গল্প : সিন্ধু সোম
লোডশেডিং
মাঝরাতে মশারির জালে জিভ জড়িয়ে গেলে দীপকের আঁঠালো ঘুম ছত্রাখান হয়ে মিহি মোরাম জমায় মুখের চামড়ার ওপর। থু থু করে দেড় মিনিট হাওয়া থোকে দীপক। কিছুই বেরোয় না। জিভের ডগায় ফেভিকল দিয়ে কেউ অস্বস্তিটা এঁটে দিয়েছে। পাখাটা কেতরে থেমে আছে! লাইন নাই। কোলিয়ারির মুফতের লাইন। আজ তিরিশ বচ্ছর হয়ে গেল গ্রামে লাইন এসেছে। একটা দিন সেই কথা ভুলতে দেয় নাই খানকির বাচ্চারা! আর সঙ্গতে হরিবোল দেয় দীপকের মায়ের তোলা দালানের পনেরো ইঞ্চির দেয়াল! চোত মাসের শেষ থেকেই জীয়ন্ত উনুনের পারা গরম পুষে থোয়। বুক বটে একখানা! নরকের আগুন রাখে বুকে। একতলা এই পাকা ঘরের ছাতে এই সময় কয়েক আঁটি খড় বিছিয়ে রাখে দীপক। তাতে সন্ধে অবধি খানিক আরামে কাটে বটে কিন্তু রাতের সোহাগ ঠেকায় কার বাপের সাধ্যি! সারাদিন দীপক থাকে কারখানায়! দালান হারামিও তাই ঠাণ্ডা থাকে বেবাক। ঠিক দীপকের ফেরার সময়টির অপেক্ষায় সে যেন ওঁত পেতে থাকে বুকের ওম নিয়ে। ঘরে ঢুকলেই তার সমস্ত গুমোট অস্তিত্ব এড়িচুমড়ি দিয়ে লাগে দীপকের পিছনে! লাথ মারো শালা এমন পৈতৃক ভিটায়। ঘণ্টা দুইও হয় নাই কমলার সায়া পূর্বস্থানে নামিয়ে রেখে চান করে এসেছে দীপক। আর এরই মধ্যে নিমজুড়ান জুড়িয়ে আসা ঘুম এমন টাঁড়ে মারা গেলে বাঞ্চোত কার না মাথা গরম হয়! ছাতের খড়ে একটানা খস খস আওয়াজ ওঠে। হাওয়া নাই তার আওয়াজ কেন? দীপকের কান খাড়া হয়। পেটতলানি কেমন খালি খালি লাগে! সারা দিন কুত্তার পারা খাটতে খাটতে তলিয়ে যাওয়া সমস্ত ঘুম অন্ধকার পেয়ে এখন বেরিয়ে আসে ও দুচোখের পাতা জুড়ে ঝোলাঝুলি শুরু করে। কিন্তু ফোঁপরা পেটতলানি আর সজাগ দুই কান নিয়ে দীপক ঘুমাতে পারে না। লাল চোখের শিরায় শিরায় বিরক্তি জড়িয়ে বাম হাত দিয়ে ঠেলে কমলার লেপ্টে থাকা শরীরটা সরিয়ে দিলে কমলা ঘুমের মধ্যেই শব্দ করে পাশ ফিরে শোয়। দীপকের সমস্ত পিঠে কলাপুকুরের পচা পাঁক প্যাচপ্যাচ করে এবং বুকের খাঁজে পাতলা অথচ স্পষ্ট বিরক্তি জ্বালা ধরায়। উঠোনের পাশেই শালার শাবলটা পড়ে পড়ে মরচে ধরছে। কমলার এই ছোট্ট মাথাটার মাঝামাঝি বসিয়ে দিলে কেমন হয়! সাদা খুলির আঁটুনি দেয়ালে ফাটল ধরালে বাতাস যায় কিছু! থকথকে ঘোলাটে দইয়ের ভাঁজে ভাঁজে লাল যন্ত্রণা মাখো মাখো হয়ে থাকে। কেন! সে দেখে নাই যখন বিমলের অ্যাকসিডেন্ট হল? অবিকল ঘোড়ার গোবর শুধু কাঁচা ফলারের পারা লাল সাদা মাখো মাখো! বড় রাস্তায় স্কুটার নিয়ে ওঠার সময় একটা ট্রাকে ছাতু করে দিয়ে গেছিল। আজ হঠাৎ দীপকের বড় বেশি মনে পড়ে। এই গরমে মনের ভেতরটা কি বাতাস পায় একটুও? মাগী সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমায়। সকালে কুলির কল থেকে জলটানা, কারখানা যাওয়ার আগে রান্না বান্না মায় সন্ধেয় ফিরে ছেলেটার বইপত্তর নিয়ে বসা – সমস্ত কাজ একা হাতে সামাল দিতে দিতে দীপকের হাঁফ উঠে যায়। নাকের ডগ কচি লাউ পাতার ওপর শিশিরের পারা চকচক করে। অথচ ওর কপালেই ভালো করে শোয়া জোটেনা কুড়িয়ে বাড়িয়ে। যার গতর, তারোই গাঁতালি। বাচ্চা হওয়ার পর থেকে কত বছর যে ঘুমায় নাই দীপক! ভাঙা পাঁচিলের অবসন্নতা নিয়ে গতর শালা ঘুম কুড়াতে পারে না। মদ্নায় আর জানবে কি! ঘুমও একটি পাক্কা হারামি বস্তু, হীরার পারা! না খোদলে আপন নুঙ্কু চোষো! আর কিছু জুটবে না! ও হাসিলের জিনিষ! বসে বসে পাবার নাই! খাটের সোয়াখানায় ঠেস দিয়ে আর মশারির আদ্ধেকটায় ঝুলতে ঝুলতে দীপক ভেবে পায় না কমলার অথৈ ঘুমের রহস্য! মাগীর এত ঘুম আসে কোত্থেকে কে জানে! ডিংলার পারা হ্যাঁচড়পাঁচইড়্যা চ্যাত্তেড়াঙ্গা হইঁ পইড়ি আছে দেখো! গোটা খাট ট শালা উয়ার বাপের সম্পত্তি! ঘুমন্ত বৌয়ের আঁচল ধরে দীপক বিমলের কথা টেনে আনে। বিমলের মুখটা আজকাল আবছা হয়ে আসে। ছবি দেখে মনের কুলুঙ্গি থেকে পাড়তে হয় মাঝে মধ্যে! সাকুল্যে ছবি দুজনের একটাই, তাও বাঁধিয়ে রাখা বিমলের বাড়ির মরা দেয়ালের গায়! ছোপ ওঠা কয়লার রঙ খাঁজে খাঁজে ধারণ করা দেয়ালে ওই একটিই রঙচঙে ফোঁকর! কিন্তু মরাবাড়িতে তো আর রোজ রোজ ছবি দেখতে যাওয়া যায় না! বিমলের মা কান্না শোনানোর লোক পায় না, একা বিধবা মানুষ! তো দীপককে ডাকে, বসায়, চুলের রুক্ষতায় হাত বুলিয়ে মমতার মোম দিয়ে নরম করতে চায় বিমলের মাথা। তারপর বেলপোড়া শরবতও আনে। কিন্তু কোলখালি হওয়া মায়ের চোখ বড় আকুল কুয়ার পারা লাগে দীপকের। যে কুয়ায় টুকচা উঁকি দিলে তলাইঞ্জেইতে মন হয়! তাই ইদানীং বিমলের বাড়ির সামনের পথটুক ঘুরে অন্যদিক দিয়ে বাড়ি ফেরে