গল্প : রঙ্গন রায়

দশরথ মন্ডল 

আশ্বিনের শেষ। হাল্কা হাল্কা ঠান্ডা পড়ছে। ভোরের দিকে গায়ে পাতলা কাঁথা না হলে ঘুমটা জম্পেশ হয়না। দশরথ মন্ডল বাসে করে শহরে এলেন। আজ হাটবার। কিন্তু তুলো তুলো সুন্দর কম্বল গুলো হাটে পাওয়া যায়না। কিনে নিয়েই বাড়ি ফিরে যাবেন তিনি।  গণেশের চায়ের দোকানে সপ্তাহের এই একটা দিনই তিনি প্রাণ ভরে আড্ডা মারেন। ভবেশগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলের হেডমাষ্টার সুজন বাবু তার বন্ধু লোক। এছাড়াও নগেন কুন্ডু , ভোলা দাস , মদন মন্ডল , হরি রায় সবাই ওই চায়ের দোকানে জমায়েত হয়। কাচের কাপে দুধ চা আর বিড়ির ধোঁয়া দশরথের খুব প্রিয় জিনিস।

বাস থেকে নেমে তিনি একটা বিড়ি ধরালেন। এখন একটা বাজে। তিনটার বাস ধরলে চারটার মধ্যে তিনি পৌঁছে যাবেন।

কম্বল কেনা হয়ে গেলে দশরথ দেখলেন এখনো বেশ কিছুটা সময় হাতে আছে। তিনি বাজারের পাশের বস্তির গলিটা দিয়ে ঘুরে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাবেন ঠিক করলেন।

সিমেন্ট গোলার মেশিনে সিমেন্ট গোলা হচ্ছে। রাস্তা বানানোর কাজ চলছে এখানে। অন্য আর পাঁচটা রাস্তার মতই দেখতে এই রাস্তাটাও। নোংরা। একটা সস্তার ভাতের হোটেল। চায়ের দোকান। কয়েকজন বয়স্ক মহিলা ম্যাক্সি পরে রাস্তায় দাড়িয়ে আছে।

গলি থেকে বেরোনোর  ঠিক মুখটায় একটা সিমেন্টের খুঁটির গায়ে কারা যেন লাল কালিতে লিখে রেখেছে NO NRC। ইদানিং এই এনার্সি শব্দটা শুনলেই তার এনার্জি খতম হয়ে যাচ্ছে। হাটের লোকের মুখে যেটুকু শুনেছেন তা ভীষণ ভয়াবহ। সুজন মাস্টার বলেছিল যে কত সালের যেন একটা আইন আছে। তাতে তার জন্ম সার্টিফিকেটই তার ভারতীয় হবার প্রমাণ। দশরথ মন্ডল ক্লাস থ্রি অবধি পড়াশোনা করে যখন বুঝেছিলেন যে এই লাইন তার নয় সেদিন থেকেই বাবাকে মাঠের কাজে সাহায্যে নেমে পড়েছিলেন। কিন্তু NRC এই শব্দটা তিনি পড়তে জানেন। কিছুদিন আগেই ভোটের কার্ড ব্যাঙ্কের বই আঁধার আর্ড সব লিঙ্ক না কি একটা করতে বলেছিল। সবাই রোজ রোজ পড়িমরি করে ছুটে শহরে এসেছিল। এখনো আসছে। তার ওসব ঝামেলা মিটে গেছে। সুজন মাস্টার দায়িত্ব নিয়ে সব করে দিয়েছে। কিন্তু এনার্সি নাকি অন্য জিনিস। জন্মের সার্টিফিকেট লাগে। তার তো বাড়িতে জন্ম! তিনি সার্টিফিকেট পাবেন কীকরে? তাহলে কি দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে? যেভাবে তার বাবা এক দেশ ছেড়ে এই দেশে এসেছিলেন! আর কত বার দেশ ছাড়া হবেন তারা?

