বিপন্ন মানবিকতা : প্রবীর রায়
ফুল ও পাখীকে হারিয়ে মানুষের আজ বিষন্ন ঋতু
জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর প্রয়োগের জন্য আসাম রাজ্যটি প্রস্তুত ছিল। আসামে বিভেদকামী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি বহুদিন ধরেই এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এই মনোভাবের পিছনে ছিল দীর্ঘদিনের ইতিহাস। ইংরেজরা তাদের বিস্তীর্ণ পড়ে থাকা জমিতে চাষবাস ও উৎপাদনের প্রয়োজনে আসাম সংলগ্ন বিভিন্ন অংশ অধুনা বাংলা দেশ থেকে প্রচুর মানুষকে নিয়ে আসে। ধীরে ধীরে অনাবাদী জমিকে চাষযোগ্য করে চা বাগানে কাজ করে আসামের অর্থনীতির নতুন চেহারা দিল। তার মুনাফা লুটলো স্বার্থান্বেষী মহল।
এরপর দেশভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ থেকে হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষ আসা শুরু করল পশ্চিমবঙ্গে এবং আসামে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাদের সাথে নিয়েই পরবর্তী ইতিহাস গড়েছে। কিন্তু আসামে তা হয়নি। অসমীয়াদের এক অংশের মনে হল তারা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে। ইংরেজ বাংলা ভাষাকে সেখানে সরকারী ভাষা করে রেখেছিল বহুদিন। বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা অসমীয়া ভাষার অধিকার পায়। তাদের অনেকেরই মনে হল বাঙালীরাই তাদের বোঝা হয়ে রয়েছে। শুরু হল ‘বংগাল খেদা’ আন্দোলন। সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি।
এন আর সি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সুকৌশলে আসামবাসী সমস্ত মানুষের মধ্যেই ঢুকিয়ে দেওয়া হল এই ধারণা যে দীর্ঘদিনের এই সমস্যার সুরাহা হবে। যারা অসমীয়া নন তারাও ভাবলেন লাঞ্ছনার অবসান হবে। ইতিমধ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তি সারা দেশেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। এই সুযোগে অনেকেই ভাবলো বাঙালী মুসলমানদের এইবার বিতাড়িত করা যাবে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোও এমনটাই চেয়েছিল।
বারবার বলেছিল “আমি ভারতীয়”
তার মাটি ভাষা বোঝেনি আশ্চর্য সেপাই
স্বস্তি ও সমাপ্তির আশাকে ধুলিস্যাৎ করে আতঙ্ক তৈরী করেছে। বিভাজনের গোপন উদ্দেশ্য প্রকট হয়ে উঠেছে। নাগরিকপঞ্জী অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য প্রমাণ করার দায়ও দেওয়া হয়েছে অধিবাসীর ওপরেই। জন্ম, স্কুল, জমির দলিল এইসব কাগজ জমা দেওয়ার জন্য চাপাচাপি করা হয়েছে। বিভিন্ন অজুহাতে সেসব ডকুমেন্টও বাতিল করা হয়েছে। যেভাবে প্রমাণপত্র সংগ্রহের জন্য উৎকন্ঠা নিয়ে ছোটাছুটি করতে হয়েছে তা পীড়াদায়ক।
এরপর অবশেষে চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হল ৩,১১,২১,২০৪ জনের নাম। বাদ পড়ল ১৯,০৬,৬৫৭ জন। এইবার যে আমলাতান্ত্রিক আইনী প্রক্রিয়া শুরু হল তাতে অনিশ্চিত তাঁদের ভবিষ্যত। যদি আইনি প্রক্রিয়ায় তাঁরা নাগরিক হিসেবে বিবেচিত না হন তাহলে তাঁরা দেশহীন মানুষ পরিচয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকবেন। যদিও আদালতের নির্দেশে কাউকে তিন বছরের বেশী ক্যাম্পে রাখা যাবেনা। সে ক্ষেত্রে কোনও ভারতীয় নাগরিককে তার হয়ে ২ লক্ষ টাকা জামিন দিতে হবে। এই প্রায় কুড়ি লক্ষ অধিবাসীকে ১২০ দিনের মধ্যে ফরেনার্স ট্রাইবুনালে আবেদন করতে হবে পুনর্বিবেচনার জন্য।
এই বিপুল সংখ্যক আবেদনকারীর জন্য ফরেইনার্স ট্রাইবুনালের (এফ টির) সংখ্যা খুবই কম। এই এফ টি গুলোতে যারা দায়িত্বে আছেন তাদের বিচার বিভাগীয় কোনও প্রশিক্ষণ নেই। উপরন্তু ওগুলি ঔদাসীন্য ও পক্ষপাতিত্বর জন্য কুখ্যাত। আবেদনগুলির জমা দেওয়ার দায়িত্ব বাদ পড়া ব্যক্তিদের। রাষ্ট্রের এখানে কোনও দায়িত্ব নেই।