দীপক। অ্যাক্সিডেন্টের আগে বিমল একদিন বলেছিল যাদের চিন্তা নাই, তাদের ঘুম ভালো হয়! চিন্তা শালা আবার কার না থাকে? মানুষ পয়দা হলেই কপালে চিন্তার দাগা লাগে না! বোনের চিন্তা, বাপের চিন্তা, মায়ের চিন্তা, দিদির চিন্তা, সংসারের চিন্তা, ছাঁটাইয়ের চিন্তা ছাড়া মানুষ হয় নাকি? দেখে নাই দীপক। তাইলে কি খানকির বাচ্চারা ঘুমায়ই না কেউঅয়? এই তো কারখানায় হায়দার আলি এই গরমে ফ্যান না চালিয়েই যখন তখন যেখানে সেখানে বসে হেঁড়োলের পারা নাক ডাকে! কারখানায় অবশ্য ফ্যান চালানো না চালানো সমান, কিন্তু ওই শব্দ, হৈ হাল্লা! ঠিক ঘুমায়। ওর শালা কি সংসার নাই? রাতদিন চিন্তায় মাথার চুল রাখতে পারে নাই, সব উঠে বেবাক টাঁড়! কন্ট্রাক্টর লেবারদের চিন্তাহীন জীবনটাই একটা বিশেষ চিন্তার বিষয়! তবু তো ঘুমায়! কিন্তু লোকটা খাটেও তেমন। পরিবারের জন্যে দিনরাত খাক কয়লা করে মুখে রক্ত তুলে ফেলে! এ মাগী মানুষ মনে লয় না! ডান বা শাঁকচুন্নী কিছু একটা হবে। নইলে নিজের বাচ্চার ওপরও মায়ের নিদেন কিছু টান থাকবে নাই? অথচ রূপ দেখো! বন্ধ নিটোল চোখের পাতায় ঢেউ খেলাইঁ মণি ইদিক উদিক দোড়াদোড়ি করে গুবচা খরগোশ হইঁ! কী দেখছে কে জানে! খাড়া নাকের ওপর ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। ঠোঁট দুটো বন্ধ পুরোন দরজার পারা আলগা ফাঁক হয়ে মার্বেলের দাঁত দেখা যায় একটা দুটা। কপালের সিঁদুর ঘষে ও ঘামে নেমে এসেছে নাকের বোঁটা অবধি। জেঠিমা মারা যাওয়ার সময়ও ঠিক এরম লাগছিল। শুধু সিঁদুর আর সিঁদুর। আলতা আর আলতা। মনটা নরম বাঁধে দীপকের। কমলার নিথর গলার টান টান চামড়া বেয়ে তার নীচের শাড়িটা সরে গিয়েছে এবং বুকের ডাগর ডালিমা মুখ চিতিয়ে রয়েছে ছাতের দিকে ঠার। ছাতের প্রসঙ্গে আবার দীপকের পেটটা মোচড় দেয়। ভুরু দুটো ভয়ের তাড়নায় বাসা খোঁজে ও ঘন হয়ে আসে। ছাতের শব্দটা এখন আর নেই। কিন্তু কমলার শরীর? ডাইনীর আখ্যান দীপকদের গ্রামে আজও শোনা যায় মাঝে মধ্যেই। বুড়ি হলে ফস করে চেনা যায়, তাই রক্ষে! কিন্তু যোব্তীদের চেনে কার বাপের সাধ্যি! এই রকমই শাঁসালো বুকের ভেতরে বেবাক পোড়া কাঠ। সে কাঠ দিলেক গুইঁজে হয়তো মরদের গাঁড়ে! লাইগতে আইসিছ কি মইরিছ বাবা! কলজের বালাই নাই। খাটের উল্টো দিকে অন্ধকারে মিশ খাওয়া কমলার পা দীপকের চোখে পড়ে না, অথবা সে ওদিকে তাকানোর সাহস করে উঠতে পারে না! যদি ওল্টানো হয়! বুকের ভেতর হাতুড়ির শব্দটা ক্রমশ বাড়তে থাকে। কমলার ঠোঁটটা নড়ছে না? ওকি! গুলের গুঁড়ার দানা বাঁধা অন্ধকার বেরায় বুঝি! নাহ্! বেরায় নাই! তবে এবার বেরাবে। অনিদ্রার ক্লান্ত রগ উত্তেজিত ছিলার টান সইতে পারে না! মাতালের পারা টলতে টলতে দীপক ছাতে উঠে আসে।
দু একবার ইতস্তত বোধ হয়। হাত ঘামে। পা শ্যাওলা ধরা বাথরুমের মেজে হয়ে হড়কে আসে। ছাতের দরজার আগল হিসেবে বেওহার করা হেথা হোথা তপসানো লোহার পাইপটা হাতে শক্ত করে ধরতে গেলে তাতে পাঁকাল মাছের গন্ধ লাগে। তো কাপড় সামলে সারা মুখে চোঁয়ানো অস্বস্তি কাত করলে দীপক বুকে বল পায় এবং মরচের আলপনা পড়া দরজায় একটা জোর হাড়কাঁপানো ধাক্কা দেয়। ঝোড়ো ধাক্কায় হুড়ুমদুড়ানি খোলার বয়স দরজার পেরিয়ে গিয়েছে বহুদিন। বয়স্ক আফিমখোরের আপত্তি বুকে প্রচণ্ড ক্যাঁচ কোঁচ শব্দের সঙ্গে একটা ভারী ধাতব অনুরণন নিয়ে জরাগ্রস্ত ঘাটের মড়া দরজা কাঁপতে কাঁপতে দোল খায় ও সরে একটুক-টুকানি করে। কোথায় কী! ছাতে টুকচা হাওয়া পর্যন্ত নাই! গুমোট নিথর আকাশে মেঘ আছে অনুভব করা যায়। একপেশে ঘোলাটে স্তিমিত চাঁদ ঝোলে অন্ধকারে, তবে মাঝে মধ্যেই ঝুলের পারা সূতাকাটা মেঘ ভেসে তার অস্তিত্ব কেড়ে নেয়। এখান থেকে কুলির ঢালাই পথ নজরে আসে। কুলিটা দেখায় বেবাক ফাঁকা। ভুতুইড়া গাব বুকে ভয় পোষে উত্তরাধিকারে। কতজনের কাপড় ভিজাইন্দিঞ্ছে তার রাক্ষুসে ঝাঁকুড়া মাথা। কেউ কেউ বলে ওখানে কাউকে ঝুলন ঝুলতে দেখা যায় মাঝে মধ্যেই। অথচ দীপক জানে ওই গাবের তলায় মিলন খ্যাপা শোয় রোজ। রোজের গপ্পো! তার ভূত নাই, আগুড়ি পিছুড়ি মার খেয়ে গেছে পাগলা খেতাবে। কাজেই তাকে কেউ বারণও করে নাই কখনও! দূর থেকে নজরের জাল গুটিয়ে কাছে এনে ফেললে ছাতটা দীপকের বুকের পারাই ধুকুর পুকুর করে। খানকির বাচ্চা আইলক্যুটুইনা কথাটোর চিন্তা কুটকুটাইঁ কামড় দিছে খালি! এইও শালা জলট্যাঙ্কির পিছনটা? দেখবে? পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলে পাতলা নেশার পারা ভুসোমাখা ৫০০ লিটারের ট্যাঙ্কি আর প্যারাপিটের মাঝের নীরব ফাঁক গুলো মিহি চাঁদের