প্রশ্নোত্তরে নাগরিকপঞ্জী ও নাগরিকত্বের সংকট : কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

প্রাককথন

ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স অর্থাৎ NRC বিষয়ে কিছু বলতে গেলে আমার মাথায় প্রথমেই কিছু শব্দ ভিড় করে আসে। শব্দ সংজ্ঞাবাহক হয়ে ধারণায় পরিণত হয়। একটা ধারণা কখনও ওপর ধারণার সহযোগী হয়, আবার কখনও অন্যটার ঘাড়ে চেপে বসে। অপরটার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিরোধের জন্ম দেয়। কখনও আবার তারা তর্ক, বিতর্ক এবং যুক্তির জাল বোনে। সময়ের পরিবর্তনে সংজ্ঞার বদল ঘটে। একই শব্দ সেই নতুন সংজ্ঞায় জারিত হয়ে জনমানসে ধারণার অন্য অর্থ প্রতিষ্ঠা করে।

এমনটাই ঘটে চলে সমাজ জীবনে। এই বহতা ভাষার জন্য যেমন স্বাভাবিক, একটা জাতির টিকে থাকার জন্যও তার প্রয়োজন খুব আছে। কিন্তু সেই বদলানোর পিছনে যদি কোন অভিসন্ধি থাকে, তবে তার ফল হয় মারাত্মক। সেটা ঐ ভাষা, জাতি, সমাজ, সংস্কৃতি, সকলের জন্যই তখন হানিকারক হয়ে ওঠে। এই নেতিবাচক পরিবর্তনের কাজটা আজ রাজনীতির পাঠ হয়ে উঠেছে। এর বিরুদ্ধেই আওয়াজ তুলতে হবে। দেখতে হবে সেই মাথা-ভারি করা শব্দগুলোকে, যাদের ভিড় আমাদের মাথায় আজ চাপানো হচ্ছে। অনুসঙ্গ হয়ে যে সকল শব্দ ঐ সকল শব্দের সঙ্গে আসছে, দোসর হচ্ছে, সেগুলোকেউ বুঝতে হবে। বিকল্প নির্মাণ তাই আজ খুব দরকার। সংবিধান, অধিকার, জীবন, আদমশুমারি, উদ্বাস্তু, কাঁটাতার, ছিন্নমূল, রাষ্ট্রহীন, জনগণ, হতাশা, বেআইন, উচ্ছেদ, উৎপীড়ন, আদালত, গৃহহীন, বিদেশী তকমা, দাগ, দখল, দলিল, প্রমাণ পত্র, ক্ষুধা, হত্যা, ফরেন ট্রাইবুনাল, জুলুম, জুমলা, জ্বালা, তালিকা-ছুট মানুষ, সরকার, শাস্তি, হানাহানি, দুর্নীতি, আর্থিক বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা, ধর্ম, সীমান্ত, বন্দীদশা, বিচ্ছিন্নতা, গণ-ডিটেনশন ক্যাম্প, নীতিহীনতা, সংকট, জেল, পরোয়ানা, ভয়, যন্ত্রণা, নাগরিকত্ব, অসহিষ্ণু, দেশপ্রেম, দেশদ্রোহী, দেশহীন, শেকড়হীন, ইতিহাসের পরিহাস, যন্ত্রণাদায়ক, শরণার্থী, অনুপ্রবেশকারী, উইপোকা, অস্বাস্থ্য, মৃত্যু – এমন নানা শব্দে আজ আমাদের দৈনিক দিনলিপি লেখা হচ্ছে। এটা কি আমরা চেয়েছিলাম?

NRC বা ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স কি?

ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স অর্থাৎ NRC মানে এটি রাজ‍্যের বৈধ নাগরিকদের তালিকা৷ ভারতে সংবিধান কার্যকরী করার পর প্রথমবার আদমশুমারি হয়েছিল ১৯৫১ সালে। প্রথমে ঠিক হয় যে, প্রতিটি থানাতে এই আদমশুমারির একটা নথি থাকবে, যাতে শহর, মফস‌্সল, গ্রাম ও স্থানীয় স্তরে নাগরিকদের সংখ্যার হিসেব রাষ্ট্র/রাজ্যের হাতে থাকে। এ ছাড়াও সিদ্ধান্ত হয়, এই নাগরিকপঞ্জির তালিকা সময়-সুযোগ অনুসারে পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে কোনও রাজ্যের ক্ষেত্রে কখনও তা হয়নি। ফলে সেই আদমশুমারি অনুসারে যে নাগরিকপঞ্জী বা নাগরিকদের নামের তালিকা তৈরি হয় ১৯৫১ সালে তার পরিবর্ধন ও পরিমার্জন ঘটে না, কিন্তু ইতিহাস তার ঘটমান বর্তমানে সচল থাকে৷ বর্তমানের এনপিএ হল সেই পরিকল্পনার সলতে পাকানোর কাজ।

‘এনআরসি’ কি শুধুই বিদেশী শনাক্তকরণের এক প্রক্রিয়া? এই বিদেশি কারা?

সাধারণভাবে মনে হতেই পারে যে ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স বা এনআরসিতে নাম না থাকলে বিদেশী শনাক্তকরণ করার কাজটা সহজে হয়ে যায়। কিন্তু তা ঠিক নয়। দ্বিতীয় প্রশ্নটাকে মাথায় নিলে সেই সমস্যা বোঝা যায়। একটি রাজ্যের এনআরসিতে অন্য রাজ্য থেকে আসা মানুষটির নাম না থাকাটাই স্বাভাবিক। তিনি তো বিদেশী নন। অপরদিকে ১৯৫১র পর ইতিহাসে যা ঘটেছে তাকে গুরুত্ব দিলে নাগরিকপঞ্জির তালিকা সময়-সুযোগ অনুসারে পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করার প্রয়োজনীয়তা সামনে চলে আসে। ঐ কাজটা ধারাবাহিকভাবে না করার ফলে ভোটার কার্ড ও আধার নথিভুক্তিকরণ থাকলেও এনআরসি এখন উদ্বাস্তু তৈরির রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠছে। তাই বলবো ন্যাশনাল রিফিউজি ক্রাইসিস হল NRC।

নাগরিকের অধিকারে সংবিধানের বিষয়টা ঠিক কি?

ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকের অধিকারগুলি অন্তর্ভুক্তির অনুপ্রেরণা ইংল্যান্ডের বিল অফ রাইটস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিল অফ রাইটস, ফ্রান্সের মানব ও নাগরিক অধিকারসমূহের ঘোষণাপত্রের মতো আদর্শস্থানীয় ঐতিহাসিক দলিলগুলি। মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশাত্মক নীতিমৌলিক কর্তব্য ভারতীয় সংবিধানের তিনটি অংশ। এই তিনটি অংশে নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের মৌলিক দায়দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের কর্তব্যগুলির বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই অংশগুলি সরকারি নীতিনির্ধারণ ও নাগরিকদের আচার-আচরণের ক্ষেত্রে একটি সাংবিধানিক অধিকার পত্রের ভূমিকা পালন করে। এই অংশ তিনটি ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে গণপরিষদে রচিত মূল সংবিধানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অংশ বলে বিবেচিত হয়।