গলির বাইরে দাঁড়িয়ে একটু জিরোলেন দশরথ। এসব ভাবলেই মন খারাপ হয়। শরীর কেমন যেন লাগে। মনের চাপ কমানোর জন্য বাস ধরার কথা ভাবলেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন। সামনে একটা সিনেমা হল। প্রায় নগ্ন একটা মেয়ের ছবি পোস্টারে দেওয়া। তাকে ঘিরে দুটো তাগড়াই চেহারার ছেলে। কী মনে হওয়ায় সিনেমা হলে ঢুকে পড়লেন দশরথ মন্ডল।

বেরিয়ে নিয়ে দশরথের সবচেয়ে অবাক লাগলো যে জিনিসটায় সেটা হলো একই নায়কের গলায় তিনবার তিনরকম গলার গান শোনা গেলো।

হলের সামনে থেকেই বাস ছাড়ে। উঠে  একটা জানলার ধারে সীটও পেয়ে গেলেন। বিকাল চারটা পার হয়ে গেছে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। শেষ আলোটা তার গায়ে এসে পড়ছে। হাওয়ায় অল্প অল্প কাপছে চুলগুলো। রাস্তার ধারে ধানের ক্ষেতে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখতে দেখতে দশরথ মন্ডলের আবার মন খারাপ হয়ে গেলো।

সুজন মাস্টার বললেন ,” কীরে , আজ এত দেরি করলি আসতে?”

দশরথ মন্ডল এখনো বাড়ি যান নি। বাস থেকে নেমেই এখানে চলে এসেছেন। হাতে কম্বলের ব্যাগটা ধরা। সেটা দেখিয়ে বললেন ,”শহরে গেসিলাম। ঠান্ডা তো পইড়েই গ্যালো। বাসায় একখান ভালো কম্বল নাই। মেয়েটা কইসিলো নিয়া আসার লগে। আইজ নিয়া আইলাম! সন্দোর না?”

মদন মন্ডল আর ভোলা দাস তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো জিনিসটা। কিছু বললোনা। তাদেরও এরকম একটা কেনা দরকার ছিল। সুজন মাস্টার বললেন , “বাহ! খাসা হইছে তো! কত পড়লো?”

দামটা শোনার জন্য গণেশও এদিকে কান দিলো। দশরথ বললেন ,”এই হাজার চাইসিলো। দিসি আটশো। সস্তা হইসে না?”

সূর্য বেশ কিছুক্ষণ আগে ডুবে গেছে। অন্ধকার। হাটের দোকান গুলোতে বাল্ব জ্বালানো হয়েছে। যারা রাস্তায় বসেছে তাদের কুপি জ্বলে উঠেছে। বেশ গমগম করছে হাট। দশরথ চা খেয়ে বিড়ি ধরালেন। হরি রায় বললো ,”দশরথ , দক্ষিন পাড়ার ফজলুলের খবরটা শুনসোস?”

“নাতো! কি হইসে?”

“ফাঁসি দিসে।”

“কীহ! হায় রামো। কেনে?”

“ওই যে কিসব করবার লাগতাসে না আইজকাল! লিঙ্ক না কি সব!”

“হ।”

“ঐটার লাইগাই মরলো ওয়।”

সুজন মাস্টার বললেন , “আরে এইসব আর ভাল্লাগতেসেনা। সরকার যহন যা ইচ্ছা করতেসে আর আমাগো নাকানি চোবানি।”

“আরে মাস্টার তুমি খুইলে কওনা বিষয়টা!” দশরথ উৎসুক হয়ে উঠলেন। তাকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। অ্যাড্রিনালিন হরমোন একটু বেশি ক্ষরণ হয় দশরথের। এই কথাটা মাস্টার বলে। তিনি বোঝেননা। তবে হরমোন নাকি খারাপ শব্দ। পাড়ার ছেলে ছোকরা গুলো বলে। দশরথ এইজন্য লজ্জা পান। আড্ডায় তিনি পারতপক্ষে উত্তেজিত হননা।

সুজন মাস্টার যা বললেন তাতে দশরথের মাথা ঘুরে গেলো। আধার কার্ড ভোটার কার্ড ব্যাঙ্কের বই সব লিঙ্ক করানোর জন্য সবাই শহরে ছোটাছুটি করছে। এখানেও অনেক দালাল গজিয়েছে সেগুলো করানোর জন্য। কিন্তু লিঙ্ক সবার ঠিকমতো হলেও ফজলুলের নাকি হয়নি। মাস্টার বললো কি সার্ভার ডাউন না কি ছিল তার জন্য হয়নি। পরে নাকি হয়ে যাবে। কিন্তু গ্রামের অশিক্ষিত চাষী মানুষ ফজলুলের মাথার মধ্যে কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে যে লিঙ্ক হয়নি মানে তার এই দেশের নাগরিকত্ব থাকবেনা। এনার্সি করে সবাইকে বের করে দেবে। ফজলুল সেটা শুনে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। বাড়িতে খাওয়া দাওয়াও ঠিক করে করেনা। বউ ছেলেমেয়েরা ফজলুলের এই আচরণে একটু চিন্তায় পড়লেও অত কিছু ভাবেনা। কিন্তু আজ সকালে ফজলুলকে বাড়িতে পাওয়া না গেলে খোঁজ পড়ে যায়। সবাই দেখে গ্রামের শেষে যে বুড়ো আমগাছটা আছে ওর ডালে ফজলুল ঝুলছে। তারপর মিডিয়া টিডিয়া লোকে লোকারণ্য।