ছোপধোয়া দাঁত বার করে হালচাল পোছে! একটু হতাশই হয় দীপক! এখানেও বাঞ্চোত কেউ অপেক্ষায় নাই? শঙ্করদার ছাতটা ওদের হেঁসেলের গা ঘেঁসে শোওয়া। দিন কতক আগে শঙ্করদার ছেলে, নান্টু, ঠিক এই ট্যাঙ্কির ওপরে কাকে যেন বসে থাকতে দ্যাখে! কালো মতন একখান শরীর। উবু হয়ে বসে কি যেন মাপামাপি করে! পলক ফেলতে না ফেলতেই গায়েব। আর দেখা যায় নাই। তাই নিয়ে হেই হুদুইমা হৈ হুদুইমা তক্কো হয় কুলিতে কয়দিন। কাউকে বলে নাই দীপক কিন্তু বিমলের কথা ফিরে ফিরে মনে লয়। বিমইলা ছোঁড়া ঠিক ওমন করেই ট্যাঙ্কির ঢাকার ওপর চড়ে বিড়ি খেত। শঙ্করদার চোখে পড়বে বলে কত্তবার বারণ করেছে দীপক। শোনে নাই। খড়ের গাদার ওপর বাতাবি পাতার ছিট ছিট ছায়ানক্সা ছোপ ধরালে দীপকের চোখ আরো সজাগ হয়। যেন ভালো করে নজর করলেই সামনে পাতলা পায়খানার পারা ছিটানো অন্ধকার তাল পাকাবে। একটা মুখের অবয়ব খোঁজে ও। পায় কই? পায় না! সে মুখ ছাতুমাখা হয়ে গিয়েছে যেন কয়েক জনম আগে! দুবছরের খড়ির দাগের ভিতর টপকে সে মুখ কোঁদার কাজ পাড়ার সীতাহরণ পালায় সীতা সেজে সরু গলায় চিৎকার করার চেয়েও ঢের কঠিন হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে! মনটার ভুজুং পেড়ে বোঝাতে হয় – আরো, আরো বল দিতে লাইগবেক, এইটুকচা মনের বলে কি আর দেখা যায়! তবে নাম ডাকলেও আসে শুনেছে দীপক। নাম ধরে ডাকতে গিয়ে নিজেরই ফ্যাঁসফ্যাঁসে বাতাস শুনে আরেকবার বুকের কাছটায় ইঁদুর দোড় শুরু হয় দীপকের। গোটা পাঁজরায় বাঞ্চোত শ ডজন গত্ত। গা গুলায়। নাহ্! এভাবে খোঁজ লাগানোর মানে নাই! আস্লে কি আর বিমল দীপককে না দেখা দিয়ে থাকতে পারবে? অতদিনের ইয়ার! আচ্ছা জলট্যাঙ্কির ভেতরটা? ঐখানটা তো উঁকি দেয় নাই! দীপকের আলগা হয়ে আসা লোহার মুঠটা শক্ত হয় আরেকবার। ঢাকনা তুলে ফেলতেই একটা ভ্যাপ্সা গুমোট মুখে ধাক্কা মারে এবং দীপকের ভুরুর থেকে ঘাড়, ঘাড়ের থেকে থুতনি হয়ে পাক দিয়ে দিয়ে ওঠে খালি। হাঁ করে থাকা গহ্বরের ভেতর থেকে একবেলার বাসি ভাপ শূন্যে উড়াল দেয়। একফালি চাঁদের আলো সেই হাঁয়ের এককোণে পড়ায় জলের ওপর দাগটা দুলুনিতে বোঝা যায়। কিন্তু তল নাই। মেঘ ভরা আকাশদেয়ালের গালে থোকা একদলা জমাকফ নিবু নিবু সব্জে চাঁদের রূপ নিলে দীপকের মনে হয় এই অসীম অনন্ত সুড়ঙ্গ সোজা নেমে গিয়ে ঘা জমিয়েছে নরকে! তারই তাঁত পায় চোখে মুখে। তবে ওই পথ বেয়েই তো ড্যাকরা বিমল দিব্য আসতে পারে! বাঞ্চোত ভাও খায়! দুই দুইটা বচ্ছর ইয়ারের সাথে আড্ডা জমায় নাই দীপক। কম বাজা বাজে? বুকের গোড়ায় চিনচিনানি বোল ধরে। কিম্বা হয়তো এসেও থাকতে পারে। দরজায় কমলা কালীর ফটো চিপকায়ে রেখেছে। শালা গোঁত্তা খেয়ে ফিরে গেছে বার দুয়ার থেকে নিশ্চয়! ঢুকার পথের হদিস পাই নাই! মাগীর কথার ওপর আর কথা চলে কই! জন্ম বড় কম লয় হে! সেই আগুন্যাবুকো একাত্তর সাল! চল্লিশ ঢলে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই হতে চলল প্রায়! রগ পাকে তার দাড়ি পাকে! রোজ রোজ কামানোর বড় হুজ্জত! দীপক থুতনির নীচে কাঁটার মতো বিঁধতে থাকা মর্দানগিতে হাত বুলিয়ে বড় আত্মপ্রসাদ অনুভব করে। জন্মসালটা এখন মনে করলে প্রাতঃকৃত্যের মাঠের কুয়াশা নেমে সব আবছা হয়ে আসে। কুয়াশা আর আমের বোল মাখা গুয়ের গন্ধের দিন গ্যালা নিথর ময়াল সাপের পারা চিত হয়ে পড়ে রয়। লড়ে চড়ে না। সেই ধোঁয়াটে জন্মাবধি বিমল আর দীপক দুজন দুজনকে সবটাই বলে এসেছে। বলার লোক পেলে মুখে খই ফোটে না শালা কার? পুকুরের সাঁতার থেকে চড়ুই ধরে রঙ করা, কুত্তা ঠ্যাঙ্গানো চড়া তানের দুপুর, দীইপকা গুরু, বিমইলা অনুচর! সেই বিমল কি নরকের কথা না বলে রইতে পারে দীপককে? অপঘাতে মানুষ মুক্তি পায় না। আর মুক্তি কার না বিমইল্যার! অতো মুক্তি ধুইঁ কি জল খাবে শালার বাঞ্চোত! মুক্তি হোক তাও চায় না দীপক। কথা! অল্প কথা বলার লোক চায়! কথা বলে হাজার জনা, কিন্তু শালা কেউঅয় বলে না! মান্সে বুঝি জেবনে একবার একজনার সাথেই কথা কয়! সে ওই বিমলের পারা কেউ। তারে ডাক দিতে লাগে না, কথা পাড়তে লাগে না! দোস্তো কথা সমঝে লেয় ঠিকোই! আজ লয় বিমইল্যার দুটা কথার উত্তরে নিজের সেই কথাটো বইলে লিবেক উ! দীপক ভেতরের চাপা কথাটার ওপর থান ইট কলজে চাপায় ও ট্যাঙ্কির ঢাকা যথাস্থানে লাগিয়ে পনেরো ইঞ্চির প্যারাপিটের ওপর আয়েস করে বসে। গাঁড়ের ভাঁজে ওম লাগলে মন্দ লাগে না! রগে জমে ওঠা কয়েক পুরু ঘাম হাতে ঝেড়ে ফেললে দীপকের মনে হয় সে দেখতে গেলে ওর বাপের কেসও তাই। ছিল কম্পাউণ্ডার। মরল নিজেরই হাসপাতালের ডাক্তারের ভুল