গল্প : সোমনাথ ঘোষাল
ঘর
বহু পুরোনো শরিকী বাড়ি। বাবা মা মারা যাওয়ার পর, যীশু এখন একাই থাকে। বিয়েথা হয়নি। শ্যামবাজারের ফুটপাতে একটা গুমটি দোকান। গ্যাসলাইটার, ঘড়ির। সকাল নটা থেকে বেলা একটা। আবার বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নটা। সারাদিনের রোজগার বলতে মেরেকেটে ষাট-সত্তর। বাবার কিছু জমানো টাকা আছে পোষ্ট অফিসে। তাতে মাসে তেরশো টাকা মতন আসে। উত্তর কলকাতার ঘটি। মাধব পালদের একটাই সন্তান যীশু পাল। ডাকনাম ফেক্লু। গোপালমোহন লেনের এই আধভাঙা শরিকী বাড়িতে এখন তিনঘর পরিবার থাকে। তারমধ্যে একঘর নতুন আসা একটা অবাঙালি পরিবার। ওদের একটাই ঘর। ওপরে যীশুর সেজকাকারা থাকে। যীশুর দুটো ঘর। একটা নিচে আর একটা ওপরের সিঁড়িরঘর। সেজকাকাদের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক নেই। বাড়ির মালিক শোভাবাজারে থাকে। বহুবছরের পুরনো বাসিন্দা। তাই তুলতে পারছে না। কেস চলছে। যীশু এমনিতেই খুব ভীতু। একা থাকে। তেমন বন্ধু বান্ধব নেই। আর এই অবাঙালি পরিবারটি চাইছে যীশুর নিচের ঘরটা নিয়ে নিতে। কারণ একটা ঘরে পাঁচজন থাকা যায় না। একজন বারান্দায় ঘুমায়। পাড়াতে অনেকেই জানে যীশু খুব ভীতু। তাই বান্টি শোয়ার সময় নানারকম শব্দ করে। যীশুর ঘরের দজার সামনে দাঁড়িয়ে খুটখাট শব্দ করে। সকালে বান্টির মা বলে, ও যীশু বেটা তু উপার চলা যা, ইখানে ভুত আছে। বান্টি হামাকে রোজ বলে কী তুমার ঘরের সামনে এক আতমা আসে! তুম উপার চলে যাও। আমরা লিচে থেকে যাব। আমাদের মাতাজী আছে। ও কিছু হবে না! তুমাকে পাঁচশো টাকা মাসে মাসে দিয়ে দেব। প্রতিদিন এই অশান্তি নিয়ে যীশু চলে। যীশু নিজেও জানে ভুতের গল্প মিথ্যে। কিন্তু যীশু একা। কিছু করতেও পারে না। পাড়াতে কয়েকজনকে বলেও কিছু হচ্ছে না।
যীশু দোকান করে বাড়ি ফেরে। স্নান করে, আলু, পটল, কুমড়ো, ডিম সেদ্ধ দিয়ে ভাত খেয়ে টানা ঘুমায়। এখন রোজ রাতের নাটকের জন্য আর রাতের ঘুমটা হয় না। বিকেলে একটা চেনা চায়ের দোকানে চা খেয়ে দোকান খোলে। যীশুর আর এই রোজকার অশান্তিটা নিতে পারছে না। চুপ করে বসে থাকে। রোগাপাতলা শরীরটা যেন আরও কিছুটা ঝুঁকে গেছে এই বছর বেয়াল্লিশের যীশুর। লম্বা নাকের ওপর বাঁকা চশমাটাও হাঁ করে যেন নিজেকেই দেখছে। যীশু রোজ রাতে বাড়ি ফেরার সময় গলির কুকুরগুলোর জন্য অনেক বিস্কুট নিয়ে যায়। ওদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে, রাতে খেয়ে শুয়ে থাকে। কিন্তু ঘুমোতে পারে না। বান্টি এখন মাল খেয়ে নানারকম ভুতের আওয়াজ করে। যীশু সারারাত যীশুর ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাতের আলোতে শিশির পড়ে। এখন হেমন্তকাল। যীশু কানপেতে থাকে কখন কাকের ডাক শুনবে! আগে হলে সিঁড়িরঘরে শুতো। কিন্তু যবে থেকে বাড়ির মালিক এদের এনেছে, তবে থেকেই ঘর হাতছাড়ার ভয়ে আর ওপরে যায় না। যীশু রাত গুনতে থাকে। খুব পুরনোদিনের ঘর বলে এখনি বেশ ঠাণ্ডা। শীত পরলে কী হবে কে জানে! যীশুর খুব একা লাগে। কান্না পায়। আবার নিজের নাম ভেবে হাসে। বলে ওঠে, যীশু বড় দয়ালু শীতকালে খায় রাঙআলু…
