োয় কাউন্টারের লোকটা আদৌ ঠিকঠাক শুনতে পেয়েছিল তো, তা অবশ্য টিকিটের ছাপা দেখেই বোঝা যেত কিন্তু কলমের তা মাথায় এল না।

এমন সময় মেঘ ঘনিয়ে এল – অথবা যেহেতু ট্রেন চলমান এমনও বলা যেতে পারে ট্রেনটা ঢুকে পড়ল মেঘ-ঢাকা অঞ্চলে। চলন্ত ট্রেনে বৃষ্টি বড় অদ্ভুত। কয়েকটা জানলায় ঝাঁপ পড়ে গেল অতি-সাবধানীদের হাত দিয়ে। মেদুর বা থমথমে যেভাবেই হোক দেখা যেতে পারে ট্রেনের ভিতরটাকে। বৃষ্টি ঝাঁট মাঝেমধ্যে ভিতরে আসছে – দরজার সামনের হাওয়া-লোভীদের জটলা ভিতরমুখী।

যারা কামরার ভিতর দিকে আসছে তাদের অনেককেই কলম মনে হল চেনে। কাদের দেখছিল কলম?

যে লোকটাকে প্রথম চেনা লাগল তাকে সে পাড়ায় দেখেছে, বাজার যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে, হৃষ্টপুষ্ট গোল মুখ, চুল পেতে আঁচড়ানো, সবার সঙ্গে যাতায়াতের পথে খেজুর করতে করতে যায়, চলার গতি থামে না – অনেকটা তার মতো দেখতে। নিশ্চয়ই সে নয়, সে এখানে কী করে আসবে? লোকটা পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছে এবার, কাজেই তার সন্দেহ নিরসনও সম্ভব নয়। কিন্তু সামনের প্যাসেজ পেরিয়ে তাদের বগিরই পরের কামরায় যাকে সে দেখতে পেয়েছে সে অবশ্যই চেনা। কাফিখানার আড্ডায় তাকে সে দেখেছে বহুবার, যদিও আলাপ হয়নি কখনো। কাঁচা-পাকা চুলের পঞ্চাশোর্দ্ধ ভদ্রলোক, স্ট্রাইপ শার্ট ও ট্রাউজার পরা, গোঁফ যত্নে ছাঁটা, চেয়ারে হেলে বসে রিমলেস চশমার ভেতর দিয়ে খবরের কাগজ খুলে বসেন, স্টেটসম্যান কাগজ। মাঝেমধ্যে চুপচাপ বসে পাইপ টানেন কালো কফি আর কালেভদ্রে টোস্ট ছাড়া আর কিছু তাকে সে খেতে দেখেনি, সামনে বসা কোনো পরিচিত থাকলে অল্প বাক্য বিনিময় হয়তো – এমন লোক এখানে কী করছে?

এমন বেশ কিছু চেনা মুখ সে দেখতে পায়, যদিও চলন্ত ট্রেন এবং লোকজনের নড়াচড়ায় চোখের সামনে মাঝেমধ্যে বাধা আসে কিন্তু কলমের স্পষ্ট বুঝতে অসুবিধে হয় না – সে ভুল দেখেনি। এই নিয়ে বেশি ভাবার সময় সে অবশ্য পেল না। তার সামনে দাঁড়ানো দু’জনকে সরিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে যে তার মুখের দিকে না তাকিয়েও কলম বুঝতে পারে কে। সে ভয়ে আর চোখ তোলে না। ফলত, তার দৃষ্টি ব্লাউজ ও শাড়ির ফাঁকের অনাবৃত অংশে আটকে রয়েছে – বেঁটেখাটো মেয়েটার শাদা ফর্সা চামড়া কোমরের মৃদু ভাঁজে ট্রেনের গতিময়তায় কিছুটা আন্দোলিত কারণ সে ভর রাখতে পারছিল না উপরের হাতল পর্যন্ত হাত না পৌঁছনোয়। তাকে দেখতে পেয়েই যেন শরীরের কাছে ঘন হয়ে এল এবং আধো আধো গলায় তাকে সম্ভাষণ করল। কলম এখনো তার মুখের দিকে তাকায়নি। তাকালে ওই ফুলো ফুলো মুখ, বাম চিবুকে ছোট তিল আর পাউটিং ঠোঁট – যেন সন্দীপন চাটুজ্জের উপন্যাস থেকে নেমে এসেছে, এটা দূর্বার সঙ্গে প্রথম আলাপেই মনে হয়েছিল – তা চোখে পড়ত। তার বদলে চোখে পড়ছে উঁচিয়ে থাকা নিতম্বখানি। তার নানীর কথা মনে পড়ল, এমন মেয়েদের তিনি বলতেন ‘বোল্লা-ঠোঁটি, ডেঁও-পোঁদী’। চমৎকার সব কাহাবৎ, প্রবাদ ছিল নানীর জানা, সে সব হারিয়ে গেছে, এমনকি বয়স্কদের মুখেও আর শোনা যায় না, সেই সব প্রবাদ প্রবচন পথ হারিয়ে বন্দী হয়ে আছে লাইব্রেরির কোনো বইয়ের পাতায়, যা আর কোনোদিন বাসা পাবে না মানুষের মুখে, তবে আজ এই মুহূর্তে নয় বলাই বাহুল্য। এই মুহূর্তে সে তার নানীর উপমাটাই উপভোগ করছিল সামনের নারীর শরীরে।