সুঁইতে। গোটা শরীর ফুলে গেছিল নাকি! তা অত মনে নাই চার বছর বয়সের কথা। বাপ খুব নামী মানুষ ছিল লোকের কথায় আর ওর বাপের নামে গাঁয়ের লাইব্রেরীতে স্পষ্ট! তাতে ছিঁড়া যায় বালটারে! বাপের অবদান ট তবে হইল ট কি? যে বাপ শালা ছেলের গেরাস নিজে দিতে পারে নাই পেরাই সারা ট জীবন তাকে লিয়ে খোয়ারি চইলতে পারে, প্যাট চলে না! মরার কে দিব্যি দিঞ্ছিল অত জলদি! বাপকে দীপকের মনেই পড়ে না প্রায় কিছু, শুধু ঘোল পাকানো আকাশের মেঘের ওপর রাগ হয়! মন্দ হয় নাই, মইরিছে! বেঁচে থাকলে বাপের মাথাটও ফাঁক কইরে দিথ না উ! ঘন ঘন শ্বাস বাড়ে দীপকের! মুঠো পাকানো হাত নিয়ে দীপক গুটি গুটি উঠে যায় খড়ের নীচু মাচা পেরিয়ে ছাতের জলনিকাশি ফুটোর সন্ধানে। সেখানে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে নিরলস চেষ্টা করলেও দীপকের পেচ্ছাব পায় না তবে ঠোঁট গোল করে হুশশ হুশশ শব্দের জবাবে এক দু ফোঁটা বাধ্যতা বেরিয়ে আসে। পুরুষাঙ্গের মুখটা সঙ্গে সঙ্গে চিড়বিড়িয়ে ওঠে। দীপকের মনে পড়ে অনেকক্ষণ জল খাওয়া হয় নাই। তারপর ঘামের আক্রমণে প্রায় রক্তাক্ত পেচ্ছাপের শোকপালনে এবং সম্ভবত বাপের ওপর পরত পরত রাগে জমতে থাকা কফ গলা থেকে টেনে তুলে দীপক এক কোণে থোকে এবং আবার প্যারপিটে বসে গাঁড় সেঁকে মন নরম করে। ওভাবেই বসে থাকতে থাকতে দীপকের একসময় মার কথা মনে পড়ে। পড়ার প্রায় সঙে সঙ্ যেন গরম মাথার কড়াইয়ে জল ঢেলে নামিয়ে দেয় কেউ। এতক্ষণ অপেক্ষার ফুটে ক্ষিদা মরে ঘন হয়ে বগলের নীচে বাঁদিকটা চিনচিনানি শানায় আবার! একা আয়ার কাজ কপচাইঁ দুই মেয়ে এক ছেলের বোঝা ঘষটে এতদূর এনেছে বুড়ি। এলেম নাই? বাড়ি থেকে পাঁচ মাইল হেঁটে ডিউটি যেত রোজ। শীত গরম বর্ষা ভ্রুক্ষেপ নাই! বাপ ট শালা দুনিয়ার লোকের ভালো কইরে গুচ্ছের ঋণ রাইখে মইরি গেল সকাল সকাল! কাঁচা মাটির ভিটা রেখে। সেই মাটি ঘামের আগুনে দিনরাত এক করে পুড়ায় ইঁটের ভিত তক্ক মাইই থোয় তিন ছেলে মেয়ের হাত ধরে, একার রোজগারে! সরু ক্ষয়াটে ভাঙ্গা হাড়গিলা পথের ধারবাথানে সেই সদ্য পাকা ভাপ ওঠা উঠোনের কালিতে বসে তিন ভাই বোন অপেক্ষা করে আজও মায়ের আসার। বোন চোখ বুজে নাক খোঁটে। অন্ধকারের মধ্যেও ঘোড়াছাপ স্পষ্ট দেখে দীপক। ওই তিনজনাও কি নরক থেকে হাঁচইড়ে পাঁচইড়ে উঠে এসেছে? মেঘের ঝুরিভাঙ্গা ছাতাপড়া গালে অবিকল মায়ের রেখা। মায়ের কাছে মন্তর নাই ছিল ম্যাঘ ভাগাবার? মুখ ট জীর্ণ গরুর পারা উঠাইঁ বইলত বুড়ি, “কাশ্যপগোগোইত্র খাঁকার দিইল, আইল ম্যাঘ উড়ে গেইল!!!” মা মাগীর বড্ড ছেলে ছেলে টান! এখনও! অনেকটা সেই কারণেই দীপকের মনে হয় ওর পড়াশোনাটা হয় নাই! দিদি হেড দিদিমণি, বোন উকিল একা দীপকেরই এই যে কিছু হয় নাই, জুটল কন্ট্রাক্টরের আণ্ডারে লোহা বওয়ার কাজ তার পিছনে কি তার একার হাত! গুষ্ঠিতে এক ছেলে! যারা লাই দিয়েছিল তারা ভাত দিল নাই কেউ! মাল খাওয়াবে মেলা লোকে ভাত দিবে নাই একজনা বাঞ্চোত! মাধ্যমিকটা অন্তত আরেকবার দেয়ার জন্য জামাই বাবু তখন অনেক করে বোঝালেও কথা কানে লেয় নাই দীপক। রোয়াব ছিল কত! সমস্ত রোয়াব এখন গুটি গুটি বেরিয়ে এসে গলায় চাপ বসায়, বুকে দাঁত বসায়। উপরের চামড়ায় হাত ফিরালে ভিতরের বাড়তে থাকা ক্ষত টের পায় দীপক। মায়ের কথা ভাবলে মনটা বড় ঠেস খায়। সেই লবলইব্যা বিশাল কাঁধ মায়ের, বুক ভত্তি অপার দুধ, সেও বয়সের ভারে কেমন ছোট হয়ে কুঁচকে গেল সবজির চিকচিকির পারা! পড়ে পড়ে কষ্ট কম পাছিল ইখানে! কমলা খেতে দিত নাই। নিজেই নড়া হাতে টুকচা চাল ডাল ফুটিয়ে দুটি দাঁতে কাটত কোনোরকম। জল বয়ে বয়ে ছোপ্যুনা বুকটায় শ্যাওলা টাটাতো খুব। রান্নাঘরের পিছনের দেয়াল অবিকল। সেই শ্যাওলার গা চোঁয়ানো স্যাঁতসেঁতে কি একখান কাশি ধরিয়ে বসে সারাক্ষণ জল ঘেঁটে ঘেঁটে। সে কাশি আর থামতেই চায় না। নাকের সিকনি মুখে গড়ায়। ড্যাম্পের ছাড়া জলের পারা নালা উপচিয়ে যায়! কমলার ভয়ে ডাক্তার পর্যন্ত দেখাতে পারে নাই দীপক। মাগীর মুখ কি! আর কথায় কথায় ফলিডল দেখায়! দীপকের খুব বলতে ইচ্ছে করে যারা খাওয়ার তারা অত ভওকে না রে বাল! কিন্তু কমলার সামনে ওর জিভে তালা মেরে রাখে কেউ। বলেছিল দিদি! কমলার ব্যাভারে দিদি বোন দুইই বাপের বাড়ি আসেই না প্রায়। সেবার হঠাৎ ঘুরতে এসে মায়ের অবস্থা দেখে দিদির মুখ আমড়াতলা শ্মশানে লাশজ্বলা ধোঁয়ার পারা থমথম করছিল। কমলাকে ডেকে খুব ভদ্র ভাবে বলেছিল, “তোমার বাবা মা নেই? শেখায় নি কীভাবে বয়স্ক মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়? তাঁর বাড়িতে