ধারাবাহিক গদ্য : সিন্ধু সোম
রাজস্থান ডায়েরিস
পর্ব-২
রাজস্থান ডায়েরিস-৪
লাঠি এসে গেছে, লাঠি এসে গেছে। এল অনেকক্ষণ পরে। স্টেশনের নাম লাঠি। ট্রেনের ছায়া নেই কোনও। রোদ এসেছে তখন নিমগাছের ওপর। টুকরো ডানা। থিরথির। গরম হাওয়ার ওঠানামা। নিম গাছ? মরুভূমির পাশে? ওরম। ওরকমই। ধূসর দুপুরে আড্ডা জমায় একটা বট। স্মৃতির ধারা বাহিক। গোল। থেকে গোল। বৃত্তের আকারে বয়স। ছোপ ছোপ। একটা গেট পাথুরে আশ্বাসে। সবুজ প্যান্টের দুটো চুলছাঁটা ছেলে নেমে গেল। মিলিটারি। ধূসর ক্যানভাসে স্প্লিন্টার। সবুজ কার্পেট। আশ্চর্য! জীবনের রঙটাও খানিকটা ওরম। শক্তি শুকনো ঠোঁট চাটেন। কানের মধ্যে গরম সুরা।
“মানুষের ভেতরের আলো তাকে পথ থেকে ঠেলে
নামায়, যেখানে কাঁটা ঝোপঝাড় এইসব
চোখে পড়া পথ নেই, আছে—যাতে বুকে হেঁটে যাওয়া…[i]”
একটা ন্যাংটো ছেলে হাঁটু অবধি জামা পরেছে। মন দিয়ে উল্টাচ্ছে। হাতে একটুকরো কাগজ। ও কি! মনকেমন! দিতির চিঠি বুঝি? বালিতে জন্মান্তরে ধূসর হয়ে গেছে? চিঠি মেখেছে। মাখতে থাকে ধোঁয়াশা। আকাশ গলে পড়ে। হলদেটে দাগে অতীত হানে বন্যতা। একদিকে দিগাঙ্ক লাল। থরথর করে কাঁপছে জোড়া বালি। যন্ত্রদানব জন্মান্তর নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। ওদের ওতে যাবার কথা। সেই চুল ছাঁটা জীবন। বোতলের ঝঙ্কারে অবান্তর কবিতা ফুটে ওঠে। কে যাবে? কে যাবে রেএএএএএ! শিউরে ওঠে বাচ্চাটা। তার কামানে জলের গোলা। তাতেও বালি আগাছা দেয় ফসল করে। রাষ্ট্রতীরে রক্ত ফেনার নদী। তাতে বয়ে আসে গণসজারু। মোটা মোটা খোঁচার নাগালে। ফণীমনসা সেলাম ঠোকে। মরা ছোট্ট দুটো পা নজর আনে। টানতে হয়। “এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?” বাচ্চা-ঘুড়ির মতো ঘুম ক্ষিদে-মায়ের মতো কোল পাতে।
“……বাজ পোড়ানো গাছের নিচে নষ্ট পাথর
কেউ দেখেছে দুইপা………[ii]”
লাঠি নিয়ে টুকটুক। টুকটুক। কুঁজো হয়ে কাঁপে। থরথরিয়ে আসছে দিগন্ত। পচ। এতটা পিচে লাল হয় এখানে ওখানে বালি। হেলেদুলে। তাড়া তার নেই। পথের দুপাশ। ফেরার পথের চিহ্ন রাখে গরু ছাগলের কঙ্কাল। সংগ্রহতে বিয়োগের আগাম অতীতবার্তাকু। এরকমএকটা ছাদ ছিল। জল ছিল। বাবলার হাত ধরে হাঁটতে বেরিয়ে ঠিক কয়েকশো বছর আগে এভাবেই পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। চিকচিক। রোদ। কপালের