কলমের কাঁধে আলগোছে হাত রেখে দূর্বা কথা বলে চলেছে, চশমার ভিতর দিয়ে চোখ দু’টো খানিক বিস্ফারিত। অ্যানিমেটেড।

যদিও কলম এই বেহায়াপনায় বিব্রত বোধ করছে এবং তার আশপাশের লোকজনের প্রতিক্রিয়া, টোন-টিটকিরি এসব ভেবে আশঙ্কিত – তবুও তার শরীর উত্তেজনা বোধ করল, তার দু’পায়ের ফাঁকের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে দূর্বা, এবং সে আশ্চর্য হল যে সহযাত্রীদের মধ্যে কোনো প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া তার কানে পর্যন্ত পৌঁছল না, কান বলছি কারণ সে লজ্জায় এবং অস্বস্তিতে তাদের দিকে আর তাকাচ্ছিল না। তার চোখ এখন দূর্বার মুখমণ্ডলে সীমাবদ্ধ। দূর্বা এখন তার বাম থাইয়ের উপর বসেছে। কলমের চোখ প্রায় আধবোজা – এভাবে দূর্বার সঙ্গে সে লেক বা আউটরাম ঘাটেও কখনো বসেনি, এই অবস্থায় সে প্রথম লক্ষ্য করল যে কথা বলতে বা আসতে দূর্বার মাড়ি বেরিয়ে যায়।

কলম যেমন প্রথম আলাপে যুগপৎ শিহরিত ও শঙ্কিত হয়েছিল, আজও তেমনি ঘটে চলেছে। সেই দূর্বা যে নিজে যেচে এসে আলাপ করেছিল বইমেলায় না কাফিখানায় তা মনে নেই এবং অফার করেছিল হুইস্কি, জল মেশানো একটা প্লাস্টিক বোতলে – প্রাথমিকভাবে এই সাহসীপনায় কলম আকৃষ্ট হলেও পরে জানতে পারে এই বাহাদুরি আসলে দূর্বার নিজস্ব নয় – কোনো এক কবি প্রেমিকের থেকে টুকলি। আসলে দূর্বার কিছুই নিজস্ব কিনা সে বুঝে উঠতে পারেনি।

অন্য কামরায় একটা শোরগোল শুনতে পেল কলম। যদিও আধো অন্ধকার, এবং দূর্বার আড়ালে সে বুঝতে পারছিল না ঠিক কী ঘটছে। দূর্বা এখন দু- হাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে যেন কতদিনকার প্রেমিক, এমনকি সেই শোরগোলের দিকে ঘাড় ঘোরানোরও সুযোগ দিল না আদুরে গলায় বলল ‘অন্যদিকে না, শুধু আমাকে দেখ।’ কলম মন্ত্রমুগ্ধ, যেমন জাদুকর ম্যানড্রেকের চোখের দিকে তাকিয়ে হয় না কি – অনেকটা তেমন। যদিও তার মনে পড়লে এর অস্বাভাবিকতায় আশ্চর্য হত – সে বেশ কিছু দিন আগে দূর্বাকে ইন্‌স্টাগ্রাম বা ফেসবুক থেকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছে। দূর্বা কোথায় আছে, কি করে কেউ জানে না – যেমন হয় দু’চার বছর জমিয়ে বইমেলা, ফিল্ম ফেস্টিভাল, আকাদেমি চত্বর – খপ করে সেখানকারই উদীয়মান (যারা চিরকালই তাই থাকে) নির্দেশককে বিয়ে, তারপর একটু নাম-ধাম হওয়া পাকা চুলো কবি, সাহিত্যিকের নেক নজর, উদ্দাম প্রেমের জোয়ারে ভাসালে মন্দারমনি, অযোধ্যা পাহাড় ডুবুডুবু সোশ্যাল মিডিয়ায় পোশাক ও প্রেমের উন্মোচন যাতে লাইক পড়ে আর পিছনে হ্যা হ্যা ছ্যা ছ্যা। এসব হুজুগ কেটে গেলে কী হয় কে খবর নেয়? তাপ্পর কোথায় যায় মেয়েগুলো, আদপে তাদের বাসা ছিল, ছিল সাকিন ঠিকানা?