১) মৌলিক অধিকার হল সকল নাগরিকের মানবাধিকারের মূলভিত্তি। সংবিধানের তৃতীয় খণ্ডে বর্ণিত এই অধিকারগুলি জাতি, জন্মস্থান, ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সমভাবে প্রযোজ্য। এই অধিকারগুলি আদালতে বিচারযোগ্য। তবে এগুলির উপর কিছু নির্দিষ্ট বিধিনিষেধও আরোপ করা যায়। ২) রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশাত্মক নীতি হল সরকার কর্তৃক আইন প্রণয়নের নীতি-সংক্রান্ত নির্দেশিকা। সংবিধানের চতুর্থ খণ্ডে বর্ণিত এই নীতিগুলি আদালতে বিচারযোগ্য নয়। তবে আশা করা হয়, সরকার পরিচালনার মৌলিক নির্দেশিকার যে আদর্শগুলির উপর এই নীতিগুলি প্রতিষ্ঠিত, আইনের রূপদান ও প্রণয়নের সময় সরকার সেগুলি মেনে চলবে। ৩) মৌলিক কর্তব্য হল সকল নাগরিকের নৈতিক দায়দায়িত্ব। এগুলির উদ্দেশ্য, দেশের জনগণের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগরিত করা এবং দেশের ঐক্য রক্ষা করা। সংবিধানের চতুর্থ খণ্ডে বর্ণিত এই কর্তব্যগুলি দেশের প্রতিটি ব্যক্তি ও জাতির প্রতি প্রযোজ্য। নির্দেশাত্মক নীতিগুলির মতোই এগুলিও আদালতে বিচারযোগ্য নয়।

এন আর সি প্রসঙ্গে সংবিধান সংশোধনের বিষয়টা ঠিক কি?

সংবিধান অনুসারে ভারতবাসীর মৌলিক অধিকার, ভারতের প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। সবরকম অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটানো। রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের কোন ধর্ম নেই।

সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলি হল :

১) সাম্যের অধিকার (১৪ নং থেকে ১৮ নং অনুচ্ছেদ)

২)স্বাধীনতার অধিকার (১৯ নং থেকে ২২ নং অনুচ্ছেদ)

৩)শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার  (২৩ নং ও ২৪ নং অনুচ্ছেদ)

৪)ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার  (২৫ নং থেকে ২৮ নং অনুচ্ছেদ)

৫)সংস্কৃতি ও শিক্ষা-বিষয়ক অধিকার  (২৯ নং ও ৩০ নং অনুচ্ছেদ)

৬)সংবিধানের প্রতিবিধানের অধিকার  (৩২ নং  অনুচ্ছেদ ও ২২৬নং অনুচ্ছেদ)

নাগরিকত্ব সংবিধানের আওতাভুক্ত এবং কেবলমাত্র সংসদের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে। সংবিধানে নাগরিকত্ব-র কোনও কোনও সংজ্ঞা নেই, কিন্তু ৫ থেকে ১১ নং অনুচ্ছেদে কারা নাগরিকত্বের আওতায় পড়বেন তার বিভিন্ন ভাগ স্থির করা হয়েছে। সংবিধানের অন্য সংস্থানগুলি ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি কার্যকর হলেও এই ধারাগুলি লাগু হয়ে যায় সংবিধান গ্রহণের ক্ষণ থেকেই, অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে। নাগরিকত্ব স্বীকৃতির জন্য দুটি পরিচিত নীতি রয়েছে। একটি পদ্ধতিতে নাগরিকত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় জন্মস্থানের হিসেবে, অন্যটিতে রক্তসম্পর্কের চিহ্ন মোতাবেক। ১৯২৮ সালে মতিলাল নেহরু কমিটির সময় থেকে ভারতীয় নেতৃত্ব জন্মস্থানের স্বীকৃতির আধুনিকমনস্ক ধারার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। অন্য ধারাটি খারিজ হয়ে গিয়েছে তা ভারতীয় ভাবধারার বিরোধী বলে। ১৯৫৫র পর তার নানা সংশোধনী।

স্বাধীন ভারতে নাগরিকত্ব কীভাবে স্থির হয়?

    ভারতীয় সংবিধানের ৫ থেকে ১১ নং অনুচ্ছেদে কারা নাগরিকত্বের আওতায় পড়বেন তার বিভিন্ন ভাগ স্থির করা হয়েছে। ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হল: ভারতে যাঁরা বাস করেন এবং যাঁরা জন্মেছেন তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এমনকি, যাঁদের জন্ম ভারতে নয়, কিন্তু বসবাস ভারতে এবং যাঁদের বাবা-মায়ের মধ্যে যে কোনও একজন ভারতে জন্মেছেন, তাঁরাও নাগরিকত্ব পাবেন। যাঁরা এ দেশে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন, তাঁরাও নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। ৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হল: এ দেশের স্বাধীনতা যেহেতু এসেছে দেশভাগ ও অভিবাসনের মধ্যে দিয়ে, সে জন্য যাঁরা ১৯৪৯ সালের ১৯ জুলাইয়ের আগে ভারতে এসেছেন, তাঁদের বাবা-মা বা ঠাকুর্দা-ঠাকুমার কেউ যদি এ দেশে জন্মে থাকেন, তবে তাঁরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন। কিন্তু ওই তারিখের পর এ দেশে প্রবেশ করলে তাঁদের নিজেদের নথিভুক্ত করতে হবে। অনুচ্ছেদ ৭-এ বলা হল: এমনকি ১৯৪৭ সালের ১ মার্চের পর যাঁরা পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন কিন্তু তারপর আবার পুনর্বাসনের সার্টিফিকেট নিয়ে ফেরৎ এসেছেন, তাঁরাও নাগরিক বলে গণ্য হবেন। যাঁরা পাকিস্তান থেকে এদেশে এসে উদ্বাস্তু বলে পরিচিত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি আইন বেশি সহানুভূতিশীল। ৮ নং অনুচ্ছেদে বলা হল: ভারতীয় বংশোদ্ভূত কোনও ব্যক্তি যিনি ভারতের বাইরে বসবাস করেন, যাঁর বাবা-মা বা অথবা ঠাকুর্দা-ঠাকুমার কেউ ভারতে জন্মেছেন, তিনি দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে নিজেকে নথিভুক্ত করতে পারেন।

মূলত রক্তের কৌম সম্পর্ককে গুরুত্ব না দিয়ে, বৈবাহিক সম্পর্কজাত জন্মের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন পাশ হয়। বসুধৈব কুটুম্বকম্ (সংস্কৃত: वसुधैव कुटुम्बकम्) (“বসুধা=পৃথিবী” + “এব=প্রকৃতপক্ষে” + “কুটুম্বকম্=পরিবার”) হল একটি সংস্কৃত বাগধারা, যেখানে বলা হয়, সমগ্র মানবজাতি একটি পরিবার।

১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন পাশ হওয়ার পর কেমন সংশোধনী আনা হয়?