থাকো, তাঁর খাও, পরো তারপর মায়ের সঙ্গে এই ব্যবহার করতে তোমার রুচিতে শিক্ষায় বাঁধে না? তোমাদের আজ বার করে দিলে তোমার বর তোমাদের খাওয়াতে পারবে তো একার টাকায়?” কমলা জবাব দেয় নাই কিছু। দিদির পাহাড়িয়া ব্যক্তিত্বের সামনে ওরো মুখে লাল কাটে শুধু! মুখ নড়ে আওয়াজ বেরায় না। তা ছাড়া রুচি শিক্ষা এইসব লোহা গদ্দ ভারী জিনিসের আঁচই নাই কমলার! শুঁধাই দেখ! এক মেয়ে, বাপ পুলিসের চাকরগিরি করে। লাই খেয়েছে আর ঘুমানো শিখেছে খালি! কুত্তি! এখন মায়ের তক্ত খায়, দীপকের রক্ত খায়! সেদিন ঝাড়ও খেয়েছিল নির্বিকার টানা আধ ঘণ্টা। দীপকের জন্যে শালা সেইটা গিয়ে দাঁড়াল পাক্কা দুই ঘণ্টা! “তোর শিরদাঁড়া টো ইয়ার পর মাইক্রোস্কোপ দিয়েঁ খুঁইজতে হবেক রে! বউ খেইতে দিছে নাই, মাকে ফেলাইঁ রাইখিছে কুকুর বিড়ালের পারা। তোর অন্ন নাইমছে মুখ দিয়েঁ? বউয়ের তোর এত সাহস হয় কী কইরে? আর তুই কিছু বইলতে লারিস? ক্যানে মাকে মুখ করার সময় তো বড় কথা বিরায় তোর? কি ছিলা মানুষ কইরিছে রে ভাই মা তাই ভাইবছি! তাও দীইপকা দীইপকা কইরে অস্থির! শুন, মায়ের যদি কিছু হইঞ্ছে, আমি কিন্তু আদালত তক্ক যাবো! জেলের ভাত খাওয়াবো তোদের দুইজনাকেই! যা পারে কইরতে বলিস তোর শ্বশুরকে! আর আইজকের পরে মা ইখানে থাইকবেক নাই! আমি লিইঞ্জাছি। কুকুর বিড়ালের পারা শেষ হইতে দিব নাই মাকে আমি! জীবন ট প্রায় শেষ হইতে চইল্ল, এখন অল্প আরামে বাঁচুক! তুই করিস কি কইরে রে! কি করে নাই মা আমাদের জইন্য? একা লিজের পায়ে আমাদের ঐভাবে আগ্লাইঁ রাইখিছে ভাই, তুই সব ভুইলি গেলি বউ পাইঁয়ে?” দিদি কিছু বললে দীপক মাথা নামিয়ে থাকে। কথা বলতে পারে না কোনোদিনই! তা কারই বা বিরোধে জোর গলাটা ওঠে শালার পুত! ওঠে না! সে গলার জোর নাই। তাই বিমল আসে না ডাকলেও! তাই কবিতা ওকে ল্যাং মেরে শঙ্করের গলায় ঝুলে পড়ে। ল্যাং খেয়ে বিয়ে না করার সঙ্কল্প নিয়েও খানকির বাচ্চা বিয়েটা করতেই হয়! না করলে বাল কে ভুগত এত! দুটি আনত খেত, দিব্যি রইত! কিন্তু কপালে নাই শালা হয় কার বাপের সাধ্যি! ইয়ার আগে দিদি কোত্থেকে এক কালো মেয়ের সম্বন্ধ আইনিছিল! একদমই হজম করতে পারে নাই দীপক! দিদির উপর খুশি হয় নাই মাও! তুইঁ শিক্ষিত! অল্প ভালো মেয়ে আইনবি নাই? শালার মেয়ে কালোর কালো ভূত, তাই সে আবার নাকি টিউশনি করে বাপ মাকে দেখে! বিয়ে কইরে তাপর বাচ্চাগেলা কালো হোক! বংশে ঢালো কালি! আবলুসের রঙ মান্ষে ছাতে ঢালে, ঘরে তোলে না! ছোঃ! মায়েরও পছন্দ হয় নাই! ফরসা রুপসী দেখে মাইই কমলাকে পছন্দ করে এসেছিল। সে আগুন এমন করে কপালে খরা বয়ে আনবে যে জানতটা কোন শালা!
বাতাবি ঝাড়ের পিছনতলায় রায়দের চওড়া বাগানে হিস হিস করে হঠাৎ বাতাস উঠলে দীপকের আবার চোখ টানে এবং ও প্যারাপিটে শুয়ে পড়ে। হাওয়ার শব্দ শেষ হয়ে আসা নলের জলের পারা শ্যাসসসসস্ শ্যাসসসসস্ করে কাঁপতে কাঁপতে বিমলের গলার স্বর হয়ে ওঠে একসময়। দীপক চোখ মেলে অন্ধকার বিনা কিছুই দেখার নাগাল পায় না! তবে খানিকক্ষণের নিরলস চেষ্টা করলে বিমলের কবন্ধ শরীরটা নিজেই ঘোঁট পাকায় অল্প অল্প করে হেই খাবলা হুই খাবলা অন্ধকার ছিঁড়ে। ঠিক কবন্ধ না! ভাঙা হাঁড়ির তলোদেশের পারা ফুটিফাটা চোয়াল আর খুলির পিছনের হাড় টুকুর মাঝে একটা গভীর খোঁদল। তার উপরে আর কিছু নাই। মুখ নাই তার লাশ চিনার অলগ কৌশল আছে! গায়ের গেঞ্জিতে মাইয়ের ঠিক দুই কাঁটি ওপর একটা হুড়ুইল্যা ফুটা! এই বেনিয়ান ছিল বিমলের গায়ের চামড়া। মরার পর ওর লাশের গায়েও এই বেনিয়ান লেপ্টে ছিল খুউউব। মাস গেলে বিমলের মা জোর করে গা থেকে খুলিয়ে না নিলে সে আর কাচাই হত না! তারই সাক্ষ্য লয় ওই ফুটা? ভালোলাগার বস্তু বড় হারামি মনে লেয়! উয়াদের দূর দূঊঊর সরাইঁ রাইখে দেখ! মনে হুল দিবেক ভোমরার পারা। কিন্তু নিকটে রাইখিছ কি মইরিছ! জত ল্যাপ্টাইঁ রাইখবে তত পচন ধইরবে মাঝরাস্তায়! হড়পাভুইতা বিমলের মাথা ট নাই তাই লাগে যেন বুকের মরম থেকে গমগইম্যা শব্দ উঠে আসে! ট্যাঙ্কির ঠিক উপরের আসনটায় বসে বিমইল্যা বলে, “শালা তোর বৌ বাচ্চা নিচে রেইখে তুই ইখানটতে শুছিস ক্যানে? যা নীচে যা!”
“তোর সাথে কদ্দিন কথা বইলি নাই বিমইল্যা! অল্প থাইকতে দে!”
– না না! ইয়ারপর শালার জ্বর গা বেদ্না হইলে কাম হবেক? পয়সা কাইটবেক নাই কনট্রাক্টর?
– কনটাকটোরের মাইরো গাঁড়! গেলবার পাঁচ মাস পর দিইঞ্ছিল। ইবারও মাস দুই হইতে চইল্ল বেতন দিছিল নাই! তার উপর আইজগে…
– তবে তো দিদি ঠিকোই কইরিছে! মাসিমা কে লিয়ে যাইঁ? খরচা কম, উপরি মাসিমার এম আই এসের টাকাটো পাছিস!