সকালে মুড়ি আর বোঁদে খেয়ে দোকান খোলে। পুরনো খদ্দের সুনীলবাবু দোকানে আসে। তিনটে লাইটারে গ্যাস ভরাতে। যীশুকে বলে, কী হে ভায়া তুমি ঘটি না বাঙাল? যীশু বলে বাপঠাকুরদার আমল থেকে তো এখানেই আছি, পাঁড় মোহনবাগান। বাঙাল কেনও হবো? না, বাবার জন্ম সার্টিফিকেট আছে তো? বাড়ির দলিল? বাবার জন্মদিনই জানি না! দেখতে হবে। আর ওসব নেই। শরিকী বাড়িতে থাকি। এখানেই জন্মকর্ম। একটা লিখিত কাগজ আছে। শুনেছি বাবারা আগে বারাসাতের দিকে থাকত। কিন্তু বাপঠাকুরদাও এখানে চলে আসে। শাড়ির দোকান ছিল। কাকারা চিটিংবাজি করে নিয়ে নেয়। পুরনো কলকাতার বাসিন্দা। পাঁড় ঘটি। কিন্তু কেন বলতো? সুনীলবাবু বলে, তুমিতো দেখছি কিছুই জানো না! আসামের অবস্থা জানো? কি হয়েছে? যীশু বলে হ্যাঁ শুনেছি। কিন্তু আমারতো ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড সবই আছে। তাতে কী হয়েছে! এতে চিঁড়ে ভিজবে না! যদি চাকা ঘুরে যায় কী করবে? ওখানে কার গাঁড়ে গ্যাস ভরবে! একেই বাড়ির সমস্যা। তারপর সুনীলবাবুর কথা শুনে বেশ মনমরা হয়ে পরল যীশু। রোজ রাতে এমনিতেই ঘর বাঁচানোর লড়াই! তারওপর শিবির…
রাত হয়ে আসে। হলুদ আলোর গলিতে বাড়িগুলোর বেঁকাট্যাঁরা ছায়ারা যীশুর দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে লালু, ভুলু, কেলো, পান্তা, আর উদো লেজ নাড়তে নাড়তে যীশুর কাছে ছুটে আসে। আজ যেন ওরাও বুঝতে পারছে, যীশুর খুব মন খারাপ! যীশুকে আদর করতে থাকে। বড়দিনের দিন জন্ম হয়েছিল বলে মা বাবা সাধ করে নাম রেখেছিল যীশু চরণ পাল। কিছু বছর পর যীশু পাল হয়ে যায়। মা বাবার কথা মনে পরে। একটা নির্জন আলোতে ছায়ার মতন বসে থাকে যীশু। সঙ্গে যীশুর বন্ধুগুলো যীশুকে ঘিরে থাকে। বিস্কুটের আনন্দে। দূর থেকে অতনুদার মা চিৎকার করে বলে কদ্দিন আর ওদের নিয়ে থাকবি! বিয়েথা কিছুই করলি না! আর এখন কে করবে! আইবুড়ো রয়ে গেলি… যীশু হাসতে হাসতে বলে তুমি করবে? বিয়ে! বুড়ি রেগে বলে, মুখপোড়া মিনসের কথা শোনো, মর মর… নীরবতা কেটে যায়। আবারও নীরব আলোরা ঘিরে ধরে।
দেয়ালের গায়ে একটা পেরেক লাগাতে থাকে। এইসময় খুব মশার উৎপাত। একদম দাঁড়ানো যায় না! তাই রাতে মশারী টাঙাতে হবে। তারওপর ডেঙ্গু! কোনোরকমে একটা পেরেক লাগিয়ে একটা বাতাসা আর জল খায়। আজ রোববার দোকান বন্ধ। পঞ্চাশ টাকার মুরগি এনেছে। উচ্ছে ভাজা ভাত আর মুরগির ঝোল। রোববার করে দুপুরে গঙ্গার ঘাটে যায় যীশু। চুপ করে বসে থাকে। বিকেলের পড়ন্ত আলোতে জলের মায়া কুড়োতে থাকে। কেউ স্নান করেছে, কেউ প্রেম করেছে, কেউ নেশা করছে, যীশু ভাবছে ঘর! কীভাবে ঘরটা বাঁচাবে! দুটাকার মুড়ি আর তিনটাকার বাদাম কিনে খেতে খেতে সোজা শঙ্করদার চায়ের দোকানে আসে। কেটলি থেকে জল খায়। বলে আদা দিয়ে একটা লিকার। আজ রোববার যীশুর একটা সিগারেট খাওয়ার দিন। যীশু একমাত্র সপ্তাহে একদিন রোববার, সন্ধেবেলায় পাঁচ থেকে সাত মিনিটের জন্য সাহসী হয়! সেটা যীশু ভাবে। কারণ সিগারেট খেলেই ক্যান্সার হবে। আর অনেক টাকা লাগে। তাই প্রতি রোববার সন্ধেবেলায় একটা সিগারেট। শঙ্করদা বলে কিরে কী ব্যাপার তোর, এত মনমরা কেন? সিগারেট ধরিয়েও নিজেকে মিঠুন ভাবছিস না! কি