১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন পাশ হওয়ার পর তা বহুবার সংশোধিত হয়। নাগরিকত্বের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের হাতে দেওয়া হয় এই সকল সংশোধিত আইনের বলে। তবে, জন্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের যে ব্যাপ্ত নীতিমালা ছিল গত কয়েক দশক জুড়ে, তা অনেকটাই সংকীর্ণ করে আনা হয়। কঠোর সংশোধনীগুলি আনার ফলে ক্রমশ ভারত রক্তসম্পর্কের মাধ্যমে নাগরিকত্বের নীতিসমূহের দিকে এগিয়ে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় “বিদেশি আইন”, যার বলে কোনও ব্যক্তির উপর নিজেকে বিদেশি নয় প্রমাণ করার চাপ ব্যাপক পরিমাণে বেড়ে যায়।

জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিকত্বের যে ব্যাপকতার ধারণা ১৯৫৫ সাল থেকে প্রচলিত ছিল, তা ১৯৮৬ সালের সংশোধনীতে অনেকটাই খর্বিত হয়। এই সংশোধনীতে শর্ত আরোপ করে বলা হয় যে যাঁরা ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি বা তার পর থেকে ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে জন্মেছেন, তাঁরা ভারতীয় নাগরিক বলে গণ্য হবেন। যাঁরা ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের পর থেকে ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বরের আগে জন্মেছেন তাঁরা ভারতে জন্মালেও, জন্মকালীন সময়ে তাঁদের বাবা অথবা মা-কে অন্তত ভারতীয় নাগরিক হতে হবে। ২০০৩ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন সরকার বিষয়টিকে আরও “শুদ্ধ রক্ত” ধারণায় জারিত করে সংশোধনী আনেন। বলা হয় যে যাঁরা ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বর বা তার পরে জন্মেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্য, হয় তাঁদের বাবা-মা উভয়কেই ভারতের নাগরিক হতে হবে, অথবা যে কোনও একজনকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে এবং সেই অন্যজন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হলে চলবে না। এই কঠোর সংশোধনীগুলি আনার ফলে ভারত ক্রমশ রক্তসম্পর্কের মাধ্যমে নাগরিকত্বের নীতিসমূহের দিকে এগিয়ে যায়। ১৪-এ ধারার সংযোজনের ফলে কোনও বেআইনি অনুপ্রবেশকারী সাত বছর ধরে ভারতে বসবাস করলেও স্বাভাবিকতার সূত্রে বা নথিভুক্তির মাধ্যমে নাগরিকত্ব দাবি করতে পারবেন না।

নাগরিকত্ব আইনের আলোচনা ২০০৩ সালের পর কি করা হয়েছে? 

২০০৫ সালের ২৮ জুন, নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীতেও ১৪-এ ধারার বাধ্যতামূলক এনআরসির বিষয়টা বাতিল করা হয় না। এই ধারা বাতিলের জন্য সংসদে বামপন্থীদের আওয়াজ শোনা গিয়েছিল। তারা বাতিলের কথা বলেছিলেন। দীর্ঘ উদ্বাস্তু আন্দোলনের লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই তারা এর বিপদের কথা জানতেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা তারা মানতেন। অন্যদের তা তেমন না থাকায় তারা বামপন্থীদের সঙ্গে গলা মেলাননি। বামপন্থীরা সেদিন অসফল হন।

মূলত বিরোধীদের চাপ। আমরা জানি সেই সময় আজকের শাসক নেত্রী কি ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই দ্বিচারিতার মুখোশ যে আজ খুলে পড়ছে তা পরে বলছি। তবে এই ২০০৫-এর সংশোধনীতে সরকার উদ্বাস্তু, ছিন্নমূল মানুষের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ রাখে। ইউপিএ সরকার পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে আসা সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্বের সময়সীমা ১০ বছর রেখে এই আইন সংশোধন করে। জন্মের ভিত্তিতে পাওয়া নাগরিকত্বের ভিত্তিকে ২০১৫-র সংশোধনী বিলে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়। সন্তানের পিতা-মাতার নাগরিকত্বের প্রকৃতি সেখানে প্রধান বিচার্য বিষয় হয়। রক্তের সুদ্ধতা বিচার করে বর্তমান পিতা-মাতা ভারতের নাগরিক হলেও তাঁদের পূর্বপুরুষ কোন দেশের নাগরিক ছিলেন, বা আদৌ ভারতের ছিলেন কিনা তা দেখার কথা বলা হয়। পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে আসা সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্বের সময়সীমা ১০ বছর থেকে কমিয়ে এর বৈধতাকে “ভিসা”-র নিয়মে বেআইনি করে তোলা হয়। বিদেশীকে বিবাহ করার ক্ষেত্রে এবং বিচ্ছেদে এই নাগরিকত্বে নিয়ম কড়া হয় যেখানে দেশপ্রেমের ফ্লেভার মিশে যায়। বলা হয় যে কোন বিদেশী যদি অবৈধভাবে ভারতে না এসে থাকেন, সেক্ষেত্রে তিনি বিবাহের মধ্যে দিয়ে নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারেন। তবে বিচ্ছেদে তাঁকে তার দেশে ফিরে যেতে হবে। ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারী এই বিল কার্যকরী হয়।

এনআরসি প্রসঙ্গে তৃণমূলের দ্বিচারিতা কিভাবে প্রকাশ্যে আসছে? 

বাংলার শিল্পী মুখ্যমন্ত্রী, তৃণমূলের একমাত্র মুখ, মাননীয়া মমতা ব্যানার্জীর গলায় আজকে আমরা  এনআরসি নিয়ে কান্না শুনছি। ২০০৫ সালের ৪ আগস্ট সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি কি করেছিলেন সেই ঘটনা তার মনে না থাকলেও আমরা তা স্মরণে রেখেছি। পার্লামেন্টের সরাসরি সম্প্রচার, যা স্পীকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ চেষ্টায় সফল হয়েছিল, তাতেও আমরা ঘটনাটা দেখেছি। মিডিয়ায় রক্ষিত আছে। উদ্বাস্তু, শেকড় ছেঁড়া মানুষের ভোটে কেমন করে বাংলার বামপন্থীরা জিতে যাচ্ছেন, তার গল্পে ভরা আসরগুলোতে দিল্লী মাতাতেই নিশ্চয়ই সেদিন তিনি এই পথ নিয়েছিলেন। সবসময় তিনি নেতিবাচক রাজনীতির আশ্রয় নেন। সেদিনও তাই ছিল। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে সংসদে আলোচনা চেয়ে এবং অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরি করে তা সংসদে পেশ করার জন্য দাবি জানিয়ে তাঁর নোটিশ লোকসভার তৎকালীন চেয়ারে বসা ডেপুটি স্পিকার চরণজিৎ সিং খারিজ করে দিয়েছিলেন বলেই তিনি উত্তেজিত হয়ে ডেপুটি স্পিকারের দিকে ওই তালিকা সংবলিত ফাইল এবং চাদর ছুঁড়েছিলেন।

সম্ভবত উনি বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন যে কলোনিগুলোতে বসবাসকারী মানুষের অধিকৃত জমির স্থায়ী স্বত্ব বাংলার সরকার উদ্বাস্তুদের দিয়েছিলো। এবং তার সুবাদে গোটা রাজ্যটাই তখন ছিল বামফ্রন্টের ভোটব্যাংক। উল্টো দিকে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন অভিযোগ করছেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের খেদানোর কাজ শুরু হচ্ছে না বলে সংসদে উত্তেজিত হচ্ছেন, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৬ সালে পেশ করা নাগরিকত্বের বিলে বিজেপিকে সমর্থন দিচ্ছেন। ২০১৯-এর বিলে বয়কটের রাজনীতি খেলে বিজেপিকে আস্থার বার্তা দিচ্ছেন, আসাম থেকে পাঠানো বাঙালির লিস্ট অনুসারে উত্তর দেওয়ার কাজটা না করে, শুধু ‘অনুপ্রবেশকারী’র সংজ্ঞাটা পাল্টে ‘শরণার্থী’ করেছেন। কারণ তিনি আসামের যন্ত্রণায় এখন কাতর। তবুও তিনি বলছেন বাংলায় এনআরসি হবে না।

এটাই দ্বিচারিতা। একের পর এক এই ধরনের দ্বিচারিতার মুখোশ তিনি প্রকাশ্যে আনছেন।

আসামে এনআরসি-র ঘটনাটা কি?

