সম্পাদকীয়
NRC-গত কয়েক মাস ধরে আমাদের চিন্তা-চেতনাকে এই তিনটি অক্ষর বোবা দরজার সামনে দাঁড় করিয়েছে। কিছু দিন পূর্বে অসমে এই NRC ঝড়ে বলি গিয়েছেন প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ, মৃত্যু হয়েছে মানুষের, হয়েছেন পরিবার বিচ্ছিন্ন। ধুঁকছেন ডিটেনশন ক্যাম্পের অব্যক্ত যন্ত্রণায়। পশ্চিমবঙ্গেও NRC বা NPR-জনিত আশঙ্কা প্রায় হিস্টিরিয়ায় পরিণত হচ্ছে। আতঙ্কগ্রস্ত অসহায় মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এমত পরিস্থিতিতে আমরা NRC বিষয়ে বিস্তারিত এক আলোচনার পরিসর চেয়েছি আমাদের পত্রিকার আঙিনায়—NRC কী, NPR বা CAB কী? কীভাবে এই বিষয়গুলি এত সংখ্যক মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছে? সমাজের চিন্তক, ভাবুক, শিল্পী, সাহিত্যিক মানুষেরা কেন চিন্তিত? কেন প্রতিবাদমুখর?
NRC (National Register of Citizenship) বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। গণপরিষদে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর এবং তা কার্যকরী হয় ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি থেকে। এই সংবিধানের ৫নং ধারায় কে বা কারা সংবিধান গৃহীত হওয়ার দিন থেকে ভারতের নাগরিক বলে গণ্য হবেন তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। সেখানে মূলতঃ তিনটি শ্রেণীভাগ আছে— (১) ভারতে জন্ম এবং ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, (২) কোন ব্যক্তির পিতা-মাতার মধ্যে কোন একজন ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, (৩) সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগের পাঁচ বছর যাবৎ ভারতে বসবাস করেছেন। এ’ছাড়া আর একটি বিধি নির্দিষ্ট করা আছে সংবিধানের ৬ (এ) (বি) (i) নং ধারায়। সেখানে বলা আছে কোন ব্যক্তির পিতা-মাতা বা ঠাকুরদা-ঠাকুরমা’র যেকোন একজন যদি ভারতে জন্মগ্রহণ করে থাকেন এবং তিনি যদি দেশভাগের পর পাকিস্তানভুক্ত এলাকা থেকে ১৯৪৮ সালের ১৯শে জুলাই তারিখের আগে ভারতে এসে থাকেন ও তারপর থেকে ভারতে বসবাস করেন, তবে তাকে সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময় ভারতীয় নাগরিক বলে স্বীকার করা হবে।
এ তো গেল আইন-সংবিধানের কথা। কিন্তু দেশভাগের সময়, যে অখণ্ড ভারত র্যাডক্লিফের লাঠির খোঁচায় টুকরো-টুকরো হল সেই অখণ্ড ভারতের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় নেতারা, যারা পরবর্তীকালে খণ্ডিত ভারতের দেশনায়ক হলেন, তাঁরা ‘নাগরিকত্ব’ প্রসঙ্গে কী বলেছিলেন?
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু স্বাধীনতা ঘোষণার অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “আমরা সেইসব ভাইবোনদের কথা ভাবছি, যাদের একটা রাজনৈতিক সীমারেখার দ্বারা আমাদের থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে এবং যাঁরা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে পারছেন না। তবে যাই ঘটুক না কেন, তাঁরা আমাদেরই একজন এবং ভবিষ্যতে আমাদেরই একজন হয়ে থাকবেন। ভাল বা মন্দ, যাই হোক না কেন, সব কিছুতেই আমরা তাঁদের সমান ভাগীদার হয়ে থাকব।”
ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “আমরা সেই সমস্ত উদ্বাস্তু মানুষকে পুনর্বাসিত করার জন্য অধীর ও উদ্বিগ্ন, দেশভাগের জন্য যাদের যথেষ্ট ভোগান্তি হয়েছে এবং এখনও অমানুষিক কষ্ট ও দারিদ্রের মধ্যে কাল কাটিয়ে চলেছেন।”
সুতরাং ভারতীয় উপমহাদেশ, অখণ্ড ভারতের সকল মানুষের প্রতি খণ্ডিত ভারতের দেশনায়কদের ক্ষেদ ও মমত্ব ছিল। অন্তত তাঁরা সে’কথা বলতেন।
দেশনায়করা গত হয়েছেন। দেশের নাগরিকত্বের আইনি, সাংবিধানিক পরিসরও ‘সংশোধিত’ হয়েছে—১৯৫৫ সাল, ১৯৮৬ সাল (যা কার্যকরী হয় ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাই) এবং ২০০৩ সাল (যা কার্যকরী হয় ২০০৪ সালে)। ৩১শে জুলাই ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত NPR (National Population Register)-এর ভারত সরকারের গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যাচ্ছে ২০০৩ সালের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে ভিত্তি করে নাগরিকপঞ্জী তৈরি করা হবে। তাহলে আমাদের দেশে নাগরিকত্বের বর্তমান পরিসরটি কেমন?
