ধারাবাহিক উপন্যাস : নীলাব্জ চক্রবর্তী

যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে

অষ্টম পর্ব

১৭

A film has a beginning, a middle and an end, but not in this order

নিপাতনে সিদ্ধ এক ধাতু, রূপ ভাবছে। পূর্ণ বিরহ আর অর্ধেক যৌনতায় কাতর একেকটা বিকেল… সন্ধ্যা… ব্যবহার নামের একটা নিরুত্তর ঋতু… অথচ, নিতান্ত গাধার মতো গেয়ে যাচ্ছে, ‘ম্যয় কোই অ্যায়সা গীত গাউ / কে আরজু জাগাউ / আগর তুম কহো’… কোনও মানে হয় এসবের? ভালো কথা, নবারুণের লেখায় পপুলার বাংলা বা হিন্দি গানের ব্যবহার নিয়ে তোমরা কেউ কোনোদিন রিসার্চ করার কথা ভেবেছ? ওঁর কত লেখায়, তা সে ছোটগল্পই হোক বা উপন্যাস; কত কত পপুলার বাংলা আর হিন্দি গানের লাইন… যাকগে, ঘটি হারাও কলকাতা শহর। ঘটি হারাও তোমার আতুপুতু রুচি আর ন্যাকা সংস্কৃতির কোলবালিশ কোলে নিয়ে। আর স্রেফ উপেক্ষা করো যে কীভাবে নিরক্ষীয় অবস্থান বরাবর প্যান করছে কণ্ট্রোল করছে জুম করছে, তবু, স্পষ্টতা আর অস্পষ্টতার মাঝামাঝি এক রাজনৈতিক লাইনের মতো বারবার ফেল করছে একটা অচেনা স্মৃতির কাঁচাপাকা গাছ। ঘটি হারাও কলকাতা শহর। আমি স্রেফ ঘুমোতে চাই। নীড টু স্লিপ। ঘুমবো। মরে না যাওয়া অথবা মারাত্মক পেচ্ছাপ না পাওয়া অবধি ঘুমবো কাল সকালে…

= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =

 ক্রস-ড্রেসারদের জন্য বলছি

প্যাণ্টি একটা ফাঁদ

ওতে পা দেবেন না

= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =

# * # * #

মঙ্গলবার একটি পত্রিকায়

করিনা কাপুর বলছেন –

একটা সময়, জানেন, বছরের পর বছর; রোজ রাতে শুটিং শেষ হওয়ার পর বাড়ী ফিরে ভোরবেলা পর্যন্ত কাঁদতাম…

*

শুক্রবার মদের টেবিলে

প্রগতিশীল অত্যাধুনিক বিপ্লবী কবি বলছেন –

আরে, সায়নের কথা ছাড়। ও তো কুণ্ডুর বাচ্চা, নীচু বংশের ছেলে…

*

সোমবার একটা পুরনো বইতে

সুবিমল মিশ্র বলছেন –

চৌকিদার হ্যাজাক জ্বেলেছে… চৌকিদার হ্যাজাক জ্বেলেছে…

*

শনিবার সন্ধ্যাবেলা

একজন অর্জুনগাছ বলছে –

ডার্ক চকোলেট খাও, বুঝলে, মন খারাপ কমবে। সিরিয়াসলি বলছি। তুমি এটা জানতে তো? ডিপ্রেসনে ডার্ক চকোলেট হেব্বি কাজ দেয়…

*

বৃহস্পতিবার টেলিফোনে

প্রাজ্ঞ, আজীবন পরীক্ষাকবিতায় বিশ্বাসী প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলছেন –

বিখ্যাত লোকজনদের সাথে, এই যেমন ধর… বড় কবি, নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালক, তারপর ধর গায়ক-টায়ক বা অভিনেতা; মানে, এরকম যাদের যাদের সঙ্গে চেনাজানা বার করা সম্ভব আর কী কোনোভাবে, বুঝলি তো, অ্যাঁ, এদের সঙ্গে একটু যোগাযোগ-টোগাযোগ রাখতে হয়… বই বেরলে কী পত্রিকা বেরলে একটু দ্যাখা-ট্যাখা করা, নিজেদের কাজগুলো একটু এগিয়ে দেওয়া… এইরকম আর কী…