দশরথ মন্ডলের মুখটা থমথমে হয়ে গেলো। তার সব ঠিকঠাক হলেও বার্থ সার্টিফিকেট নেই। মাস্টার এটা আগেই বলেছিল যে ওটাই নাকি মেন। ওটা থাকা মানে নাগরিকত্ব থাকা। সবাই চুপ করে আছে দেখে মদন মন্ডল ফস করে বললো ,”আজ দুপুরে এইহানে একটা পার্টি আইসিলো। ওরা মাইকে বললো যে এনার্সি নিয়ে নাকি অত ভয়ের কিসু নাই। আমাগো কিস্যু হবেনা। আসামে নাকি কি একটা ক্যাম্প হইসে ওখানে কিসু লোকরে রাখসে সরকার এনার্সিতে অদের নাম নাই দেইখে। কিন্তু আমাগো রাজ্যে নাকি করতে দিবোনা।”

মাস্টার বললেন ,”ওহ্ ডিটেনশন ক্যাম্প! কাগজে পড়লাম যে ওখানে নাকি কয়েকজন মারাও গেসে। হিন্দু মুসলিম বলে কিছু নাই। যার নাম এনার্সিতে নাই সেই যাবে ডিটেনশন ক্যাম্প। শালা দেশটাকে হিটলার বানায় দিলো।”

মাস্টারের মুখে “শালা” শুনে সবাই অবাক হয়ে মাস্টারের দিকে তাকালো। দশরথও তাকালেন। কিন্তু চুপ করে গেলেন। তার কষ্ট হচ্ছে। আর সেই সাথে হচ্ছে ভয়। ভীষণ ভয়। ডিটেনশন ক্যাম্প মানে কী?

মাস্টার বলতে লাগলেন ,” হিটলার যেমন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানায় তাতে ইহুদিদের মারসিলো আটকায় রাইখে। এইখানেও তা করার ধান্দা।”

এরপর ইহুদিদের হিটলার কিরকম নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল সেই বর্ননায় আড্ডা গড়াতে থাকলো। দশরথের দ্বিতীয় কাপ চা শেষ হতেই তিনি উঠে পড়লেন। তার ভালো লাগছেনা। একদম ভালো লাগছেনা। এই গ্রামের মুসলমানরা ইদানীং একদম চুপ হয়ে গেছে। সবাই কেমন ভয়ে ভয়ে থাকে। মাঝে গ্রামের ছেলে ছোকরারা “জয় শ্রী রাম” বলে হাঁক দিয়ে উঠতো মাঝে মাঝেই। মুসলমানদের গ্রামের দিকে তারা বেশি বেশি করে এসব ছুড়ে দিতো। এখন জয় শ্রী রাম কমে গেছে। দশরথ নিজের মনকে প্রবোধ দিলেন। আর যাকেই দেশ থেকে তাড়াক , তিনি দশরথ মন্ডল। রামের বাপের নামে নাম। রাম মন্দির নিয়ে দুদিন আগেই ভীষণ হইহই হয়েছিল আড্ডায়। কোর্ট নাকি রাম মন্দির বানাতে বলেছে। তাহলে রাম থাকলে রামের বাপও থাকবে।