হয়েছে তোর? যীশু বলে রাতে ভুতের উৎপাত! ঘুমোতে পারি না! আরে হনুমানজীর পুজো কর। মঙ্গলবার করে। সেইদিন শুধু নিরামিষ খাবি। আরে ধুর, মানুষ ভুত। শঙ্করদা বলে মানে? যীশু বিষয়টা জানায়। শেষে বলে এই করেই হয়তো মরে যাব। একেই মোদী ক্যাম্পে পাঠিয়ে গাঁড় মেরে দিচ্ছে, তারওপর এইসব ভুতমারানি কেস। শঙ্করদা বিড়ি ধরিয়ে বলে, এই পাঁচশো টাকা নিয়ে আয়। তোকে হনুমানই বাঁচাবে! যীশু বলে ধুর আমি বিজেপি নই। তো কী হয়েছে… যা বলছি তাই কর। বলছি কেসটা। যীশু খানিকপর পাঁচশো টাকা নিয়ে আসে। শঙ্করদা চা দিয়ে বলে, শোন এই পাঁচশো টাকায় একটা হনুমান মূর্তি মালাটালা সব হয়ে যাবে। তুই খালি মঙ্গলবার থেকে বাড়িতে পুজো করবি। যীশু বলে আর দোকান? আগে ঘর বাঁচা। শঙ্করদা বলে চিন্তা করিস না। তুই খালি লাল একটা ফতুয়া আর ধুতি পড়ে খালি প্রত্যেক মঙ্গলবার ঘরের ভেতর নেচে বেড়াবি! আমি পুলিনদাকে বলে দিচ্ছি। ও প্রত্যেকে সপ্তাহে আসবে। দুবেলা পুজো করে যাবে। তুই দেড়শো টাকা হাতে দিয়ে দিস। আর আমি দোকান বন্ধ করে আসছি তোর ঘরে। একটু ছোলা আদা নুন লঙ্কা রাখিস। মাল খেতে খেতে বিষয়টা সাজিয়ে দেব। একদম চিন্তা করিস না! জানে তো না বাঙালি কী জিনিস! একে তোর বিয়েথা হয়নি। আইবুড়ো মাল! তুই তো খাঁটি হনুমান। শঙ্করদা হাসতে থাকে।
মঙ্গলবার ভোরবেলা যীশু স্নান করে লাল ফতুয়া আর লাল ধুতি পড়ে প্রায় হাফ কাপালিক সেজে গম্ভীর হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এতে বাড়ির লোকজন যীশুকে দেখে বেশ ঘাবড়ে যায়। সকাল সাতটা নাগাদ শঙ্করদা তার বউ, পুলিন পুরোহিত, আরও দুজন ছেলে আসে। পুলিন পুরোহিত যীশুকে দেখে বলে বাবা, এই নাও তোমার হনুমান। আজ থেকে তোমার ঘরে থাকবে। ইনিই তোমাকে ভুতের হাত থেকে রক্ষা করবেন। শাঁখ কাঁসি ঘন্টা বাজিয়ে, ধূপ ধুনো দিয়ে পুজো শুরু হয়। সঙ্গে হনুমান চল্লিশা পাঠ। যীশুর ঘরে হনুমান বসে। ফুল মিষ্টি সাজানো। পুলিন পুরোহিত পুজো শেষ করে চিল্লে চিল্লে বলে, যীশু বাবা তোমার মধ্যেই হনুমান আছে। তুমিই হনুমান! এদিকে যীশুর এইসব পুজোপাঠ দেখে, আর নিজেকে হনুমান শুনতে শুনতে শুঁকনো বুকের ছাতি ফুলে ওঠে। যীশু আনন্দে দালানে জয় তারা জয় তারা বলে নাচতে থাকে। এইসব দেখে বান্টির মা বেশ ভয় পেয়ে যায়। বান্টি কিছুই বুঝতে পারে না! যীশু বাড়ির সবাইকে আর আশপাশেও প্রসাদ দেয়। সন্ধেবেলা আবার পুজো। পুলিন পুরোহিত ধূপ ধুনো দিয়ে যাবে।
এইভাবেই বেশ কিছুদিন চলতে থাকে। রাতে বান্টিভুতের উৎপাত আর হয়না। হনুমানের ভয়ে। ঘরটাও বেঁচে যায়। খালি শঙ্করদা বলে দিয়েছে। কিছুদিন নিরামিষ খাস। তারপর একটা ভালোদিন দেখে কালী ঠাকুর রেখে দেব। তখন আর চিন্তা নেই। শনিবার কালী পুজো হবে। যা হবে ছোট করে। সকালে হনুমান চাল্লিশা আর রাতে শ্যামাসঙ্গীত বাজাবি। আর তখন আমিষ খাস। আমাদের মা তো মদ মাংস খায়। প্রতি শনিবার মায়ের প্রসাদ নিয়ে পুজো দেব। তুই খালি, ছোলা আদা নুন লঙ্কাটা রাখিস। আর শীতে ওপরের ঘরে ঘুমবি। নিচে হনুমান আর কালী থাকবে। তোর আর কোনো চিন্তা নেই। খালি মাঝে মধ্যেই বলে উঠবি জয় তারা… জয় কালী…!
Posted in: Cover Story, November 2019