*

রবিবার আপনাদের বাড়িতে

জনৈকা মধ্যবয়সিনী বলছেন –

চিনি দাও বুঝি বইন? চিনি দিবা না পায়সে। বাতাসা দিবা। সাদা বাতাসা না আবার। লাল বাতাসা দেওন লাগে। বাতাসা আর মিসরি মিশায়া মিশায়া দিবা। তিন কেজি দুধে আড়াইশো বাতাসা। অল্প মিসরি। দেড়শো চাউল দিবা। আগে চাউল এট্টু ভাইজা নিবা ঘি দিয়া। সোয়াদ বাড়বো পায়সের…

*

বুধবার এই পৃথিবীর কোথাও একটা

তুমি বলছ –

গল্প লিখতে পারো না? লিখেছ কখনও, অ্যাঁ, গল্প?

# * # * #

একদা

অভিজ্ঞতা বলতে ধবধবে দুটো ঊরু আর ক্যালেণ্ডারহীন দেওয়াল। অফ হোয়াইট। আমি ওর পায়ের পাতা লক্ষ করতে থাকি। তুলছোই যখন, প্লিজ নাভি পর্যন্ত তোলো। একবার। হ্যাঁ, একটু ঘুরে দাঁড়াও না, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওইভাবে। ফিকে শারদধ্বনিতে অতঃপর এক তর্জনীর শাসন। তখন তুমি একটা সর্বনামমাত্র। এবং, আমিও। একটাই আনারসের গন্ধ টেবিল ছেড়ে নেমে আসছে বারবার। সেক্স সেক্স করছে সারাদিন ধরে…

সতেরোতলার ওপর অন্তর্বাস সরিয়ে ফেলে জানলা খুললেই টানা অনেকখানি নগ্নতা। চুপ করে থাকার। এভাবে, বধিরতার ভান করছে শহর। একটা-দুটো ফুটে ওঠার বিলবোর্ড। অহংকারী মুখগুলো দ্যাখা যাচ্ছে বিজনেস পত্রিকাদের কভারে। দূরে কোথাও চাবাগান জরিপবাগানের কালচে বাতাস। দূরে কোথাও চটকল গেটে ফ্যাকাশে রামধনু আঁকা। শুধু প্রকৃত মূর্খরাই জ্ঞানীদের মতো কথা বলতে পারে, মনে পড়ে। আরও মনে পড়ে বাধ্যতামূলক কর্পোরেট ব্যাডমিন্টনের উশখুশ। এছাড়া আরও যা যা, যথা রুবি রায় ইত্যাদি। যৌনতার খোলস ছেড়ে বেরোতে বেরোতে গোটা দু-তিন ভাঁজ। কোষগুলোয় জারি হচ্ছিলো আগাম সতর্কবার্তা।