ঐতিহাসিক কারণেই ভারতের নাগরিকত্ব আইনের সঙ্গে আসামের নাগরিকত্ব আইন কিছুটা আলাদা। ১৮২৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সেখানে চা চাষের জন্য কম পারিশ্রমিকে কর্মীদের নিয়ে যাওয়া হতো। ফলে আশপাশের অঞ্চল বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ আসামে বসবাস শুরু করে। এছাড়াও ব্রিটিশ শাসনের পর আরও দুটি পরিবর্তনের জোয়ার এসেছিল দেশ ভাগের সময় এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর। আসামের নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে দুটি তারিখের হিসাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ দুটি তারিখ হল- ‘১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি’ এবং ‘১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ’।

১৯৫১ সালে জনগণনার ভিত্তিতে দেশে প্রথম ন্যাশনাল রেজিস্ট্রি অফ সিটিজেন্স তৈরি করা হয়। অসমের বাসিন্দা তাঁরাই যাঁদের নাম সেই তালিকায় ছিল। তাঁরা সকলেই আসামের নাগরিক। সেই নিয়ম অনুযায়ী, যাঁরা ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে যাঁরা এ দেশে এসেছেন তাঁদের নাম নথিভুক্ত করতে হবে বিদেশি নিগরিক হিসাবে। এই বিদেশি চিহ্নিত হওয়ার ১০ বছর পর তাঁরা ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন। অন্তর্বর্তী সময়ে তাদের ভোটাধিকার থাকবে না, কিন্তু তারা সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন। বিদেশি চিহ্নিত করা হবে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী আইন অনুসারে, যা কেবল আসামের জন্য প্রযোজ্য। ফলে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত যাঁদের নাম অসমের ভোটার তালিকায় ছিল তাঁরা আসামের নাগরিক, বাকীরা বিদেশী, এবং দেশদ্রোহী। যাঁরা এখন অসমের বাসিন্দা, তাঁদের প্রমাণ করতে হবে যে তিনি নিজে অথবা তাঁদের পূর্বপুরুষরা ওই সময়ে অসমের বাসিন্দা ছিলেন।

যারা অবৈধ ভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছেন, তারা মাত্র ছ-বছর এই দেশে থাকলেই এই দেশের নাগরিক হয়ে যাবেন, এই নিয়মে ঘোর আপত্তি অসমের। শুধু অসম নয়, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্য রাজ্যগুলিতেও উদ্বাস্তু সমস্যা রয়েছে।

আসামের ইতিহাসটা ঠিক কি?

১৯৬০-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৭২ সালের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা মাধ্যম সংক্রান্ত আন্দোলনকে যদিও আংশিক সমাধানসূত্র খুঁজে বার করে ধামাচাপা দিয়ে নিরস্ত করা গিয়েছিল, কিন্তু ১৯৭৯ সালের বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলন শুরু করে আসু, যা পরবর্তী দীর্ঘ ছ’বছর ধরে চলে, তার সমাধানকল্পে ১৯৮৫ সালের ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে ত্রিপাক্ষিক অসম-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। রাজীব গাঁধীর উপস্থিতিতে তা হয়। আসুর বক্তব্য ছিল, দেশভাগের পর থেকে দলে দলে বাঙালির আগমনে অসমের জনবিন্যাস যেমন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, অসমিয়া ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও অর্থনীতিও ক্রমে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।

সেই চুক্তিতে সই করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব, অসমের মুখ্যসচিব এবং অসমের পক্ষে আসুর তৎকালীন সভাপতি প্রফুল্লকুমার মহন্ত, সাধারণ সম্পাদক বিকে ফুকন, উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। অসম অ্যাকর্ড অনুযায়ী ১৯৫১ সালে জনগণনায় যাঁদের নাম আছে তাঁরা দেশের নাগরিক, তার পরে ১৯৬১ সালের জনগণনায় যাঁদের নাম যুক্ত হয়ছে তাঁরা ভারতে থাকলেও নাগরিক হবেন না, সুযোগ-সুবিধা পাবেন। এমনকি বাংলাদেশ গঠনের সময় যাঁরা এসেছেন তাঁদের কথাও উল্লেখ করা হয়।

এই চুক্তিতে বিদেশি শনাক্তকরণ ও বিতাড়নের জন্য ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের মধ্যরাতকে ভিত্তি তারিখ হিসেবে বেছে নেওয়া হয় সর্বসম্মতিক্রমে। অসম চুক্তিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইনকে সংশোধন করে ১৯৮৫ সালেই ৬(ক) ধারা সংযোজিত হল, যাতে নাগরিকত্বের প্রশ্নে অসমের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা বলবৎ থাকে। কিন্তু, এর মধ্যে বিদেশি বিতাড়নের নামে যাতে কোনও প্রকৃত নাগরিককে হেনস্থা হতে না হয়, তার দাবিতে ১৯৮৩ সালে ‘আইএমডিটি’ (ইললিগাল মাইগ্র্যান্টস ডিটারমিনেশন বাই ট্রাইবুনাল) অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয় রক্ষাকবচ হিসেবে। এই অবধি ঠিক ছিল। সমস্যা তৈরি হল এটার প্রয়োগে।

‘ডাউটফুল ভোটার’ (ডি ভোটার) তালিকার মধ্যে দিয়েই কি আসামের সমস্যা তৈরি হয়?  

কথাটা বলা যেতে পারে। সম্ভাবনাটা ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণে সিদ্ধ। ১৯৯৭ সালে আসু নির্বাচন কমিশনের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে যে, ভোটার তালিকায় অনেক বাংলাদেশির নাম ঢুকে যাওয়ায়, ‘ডাউটফুল ভোটার’ (ডি ভোটার) নামে এক শ্রেণির তালিকা তৈরি করা দরকার। তার পর ২০০৫ সালে ভারতের উচ্চতম আদালত আইএমডিটি অ্যাক্টকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়ে বাতিল করে দেয়। এই প্রেক্ষাপটেই এখন শুরু হয়েছে কেন্দ্র ও অসম রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে এনআরসি-তে প্রকৃত নাগরিকদের নাম নথিভুক্ত করার কাজ। এটা বিজেপির ঘোষিত নির্বাচনী এজেন্ডা। বিভাজনের রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলা তৈরির সহজ একটা উপায়। যেটা আরএসএস ও বিজেপির রাজনৈতিক পথ। রাজনীতিকে ধর্মের সঙ্গে মিশিয়ে দাও, রাজনীতিকে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে ঢুকিয়ে দাও, রাজনীতিকে ঘৃণ্য ফ্যাসিবাদী কায়দায় ধারালো করো, অথবা প্রয়োজনে দেশবাসীকে জ্বালাও, যন্ত্রণা দাও, অসহিষ্ণুতার আঁচে সেঁকে নাও – এইগুলো হল তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা নির্ভর কাজ। আসামেও তাই নাগরিকের শর্তাধীন দৈনন্দিন জীবন শুরু হয়। নাগরিক নথিভুক্তির শর্ত হয়, ১৯৫১ সালের এনআরসি, ১৯৬৬-র ভোটার তালিকা, বা ১৯৭১-এর ভোটার তালিকায় যাঁদের পূর্বপুরুষ বা নিজেদের নাম আছে, তাঁরাই অসমের নাগরিক হিসেবে থাকতে পারবেন। তা হলে যাঁরা বিদেশি বলে প্রমাণিত হবেন, তাঁদের পরিবার ও সন্তানসন্ততি নিয়ে কী উপায়? ঠিক হয়েছে, তাঁদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। প্রথমে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ তার পর ‘ডিপোরটেশন’। যার মোদ্দা অর্থ হল, রাষ্ট্র যাঁদের নাগরিকত্বের দাবিকে স্বীকার করছে না। কারণ তাঁরা তাঁদের নাগরিকত্বের যথেষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেননি। সেই ভাসমান জনগোষ্ঠীকে ‘রাষ্ট্রহীন’ পরিচিতে চিহ্নিত করে দেওয়া হবে। ৪০ লক্ষ থেকে কমে আজ যে ১৯ লক্ষ ২ হাজার ৪৬২ জনের নাম নাগরিকত্বের খাতা থেকে বাদ গেছে তাদের কেউ ডি ভোটার, আবার কেউ রক্ত-সম্পর্কের প্রমাণ পত্র, দলিল শুনানির সময় দেখাতে পারেননি।

