অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার
সপ্তম কিস্তি
“বেরঙ হয়েছি তাহার আশে”: মীরাবাঈ
মীরাবাঈ একটি বহুচর্চিত নাম। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর রাজস্থানের অন্যতম প্রতিবাদী স্বর মীরা।“ভক্তি”ধারার এক গুরুত্বপূর্ন কবি, ভারতীয় সংস্কৃতির একজন “ক্যানন”। এই প্রেক্ষিত থেকে মীরাবাঈ দুটি সম্ভাবনা নিয়ে আসেন: এক, মীরাবাঈ এর লেখা “বিপজ্জনক” মনে না করে ভারতীয় পিতৃতন্ত্র তাঁকে নিজ সংস্কৃতির মুখ বলে পরিচিত করতে চেয়েছে; দুই, মীরাবাঈ একটি “মুখোশ” ব্যবহার করে ভারতীয় পিতৃতন্ত্রকে বোকা বানাতে সক্ষম হয়েছেন। এই দ্বিতীয় প্রেক্ষিত থেকে দেখলে , মীরাবাঈ নারীবাদের সেই মুখ যিনি “পিতৃতন্ত্র”-কে ব্যবহার করেছেন পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে।
সম্ভ্রান্ত রাজপুত পরিবারে জন্মেছেন মীরা। বিবাহ সূত্রে মেবারের রাজপরিবারের সাথে সম্পর্কিত হন। আভিজাত্য বা সামাজিক অবস্থান কোনটিই তাঁকে মাটি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁর প্রেমের দেবতা, প্রাণের দেবতা গিরিধর অর্থাৎ কৃষ্ণ । মীরার গিরিধরকে আরাধ্য দেবতা হিসেবে বেছে নেওয়া একটি নারীবাদী প্রবণতা। ষোড়শ শতাব্দীর রাজস্থানে শিব কিংবা ব্রহ্মা-কে বেছে নেওয়াই “স্বাভাবিক” ছিল একজন অভিজাত নারীর পক্ষে। মীরা সেখানে “বিধি” ভেঙেছেন। মীরার কবিতায়, ভক্ত শুধু নয়, প্রভু গিরিধরও বারে বারে ফিরে ফিরে আসেন ভক্তের কাছে, আকুল হন গোকুলবালাদের জন্য। এই আকুলতায় মিশে থাকে প্রেম ও কাম। প্রেমের আনন্দে ভাসেন ভক্ত ও ভগবান দুজনেই।
মীরার অসামান্য ছন্দবোধ, শব্দ ব্যবহারে অসীম দক্ষতা তাঁকে ভক্তি আন্দোলনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছে। অধিকাংশ পদ ব্রজবুলি-গুজরাতিতে লিখলেও, যখন যে অঞ্চলে থেকেছেন, পদ রচনা করেছেন সেখানকার আঞ্চলিক ভাষায় । স্বাভাবিক ভাবে স্থানিকতাকে এই মর্যাদা দান অবশ্যই একটি নারীবাদী বৈশিষ্ট্য। পিতৃতান্ত্রিক একটি নিজের “বিধি” থেকে না বেরিয়ে, নিজের “বিধি” যেকোনো স্থানের উপর চাপিয়ে দেওয়া। মীরা এর বিরুদ্ধে গিয়ে বার বার পিতৃতন্ত্রের বিধি ভেঙেছেন। স্থানীয় মানুষের সাথে নিবিড় সম্পর্ক তাঁকে রাজ পরিবার এবং স্বামীর থেকে বহুদূরে সরিয়ে এনেছে। কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন মীরা। তাঁর প্রতিরোধ একজন রাজার বিরুদ্ধে, সেই রাজা যিনি তাঁর “স্বামী”ও বটে। পিতৃতন্ত্রের ক্ষুদ্রতম এককটি হল স্বামী, বৃহত্তম এককটি হল রাজা (শাসক অর্থে)। মীরাবাঈ একই সাথে প্রশ্ন করেছেন নিজের ঘরকে এবং সেই প্রশ্নের আবর্তন প্রতিবাদের পরিসর ক্ষমতার সর্বোচ্চ কেন্দ্রকে ঘিরেও। তাঁর প্রতিরোধ, নিজের বেছে নেওয়া জীবন থেকে কখনও সরে না আসার জেদ, সর্বপরি তাঁর স্বকীয়তা তাঁকে আজও প্রাসঙ্গিক করে রাখে।
১
বেরঙ হয়েছি তাহার আশে;
লোকে ভাবে ধরেছে রোগে।
ছুড়ে ফেলে সব অজুহাত,
দেখা হোক বারবার “দৈবাৎ”।
তারা পাঠিয়েছে বদ্যি;
নাড়ি টেপে সে
কখনও বা টানে হাত;
কোথায় ব্যাথা
সে বুঝবে কেমনে?
মনের গহনে আঘাত।
চলে যাও, ওহে বদ্যি
আমায় ডেকো না
তাঁর নামেতে আহত আমি
ওষু্ধে কাজ হবে না
মধুভান্ড দুই ঠোঁট তাঁর,
তাতেই বাঁচবে প্রাণ;
মীরার প্রভু গিরিধারি
সে মধু করাবে পান ।
২
যন্ত্রনার পুঁটুলি এই দেহ,
এরে ছাড়ি কেমনে?
এতো রণছোড়াই শেঠের
এতো শ্যমলসা শেঠের
এরে ছুঁড়ে ফেলি কেমনে?
বালি তেঁতে ,পুড়ে যায় পা
গরম বাতাসে জ্বলে ওঠে গা
এরে ছুঁড়ে ফেলি কেমনে?
মীরার প্রভু গিরিধারি
তাঁরেই পাওয়ার আশ
ছুঁড়ে ফেলি কেমনে?
কেমনে ছাড়ি এ বাস?
৩
আমি সত্য শুধু তাঁরই কাছে
ওগো, শরম কি আছে
এখন, নাচতে লেগেছি সবার মাঝে
দিনে আমার ক্ষুধা নেই
নিদ আসে না রাতে
জঞ্জাল ফেলে ওপারে গিয়েছি
জ্ঞানের শিখা হাতে
মৌমাছি মত আত্মীয় যত
ঘিরেছে চারিপাশ
মীরা শুধু জানে গিরিধারি
মীরা প্রভুর দাস
করুক তামাশা সকল লোকে
মীরা্ কিছু মানে না
গিরিধারী বিন জানে না।
৪
কুলের পর কুল খেয়ে ভীল মেয়ে তাঁকে দেওয়ার যুগ্যি কুলটি খুঁজে পায়,
এ কেমন আদব মেয়ের?
সুন্দরী নয়, গরিব নিচু জাত
শতচ্ছিন্ন বাস
তবু, রাম সেই ফল খান, নষ্ট, এঁটো ফলটি খান
এ ফল ভালবাসার, হৃদয়ে জানেন
এ মেয়ে যেমন শুধু জানে ভালবাসার স্বাদ
আর রাম জানেন না কোন উঁচু , নিচু ভেদ
কোন বেদ পড়েছে এই মেয়ে?
বিদ্যুৎবেগ রথে চড়ে তবু স্বর্গের দিকে ধায়!
শুধু প্রেমের বাঁধনে বেঁধে প্রভুর সনে
সে মেয়ের মত যে ভালবাসে
তারই তুমি আশ্রয়
গোকুলবালা মীরা তোমার দাস,
পার করাও তারে
পার করাও এবার ।
Posted in: November 2019, Translation