সাতদিন পর সবাই দেখলো গ্রামের শেষ মাথার একটা পোড়ো মাঠে অনেক ইটবালি পাথর এসে পড়েছে। বেশকিছু রাজমিস্ত্রী কামলারাও এসেছে। তাঁবু খাটিয়ে আছে তারা। এখানে নাকি সরকার একটা বিল্ডিং বানাবে। কেন বানাবে সেসব কিছু প্রকাশিত হয়নি। গ্রামের কিছু ছেলে ছোকরাও ওখানে কাজ পেয়ে গেলো। দশরথ মন্ডল দেখলেন দারুণ উদ্যোমের সাথে কাজ শুরু হয়ে গেলো।  গ্রামের ছেলেরা কাজ পেয়েছে এটা জেনে সবাই ভীষণ খুশি। যে বিশাল আয়োজন , দেখে মনে হয় কারখানা হবে। হোক। গ্রামের মানুষ কাজ পাক। এমনিতেও ওই জমি ফাঁকাই পড়ে থাকে।

ভোর বেলা দশরথ মন্ডল হাঁটতে বের হন। মুখে নিমের দাঁতন নিয়ে কিছুটা হেঁটে পালদের পুকুরে মুখ ধুয়ে বাড়ি ফেরেন। এই সময়টা তার খুব পছন্দের। চারিদিকে নিস্তব্ধ। পাখি ডাকে। মাঝে মাঝে বাড়ির দিকে গমন রত শিয়ালদের সাথে দশরথ মন্ডলের দেখাও হয়ে যায়। শিয়াল খুব ভীতু ধরনের প্রানী। কিন্তু ভীষণ সেয়ানা। তার বাড়ির মুরগি বেশ কয়েকবার খেয়ে গেছে বদমাশ গুলো। দশরথ আজ হাঁটতে হাঁটতে পোড়ো মাঠের দিকে এলেন। দেখা যাক কতটা কাজ এগিয়েছে।

তাঁবুগুলোর একদম কাছে যখন চলে এসেছেন তিনি তখন বাইরের কোনো গ্রাম থেকে আসা এক কামলা ঘুম ঘুম চোখে বেরিয়ে এলো। আড়মোড়া ভেঙে সে ভালো মত তাকাতেই দশরথ মন্ডলের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেলো। দশরথ তার দিকে এগিয়ে গেলেন। লোকটা হাসি হাসি মুখে  বললো , “আরে মিয়া , আসসালাম আলায়কুম!”

সর্বনাশ! দশরথের লুঙ্গি আর মুখের দাড়ি দেখে লোকটা তাকে মুসলমান ভাবছে। ছিছি! সকাল সকাল কীসব শুনলেন তিনি! কিন্তু তবুও দশরথ বাইরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টাই করলেন। বললেন ,” আলায়কুম আসসালাম। এই টা তোমরা কী বানাইতাসো?” লোকটার মুখ শুকিয়ে গেলো। বললো ,”আমি কানাঘুষা শুনসি যে এইটা নাকি ক্যাম্প হইবো। যাগো নাম এনার্সি তে নাই তাগো এইহানে রাখা হইবো।”

দশরথ অবাক হলেন! “কিন্তু আমাগো রাজ্যে তো এহনো এনার্সি করেনাই?”

“আরে করেনাই বইলা কি করবোনা! করার পর সেই লোকগুলারে কই রাখবো? তাই আগে ভাগেই বানানো শুরু হইসে।  বাড়ি বানাইতে সময় লাগেনা!”

দশরথের মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। তার বার্থ সার্টিফিকেট নেই। তাহলে তাকেও কয়েকদিন পর এই জেলেই থাকতে আসতে হবে। এই ভোর বেলা দাঁতন করতে করতে এইভাবে হাঁটার দিন শেষ?  এই মুসলমান গুলোকেও তো রাখবে। এমনকি যারা এই বাড়িটা বানাচ্ছে এদেরও তো বার্থ সার্টিফিকেট নেই। দশরথদের সময়ে কারোরই সার্টিফিকেট হতনা।

লোকটা বললো ,” আরো শুনো মিয়া , এই কথা গুলা কারে বুলবো বুঝিনা। কেউ তো আমাগো মুসলমান নাই এইহানে। আমি প্যাটের টানে আইসা পড়তে বাধ্য হইসি। বাড়ি আমার রহিম পুর।”

দশরথ চুপ করে শুনে যাচ্ছিলেন।

“হিন্দু কামলারা এইহানে ছোট্ট রাম মন্দির বানাইছে। রামেরে পূজা দিলে নাকি সব কাজ পবিত্র হয়। সেই কথাই বইলে গেসে আমাদেরকে কন্ট্রাক্টর।”