আসামে এনআরসির ফলে ঠিক কি ঘটলো?

এনআরসি নিয়ে কংগ্রেস সরকার ঢিমেতালেই চলছিল, কিন্তু ২০০৫ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে জানিয়ে দেয়, নির্দিষ্ট সময়েই মধ্যেই এনআরসি নবীকরণ করতে হবে। তার জেরেই এই তালিকা প্রকাশ।

দেশের অন্য অংশে অবশ্য নিয়ম, যাঁরা ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে ভারতে এসেছেন, তাঁরা ভারতীয় নাগরিক। ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে এই তালিকা নবীকরণের কাজ শুরু হয় ৷ ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে অসমে আসা ব্যক্তি ও তাঁদের বংশধরদের নামই এনআরসিতে উঠবে বলে জানানো হয় ৷ ২০১৫ সালে এনআরসি নবীকরণের কাজ শুরু হয় ৷ কয়েক দফায় তারিখ পিছোনোর পরে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রথম খসড়া প্রকাশিত হয় ৷ দ্বিতীয় খসড়া তালিকা প্রকাশিত হল সোমবার অর্থাৎ ৩০ জুলাই, ২০১৮৷

এই দ্বিতীয় খসড়া নাগরিকপঞ্জি-তে চল্লিশ লাখ মানুষের নামের পাশে লালকালির দাগ। কার্যত রাতারাতি ভারতীয় নাগরিকত্ব হারানোর পথে তাঁরা। নাগরিকপঞ্জীতে নাম তোলার জন্য আবেদন করেন ৩ কোটি ২৯ লক্ষ মানুষ ৷ তালিকায় প্রকাশিত হয়েছে ২ কোটি ৮৯ লক্ষ মানুষের নাম৷ সংশোধনীর পরও কার্যত প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষের নতুন পরিচয় হচ্ছে “রাষ্ট্রহীন মানুষ।” এরা যাবেন কোথায়? ঘিরে ধরছে বন্দিদশার অনিশ্চয়তা আর দেশছাড়া হওয়ার আশঙ্কা।

এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ভাষ্য কি হচ্ছে? বলা হচ্ছে যে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সরকার আশ্রয় দেবে। কারণ, তারা বিপদের মুখে নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন। অন্যদিকে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানো হবে, কারণ সীমান্তের ওপার থেকে রোজগার বা বাসস্থান খুঁজে পেতে, কিংবা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই তারা ভারতে এসেছে।

হিন্দু উদ্বাস্তু ও মুসলিম অনুপ্রবেশকারী – উদ্বাস্তু পরিচিতিতে এমন দ্বৈত রূপ কেন?

এনআরসি হল একটি চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া। ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল উদ্বাস্তু হিন্দুদের আশ্রয়স্থল ভারত এবং ক্ষমতায় এসে তিনি সে ব্যবস্থাই করবেন। কথামতো কাজও করেছেন তিনি। পাসপোর্ট আইন, বিদেশি আইন বা ফরেনার্স অ্যাক্ট-এর সংশোধন করা হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-এর মধ্যে যারা বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই ভারতে এসেছেন তারা আইনিভাবে বসবাসের অধিকারী হয়েছেন।

কিন্তু মুসলিম প্রশ্নে মোদি সরকারের অবস্থান ভিন্ন। তাদের মতে, মুসলিম মানেই অনুপ্রবেশকারী। কারণ তারা ধর্মীয় ও জাতিগত নিগ্রহের শিকার হয়ে ভারতে আসেনি। এসেছেন ক্ষতির উদ্দেশ্য নিয়ে। এরা দেশদ্রোহী। নিশ্চিতভাবেই কাতারে কাতারে বাংলাদেশি উদ্বাস্তু মানুষ যদি রোজ এখানে আসেন তাহলে দেশের অর্থনীতির জন্য তা যেমন ক্ষতি করে, জনবিন্যাসের ভারসাম্যর পক্ষেও তা বিপজ্জনক হয়। বিজেপি প্রত্যাশিত ভাবেই এই প্রশ্নে শুধু মুসলিম অনুপ্রবেশের বিপদ দেখছে। অথচ ঘটনা হল, এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা মুসলিম জনসাধারণ নন। তাঁরা হিন্দু, এবং আরও নির্দিষ্ট ভাবে, দরিদ্র, অশিক্ষিত, দলিত হিন্দু। এঁদের সংখ্যা প্রায় দু’কোটি!

জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংজ্ঞার বিকৃতি মোদি সরকারের হাতিয়ার। জাতিসংঘের উদ্বাস্তুর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে ব্যক্তি জাতি, ধর্ম, নাগরিকত্ব, সামাজিক বা ধর্মীয় সংস্থার জন্য অত্যাচারিত হচ্ছেন বা হওয়ার আশঙ্কায় দেশ ছেড়েছেন তারাই উদ্বাস্তু। সরকারের মতে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র। সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাই হিন্দু হল উদ্বাস্তু, যখন মুসলিম হল অনুপ্রবেশকারী। হিন্দুদের আশ্রয় দেওয়াটা আইনসংগত, কিন্তু মুসলিম জনগণ কোনও অধিকারেই এখানে থাকতে পারে না। তাঁরা রাষ্ট্রহীন।

বিজেপি, আরএসএস-এর এই শরণার্থী-অনুপ্রবেশকারীর যুক্তি কি সত্য?