আসামের এই বাদ পড়া মানুষের সংখ্যা নিয়ে এখনও অস্থিরতা কাটেনি। অসম পাবলিক ওয়ার্কস ঘোষণা করেছে যে অনেক অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর নাম তালিকায় রয়ে গেছে। অগপ (অসম গণ পরিষদ) এবং আসু (অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন) অনেক কম মানুষের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির আশা করেছিলেন। প্রাথমিক ভাবে ৫০ লক্ষ বাদ পড়া মানুষের সংখ্যা পুনর্বিবেচনায় প্রায় কুড়ি লক্ষে নামায় তারা অসন্তুষ্ট। এই সংখ্যা তাদের প্রচারিত সংখ্যার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইতিমধ্যে আসামের অর্থমন্ত্রী বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা আসু ও এ পি ডব্লুকে অনুরোধ করেছে, তারা যেন উচ্চতম আদালতে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য রাজ্য সরকারের সাথে যুক্ত হয়।
বাঙালী বিদেশী হলে তার লাশ ভারতীয় হবে
আসামের ডিটেনশন ক্যাম্পের ভয়াবহতা দেয়ালের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। একে একপ্রকার কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পই বলা যেতে পারে। ২০১৮ তে হর্ষ মান্দারের নেতৃত্বে তিনজনের একটি গবেষকদল আসামে দুটি ডিটেনশন ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। মানবাধিকার কমিষনের কাছে তিনি রিপোর্ট জমা দেন। কিন্তু সেখানে কোনও রকম সাড়া না পাওয়ায় তিনি চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং রিপোর্টটি জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। ক্যাম্পে মেয়েদের আর পুরুষদের আলাদা আলাদা ক্যাম্পে রাখা হয়। মেয়েদের কোন গোপনীয়তা নেই। ছ বছরের বেশি সন্তানদের মায়ের কাছে রাখা হয়না। মেয়েদের ক্যাম্প থেকে প্রায়ই কান্নার ধ্বনি ভেসে আসে।
এন আর সি তে কখনো শিশু কে নাগরিক এবং বাবাকে মাকে অনাগরিক ঘোষণা করে ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। বাইরের কারও সাথে দ্যাখা করতে দেওয়া হচ্ছেনা। ক্যাম্পে মৃত্যুও হয়েছে অনেকের। দুলাল দাসের মৃত্যুর পর তার বাড়ীর লোককে মৃতদেহ নিয়ে যেতে বলা হয়। কিন্তু তার ছেলে এবং অন্যান্যেরা নিতে অস্বীকার করে। তারা জানায়, তাকে বাংলাদেশী বলা হয়েছে ডেথ সার্টিফিকেটে। যতক্ষণ পর্যন্ত না তাকে ভারতীয় বলা হবে ততক্ষণ তার দেহ নিতে অস্বীকার করেন।অবশেষে তার ঠিকানায় আসাম লেখা হয়। এর পর মৃতদেহ নিতে রাজী হন আত্মীয়েরা।
একই ঘটনা ঘটে কয়েকদিন বাদেই। অন্য একজন বাঙ্গলী পলু দাসের আত্নীয়রাও একইভাবে তার মৃতদেহ নিতে অস্বীকার করেন। যেহেতু তিনি ভারতীয় নন,তার দেহ বাংলা দেশে পাঠিয়ে দিতে বলেন।
রাজা জানেনা তার প্রজা বিবরণ
প্রমাণ অভাবে তাই কারাবাস যাবজ্জীবন
এন আর সি বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবী, রাষ্ট্রদূত এবং সম্মানিত ব্যাক্তিদের নিয়ে গঠিত বিচারকমণ্ডলী নিয়ে একটি গণআদালত বসান হয়েছিল। দুদিন ব্যাপী শুনানী হয় দিল্লিতে ৭ই ও ৮ই সেপ্টেম্বর ২০০১৯এ। এই শুনানির থেকে অমানবিক ছবি পাওয়া যায়। লক্ষ লক্ষ দরিদ্র ও নিরক্ষর মানুষের ওপর এক বোঝা হয়ে দঁড়িয়েছে। সমগ্র প্রক্রিয়াটি সংবিধান সম্মত হচ্ছে কিনা এই প্রশ্ন তারা তুলেছেন। অসহায় জনগোষ্ঠীর অপর বিপুল চাপ তৈরী হয়েছে। তারা সহজ শিকারে পরিণত হয়েছে। চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত হওয়ার পর খতিয়ে দেখার উদ্যোগ পঞ্জীতে থাকা এবং না থাকা সবার ওপরেই চাপ সৃষ্টি করেছে। বিপুল সংখ্যক মহিলা ও পুরুষ অন্তর্ভুক্ত হননি যাদের বংশজরা নাগরিক তালিকায় রয়েছেন। এ যাবত সন্দেহজনক ভোটার হিসেবে ট্রাইবুনাল যাদের ঘোষনা করেছেন তাদের অনেকেরই ভোটার কার্ড ছিল বলে জানা গেছে।