– তাথেও কুইলাছে কই শালা! ধার কইরছি, কারখানার সেই বিশু ছিল নাই? আরে তুই দেইখিছিস, রাম খাওয়ালো নাই সেবার? ছিলার অন্নপাশোনে? হঁ! উয়ার কাছকেই ধার কইরি।
– ক্যানে? শঙ্করদা? গাঁয়ের লক, পাশের লক! লিস নাই ক্যানে? আগে তো লিথিস?
– আরে বাঞ্চোত গাঁয়ের লোক মহা হারামি। আজ ইয়ার কাছকে লাগাবেক, কালকে উয়ার কাছকে! ভদ্দরলোকের ছিলা হওয়ার বাওয়াল কম শালা! আমাদের হায়দার আলিকে অইসব চুতমারানি কথা শুনাইলে এক, আমার কান লিবার পারে না! ইরি ফ্যালেট কিনিছে জানিস? গরাই রোডের উপর। সেকণ্ড হ্যান্ড! মাত্র দশ লাখে পাইঞ্ছে! কাল খেইতে ডেইকিছে।
– দশ লাখ? শালা এমন বইলছে যেন কারি পাত্তা! তুই শালার দশ লাখ চোখে দেইখেছিস কখনও?
– তা দেখি নাই! কিন্তু ইরি বইলিছে সস্তায় পাইঁঞ্ছে। তুই দেখিস নাই বিমইল্যা দশ লাখ? ছাইড়, আজ যা হইঙ্গেল তার পর আর…… শুন কেনে…
বলে কিছুক্ষণ বিমলের মনোযোগের জন্য অপেক্ষা করে দীপক অন্ধকারে। কথাটার উত্তর আসে না। দীপক সচকিত এদিকে তাকালে বিমলের শরীরটা ভাঙা মাথাতলানি নিয়ে তরলের পারা ট্যাঙ্কির ঢাকনা গলে নেমে যায়। দীপকের মনে হয় বিমলকে দশ লাখের কথা শুধানো ঠিক হয় নাই। হয়তো রাগ হয়েছে! কিন্তু কথাটো? যে জন্যে আজ দুই বচ্ছর পরে বিমলের দরকার পড়ল দীপকের সেটা ঝুলে থাকে বৃষ্টি না হওয়া মেঘের পারাই। নাকি বিমল জেইনে লিইঞ্ছে? উয়ারা অল্তর্যামি হয়! হুঁ হুঁ বাওয়া! কেনে ফটিকের বাপ কেমন ফটিককে মাল খেইতে বারণ টো কইরে গেছিল? মনে নাই আবার! ফটিক যে ফটিক কারো সামনে কুইনু দিন মাল ছোঁয় নাই, উয়ার ঐ বাঁধা শুঁড়ি ছাড়া কেউ জাইনথ নাই গাঁয়ের লক, তার বাপও জীয়ন্তে জাইনতে লাইরিছে, মরার পর ঠিক আইসে বারণ টো কইরি দিইঙ্গেছিল উয়াকে! শুঁড়ি থেইকে চুর হইঁ ফিরার পথে গাঁ দুয়ারের পাকুড় গাছ টোর তলে ফটিক দেইখলেক উয়ার মরা বাপ ভর আন্ধারে দমে হাত লাইড়ছে আর ঠোঁট বিড়বিড় কইরছে। বাপ তো বাপ, তাই শুরুয়াদে ফটিক ভয় পায় নাই। দুপা এগাইঙ্গেছিল। তাথেই উয়ার বাপ আকাশের দিকে মুখ টো তুলে যে হাঁকার দিলেক বাপোঃ! সেই হাঁকারে ফটিক পেরায় লুঙ্গি ভিজাইন্দিঞ্ছিল। হাঁকারে ফটিক পস্টো শুনে “মাল ছাড়, ফইটকা রে, নির্বংশ হইঞ্জাবি!” ব্যাস ফটিক উল্টাইঁ ইট ভাঁটার কাছকেই পইড়িছিল বাকি রাত টো। ভোরে চ্যাতনা আইলে বাড়ি ফিরে। এক দোস্ত ঐ শুঁড়ি ছাড়া আর কারেও বলে নাই। বেবাক চেইপে যাছিল। তবে কথা কাঁহাতক চেইপে রাখা যায়? দীপক বুইঝছে নাই আজ? কথার ওজন বড়ো তিতা হে! শুঁড়ি গোপাল মণ্ডল দিলেক ফাঁস কইরে! কিন্তু তখন আর কি! সাপ তখন গত্তে। আর কুনোদিন মাল ছোঁয় নাই ফটিক। অল্তর্যামি লয়? উয়ারা সব জানে। ভাবার পর এক মুহূর্তের জন্যে দীপকের চোখে ছানি পড়ে। তবু আরাম। দুইটা মিশ খাইঁ গেলে চোখে এমনই জল কাটে বাল। তো দীপকের চোখ ছানি আর আরামে বুজে আসে। এদ্দিন পর বিমইল্যা আইল! দরশনের রাহত নাই? বাতাসে তার খোশবু লাইগিছে যেন। ফ্যাক্টরির উপহার দেয়া এখানে ওখানে ছেঁড়া ফাটা চামড়ায় হাত বুলিয়ে আরাম নেয় দীপক। হাওয়া বাড়ে। হাওয়ার শিরশিরানির ঝুম নেশা চড়লেও আজ আর বিমলের গলা শোনা যাবে নাই — চোখ না খুলেও এইটো মনছাপানি টের পায় দীপক।
পরদিন সকালে বোনের বাড়ি পৌঁছতে ঘাড় ভেঙে রোদ নামে। গড়াই রোডের ওপরে ঝুলে থাকা একটি ইঁটের পাহাড়ের গোড়ায় যখন দীপকের ট্রিপল লোডের মান্ধাতা স্কুটার ভৌক ভৌক করে একটানা অবিকল বুড়ির কাশি কাশতে কাশতে হঠাৎ থেমে যায় তখন বাতাস লুয়ের আলখাল্লা চাপা নিয়েছে। তাতে বেশীক্ষণ থাকলে নাক ফেটে রক্ত আসে। নাকের ভেতরে অবিকল পলার নক্সাকাটা। তারপর সেই রক্ত সিকনির সাথে জোট পাকিয়ে কালো চামড়া হয়ে উঠে আসে নাক খুঁটলে। এরম এক দলা তর্জনী দিয়ে বার করে রাস্তার ওপরে ফ্ল্যাটের সীমানা-পাঁচিলের গায়ে মোছার পর দীপক স্কুটার ঠেলে ফ্ল্যাটের অঙ্গনে উঠে আসে ও ছাওয়া দেখে গাড়িটা ডবল স্ট্যান্ডে দাঁড় করায়। তারপর বৌ বাচ্চা নিয়ে গ্যারেজ পেরিয়ে এগিয়ে যায়। একপাশে খোলা গ্যারেজের ফোকলা বুক পেরোলে কয়েক সারি গ্রাউণ্ড ফ্লোরের ফ্ল্যাট। সব থেকে সামনে রাস্তার কাছের ফ্ল্যাটটা দীপকের বোনের নতুন আস্তানা। একটা ঘেয়ো নেড়ি কুকুর এদিক ওদিক নালা শুঁকে বেড়ায়, যদি ড্রেনের জলের বদলে ভাত ভেসে আসে! গুদটা লাল হয়ে ফুলে বেরিয়ে ঝুলে রয় পেছনে। তার থেকে রস গড়ায় ফোঁটা ফোঁটা গ্যারেজের মেঝের ওপর। তাতেও আকাশের প্রতিচ্ছবি দেখা যায় কোনাকুনি। কুত্তাটার ওরকম শোঁকার অভ্যেস দেখতে দেখতে দীপকের মনে হয় খাবার কিছু জুটেই রোজ। নইলে মইরে যাওয়ার আগে এত দোড় ঝাঁপ করে কোন শালা? কিরকম একটা চেনা বোধে দীপক চমকিয়ে ওঠে!