জল জিভের উপর। মুখ পুড়ে মুখপোড়া। জ্বলে গিয়েছিল বুক। হাপরের টানে তখন আঁচ নিয়েছে পৃথিবী। দিতি বলে প্রকৃতি? আমি বলি, মিথ্যে কথা। আমার প্রকৃতি দিতির অবয়ব। তাই ঈর্ষা করে। ঈর্ষা করে অস্তিত্ব। জন্মান্তর তারই কাব্য। ঈর্ষা মহাকাব্য ভাসিয়ে তুলতে পারে বহুদিন। একা শেষ শ্বাস টেনে শোওয়া। আমার হাড়ের ওপর দিয়ে ছুটে গেছিল কেউ। এগিয়ে গিয়ে দেখি দুটো হরিণ। বাবলারও ছায়াহয়। তুমিও অপেক্ষায় ছিলে।
একটা মোটা বাবলার ছায়ায় ত্রিশটা ভেড়া। “…………জল নয় কাঠ ও পাথরে / প্রতিশ্রুতিহীন কাঠ আমাকে নিজের করে নেবে[iii]”। নাকে নথ। ঝিকমিক। ঘাঘরার ফাঁকে ফাঁকে। এক পা দুই পা। ওদের চরাতে আসতে দিতি তখন। তোমার খোঁজে চরম আকন্দ চুম্বন। আস্তে আস্তে ধুলোয়। মিলিয়ে এল আকার। তবু খাঁচা রয়ে যায়। আমার কঙ্কালের বেড়ে দিতির অক্ষর খোদাই করা আছে। আমি নিজেকে নিজের বাইরে দেখেছি। রোদ আমায় ধমক দিল, “ধুর! তুই বড্ড আঁচল ধরে থাকিস।” আমি সময়ের চোখে ঠার। তাই? তাইতো। আমার গ্রামের কথা মনে পড়ে গেল। আঁচল পেতে বসত আলপনাদি। আমার হাতের মুঠো ঘেমে উঠত। সেই গ্রীষ্মের দুপুর। একটানা ওঠানামা। আমাদের শরীরে ঘামের গন্ধ। বাতাস ছুঁইয়ে যেত বুড়ি কাঠি। তোমারআঁচল ধরেই ছিলাম দিতি। টানতে পারলাম কই! সেজন্ম অভিশপ্ত। এ মৃত্যুর প্রান্তরের মাঝে উদ্দাম মিলনের সহজিয়া ছিল। জীবনের চূড়ায় পৌঁছোনোর কথা হতে পারত। আমার নমনীয়তায় ছোঁয়া যায়নি দিতি। সেবারের মতো। ক্ষমা। ক্ষমা। ক্ষমা।
ঝুরঝুরে হাত। আজও বাবলার কাঁটায় কাঁটায়। রুমাল? নানা! কাগজ। জমাতে পারেনি বাচ্চাটা। তোমার উড়তে থাকা আঁচলে কালরাতের ভেজাগন্ধ। সন্ধানে সন্ধ্যা আনে একাঙ্ক নাটক। মরুভূমির যৌনতা আমি হাজার বছরেও খুঁজে পাই নি। কলকাতার ঘুপচি ঘরে। একা পুড়তে থাকা লন্ঠনে।তীব্রশিস। বিছানারঘটাংঘটাং। বস্তিতেপ্রাণনামেরাতে। ঝড়ওঠে। খুশির তীব্রতা-বিহ্বল চারচোখ। সময়ের কাঁপতে থাকা ছায়ায় ট্রেন থেমে আসার আশ্বাস। অনেকটা রতিতৃপ্ত যৌনাঙ্গের মতো…
আলোকলেখ্য- স্বয়ং
২৩শে অক্টোবর ২০১৮
দুপুর ১২টা ৪৩

রাজস্থান ডায়েরিস—৫