পুরোটাই মিথ্যা। উদ্বাস্তু সমস্যা সারা পৃথিবীজোড়া সমস্যা। এমন ধর্মাশ্রয়ী কুযুক্তিকে “জাতিসংঘের উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা” বলাটা মুর্খামি। কি বলা হয়েছে জাতিসংঘের উদ্বাস্তুর সংজ্ঞায়? বলা হয়েছে যে সকল ব্যক্তি ভয়ের কারণে দেশত্যাগী হবেন, দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেবেন, তারাই উদ্বাস্তু। এই ভয় তাদের জাতিগত, ধর্মীয়, নাগরিকত্ব সম্পর্কীয়, সামাজিক অথবা রাজনৈতিক কোন গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার জন্য তৈরি হতে পারে। এই অন্য বা ওপর বিবেচনায় অত্যাচার, অথবা কোন অত্যাচারের শঙ্কা থেকে যারাই দেশ ছেড়েছেন, তারাই উদ্বাস্তু।

এই উদ্বাস্তু সংজ্ঞাকে বিকৃত করে আপামর জনসাধারণকে ভুল বোঝাচ্ছে বিজেপি, আরএসএস পরিচালিত ভারত সরকার। বিষয়টাকে শুধুমাত্র বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং হিন্দু-মুসলমানে সীমাবদ্ধ রাখছেন। জাতিসংঘের কথা বলে বয়ানটাকে ধর্মাশ্রয়ী করা হচ্ছে। বিশ্বজোড়া উদ্বাস্তু সংকটকে লুকিয়ে রেখে বিকৃত, বিভাজনের রাজনীতি করা হচ্ছে। যেমন, ইংল্যান্ডেই প্রায় লক্ষাধিক ভারতীয় নাগরিক উদ্বাস্তু হয়ে আছে। গত বছর তাঁদের ফেরত পাঠানোর জন্য ভারতের সাথে একটা চুক্তিতে যেতে চায় ইংল্যান্ড। তখন এই মোদীই সেই চুক্তিতে সই করতে অস্বীকার করেন। একইভাবে পাকিস্তানের, ভারতের অথবা বাংলাদেশের বহু মানুষ আমেরিকা ও ইউরোপে উদ্বাস্তু হিসেবে চিহ্নিত। পরিচয়টা উদ্বাস্তুর, উদ্বাস্তু পরিচয়ের বাইরে হিন্দু-মুসলিম বলে আলাদা কিছু নেই।

মোদী সরকার পাকিস্তানের বাইরে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকেও এখন মুসলিম রাষ্ট্র বলে হেঁকে দিচ্ছেন। উদ্বাস্তু পরিচয়ে বিভাজন ঘটাচ্ছেন। সীমান্তে ধরতে না পেরে, সরকার এখন দেশের নাগরিকদের ধরে তাঁদের সম্পত্তি লুট করতে চাইছেন। মুসলিমদের বেশী শাস্তি, এই প্রচারে হিন্দুত্বের কার্ড রাজনীতিতে খেলা হচ্ছে। হিন্দু অংশে উদ্বাস্তু তৈরি করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার কাজটাও শুরু করতে চাইছে। এই শীতকালীন অধিবেশনে ক্যাব পাস করার প্রয়াস নেবে সরকার।

সুপ্রিম কোর্ট কি এনআরসি প্রসঙ্গে কিছু জানিয়েছে?

সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, অসমে নাগরিকপঞ্জির দ্বিতীয় খসড়ায় যে চল্লিশ লক্ষ মানুষের নাম নেই, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা যাবে না।

স্বাধীনতার সেই সন্ধিলগ্নে প্রধানমন্ত্রী নেহরু বলেছিলেন, ‘আমরা সেই সব ভাইবোনদের কথা ভাবছি, যাদের একটি রাজনৈতিক সীমারেখার দ্বারা আমাদের থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে,…তবে যা-ই ঘটুক না কেন, তারা আমাদেরই এক জন এবং ভবিষ্যতে আমাদের এক জন থাকবেন।’ গাঁধীজি বলেন, ‘যে সমস্ত শিখ ও হিন্দুরা পাকিস্তানে আছেন, তাঁরা যদি সেখানে না থাকতে চান, তা হলে যে কোনও সময়ে, যে কোনও ভাবে ভারতে চলে আসতে পারেন।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই পটেল বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু মানুষেরা আমাদের রক্তমাংসের সমান, যাঁরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। একটা সীমারেখার ও পারে পড়েছেন বলে হঠাৎই তাঁরা বিদেশি বলে গণ্য হতে পারেন না।’

বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এবং বিচারপতি রোহিংটন নরিম‍্যানের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে, চল্লিশ লক্ষ মানুষ তালিকায় নাম তুলতে যেন ঠিক মতো সুযোগ পায়। এনআরসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তা নিশ্চিত করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। যাঁদের নাম তালিকায় ওঠেনি, তাঁরা ৮ অগাস্ট থেকে নিজেদের দাবিদাওয়া ও অভিযোগ জানাতে পারবেন। যা খতিয়ে দেখা হবে ৩০ অগাস্ট থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ১৯ লক্ষ মানুষ বাদ থেকেছে। তাদের জন্য ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করা হচ্ছে। তবে তালিকা থেকে বাদ পড়াদের দাবি ও অভিযোগ কোন পদ্ধতিতে খতিয়ে দেখা হবে তাও কেন্দ্রকে জানাতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। কোর্টের শুনানিতে এনআরসি কর্তৃপক্ষের তরফ জানানো হয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ করা হবে, এই তথ‍্য ঠিক নয়। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের দিনক্ষণ ঠিক করবে শীর্ষ আদালতই।

আসামে এনআরসির ফলে বিজেপির কি ধরণের রাজনৈতিক লাভ হচ্ছে?

রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির সবটা এখনই বলা যাবে না। সামাজিক অসন্তোষ, সংঘর্ষ, কিছু নেতার পদত্যাগ অবশ্যই বিজেপির পক্ষে মঙ্গলময় নয়। সামাজিক স্তরে যাঁদের স্কুল পাস করার শংসাপত্র নেই, এতদিন মনে করছিলেন পঞ্চায়েতপ্রধানের শংসাপত্রই যথেষ্ট, এখন তাঁরাও সমস্যায় পড়েছেন। এঁদের বেশিরভাগই মহিলা। অন্য দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের সংশোধনী বিল অনুযায়ী সমস্যায় পড়বেন মূলত মুসলমানরা। কারণ বিলে স্পষ্ট ভাবে বেশ কয়েকটি ধর্মের কথা উল্লেখ করা থাকলেও, এখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কথা বলা নেই। তার কারণও সহজেই অনুমেয়, দেশ ভাগের সময়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা দেশ চাওয়া হয়েছিল, তাই ধর্মীয় কারণে মুসলিমরা দেশ ছাড়েননি, অন্য কোনও কারণে দেশ ছেড়ে থাকতে পারেন। এই ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন বিজেপির রাজনৈতিক লাভ। তারা যে বিভাজনের রাজনীতি চালাতে চায় তা তারা আসামে করতে পেরেছে।

লাভের ওপর দিকটি হল, তালিকায় না থাকা অংশকে রাজনীতির ছাতার তলায় নিয়ে আসার সুবিধা। প্রথমত, আসামে থাকা বাঙালির যে অংশ পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দা, তাদের নাম ও বসতির ইতিহাস সরকারিভাবে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল পরিচালিত সরকারের কাছে আসাম সরকার জানতে চেয়েছিল। সম্পূর্ণ তথ্য না দেওয়ায় যারা এখনও ‘নিজভূমে পরবাসী’, তাদের তালিকাভুক্তির সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি দলভুক্তির কাজটাও সহজ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ঐ নতুন করে উদ্বাস্তু হওয়া অংশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার সুযোগ থেকে যায়। ঘোলা জলে মাছ ধরা সহজ। কি হবে তা আগামী বলবে। পেন্ডোরার বাক্স খুলে গেছে। প্রতিটা সীমান্ত রাজ্য উৎসাহিত হচ্ছে শতবর্ষের সহাবস্থান ভেঙে ফেলতে। যেখানে বিজেপি ঢুকছে সেখানেই তাণ্ডব শুরু হয়ে যাচ্ছে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য শব্দবন্ধটি ডুবে যাচ্ছে হোমোজিনিটির অতলে। এই পরিণতির পরিণাম এখন ভুগছে সবাই, বিশেষ করে উদ্বাস্তু বাঙালিরা।

আসামের এনআরসিতে বাঙালি কি সফট টার্গেট?