বোনের ফ্ল্যাটে দিদি জামাইবাবু হুল্লাগুল্লা করে। ভাইগ্না একমনে ফোন নিয়ে ব্যস্ত। দীপকের ছানা তারই মাঝে কুড়িয়ে পাওয়া দাদার গালে কালি দিয়ে একমনে কিছু আঁকে। আর মা এককোণে একটা সেলোর প্লাস্টিক চেয়ারে বসে থিরথিরে চোখ নিয়ে চশমার আড়ালে কি যেন খোঁজে। সেই খোঁজ বারবার দীপকের মুখের ওপর এসে থামলে দীপকের বড্ড বিরক্ত লাগে ও সে সোজা ভেতর ঘরে গিয়ে একবাটি মুড়ি ও খবরের কাগজ নিয়ে বসে। “দেশভাগ হতে দেব না বললেন মোদী” দীর্ঘদিন পড়ার অভ্যেস না থাকায় বানান করে গিটি ভাঙা মেশিনের পারা গুঁড়ো গুঁড়ো উচ্চারণে নিজের কানেই বাঁজখাই লাগে। ঠিক এই সময় দীপকের সরকারী চাকুরে জামাইবাবু ঘরে ঢোকেন এবং দীপকের উচ্চারণ তাঁর কানে যায়। তিনি দীপকের সঙ্গে মজা করেই হয়তো বলেন, “আরেহ! দেশভাগ চেয়েছেটা কে? এখন নির্বাচনী ভূত ধরেছে বুঝলি কিনা! ভৌ ভৌ করবে কয়েকদিন!” মুড়ি থেকে খোলা ছাঁচি পেঁয়াজের ঝাঁঝে চোখের জল নাকে নেমে আসা অবস্থায় দীপক ঘাড় নাড়ে ও ছোপ ধরা দাঁত বার করে। উচ্চশিক্ষিত জামাইবাবুর সামনে দীপকের মেরুদণ্ড ভেজা সাগুর পাঁপড় হয়ে নেতিয়ে থাকে। জামাইবাবু লোক খুব ভালো। কিন্তু তা সত্বেও এখন তত্ত্ব আলোচনায় মন বসে না দীপকের। কমলা রান্নাঘরের দিকে গেল কেন? মনটা বড় খইরকা টানে দীপকের। যদিও উয়াকে কিছুই বলা হয় নাই এখনও, তবু ডান গ্যালাও বোধহয় জাইনতে পারে মনের কথা! রান্নাঘরের দোর দিয়ে এক থাবা দুই থাবা একখান বিড়াল বেরাবার অপেক্ষায় কান দুটো খাড়া হয়ে ওঠে দীপকের। জামাইবাবুর কথা, খবরের কাগজ তার মাথা ঘেঁষে যায় বটে কানাইদের ছিলার পারা, কিন্তু ওই টুকি দেয়া সার, হাড়ের বেড়া গলে ভিতরের নাগাল পাই কই! হঁ! দেইখেছ! ঠিক লাগাইঞ্ছে কিছু একটো! শিঅর! বোনের ঝটর পটর রান্নাঘর থিকে বিরাইঁ আইসতে দেখেই বুঝে লিঞ্ছে দীপক। উয়ার সঙে তো বাবা ফোঁপরদালালি চইলবেক নাই! চোয়ালের পেশিগুলো অচানকই কামড়ে ওঠে পরস্পরকে। বোন দিদিকে কিছু একটা বলে। ওরা দুজনেই এদিকে তাকায়। দীপক বিরক্ত হয়। তার থেকেও বেশি হয়তো ভয় পায়! মায়ের থুরথুরে আতস আঁকুড় পাকুড় চখ এড়াবার জন্যে ভেতর ঘরে বসা। তো এখানেও সেইরকম দুই জোড়া দৃষ্টি এড়াতে না পেরে দীপক কান পাতে, নাগাল পায় না। অনিদ্রার রগ ওর আবার ঢিপ ঢিপ করে। তারপর বোন এগিয়ে আসতে থাকে। দীপকের বুকে কারখানার হাতুড়ি পড়ে। এক কদম এক ঘা এক কদম এক ঘা। “আপনি একটু যাবেন? দই আনতে হবে। মাংস তো প্রায় হয়ে এল! ওর আসতে বোধহয় দেরী হবে। এই সামনের মার্কেট থেকে আনবেন?” জামাইবাবুকে লক্ষ্য করে দীপকের বোন এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে গেলে দীপক হাঁফ ছাড়ে এবং ঢোঁক গেলে। শুকনো গলার দেয়ালে আটকে ঢোঁকটা ঝুলতে থাকে। জামাইবাবু উঠে গেলেই দীপকের বোনের অনুনয়ের চোখ সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে, এবং সে সরাসরি দীপককে প্রশ্ন ছোঁড়ে, “তোর শরীর ঠিক আইছে? হ্যাঁ রে? চোখটো অমন লাল হইঁ আছে ক্যানে?” বোনের গলার খোঁচা খোঁচা সন্দেহ দীপকের ভুরুতে গুণ পরায়। দীপক ঝাঁঝ পেড়ে বলে, “অল্প শুবার জো আইছে? রোজের খাটুনি! তার গতর কি আর ঠিক থাকে! তাই চখ লাল। মাল খাই নাই………” শেষের কথাগুলোয় তার অবিশ্বাস্য রকমের জোর দেয়া দেখে দীপকের বোন কী আন্দাজ করে বোঝা যায় না। কিন্তু তার গলা নরম হয়ে আসে। “শরীর ট ঠিক যাছে নাই তো ডাক্তার দেখা! ফেইলে রাইখলে কি সারে?” আরো পাঁচটা হাবিজাবি কথার মাঝে পিছনে কখন কমলা এসে দাঁড়ায় দীপকের বোন বুঝতে পারে নাই। মাংসটা এবার ধরে যাবে, কিন্তু আসল কথা বলা হয় নাই! এমন সময় পিছন থেকে কমলার গলা শুনে দীপক আর দীপকের বোন দুজনাই প্রায় চমকে ওঠে। “আজকাইল লিজের সাথে লিজেই কথা বলে দিদি, আমি তো ভয়েইঁ মইরে যাছি! উয়াকে বলো না দিদি অল্প ডাক্তার দেখাইঁ আসুক!” ব্যাস হইঙ্গেল খানকির ছেলে চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার। “মইর মইর! মইরলে তো আমার হাড় গেলা জুড়ায়!” মনে মনে কমলাকে গাল দেয় দীপক। কিন্তু গলাটর নিমকহারামিতে কেউঅয় শুইনতে লারে। দীপকের মনে লেয় কমলার বেলের পারা ছোটো খানকিচোদা মাথা টো এখনই পিছনের চৌকাঠটয় দড়াইমে ঠুইকে দিলে কেমন হয়? কল্পনাতেই গঙ্গাজলের গন্ধ পায় দীপক। ওর চোখ গালার দণ্ডের পারা ঘুবঘুব জ্বলতে থাকে।
বোনের বাড়ি থেকে গলা তক্ক মাংসভাত নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। পথে দীপক একটাও কথা বলে না। শুধু পথে রায়দের বুড়া শিব মন্দিরের পাশটতে ঝুইলি থাকা বেলতলায় ভাঙা পাঁচিলটর ওপর কানাইদের ছিলা চাইপি থাইকলে দীপক তাকে বাঞ্চোত বইলে গালি দেয় ও স্কুটার থামাইঁ খুব ঝাড়ন ঝাড়ে!