উলস্। বাপরে! ভীষণাকৃতি বিভীষণ লঙ্কার চপ পাকস্থলী পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিল। শশামার্কা লঙ্কার তেজেই কি দূর্গার অকালবোধন? কৃত্তিবাস কেঁপে ওঠেন। শীত মরুর বুকে মুণ্ডনের মতো আসে। ডানপায়ে তার বিষফোঁড়া। গ্যালগ্যালে। মাছি তাড়ায় রামধনু। রাম তো রাজস্থান আসেন নি। রামে আর থরে জটাজটি। সে কি চুমুক! সুকুমার রায় চশমার ওপর দিয়ে স্থির। ঝপাটলপাট। লু-এ উল্টে আসে পাতা। থর শিরস্ত্রাণ খুলে রাখে। চুমু খায় রামগালে। নাহ্! দাড়ি নেই একফোঁটা। দুপাত্তর পড়লে অমন হয়। তারপর? আর রেলের মজা পায় না পথের পাঁচালী। অপুর চোখ। টেনে আনেন কৌশিক গাঙ্গুলি। কাঁচের বয়ামে রাখেন সাজিয়ে। একঘেয়ে কষা কষা ঘাম। বিবাহিতার এক ঝলক। আমাদের সঙ্গে মালপত্তর আছে। ওজন। কথায় ভারী হয়ে আসে পা। ওভারব্রিজটা লম্বা হতে থাকে। থাকে। থাকে। থাকে। থাকে। দুমড়িয়ে ঘুরিয়ে দেয় কেউ। হলুদ শাড়ি। সোনার শাড়ি! ঝুমঝুমঝুম। নূপুর পরে ছুটে গেল দিতি। দিতির সঙ্গে ভাব জমায় বিবাহিতা। তাতে তাস গোনার সংকোচনটা লেগে থাকে। মনের ভেতরে হাফ প্যান্ট কুশলের কোঁচকানো ভুরু। বিরক্ত হয়ে বকে ফেললাম- “তাং মাত করো, তাং মাত করো!”
হেই লাও! গাড়ি নড়েচড়ে না। ক্রঁক ক্রঁঅঅক। শব্দের উপসংহার। আড়াই দিনে মুক্তি।
“……………চরিতার্থতার শেষে আছে কি বিস্ময় ঘেরা দেশ
মুক্তির সংস্রবহারা এ দিনযাপন?
কিম্বা মুক্তি মৃত্যু ও শৈশবে।[iv]”
ছুটতে গেলে একটা জেলখানা লাগে। তার দরজায় খর চোখে দপদপ করে। ওভারব্রিজটা ফট করে শেষ হয়ে যায়। হিসেব বাড়ে। ছায়ার করিডোরের ওপারে অপেক্ষা করছে রোদ। ওর আবার নিচের দিকটা অপছন্দের। পাথর। ঘের কাটা স্বপ্নের নক্সা। কাগজ ফুল চুঁইয়ে পড়ে। জেয়সলমীর স্টেশন মাস্টার ঝিমায় দুপুরে। মনে পড়ে। ওভার ব্রিজ পেরিয়ে এসেছি। আস্তিন টেনে ঠোঁটে ডুব। ভিজে দৃষ্টির পিছনে ফুটে ওঠে সোনার কেল্লা। বাজারে তন্নতন্ন করে খুঁজে সোনার পাথর বাটি পাওয়াযায় না। এভাবে আগন্তুক চিরকাল শহুরে খোঁজ করে। ঘোমটা তুলে গ্রামের খোঁজে বাধা দেয় ভ্যানিটি।
এই রঙ খানিকটা পড়ে গেছিল। সত্যজিতের সিঁদুরের কৌটো। মনে পড়ছে। ঠুন ঠুন করে তাল দিয়ে গাইত আল্লারাখা। শিকড় যখন সোনালি হয়ে ওঠে হলুদ প্রেম তার পথ সাজিয়ে রাখে। অভিসার দিতি। ঐ মস্ত নথের প্রতিফলন। ও যে মণির মতো জ্বালিয়ে দিত বুক। অত উঁচু বুকে ছোঁয়া লাগে বারবার। আসতে যেতে। দেয়ালেরা নির্দয় হয়ে ওঠে। জায়গা ছাড়ে না এক তিল। আবার বিবাহিতার সচকিত দুচোখ। আড়াল যখন বিপাশা