১৮

You cannot make a film, the film makes you

এখন এই দৃশ্যে একটা কমিটেড সকাল। যেভাবে অফিস যায় শহরতলির প্রায়-শীতকাল। এক্সপ্রেসওয়ে। কোথাও কবিতা নেই। কোথাও রাজনীতি নেই। সবটাই আসলে অ্যাপোলিটিক্যাল। এমনটাই তোমরা চেয়েছিলে তো যুগ যুগ ধরে? যতদিন না তোমাদের নিজেদের চাকরির জায়গায় একটা গভীর সঙ্কট তৈরী হচ্ছে আর তোমরা কাজ হারানোর মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াচ্ছ। আপাতত একটা এসি বাস। জানলা দিয়ে প্রকৃতি। প্রত্যয়ও আছে কোথাও। আহ রে, প্রকৃতি আর প্রত্যয়! বিশ্বাস করো, তোমাদের পরস্পরকে খুব দরকার ছিলো। বাসের একদম শেষ দিকের সিটগুলো সামনের দিকে মুখ করা। তার সামনে একটু ফাঁকা স্পেস, লেগস্পেস আর কী। তার সামনের রোয়ের সিটগুলো গতির বিপরীতদিকে মুখ করা। অর্থাৎ, শেষ রোয়ের সিটগুলোর মুখোমুখি। তার সামনের রোয়েও একই ব্যবস্থা। এখন শেষ রোয়ে বসা একটি প্রায় মধ্যবয়স্ক লোক দেখছে তার মুখোমুখি বসা আগের দু’টি রোয়ের সিটে যারা বসে আছে তারা সবাই নিজের নিজের মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। সবার নতমুখ। প্রায় সারা শরীর স্থির, শুধু আঙুল নড়ছে চড়ছে স্মার্টফোনের পর্দা ছুঁয়ে ছুঁয়ে। নিবিষ্ট প্রত্যেকেই। শেষ রোয়ে বসা লোকটি তার ফোনটা বের করে আনে পকেট থেকে। সাইলেন্ট করে ফোনটাকে। আর তারপর খুব সাবধানে সামনের লোকগুলোর একটা ছবি তোলে। তারা কেউই কিছু টের পায় না। লোকটি দ্রুত আঙুলে ওই ছবিটি পোস্ট করে ফেসবুকে। তারপর সেই পোস্টের নীচে নিজেই কমেণ্ট লিখতে থাকে – “এই যে আমি এখন এই ছবিটা পোস্ট করলাম আর এখন এই যে এই কমেন্টটা টাইপ করছি, আমাকেও এখন ঠিক ওদেরই মতো দেখাচ্ছে। একইরকম স্থির, নতমুখ, নিবিষ্ট আমরা সবাই”…

# * # * #

সেই সময়টা চলে গ্যাছে। আর, প্রকৃতপক্ষে, সেইসব চলে যাওয়াগুলোই, থেকে যায়। ফলতঃ, এখন আমার মেজাজ ভাল আছে… এখন আমি ভাবব, শহীদুল জহির কেন ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ নামের সেই অবিশ্বাস্য গল্পে কুটির আর শিল্পের মাঝে স্পেস রেখেছিলেন… কেন কেউ কেউ ‘সবজান্তা’ না লিখে সব আর জান্তার মাঝে স্পেস রাখে… এটা কি হেমন্তকাল? হেমন্ত আর কাল-এর মাঝে স্পেস রাখব কি আমি? এসি বাসের মধ্যে নতুন গান শুরু হল… কিশোরকুমারের ‘রাহ পে রহতে হ্যয়’… সঞ্জীবকুমার ট্রাক চালাচ্ছেন এই ছবিটা সঙ্গে সঙ্গে ভেসে ওঠে… নির্মিত স্মৃতি বলে একে? প্রিয় গান, অথচ কেষ্টপুর প্রায় এসেই গেছে… এক্ষুনি নেমে যেতে হবে… একটা বাপুজী কেকের সকাল… একটা ফুটব্রিজ পারের সল্টলেক… অফিসে ঢুকে যেতে হবে… গানটা কি থেকেই যাবে বাসের মধ্যে? উল্টোডাঙা পেরিয়ে বাইপাস ধরে নেবে এবার গানটা? কোথায় চলে যায় গানগুলো? সুরগুলো? আমার কিশোরকুমার গাইতে ইচ্ছে করে। নাকে সমস্যা আছে। আমার নাক বাঁকা। আমার গলায় কিশোরকুমার মানায় না। কি মানায় তবে আমার গলায়? হিমেশ রেশমাইয়া? আমি অবশ্য শূন্য দশকের শ্যামল মিত্র হতে চেয়েছিলাম আসলে… যদিও আমাকে, এমনকি, শূন্য দশকেরও তেমন কেউ চেনে না। শেষমেশ, একটা বাপুজী কেকের জন্য এই সকাল, এরকম মনে হয়। বস্তুতঃ, আলটিমেটলি, এরকমই মনে হয় আজকাল। এই মনে হওয়াটা থেকে যাক…

(চলবে)

Facebook Comments

Leave a Reply