এতদিন যারা ভোট দিয়েছে, সরকার গঠনে মত দিয়েছে তাদের আর সেই অধিকার থাকছেনা। যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেছে তাদের অনেকেরই চাকরী থাকছে না। ভেঙ্গে যাওয়া বহু সংসারে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। নথি খুঁজতে গিয়ে জেরবার হচ্ছে সকলে। অনিশ্চয়তায় আত্মহত্যা, মৃত্যু ঘটছে।
পরিশিষ্টে লেখা আছে
ধর্ম অর্থে শাসকের রঙ
আসামের নাগরিক তালিকা থেকে প্রায় ২০ লক্ষের মত অধিবাসীর নাম বাদ পড়েছিল তার মধ্যে ১২ লক্ষ বাঙ্গালী হিন্দু, ১লক্ষ গোর্খা ও অন্যান্য ভাষাভাষী হিন্দু, ৫০ হাজার অসমীয়া হিন্দু দেড়লক্ষ মুসলমান এবং ৪ লক্ষ পুনরাবেদন না করা মানুষ। এই তালিকায় বিচলিত হয়েছিল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি এবং সরকার নিজেও। তাই দ্রুত ক্যাব (নাগরিকত্ব সংশোধনী প্রস্তাব) নিয়ে তৎপরতা এবং প্রচার শুরু হল। ছয়টি ধর্ম সম্প্রদায়ের (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রীস্ট ও পার্সি) মানুষকে যারা পাকিস্থান আফগানিস্তান বাংলাদেশ থেকে ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৪এর আগে ভারতে এসেছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সুযোগ তৈরী হবে। এখানে লক্ষণীয় – বিবেচিত ধর্মগুলির থেকে মুসলমান সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু নেতার মুখে এও শোনা গেছে, হিন্দুদের ভয় নেই। এ সকলেরই উদ্দেশ্য হয়তো ভারতবর্ষকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানো। তাতে অবাক হওয়ার কোনও কারণ নেই। ১৯৩৯এ একটি লেখায় হিন্দুত্ববাদী নেতা গোলওয়ালকার লিখেছিলেন, নাৎসি জার্মানীতে ইহুদী বিতারণ “হিন্দুস্থানে আমাদের পক্ষে লাভজনক অনুশীলন”। তা হলে কি ভবিষ্যতে তাই হতে যাচ্ছে, ইজরায়েল যেমন ইহুদিদের জন্য, ভারত তেমনি হিন্দুদের জন্য? আসাম এবং অন্যান্য রাজ্যেও অভয় দেওয়া হচ্ছে হিন্দুদের কোনও ভয় নেই। তবুও আতঙ্কগ্রস্ত সবাই।
পূবের কোনও পশ্চিম নেই
পশ্চিমের কোনও পুব নেই
ইংরেজ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বাংলাকে দু টুকরো করে দিয়ে যায়। নিমেষের মধ্যে বাঙালীর এক অংশ বিদেশী হয়ে যায়। নিজেদের ঘর ছেড়ে ভারতে চলে আসা মানুষের ঢল নেমেছিল। আজও বিভিন্ন কারণে তা অব্যাহত। দেশভাগ না হলে তারা ভারতীয়ই থাকতো। এই অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল পশ্চিমবঙ্গ। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এইসব মানুষকে যতটা সম্ভব তাড়ানো যায় এটাই কারও কারো লক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আসামের পর এন আর সি প্রয়োগ করা হবে বাংলায় এমনটাই প্রচার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলার কিছু নেতাও বলে চলেছেন এখানে দুকোটির মত বিদেশী অনুপ্রবেশকারী আছেন, তাদের বিতাড়িত করতে হবে।
জাতীয় জনগণনার কাজ (এন পি আর) শুরু হচ্ছে ২০২০-র এপ্রিল থেকে শেষ হবে নভেম্বরের মধ্যে। অনেকেই বলছেন, এন পি আর হল এন আর সি-র প্রথম ধাপ। জনগণনায় যে তালিকা তৈরী হবে সেইটাকে ধরেই যাচাই করা হবে নাগরিকত্ব। কী হবে স্পষ্ট জানা নেই। আসামের উদাহরণকে সামনে রেখে আতংকে কাটাচ্ছেন মানুষ। জনজাতি ও বিভিন্ন ভূমিপুত্রদেরো অস্তিত্ব বিপন্ন। প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে এই বাংলায়।
Posted in: Cover Story, November 2019
পড়লাম। ভয়াবহ সময়।