অনুবাদ কবিতা : রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

Io’s Song ও মুরাত নেমেত-নেজাত

মুরাত নেমেত-নেজাত, ইহুদি মার্কিন কবি লেখক ও অনুবাদক। পশ্চিমি মূলধারা কবিতার পরম্পরা ভেঙে মার্কিন সাহিত্যের অধুনান্তিক কবিতার এক অন্যতম প্রধান মুখ। তাঁর সাম্প্রতিকতম বই Io’s Song. বইটার নির্মাণকালে আমিও হাজির ছিলাম, অবশ্যই গ্লোবের উল্টোপিঠে। মুরাত কিছু কবিতা পাঠালেন তাঁর পাণ্ডুলিপি থেকে। একটা কবিতায় মন খোয়ালাম-

The secrets of a language’re hidden, in another language.
oh, tantra
tantra
the secret of my heart!

তন্ত্র সংকৃত শব্দ, শাস্ত্র বা সাধনার মার্গবিশেষ। আবার তন্ত্র বলতে বাদ্যযন্ত্রের তারও বোঝায় যার সঙ্গে আমরা সম্পর্কিত করতে পারি ভাইব্রেশন বা সংগীতকে। শব্দের উৎস যে ধ্বনি মনে পড়ল আবার। আমি মুরাতকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কীভাবে ভাষার সঙ্গে একে যুক্ত করছেন। তাঁর অপূর্ব জবাবটা তাঁরই ভাষায় বলি,

“The dialectical connection between the western idea of “content” and the Indian “tantra” is an observation. This distinction is very important for my poetry (and myself). In the West, form (consequently content) is seen in terms of restrictions. Therefore, finally, form is seen as static and “eternal”; in that sense, as “changeless.” I want to liberate that static sense of content. Form becomes movement, process, change; in that sense, it becomes vibration, music as plucking of strings. Content becomes tantra.”

তো সেই মুরাত, মার্কিন কবি হয়েও যিনি মার্কিন ভাষায় সরাসরি কবিতা লেখেননি। ইস্তাম্বুলে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি একজন পারসিক ইহুদি। বড় হয়েছেন আমেরিকায়, সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন আমেরিকার আমহার্সট কলেজ ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৫৯ থেকে আমেরিকার বাসিন্দা। এই বিবিধ অবস্থানের বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রণে ঘটেছে তাঁর মানসিক অভিযোজন। তাই দেখি প্রথমে স্বরভঙ্গিহীন তুর্কিভাষার আত্মা দিয়ে গর্ভবতী করেছেন স্বরভঙ্গিযুক্ত মার্কিন ভাষাকে আর মসৃণ মার্কিন ভাষার অন্তরে সৃষ্টি করেছেন ফাটল যাকে বিচ্যুতি বলা যায়। এই বিচ্যুতিগুলোই হয়ে উঠেছে তাঁর স্বরভঙ্গি। আর সেই ত্রুটিপূর্ণ মার্কিন ভাষাটিকে হাতিয়ার করেছেন আপন কাব্যসৃষ্টিতে। তাঁর এই নতুন বইটি থেকে অনুবাদ করা হল কিছু কবিতার।

Io’s Song

কারণ ও ফলাফল, ভাষার খেলা: কবিতার মেটাফিজিক্স

(Cause and Effect, a Linguistic Play: the Metaphysics of a Poem)

“আমরা মনে করি শব্দগুলি আমাদের জন্য, আমরা তাদের জন্য”

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যখন ফলাফলের আগে কারণ (“কিছুই আসে না কিছু না থেকে”), অর্থাৎ,কারণ হল ফলাফলের কারণ – তারা দুজনেই সমান। ভাষায় একটা নতুন মানে হল তার নিজের কারণ (ফলাফলের জন্য), ফলাফল কারণের কল্পনা করে, এটা হল ফলাফলের আসল কারণ। ভাষার আয়নায় আমাদের অভিজ্ঞতা হয় ওলটানো পৃথিবীর; সময় বিপরীতমুখি (অথবা চলনশক্তিহীন, সময় নিজেকে মুক্ত করে বাতাসে বিলীন হয়ে যায়)। আমরা ভবিষ্যৎকে দেখি অতীত হিসেবে। ব্যুৎপত্তিগতভাবে প্রতিটা শব্দের সামনে ছড়ানো থাকে অনন্ত শুরুয়াৎ। কিন্তু একবার দিক নির্ণয় হলে সেই মুহূর্তেই ভাষা মূর্ত করে তোলে ধ্বনির জন্য এক নতুন অর্থ আর সঙ্গে সঙ্গেই আরো এক অসীম খুলে যায় সেই শব্দের চারিদিকে (যেন নুড়ি বা বাশোর ব্যাঙকে ঘিরে প্রসারিত তরঙ্গ নিজেই নিজেকে নিক্ষেপ করে জলের ভেতর)। ভাষার ভেতর সময় নির্মিত হয় একসার তাৎক্ষণিক রূপান্তর দিয়ে, যখন আমরা কল্পনা করি পুরোনো শব্দার্থই এই বাড়ি তৈরি করেছে, সেই-ই তার মূল কারণ, বাড়ির ইঁট। অথচ আমাদের হাতে থাকে এক সীমাহীন প্রসারণ, অনন্ত আত্মার চলনকে অনুসরণ করে। কারণ হল এক খেয়াল মাত্র, হাওয়ার মন্থন, সেই মুহূর্তেই ঘটবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কল্পনার সমুদ্রে তা অত্যাবশ্যক, যেখানে শব্দ হল তরঙ্গ মাত্র, অর্থ হল আমরা যা দেখতে পাই নিজস্ব অন্ধকারের ভেতর, সীমাহীন ঝুঁকির ভেতর, আর পৌঁছে যাই স্বপ্নঘেরা ক্ষণস্থায়ী এক স্বপ্নের দেশে যাকে আমরা ব্রহ্মাণ্ড বলি, যাকে আমরা ভাষা বলি।