কলমের মাথায় এসব আসেনি, মন্ত্র-অবশ কলমের মনে হয়েছিল দূর্বাও বোধহয় তারই মতো বাসায় ফিরতে বেরিয়েছে। একটা অস্ফূট চিৎকার কানে এল কলমের কিন্তু সে আর মাথা ফেরাতে পারল না, দূর্বা দু’হাতে তার মাথাটা টেনে নিয়েছে ঠিক তখনই, তার স্ফুরিত ঠোঁট দু’টো তার ঠোঁটের কাছে নিয়ে এসে বলল, ‘না, না, ওদিকে তাকিও না প্লিজ…’ কলম সেই মুহূর্তে আঁকড়ে ধরে ভুলতে চাইছিল তার আশপাশ। যে আশপাশ ক্রমশ ফাঁকা হয়ে আসছিল।

কলমের চোখে যা পড়েনি তা হল উলটো দিকের কামরার মধ্যে চলা শোরগোলের প্রকৃত কারণ – একটা ঝাঁকড়া চুলো লোক। কলমের চেনা বা আধা চেনা যাত্রী বা অপরিচিতও যারা তাদেরকে সে বেছে নিচ্ছিল। র‍্যান্ডম। যে বাছাইয়ের কোনো কারণ কারো কাছে নির্দিষ্ট নয় এবং সেই বাছাইয়ের পর সে তাদেরকে আবার দিচ্ছিল দু’টোর মধ্যে একটা বাছাইয়ের সুযোগ – যেন অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কওন বনেগা করোরপতি খেলা – যদিও এ খেলাটা আরো ভয়ানক। ঝাঁকড়া চুলো নিজেকে অমিতাভ ভাবে কি না তা আমরা জানি না তবে এটা বিলক্ষণ বোঝা যায় যে সে যে  কাজটা করছে তা তার কাছে মহান এবং সে কোনো না কোনো ভাবে অনুপ্রাণিত। যদিও সে অনুপ্রেরণা দৈব না মানুষের সৃষ্টি সে সব তত্ত্ব তালাসে আমরা যাচ্ছি না। প্রথম দর্শনে কেউ তাকে নিয়ে ভাবেওনি। কালো স্যান্ডো গেঞ্জির উপর একটা তেলচিটে হলদে খাকির মোটা জামা যেমন ড্রাইভাররা পরে, তলায় একটা ধুতি দক্ষিণ ভারতীয়দের মতো জড়ানো, হঠাৎ দেখে লুঙ্গি মনে হয়, ট্রেনে এমন পোশাকের নানা হকার ওঠে ফলে আলাদা করে নজর করার মতো কিছু ছিল না। কেউ করেওনি।

কলমের বক্তব্য অনুযায়ী শুরুর দিকে সে বিশেষ সাবধানতাও অবলম্বন করেছিল। ফলে ট্রেনের বাকি লোকেরাও কিছু আঁচ করে উঠতে পারেনি, তো দেখুন ব্যাপারগুলো এমনি হয়, সাধারণ মানুষ কখনো কিছুই ভালো করে বুঝে উঠতে পারে না যেমন ধরুন বিশের দশকে যে সব জার্মান ছেলেমেয়েরা জ্যাজ শুনে, নেচে কুঁদে, বিয়ার খেয়ে এক্সপ্রেসনিস্ট সিনেমা আর সমাজতন্ত্র নিয়ে আলোচনায় কাটাত তারা কী ঘুণাক্ষরেও বুঝেছিল ওই ঝাঁটা-গুঁফো ক্লাউনের মতো লোকটা তাদের ইতিহাসকে লজ্জিত করবে – এমনকি মুগুর, লাঠি হাতে তার চ্যালা-চামুণ্ডারা শহরের পর শহর দাপাচ্ছিল, একে ধরছে, ওকে মারছে গিয়ে তখনও ভেবেছিল পাতি গুণ্ডামি। ঠিক তেমনি কলমের ট্রেনের সহযাত্রীরাও ভাবেনি। তারা কেউ কাগজ তো কেউ ফোন তো কেউ ঘুমোতে ব্যস্ত ছিল।