দশরথ মন্ডল আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। লোকটার কাধে একটা  হাত রেখে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে চললেন। লোকটা অনেক ডাকলেও তিনি আর ফিরে তাকালেন না। সুজন মাস্টারকে সব বলতে হবে। কোন পার্টি নাকি বলে গেছে যে রাজ্যে এনার্সি হবেনা। ওদের সবাইকে শিঘ্রই জানাতে হবে ভবেশ গঞ্জের কথা।

খসখস শব্দ করে লোকটা এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক দূরে কোথায় যেন শিয়াল ডেকে উঠলো। ঝিঝি পোকারা ননস্টপ ডেকেই যাচ্ছে। লোকটার হাতে একটা লোহার শাবল। খানাখন্দ পেরিয়ে লোকটা এগিয়ে যাচ্ছে। ঝোঁপঝাড়ে তার পায়ের শব্দে চমকে উঠছে গাছের মধ্যে বসে থাকা প্যাচারা। আকাশে সরু কুমড়োর ফালির মত চাঁদ। আলো ভীষণ কম। গ্রামের শেষ বাড়িটা পার হয়ে ধান খেত শুরু হচ্ছে। এখন ধান কাটার মরসুম। নবান্ন উৎসব কয়েকদিন পর। লোকটি হাঁটতে হাঁটতে একসময় ধান ক্ষেতের পরে যেখানে গ্রামের সীমান্ত শেষ হচ্ছে সেখানে এসে থামলো। দূরে পোড়ো মাঠ। ঘুটঘুটে অন্ধকার সেখানে। তাঁবু গুলোয় কামলারা ঘুমোচ্ছে। বিল্ডিংয়ের বেশ খানিকটা উঠে গেছে। বিশাল পাঁচিলও বানিয়েছে। লোকটি শাবল হাতে দেওয়ালের কাছে এসে দাঁড়ালো। তারপর আকাশ বাতাস ফাটিয়ে চিৎকার করে শাবলের ঘা বসালো দেওয়ালের গায়ে। এখনো সেভাবে শক্ত হয়নি বলে দুবার বাড়ি মারতেই ভেঙে পড়লো কিছুটা অংশ। উত্তেজিত হয়ে উঠলো লোকটি। উত্তেজিত হলে অ্যাড্রিনালিন হরমোন ক্ষরণ বেশি হয়। পাগলের মত একেরপর এক বাড়ি মারতে থাকলো সে। শব্দ শুনে কামলাদের তাঁবুতে আলো জ্বলে উঠলো। সবাই হইহই করে ছুটে এসে দেখলো একটা লোক উন্মাদের মত দেওয়াল ভাঙছে আর বলছে “বাপের দেশ কাইড়ে নিবিরে হারামজাদা ছেলে! এই দ্যাখ কেমন লাগে এইবার!”

সুজন মাস্টার মদন মন্ডল আর হরি রায় তিনজনে থানায় এসেছে। কোম্পানির মালিক ডি . কে আগারওয়াল পুলিশের সামনে বসে আছেন। তিনি গজ গজ করে বলছেন, “কোনো চাষীদের জমি কাড়িনি কিচ্ছু করিনি। একটা পোড়ো জমিকে কাজে লাগাতে চাইলাম , গ্রামের লোকদেরই কাজ দিলাম আর সেই আমারই ফ্যাকটরি ভাঙার চেষ্টা!  এই ছোট্ট ইস্যুকে নিয়ে আবার সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম করে ফেলবে মিডিয়া আপনি দেখবেন। রাম রাম।” পুলিশ অফিসার চুপ করে ডায়েরিতে কী যেন লিখছেন। বাইরে অনেক লোকজন। সুজন মাস্টার বুঝতে পারছেন না বসবেন কি না কারণ তিনি মাস্টার হলেও এখানে তাকে কেউ চেনেনা তাই কেউ বসতেও বলেনি।

দশরথ মন্ডল লকাপের ভেতর বসে হাসছেন। চোখের তলে কালি পড়েছে। ঠোঁটের কোনে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। চুল গুলো অবিন্যস্ত।  চিৎকার করে তিনি বলছেন , “আমি রামের বাপ। ছেলে বেয়াদবি করলে তাকে তো মারবোই। কি মাস্টার! ঠিক বলিনি? শালা ছেলে নাকি বাপকে বাড়ি ছাড়া করবো! মামাবাড়ির আবদার! কী মাস্টার কথা বলছোনা যে? তুমিও ভয় পায় গ্যালা?”

Facebook Comments

Leave a Reply