হয়ে ওঠে, কালো বেড়ালের মতো ছুৎমার্গে বেড়িয়ে আসে মন। মুখে ঝোলে যৌন অস্বস্তির পেটি। সদ্যচুরির গন্ধ তার গায়ে। দিতি আমার গা ঘেঁষে বসে। ডিজেল অটো গড়িয়ে যায়। রাস্তা ছেড়ে দেয় পথ। সরে দাঁড়ায় বিমূর্ত। একটা দূর্গ। হোটেলে উঠে আসে দাম্পত্য। অদাম্পত্য। আধিপত্য। অনাধিপত্য। টেবিলের ওপর একা হাসে বুদ্ধমূর্তি।
ব্যালকনি। কফির গাঢ়ত্ব আমাকে প্রলুব্ধ করে। সিঁদুর মুছে যায়। দিতির কাজলের কাছাকাছি নেমে আসেসন্ধে। আমরা স্থির জেয়সলমীরে। নগরপালিকা কার্যালয় আমাদের বাসরের সাজে দাঁড়িয়ে আছে অনন্তকাল। অহল্যাকে মনে পড়ে। পাথরের অভিমান কুঁদে আরতির প্রদীপ ওঠে। আমার সামনে ভেসে উঠল কিছু গর্ত। পা এড়ানো যায় না। দিতি অস্থির হয়ে উঠল। অঙুলের আঙটি ছুঁয়ে চমকে উঠলাম। আজ রাতে এক বিছানায় তিনজন। হারেমের ঐতিহ্য বয়ে বেড়ায় হোটেল। মোটা ফ্রেম। ঝিলিক দেয় কাঁচ। আমি গোঁফের অমানবিকতায় আঙুল ছুঁইয়ে দেখি। ভেজা। বাথরুমের থেকে বয়ে আসে নদী। দেয়াল। খোপ খোপ। মহারাজ তাকিয়ে আছে দিতির দিকে। আমি দিতির চুলটায় নাক ডোবাই। বহুজন্মের অরাজকতার ছাপ। সন্দেহ। একটা দানা বাঁধে বুকের কাছে। ঠোঁট দিয়ে সরানোর চেষ্টা করি। আমাদের দুজনের মাঝখানে এলোমেলো হয়ে নিঃশ্বাসের শব্দ আসে অহল্যার। সারারাত। ছিক ছিক ছিক। কাঁটা শুধরে দেওয়া প্রয়োজন। নইলে সময় রাগ করবে।
“……………………একটি সতর্ক পথ—মুড়ো খোলা, লেজে চেপে জাঁতি
আমার ঘরের কাছে রেখে গেছে।
আকাশের মতো তাকে মনে হয়, কিংবা ফালিকাটা
দরজির দোকানে টুকরো কাপড়ের মতো ব্যর্থ মুখ
যাকে শুধু রজঃস্বলা দুই ঊরু ঢেকে দিতে পারে
আর কেউ পারেনা।[v]”
অহল্যার ভাঁজে মন রেখে আমি বিবাহিতার চোখ ফুটিয়ে তুলি। পারতেই হয়। ইতিহাস আমার মাথায় হাত রাখে। টং ঠিসসস্। ঝলকে ওঠে তরোয়াল। বেয়ে বেয়ে নামে অনন্যতারকান্না। রাজস্থান বিবাহিতার প্রেম। ‘সতীত্ব’-র পরিণতি জহরব্রত। সবুজ পুকুর। পানার রঙ আছে। পানা নেই। কয়েক হাজার প্রজন্মের গায়ে হলুদের রঙে পাথর হয়েছে প্রেম। কিন্তু সে রঙ কি সিঁথিতে পৌঁছয় দিতি? পাথুরে শয্যা, সিঁদুর আর গায়ে হলুদের রঙে ইতিহাস বিস্তর পার্থক্য লিখে রাখে। বিস্তর…
আলোকলেখ্য—স্বয়ং
২৩শে অক্টোবর ২০১৮
সন্ধে ৭টা ২৮
[i], [ii], [iii], [iv], [v] শক্তিচট্টোপাধ্যায়



Posted in: October 2019, Prose