শেলফি বর্ণনা দেয় স্বতন্ত্র স্বপ্নঘেরা এক বিস্মরণ, যেখানে আমি জেগে উঠি……পার হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি।

——-

আইও-র বিলাপ

(Io’s lament)

শাবকের ধ্বনি
অর্ধেক ধ্বনি
খুরের চিহ্ন
চোখ ও কানের ভেতর সংগ্রামে, গানগুলো বয়ে যায় চিহ্নে,
চক্ষুদ্বীপ
মাঠের ভেতর আইও-র বিচরণ
একদৃষ্টে চেয়ে থাকে – যেতে দেয়, হতে দেয়, চটজলদি খাবারের চৌম্বকীয় ফুর্তি,
গ্রাস করে আমার অভ্যন্তর।
স্বাক্ষরগুলো

একাকিত্বের ক্ষুধাহীন বিষণ্ণতা

———–

দৈববাণী ও স্পেস

(Prophecy & Space)

এক সমতল পর্দার মুখোমুখি
প্রেমময় আশ্লেষে জড়ানো চোখ একে অপরের দিকে তাকিয়ে
শাখায় ঝুলন্ত এপ্রিকট[1]
সমতল আকাশে প্যারেডমত্ত লাইনগুলো,
মন্তাজের নিরন্তর তারল্যে প্রসারিত
আমার চোখের নদীতে বয়ে গেছে ভাঙা সময় [বয়েছে?]

আহা ভাষার টুকরোগুলো কাঁদছে
আমার আত্মার সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগামী
আহতদের বলক্ষেত্রে আছড়ানো
এক তীব্রতর জীবনের রেখাচিত্র
প্রকাশিত[2]

———

সাইক্লোপ্‌স[3]

(Cyclops)

মসৃণ সমতলের অপসৃয়মাণ দেয়াল বেয়ে পরিপ্রেক্ষিতের ঝরে যাওয়া থেকে মুক্তি[4]

——

কবি পরিচিতি:

মুরাত নেমেত-নেজাত মার্কিন পোস্টমর্ডান কবি। ১৯৯৭ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ The Bridge.  আমেরিকার মর্ডান কবি হার্ট ক্রেন নিউইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রিজ নিয়ে অনেক আগেই লিখেছিলেন ওই একই নামে তাঁর দীর্ঘ কবিতা, যা মার্কিন সাহিত্যে গৌরবের আসনে বসে আছে, তাকেই চ্যালেঞ্জ জানাবার স্পর্ধা করলেন মুরাত আপন বিশ্বাসে। আমেরিকায় যখন আখ্যানধর্মী কবিতার মৃত্যু ঘোষিত হয়েছে তখন তিনি চ্যালেঞ্জ জানালেন এবং কবিতার আখ্যানধর্মীতাকে পরিবর্তন করলেন বর্তমান সময়ের নিরিখে। গড়ে উঠল তুর্কি ও মার্কিন দুই অসম সংস্কৃতি, অসম ভাষা ও প্রতীকের যোগাযোগ সেতু, এক দীর্ঘ কবিতা, যার কেন্দ্রে টলটল করছে একজন অভিবাসীর সাংস্কৃতিক সংঘর্ষের যন্ত্রণা। তাঁর বহুল বিতর্কিত প্রবন্ধ Questions of Accent ১৯৯৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় The Exquisite Corpse পত্রিকায় এবং দ্বিতীয়বার প্রকাশিত হয় Thus Spake The Corpse (An Exquisite Corpse Reader, 1988-1999) যা শুধু স্বদেশী বা বিদেশীয়ানার সনাতন আইডিয়াকে লক্ষ্য করে নয়, বরং ভাষা ও ব্যক্তির আইডেনটিটির খোঁজ।  তারপর দীর্ঘ তিরিশ বছর পর আমেরিকার তালিশম্যান হাউস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ The Spiritual Life of Replicants. রিড্‌লে স্কটের কল্পবিজ্ঞানধর্মী সিনেমা ব্লেড রানার-এর ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছিল এই কবিতাগুলো। যেখানে বর্তমানের পিঁড়িতে বসে জীবন ও মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে অতীত ও আগামীর উত্তর খুঁজছেন এক সচেতন কবি। ২০১৬ সালে তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ Animals of Dawn. কেন্দ্রিয় চরিত্র সেক্সপিয়ারের হ্যামলেট হলেও এ কোনো হ্যামলেটের তুলনা নয়, বরং এক মেটাফর। কবি চলেছেন সেই মেটাফরের খোঁজে শূন্য ও অশূন্যের ভেতর, বাস্তব ও অবাস্তবের ভেতর, জীবন ও মৃত্যুর ভেতর, স্যা্নিটি ও ইনস্যানিটির ভেতর। ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রবন্ধের বই The Peripheral Space of Photography. ফোটোগ্র্যাফিও শিল্পের একটি মাধ্যম। আর সেই মাধ্যমের ভাষার খোঁজ করেছেন, খুঁজে পেতে চেয়েছেন শব্দ ও ছবির মধ্যে, তার ছায়া ও আঁধারে ঝুলে থাকা অন্তর্বর্তী বারান্দা, যেখান থেকে শুরু হয় কবিতাভাষা ও ফোটোগ্র্যাফিভাষার মেলবন্ধন। তিনি শুধু কবিই নন, বিখ্যাত তুর্কি অনুবাদক। তুর্কিভাষা থেকে মার্কিন ইংরেজিতে তাঁর অনূদিত বইগুলো ১৯৯৭ সালে ইসিই অ্যাইহানের A Blind Cat Black and Orthodoxies,  ১৯৮৯ সালে অরহ্যান ভেলির I, Orhan Veli. ২০১০ সালে সেয়হান এরোসিলিকের Rosestrikes and Coffee Grinds. ২০১৮ সালে বিরহ্যান কেসকিনের Y’ol – Birhan Keskin. ২০০৪ সালে তিনি সম্পাদনা ও অনুবাদ করেন  EDA: An Anthology of Contemporary Turkish Poetry. এ শুধু কবিতা ও প্রবন্ধের অনুবাদই নয়, মুরাত একে আখ্যা দিয়েছেন একটি ভাষার অনুবাদ বলে।

__________________________________

[1]নাজিম হিকমত ও তাঁর প্রিয়তমা মুখোমুখি বসে একে অন্যের চোখে তাকিয়ে আছে। পটভূমিতে অ্যাপ্রিকট গাছের সারি।

[2]The Arcades Project এ ওয়াল্টার বেঞ্জামিন দাবী করেন যে, ডা্যালেকটিক পদ্ধতি খননের মাধ্যমে অতীতের অভিজ্ঞতাকে চিরন্তন তরল ইমেজে পরিণত করে এবং তার শক্তিকে উন্মুক্ত করে দেয় ধারাবাহিকতার বলক্ষেত্রে। ভাষার ভাঙা টুকরোকে তিনি বলেছিলেন “মন্তাজের ভাঙা অনিত্যতা”। ধারাবাহিক বর্তমানের ভেতর সময়, অতীত ও ভবিষ্যতের বিলীন হয়ে যাওয়া, স্পেসের গভীরতাকে রূপান্তরিত করে চেতনার বিচ্ছিন্ন বিস্ফোরক ফলকে – বর্তমান প্রকাশিত হয় – দৈবের ডায়ালেক্টিক ভাবমূর্তি। তাই চিত্রকলায় কোলাজের স্থিরতা (বা প্রথাবিরোধী কবিতা) সিনেমায় হয়ে ওঠে মন্তাজের গতিশীলতা।

[3] সাইক্লোপ্‌স – গ্রিক মাইথোলজির নির্জন দ্বীপের গুহাবাসী একচক্ষু দৈত্য

[4]আগ্নেয়গিরির কেন্দ্রস্থল থেকে বেরিয়ে আসা শব্দকেও সাইক্লোপ্‌স বলা হয়। মস্তিষ্কের টিউমারজনিত কারণে বেঞ্জামিন হল্যান্ডার জীবনের শেষ সপ্তাহগুলোতে sense of depth হারিয়ে ফেলেছিলেন।

Facebook Comments

1 thought on “অনুবাদ কবিতা : রুণা বন্দ্যোপাধ্যায় Leave a comment

Leave a Reply