সাধারণ অশিক্ষিত ‘বাঙ্গাল’, ‘বঙ্গাল’ বা বাঙালিরা আসলে এনআরসি ফর্ম পূরণ করার জন্য ধার নিয়েও গাদা টাকা খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন, কিছু মানুষ নাম না থাকায় আত্মহত্যাও করেছেন। এই অবস্থায়, আসামের মানুষ যে ভালো নেই সে কথা বলাবাহুল্য।

আসামে এনআরসি করার উদ্দেশ্য হল, সেখান থেকে বাঙালি খেদিয়ে অসমীয়া জাতীয়তাবাদকে তোষণ করা এবং সেটার মধ্যে আরএসএসকে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজটা সেরে ফেলা। আগামী এক দশকের জন্য বিজেপি-র ঝুলিতে তাদের ভোট নিশ্চিত করার কাজ হিসেবেও এই এনআরসিকে আমরা দেখতে পারি। যে কোন রাজ্যে এনআরসির লক্ষ্য হল দরিদ্র মুসলমান সমাজকে সন্ত্রস্ত করা, অস্তিত্বের সংকট থেকে না চাইলেও বিজেপি-র সামনে তাদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করা। দেশের জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতেও তাই এই নাগরিকপঞ্জী দৃঢ়ভাবে লাগু করার চেষ্টা করছে বিজেপি। এই কাজে তাদের উদ্দেশ্য হবে মূলনিবাসী-আদিবাসী সমাজকে উচ্ছেদ করে তাদের জমি-জল-জঙ্গল কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া।

ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষকে বিজেপি-র সাপোর্ট বেস করে তোলার নাম এনআরসি। দেশবিহীন এক বিপন্ন সম্প্রদায় সৃষ্ট করার নাম এনআরসি। আরও লক্ষণীয় যে, এই কৌশলে যাদের অনুপ্রবেশকারী বলা হচ্ছে, তাঁদের ছেলেমেয়েরা, যাদের জন্ম এ দেশে হয়েছে এবং যারা কোনও দিন পাকিস্তান বা বাংলাদেশ দেখেনি, তারাও আজ অনুপ্রবেশকারী। এই ভাবে বিপুল জনতাকে পুরুষানুক্রমে দেশবিহীন রাখার ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছে। রক্ত শুদ্ধতায় জাতি বা নেশন গঠনের কজে এদের নাম ভোটার তালিকায় উঠবে না, এদের পাসপোর্ট হবে না, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হবে না, চাকরি ও উচ্চশিক্ষার সব পথ বন্ধ। এই তালিকা-ছুট মানুষের বৃহৎ অংশ বাঙালি, যাদের আপাত ঠিকানা গণ-ডিটেনশন ক্যাম্প।

আসাম ছাড়া অন্য কোন রাজ্যে এনআরসি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা হচ্ছে?

আসাম ছাড়া মণিপুর, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি করার কথা উঠছে।

ছোট্ট একটা রাজ্য মণিপুর। সব মিলিয়ে বোধহয় ১৯ লক্ষ লোকের বাস। নয় লক্ষ অ-মণিপুরী। তাদের হাত থেকে মণিপুরী কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে মণিপুর বিধানসভায় ( যেখানে বিজেপির সরকার) “মণিপুর পিপলস প্রোটেকশান বিল ২০১৮” পাশ হলো, যে বিলে বলা আছে মণিপুরে মৈতেই মণিপুরী, পঙ্গাল মুসলমান, সংবিধানে নথিভুক্ত জনজাতি এবং ১৯৫১ সালের আগে মণিপুরে বসবাসকারী সকল নাগরিক মণিপুরী হিসাবে বিবেচিত হবে।

বাকি অ-মণিপুরীদের শ্রেণিতে রাখা হয়েছে এবং তাদের এক মাসের মধ্যে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করাতে হবে। তবে তারা থাকার জন্য একটি পাস পাবে যা ছয় মাসের জন্য ভ্যালিড থাকবে। যাদের ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্স আছে, তারা পাঁচ বছর পর্যন্ত একটি পাস এক্সটেন্ড করতে পারেন, যা প্রতিবছর রিনিউ করা হবে। যে কোনও বহিরাগতকে মণিপুরে ঢুকতে হলে পাসের প্রয়োজন হবে।

প্রশ্ন হলো ১৯৫১ সালকে মণিপুরে ভিত্তিবর্ষ ধরা হলো, অথচ প্রদেশটির জন্মই হয়েছে ১৯৭২ সালে। সেক্ষেত্রে প্রামাণ্য নথি কী হবে? এই বিতর্ক এখন চলছে।

ত্রিপুরায় আপাতভাবে এনআরসি হচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব নিজেই বাংলাদেশী।

পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি এখন রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে এসে গেছে। বিজেপির বক্তব্য যে তারা রাজ্যে ক্ষমতায় এলে এনআরসি কার্যকরী করবে, যা বামেরা আগের মতোই একই যুক্তিতে, এবং তৃণমূল নতুন করে বিরোধিতা করছে। উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে এই আইনে মানবিক ধারা সংযোজনের প্রস্তাব ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ নিরপেক্ষতায় কেন রাখা হয়নি সেই প্রশ্ন রাখেন বামপন্থীরা। বামপন্থীরা মানেন যে উদ্বাস্তু স্রোত বন্ধ হলেই উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। উদ্বাস্তুর নাগরিক হয়ে ওঠাটা সমাধানের পূর্বশর্ত।

পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি নিয়ে কি ভাবনা-চিন্তা হচ্ছে?

অসমের গোয়ালপাড়ায় ঘন জঙ্গল উড়িয়ে তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম গণ–ডিটেনশন ক্যাম্প।  পেটের দায়ে এনআরসি তালিকা–ছুট মানুষগুলোই এখন ডিটেনশন ক্যাম্পের শ্রমিক। পশ্চিমবঙ্গেও এই চিত্র আমরা দেখবো। হয়তো আরও জোরালো ভাবেই দেখবো। এখানে সংখ্যাটা বেশী হবেই। আর্থিক ও শিক্ষাগত কারণ ছাড়াও প্রাকৃতিক বিপর্যয় হল আর একটা কারণ যার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ দেখানো যায় না। দুর্নীতি হল সেই ফাঁক যা প্রকৃত নাগরিককে ফাঁদে ফেলে। সরকারী কর্মীর অসহযোগিতা ও তার ভুল, নাগরিকের জীবনে সংকট ঘনিয়ে আনার কারণ হয়ে ওঠে। এই সকল প্রেক্ষিতে আসাম-বাংলা এক।

পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি নিয়ে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়েছে। ইভিএসের মধ্যে দিয়ে ডি ভোটারের কাজ শুরু হয়েছে। এনআরসির সঙ্গে এটার সম্পর্ক নেই বলা হলেও এটাকে আসামের অভিজ্ঞতায় সলতে পাকানোর কাজ ভাবতে পারেন। খোদ বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ্, পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি করার জন্য ক্ষমতা দখলের চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে অবৈধ বিদেশিদের চিহ্নিত করা, ধর্মীয় বিভাজনে অবৈধতার মাপকাঠি প্রতিষ্ঠা করা প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে দলের মহিলা শাখার নেত্রী লকেট চ্যাটার্জি মনে করেন, “পশ্চিমবঙ্গে ভীষণভাবে এনআরসি চাই! অবৈধ বিদেশির সংখ্যা আমাদের রাজ্যে আসামের চেয়েও অনেক বেশি – সম্ভবত দেড় কি দু’কোটি হবে।” এই দাবি রাজ্য সরকার মানেন না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কেন্দ্রকে এনআরসি বিষয়ে চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি জানিয়ে দেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিছুতেই এনআরসি-র মতো তার ভাষায় অশালীন ও বিশৃঙ্খলা তৈরির জিনিস রাজ্যে হতে দেবে না। আর কে ভারতীয় আর কে ভারতীয় নন, সেটা ঠিক করার অধিকারই বা বিজেপিকে কে দিল?”