ভারতের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হওয়ার দিন, অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর অবধি নূন্যতম পাঁচ বছর ভারতে থাকলে তিনি নাগরিক। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন জন্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান করে। পরবর্তীকালে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুসারে—(১) ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি থেকে ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাই অবধি ভারতে জন্মগ্রহণ করলে তিনি ভারতীয় নাগরিক। (২) ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাই থেকে ২০০৪ সালের ৩রা ডিসেম্বর অবধি সময়কালে কেবলমাত্র জন্মসূত্রে আর ভারতীয় নাগরিক হতে পারবেন না। পিতা-মাতার যেকোন একজন যদি ভারতীয় নাগরিক হন তাহলেই জাতক ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন। (৩) ৩রা ডিসেম্বর ২০০৪-এর পর যদি পিতা-মাতা উভয়ই ভারতীয় নাগরিক হন বা পিতা-মাতার একজন যদি ভারতীয় নাগরিক হন বা অবৈধ অভিবাসী না হন। আবেদনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব পেতে গেলে এই শর্তাবলী পূরণ করতে হবে—(১) আবেদন করার পূর্বে সাত বছর ভারতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে হবে। (২) অবিভক্ত ভারতের সীমানার বাইরে বিদেশে বসবাসকারী ব্যক্তির ভারতীয়ত্বের সূত্র থাকলে। (৩) কোন ভারতীয়কে বিবাহ করলে এবং আবেদনের পূর্বে সাত বছর ভারতে বসবাস করলে। (৪) ভারতীয় নাগরিকের সন্তান।
নাগরিকত্বের প্রমাণ হল ‘নাগরিকত্ব সনদ’। এই নাগরিকত্ব সনদের জন্য স্বরাষ্ট্র দপ্তরে আবেদন করতে হয়। কিন্তু ২০০৩ সালের পর থেকে সেই নাগরিকত্ব সনদ দেওয়া স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যারা ইতিপূর্বে সেই সনদ নেননি, আর সেই সনদের জন্য আবেদন করতে পারবেন না।
এহেন আইনি এবং সাংবিধানিক প্রেক্ষাপটে অসমে যে NRC চালু হয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গ সহ সমগ্র দেশে NPR-এর মাধ্যমে যে NRC চালু হতে চলেছে তার একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। অসমে দেশভাগের পূর্ব থেকেই ‘ভূমিপুত্র’ বনাম ‘অনুপ্রবেশকারী’দের একটি বিতর্ক ছিল। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ অবধি অসমে ‘বিদেশি খেদাও’ আন্দোলন কার্যত ‘বাঙালী খেদাও’ কর্মসূচীতে মোড় নেয়। ১৯৮৫ সালের ১৫ই অগাস্ট প্রায়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং অসম রাজ্য সরকারের সাথে স্বাক্ষরিত এক চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ-এর পর অসমে আসা লোকদের ‘বিদেশী’ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং বহিষ্কার করা হবে। সেই সময়ে অসমে আন্দোলনকারীদের প্রচার ছিল যে ৫০ লক্ষের উপর ‘বিদেশী’ নাকি অসমে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আন্দোলন পরবর্তী তিন দশকে, ১৯৮৫ থেকে ২০১২ অবধি, মাত্র ২৪১২ জনকে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল ও IMDT Act-এর মাধ্যমে বহিষ্কার করা গেছে। সে’কারণেই কি NRC? তাও সংখ্যাটা ১৯ লক্ষ?! ৫০-এর হিসেব কোথায় গেল? এটা নিয়েও অসমে আবার বিদ্বেষমূলক আন্দোলন শুরু! তবে পশ্চিমবঙ্গ সহ বাকি দেশের ক্ষেত্রে কিন্তু NRC-এর ভিত্তিবর্ষ ১৯৪৮ সালের ১৯শে জুলাই। সেখানে ‘অসম চুক্তি’ নেই, ফলতঃ ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ ভিত্তিবর্ষ নয়।
এই বিপুল সংখ্যক মানুষ যাদের একদা এই খণ্ডিত ভারতের দেশনায়কেরা আপন পরমাত্মীয় বলে আহ্বান করেছিলেন। তারা আইনের খোঁচায়, রাষ্ট্রের ‘বর্ডার’-এর ‘রাজনৈতিক’ নিষ্পেষণে ‘ঘুসবৈঠিয়া’ হয়ে যাবেন? ঘর-গেরস্থালী, পরিবার-পরিজন ছেড়ে বুকে ঝোলানো একটি সংখ্যার পরিচয়ে পরিচিত ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ নামক এক নরকের বাসিন্দা হবেন? ভারতের ‘বৈধ’ নাগরিকদের সস্তা শ্রমিকে পরিণত হবেন ‘মানুষগুলি’। গ্যাস চেম্বার থাক বা না থাক, এই পরিণতি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের থেকে কম কি?
কি বলব আমারা আমাদের উত্তর প্রজন্মকে? খাদ্যের খোঁজে, নিরাপত্তার খোঁজে, সুস্থ জীবনযাপনের সন্ধানে যে মানুষ ইতিহাসের সেই আদিমকাল থেকে দেশ-দেশান্তরে গেছে। সেই মানুষকে আজ এই ‘ভুবন গ্রাম’-এর যুগে, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর দেশে ‘ডিপোর্ট’ করা হবে আমাদের সময়ে!
আসুন পাঠক, বিশিষ্ট লেখক, চিন্তক, সামাজকর্মী, সাহিত্যিকরা এই বিষয়ে তাঁদের নিজস্ব মতামত, সৃষ্টি উপস্থাপন করেছেন ‘অপরজন’-এর এই সংখ্যায়, আপনাদের সামনে।

নভেম্বর, ২০১৯
Posted in: Editorial, November 2019
সুচিন্তিত এবং প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয়।