বাড়িতে এসে কমলা রুটি করে। দীপক সিমেন্টের বস্তার পারা চুপ করে নিজেকে খোঁড়ার প্রতীক্ষা করে। দীপকের ছেলে বাবার ডান উরুর ওপর মাথা রেখে ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘাড়টা একটু বেশিই নরম লাগে দীপকের। বোলাতে থাকা আঙুল গুলো একটু শক্ত হয়ে ওঠে ছেলেটার ঘাড়ের ওপর। হঁ! এবার টুকচা লাড়লেই ঘাড়টো মট কইরে ভেইঙে যাবেক। দেখবে? দেখতে ক্ষতি নাই বরং শান্তিই শান্তি! কথাটো কাউকে আর বইলতে…টুকচাপারা লাইড়ে দেখতে তো…একটা প্রচণ্ড মুক্তির তাড়ণা ঠেলে খাদের দিকে নিয়ে যেতে চায় দীপককে। মাথার ওপর আজ ঝড়ের মতো পাখাখান চল্লেও দীপকের ঘাম হয়। আর চাপা যাবে না বুঝতে পারে ও। কাঁপুনিতে ইঁটটো সইরে সইরে যেইছে। ভরা পেটের বুক এমন খালি খালি লাগে তা কে জানথ? কমলা খুঁড়বে? অপেক্ষা করা যায় না আর। ব্লাডারে চাপ বাড়তে থাকে। ছেলের মাথাটা হাঁটু থেকে খুব সাবধানে নামিয়ে ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে এগোয় দীপক। এই মুহূর্তে নির্দ্বিধায় ও বুঝতে পারে কমলাকে ও ভয় করে! ভীষণ ভয়! দিদির পরে আর কাউকে এমন ভয় কোনোদিন করে নাই দীপক। ছাতে আজ বুড়ো সন্ধ্যাতেই বোল লেগেছে। আবার কারোর দৌড়ে বেড়ানোর শব্দ শোনা যায়। ছাতটা একতলা বলে দীপকের এই মুহূর্তে আক্ষেপ হয় খুব। পরমুহূর্তেই মনে পড়ে হায়দার আলী বস্তিতে থাকে। সেখানে ছাত খুব একটা কাজে আসে বলে মনে লয় না কো! রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে নিজের মনে বারবার আউড়ে কথাটা সাজিয়ে নিতে গেলে মনে মনেই একটা ভয়ের বিরক্তি লাল পিঁপড়ে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। বছর দুই আগে একটা কানে ঢুইকে দিইঞ্ছিল। তা সে গরম তেল থেকে লিয়ে কম ঝক্কি লয়! আর এ ভূতের তো কোনো তেলই গায়ে লাগে না। হাত কাঁপে তার বুক কাঁপে। হুড়ুম দুড়ুইম্যা ঝড়ের রাতে ছাদের খোলা বুড়ো দরজার বাড়ি লাগে বুকের দেয়ালে। রান্নাঘরের দিকে লেয়া এক একটা পদক্ষেপ ক্রমশ ব্লাডার ফাটিয়ে দেবে বলে মনে হয় দীপকের। ইভাবে চাইপে রাখার জইন্যই ছিলাটকে, কমলাকে অথবা নিজেকেই একসময় নিজের হাতে শেষ করে দিইতে হবেক! ঠেকাতে লাইরবে! বইলতেই হবেক বাঞ্চোত! শরীর ট হালকা কইরতে গেইলে না বইলে উপায় কই! জীইতে গেইলে না মইরে উপায় কই! বাকি সব্বোস্সো কুয়াশা! শামুকের পারা মাটি কামড়িয়ে অবশেষে রান্নাঘরে পৌঁছালে দীপক এক কোণ ঘেঁষে দাঁড়ায় ও হাঁফ নেয়। কমলা উল্টো দিকে ঘুরে রুটি সেঁকছে। সেই উল্টোদিকের দূরত্বটুকুতে দীপকের মনে হয় কমলার মুখটা আজ উনুন হয়ে উঠেছে। দীপক ওর পায়ের দিকে তাকায়। এবারও পা দেখা যায় না। শাড়ির আড়ালে কিছু একটা ষড়যন্ত্র যেন ঘনিয়ে উঠছে মনে হয় দীপকের। দীপক গলা খাঁকার দেয় অথবা দিতে চায়। কিম্বা হয়তো বা কিছু বলে! অসংযত ও অসমান কম্পনের জন্য কথাগুলো গলা খাঁকারির পারা শোনায়। কমলা সেই শব্দেই এদিকে ফেরে এবং জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে দীপকের গলা দিয়ে কিছুক্ষণ আওয়াজ বেরায় না। দীপকের রগ ফাটে তার শব্দ হয় না কেন খানকির বাচ্চা? দীপকের ঘামে চোখ জ্বালা করে ও ভরে আসতে চায় তবু জল নাই খানকির বাচ্চা? আজ তো জল কম খায় নাই দীপক! শুকনা চট গলায় ছেঁড়া হাওয়া খেলে শ্যাসসসসস্ শ্যাসসসসস্ শোনায় কেনে বাঞ্চোত শুধু? নিজেকে একের পর এক গালি দিয়ে ও বহুক্ষণ ধরে টুকচা টুকচা আওয়াজ জমিয়ে অবশেষে দীপক একসময় বলে ওঠে, “বইলছিলম, মানে কাইলি বইলথম, কিন্তু কাল বইল্লে তুমি আইজ হয়তো ইরির ফেলেটে যেইতে নাই, ছিলাটকে মাংস খাওয়াতে পারি নাই কতদিন! সেটও হইথ নাই! তাই কাইল বলি নাই, বুইঝলে…” কমলা অবাক হতে শুরু করে এবং তার ডাইনিসুলভ মুখে বাদবাকি অবাক হওয়ার ক্ষমতা ছত্রাখ্যান করে ভেঙে দেয়ার জন্যই যেন ইচ্ছাকৃত ভাবে দীপক বলে ওঠে, “আমার আর চাকরি নাই বুঝলে… কাইল আমাদের পাঁচশো জন লেবারকে…খাক্-খাক্-খাক্ খানকির বাচ্চা কনট্রাক্টোর.… বসাইন্দিঞ্ছে… একেবারে বসাইন্দিঞ্ছে…” শেষের দিকে দীপকের কথা গেলান ভিজে আসে। আর তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেইখে ঠিক সেই বকোত কোলিয়ারির মুফতের লাইন চইলে যায়! অন্ধকার ঘরে গ্যাসের আগুনে দীপক এবার স্পষ্ট দেখে কমলার গোড়ালি উলটো দিকে ফিরানো। বাকি পাড়ার আর কেউ কিছু জানতে পারে না। শুধু লুঙিটতে ভেজা ভ্যাপসা গরম পাইঁয়ে দীপক বুইঝতে লারে ঐটো ভয়ে ভিইজল নাকি মুক্তির চাপটতে???!!!…
Posted in: October 2019, Story