লোকটা কী ভয় দেখাচ্ছিল, চুপচাপ কারো পাশে গিয়ে কোমরে ছুরি ঠেকাচ্ছিল না পিস্তল কে জানে – তবে এটা ঠিক যে কেউই তার সামনে এঁটে উঠতে পারেনি, কেমন বিহ্বল হয়ে যাচ্ছিল – ওই যে আকস্মিকতার কথা বললাম এ অবস্থায় ব্যক্তি হিসেবে কারো কিছু করারও থাকে না, লোকটা তার পরিকল্পনা অনুযায়ী তার শিকারকে কানে কানে বলছিল কিছু – একটা অপশন বা বাছাই দেওয়া এবং নিরুপায় লোকগুলো ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। এবং ভিড়ের থেকে একজন দু’জনের অনুপস্থিতি চোখেও তো পড়ে না আর কে কাকেই বা চেনে সেই ভিড়ে।

তবুও একটা দুটো ঘটনার পরে শোরগোল পড়ে যায় এবং লোকেরাও বুঝতে পারে কি ঘটছে, তাতে আতঙ্ক ও হট্টগোল বাড়ে। লোকজন বিভ্রান্ত, ফলে তাতে আরো বেশি মানসিক পঙ্গুত্ব বাড়ে দলবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

কলমি কি এই ঘটনাগুলোর কোনো আভাস পাচ্ছিল? একথা ঠিক যে সে দূর্বাতে মশগুল তখন, আমরা তাকে শেষ যে অবস্থায় দেখেছি, থাইয়ের উপর দূর্বা নামের মেয়েটি আর কলম যেন খোয়াব দেখছে, যেন বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত এক মিলন, যেন দূর্বার শরীরই সেই দেশ যেখানে সে ফিরতে এই ট্রেনে উঠেছে – যদিও এ সত্যি নয়, ট্রেনের যা ঘটে চলেছিল তার আভাস প্রত্যেকের কাছেই পৌঁছচ্ছিল আর কলমও তার ব্যতিক্রম নয়, কিন্তু কলম সেই আভাস পাওয়াটা স্বীকার করতে চায়নি।

এভাবে কতক্ষণ কেটেছে কলম জানে না, সে শুধু হঠাত দেখল লোকটা  তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাত বাড়িয়েছে দূর্বার দিকে, তার চোখ দূর্বার চোখে আটকে যেন কলম সেখানে নেইই। দূর্বা কিছু বলার আগেই তার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে দরজার দিকে নিয়ে গেল। কলম উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বুঝল কামরা প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে, যে ক’জন আছে স্থির, যেন পাথরে কোঁদা মূর্তি। ঝাপসা লাগল তাদের, কলমের চোখের বিভ্রমও হতে পারে, কী করবে সে জানে না। প্রায় টলতে টলতে সে কামরার এদিক ওদিক – যদি কিছু সামান্যতম পাওয়া যায় চ্যালা কাঠের টুকরো, ভাঙা শিক। সে দেখতে পেল ট্রেনের দরজার সামনের একতা দেওয়ালে দূর্বাকে পিষে দিয়েছে লোকটা। শাড়ির আঁচল লুটোচ্ছে, গালে চর-থাপ্পড়ের দাগ – দু’হাত দিয়ে ব্লাউজটা ছিঁড়ে দিল। তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে মুকের দিকে তাকাল, তার কথায় দূর্বা থরথর করে কেঁপে উঠেছে, দু’বার মাথা নাড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠতে যাওয়ার আগেই লোকটা আবার এক হাতে শক্ত করে তার কাঁধ ধরেছে, অন্য হাত আবার উদ্যত। দূর্বা কান্না-বোজা গলায় কী বলল কলম বুঝতে পারল না, তবে লোকটার ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে গেল। মানে দূর্বা রাজি। আলগোছে সে দু’ আঙুলে তার চিবুক ঘুরিয়ে দেখল, তারপর থুঃ করে সশব্দে এক দলা থুতু ছিটিয়ে দিল দূর্বার মুখে।

কলমের আর সহ্য হল না, সে লোকটার পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল। লোকটাও যেন তৈরি ছিল। পিঠের ঝাঁকুনি আর বাঁ হাতের একটা ঝাপটা – কলম যেন মাছির মতোই অকিঞ্চিৎকর। কলম টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল দরজার দিকে।

কলমের মনে হল পায়ের তলায় ঘাস ভিজে ঘাসের স্পর্শ পাচ্ছে, অনেক দিনের একটা ঘুমঘোর থেকে সে যেন জেগে উঠে ঠাওর করার চেষ্টা করছে সোঁদা মাটির স্পর্শটা আর একটা হাত তার মুঠোর ভিতর যা ধরে সে ছুটছে, কার হাত – দিদির, প্রেমিকার না ঘাতকের? কলম জানে না।

Facebook Comments

Leave a Reply