বামপন্থীরা এনআরসি-র পক্ষে নন। নতুন ভাবে উদ্বাস্তু তৈরির রাজনীতি করে মানুষের জীবনের দৈনন্দিন সমস্যাগুলো থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টার বিরোধিতা করে তারা। হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের আদলে ডিটেনশন ক্যাম্পে দরিদ্র, খেটে খাওয়া ভারতবাসীর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার রাজনৈতিক চিন্তার বিরোধিতা করে তারা।

পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি নিয়ে বিজেপি কোন রাজনৈতিক খেলা খেলতে চাইছে? 

বিজেপির এজেন্ডায় বিভাজনের রাজনীতি হল মূল ইস্যু। এনআরসির মধ্যে যে বিদেশী খেদাও ভাব আছে তার সাহায্যে বিজেপি রাঢ় বাংলায় বাঙাল খেদানোর বুলি আওড়ে রাজনৈতিক ভিড় বাড়াতে চাইছে। আবার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এনআরসির সাহায্যে আসামের মতো মুসলমানদের নাম তালিকার বাইরে রেখে তাদের টাইট দেওয়া যাবে সেই উন্মাদনার বুলি আওড়ে রাজনৈতিক ভিড় বাড়াতে চাইছে। মাননীয়ার হিজাব রাজনীতি সেই ফ্লেবারে লিকার মেশাতে সাহায্য করছে।

বিজেপি বলছে যে আসামে এনআরসি বিজেপি করেনি। তাহলে বিজেপিকে দোষ দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু তাঁরা এটা বলছে না যে আসাম জাতীয়তাবাদে সুড়সুড়ি দিয়ে বাঙালিকে সফট টার্গেট করলো যে বিজেপি, সেই বিজেপি বাংলায় হিন্দু উদ্বাস্তুর ত্রাতা সাজার দ্বিচারিতা করছে কিভাবে?

পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির উদ্বাস্তু সেলের পক্ষে মোহিত রায় লিখছেন, “বাংলাদেশ থেকে চলে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের এনআরসির জন্য পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে কোনভাবেই ভিটেমাটি ছাড়া হতে হবে না।… আসামের মত পশ্চিমবঙ্গের জনগণনার চরিত্র দেখলেই বোঝা যাবে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশী মুসলমানদের অবাধ প্রবেশের শুরু জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর। এই বাংলাদেশী মুসলমানরা ভোট, অস্ত্রশস্ত্র, বোমা, মাদ্রাসা সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে শাসকের বড় সম্পদ হয়ে উঠেছে। সুতরাং আসাম থেকে বাংলাদেশী মুসলমানদের যদি বিতাড়িত করা যায়, অন্তত তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে, ভোটাধিকার ও অন্যান্য সুবিধা থেকে বাদ দিয়ে আসামকে যদি নিরাপদ করা যায় তবে পশ্চিমবঙ্গে সেটা কার্যকরী করা জাতীয় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।” এই বয়ান বিচ্ছিন্ন করার খেলা খেলতে চায়। সমাজকে ধর্মের আলোচনায় বাঁধতে চায়। উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আন্দোলন হিসেবে এনআরসিকে দেখিয়ে বিজেপি হিন্দু-মুসলমান, মতুয়া-মুসলমান, একের নিরাপত্তাহীনতায় অপরকে সংগঠিত করতে চায়। এটাই রাজনীতি।

বামপন্থীদের পাল্টা যৌক্তিক অবস্থানটা ঠিক কি? 

তৃণমূল ও বিজেপি রাজনীতিতে ধর্মের ঘোলা জলে ফায়দা লুটতে চায়। এই নোংরা রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে বামপন্থীদের অবস্থান স্পষ্ট। তাঁরা মনে করে নাগরিকপঞ্জীর সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজটা দীর্ঘদিন ধারাবাহিকভাবে করা হয়নি। ভুলে ভরা ভোটার লিস্ট। যে ভুল আজও সংশোধিত হচ্ছে তাকে কিভাবে আদর্শ মাপকাঠি ধরা হবে? এনআরসির নামে একতাল মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। বেআইনি অনুপ্রবেশকারী নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ, ভয় ও ভীতির রাজনৈতিক খেলা বন্ধ করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নয়, প্রাসঙ্গিক বিভাগ খুলে দক্ষ সহনশীল কর্মী দিয়ে ধীরে ধীরে নির্ভুল রেকর্ড সহজলভ্য করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে অন্যান্য অনেক রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান একটু আলাদা। জনবিন্যাসে এবং সীমান্তবর্তী রাজ্য অবস্থানে এটা সেই সাতচল্লিশেই বলুন বা একাত্তরে, পশ্চিমবঙ্গ সব সময়ই সকল ভাষা, ধর্ম ও বর্ণের মানুষের প্রতি অ্যাকোমোডেটিভ ছিল। এই রাজ্যে উদ্বাস্তুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটানোর কাজে বামপন্থীদের অবদান ইতিহাসসিদ্ধ। বাংলার মানুষও বাইরের লোকজনের প্রতি সহৃদয়তা দেখিয়েছেন সব সময়ই। এটাকে ভোটের রাজনীতি দিয়ে ব্যাখ্যা করাও ঠিক হবে না – কারণ পশ্চিমবঙ্গের একটা অসাম্প্রদায়িক চেহারা আছে, সহনশীল মুখ আছে, সেটাও আমাদের বুঝতে হবে। এটাকে রক্ষা করা, এনআরসির নামে সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরির অপচেষ্টাকে রোধ করা, আমাদের সকলের আশু কর্তব্য। ভারতবাসীকে নতুন করে উচ্ছেদ করে দেশহীন মানুষ পরিচিতিতে দাগিয়ে দেওয়া যাবে না। ম্যাপহীন মানুষ হয় না। স্বাধীন ভারতে নির্দোষকে বিদেশী দেগে দিয়ে বন্দিশালায় রাখা যাবে না। ট্রাইবুনালের নামে নাগরিকদের যে নিদ্রাহীন অস্থিরতায় ফেলা হচ্ছে, সেটা তো ফ্যাসিবাদী প্রবণতা। যথার্থ উদ্বাস্তু নীতি প্রণয়নে এই অবস্থার স্থায়ী সমাধান করতে হবে।

[লেখক এম. এ, পি এইচ. ডি, সহকারী অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ববিভাগ, প্রফেসর নুরুল হাসান কলেজ, ফারাক্কা, মুর্শিদাবাদ]

Facebook Comments

2 thoughts on “প্রশ্নোত্তরে নাগরিকপঞ্জী ও নাগরিকত্বের সংকট : কৌশিক চট্টোপাধ্যায় Leave a comment

  1. কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুবই দায়সারা গোছের ।

Leave a Reply