ধারাবাহিক উপন্যাস : নীলাব্জ চক্রবর্তী
যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে
সপ্তম পর্ব
১৫
সকলেই চিঠি নয়, কেউ কেউ…
*
হ্যালো কবি,
কেমন আছ আর জিজ্ঞেস করলাম না। কয়েকটা কথা তোমায় বলতে ইচ্ছে করছে। হয়তো খুব একটা ভাল নেই তুমি… দ্যাখো, স্পষ্ট করেই বলি, তোমাদের অফিসে অনেকদিন ধরেই নানারকম সমস্যা চলছে আমি জানি। আমার একটা কথা মনে হয়… মাথায় বেশী লোড নেওয়া ঠিক না… নিও না। আমি অতো গুছিয়ে লিখতেও পারি না বলতেও পারি না… বাট আমার লাইফে অনেক কিছু দেখেছি আর বুঝেছি। বসের সাথে রিলেশনটা, ইন জেনারেল, খানিকটা শাশুড়ি আর বৌমার সম্পর্কের মতো। লোকগুলো নিজের টাইমে র্যাগড হয়েছে তাই ক্ষমতা পেয়ে নিজের মনোবাঞ্ছা পূরণ করে। আর, তোমাদের অফিসের ওই লোকটির তো এসব ব্যাপারে বিশেষ খ্যাতি আছে সার্কিটের সবাই জানে। লোকটা আদ্যন্ত একটা মেগালোম্যানিয়াক শুনেছি। শুনেছি বিরাট বিষাক্তও। আজ পর্যন্ত কেউ কোনোদিন লোকটা সম্পর্কে একটাও ভাল কথা বলেনি। ঘটনা, এভাবে কেউই বেশীদিন উইদস্ট্যাণ্ড করতে পারে না। ইনফ্যাক্ট তুমি ইদানীং চাকরী ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছ তাও শুনেছি। অফিসে র্যাগিং তো নানারকম হয়… আমার চাকরী লাইফে এমন তিন বছর কেটেছে, জানো… একটা বোকাচোদা সারা দিন সামনে বসিয়ে জাস্ট ভাঁট বকতো। নানারকম মেণ্টাল চাপ নিয়েছি। সেসব কিছুটা কাটিয়ে উঠেছি কোনোভাবে। আজকাল আমাদের অফিসে আমি খানিকটা যেচেই বেশী বেশী করে কাজ চেয়ে নিয়ে করি… আমার কাজ করতে ভাল লাগে তাই, তাছাড়াও, আরেকটা মিথ যে… যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে… সেটা প্রুফ করার তাগিদে। দ্য ফ্যাক্ট ইজ, এইসব জায়গায়, আই মিন, এইসব তথাকথিত উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বলো আর ইণ্ডাস্ট্রিই বলো, আমরা মেয়েরা তো চূড়ান্তরকমের সংখ্যালঘু এখানে। কাজেই দাঁতে দাঁত চেপে অনেককিছু সহ্য করে প্রতিদিন নিজেদের প্রমাণ করে যেতে হয়। কলেজে যখন টপ করতাম, অনেকে বলত মেয়ে বলে টিচাররা পার্শিয়ালটি করে বেশী বেশী নম্বর দিয়ে দেয়… জাস্ট ভাবতে পারো কতখানি অসম্মানের এইসব কথাবার্তা! যাকগে, কী আর বলব, অফিসেও তো অনেক কথা শুনেছি আর শুনছিও… তার পরেও এখানেই রয়ে গেলাম কতবছর… কারণ, অ্যাট দ্য এণ্ড অফ দ্য ডে, ট্রেড অফ করতে হয়… নিজের কাছে ফিরে যেতে হয়… ব্যালান্স করে… সামহোয়াট, উঁ… ওয়েল, বলতে পারো, হ্যাঁ, কমপ্রোমাইজ করে… দাঁড়াও দাঁড়াও… একটা পপুলার গানের কয়েকটা লাইন মনে পড়ছে… অ্যায় জিন্দেগী / গলে লাগালে / হমনে ভি / তেরে হর ইক গম কো / গলে সে লগায়া হ্যায় / হ্যায় না…
জব তুমি ছাড়তেই পারো। হয়তো এখনকার থেকে অনেক ভাল কিছুও পেয়ে যাবে… বাট তোমাকে ভাবতে হবে চাওয়া পাওয়ার হিসেবটা মিলছে কি না… সেটাই সব। ভাল করে ভেবে দেখো, নতুন চাকরিতে গিয়ে কী কী প্রবলেম ফেস করতে হতে পারে… তখন খারাপ লাগলে… ভেবে দেখো… ফ্রাইং প্যান টু ফায়ার না হয়ে যায়…
দ্যাখো, আমার লাইফে একজনকে ভালবাসার সবটুকু ক্ষমতাও শেষ হয়ে গেছে। তবে, আই ক্যান বি এ গুড ফ্রেণ্ড টু রিলাই আপন। টু সাপোর্ট ইউ। আমার কথাবার্তা খুব রাফ, আমি জানি। মে বি তোমার ফিলিংসকে হার্ট করে। এনিওয়েজ, এই কথাগুলো খুবই অপ্রাসঙ্গিক। আর… কেন যে লিখে ফেললাম তাও ঠিক জানি না…
ইসস, কতদিন এরকম টানা কোনোকিছু লেখার অভ্যাস নেই… ইমেইলটা গোড়া থেকে একবার পুরোটা পড়লাম। কেমন একটা খাপছাড়া লাগছে নিজেরই… তাছাড়া কত ইংরেজি শব্দ লিখে ফেললাম এইটুকু লিখতে গিয়ে… তুমি নিশ্চয়ই হাসছ মনে মনে… ভাবছ… বাংলা মায়ের অ্যাংলো মেয়ে, না?
থাক, যা লিখেছি লিখেছি। এডিট করব না। যাই হোক, একটা কথা শুনবে? ভেবোনা জ্ঞান দিচ্ছি। আসলে, জানো তো, পার্সোনাল লাইফ আর প্রফেশনাল লাইফ কখনও মেশাতে নেই। অফিসে, আর কখনও; ফ্যাসিবাদ কাকে বলে, মেশিন-ছাঁচ-সমাজ, রাষ্ট্র মানেই প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান মানেই রাষ্ট্র, রাষ্ট্র আর প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি পদক্ষেপকে সন্দেহের চোখে দেখা উচিত, ক্ষমতার কাছে যুক্তি অসহায়… অমুকতমুক; এগুলো নিয়ে আলোচনা করতে যেও না। কাজ করো। বেরিয়ে যাও। স্টে কুল। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ ঘুরে দাঁড়াবেই। আই থিঙ্ক দেয়ার উইল বি আ পয়েণ্ট অব নো রিটার্ন। সেদিন তোমার রিজাইন করার আগে দুবার ভাবতে হবে না। ততদিন অবধি এইসব ভাবনা থেকে দূরে থেকো… ভাল থেকো…
ইতি
…
# * # * #
রিজেকশানের ভেতর যে ভাষা
থেকে গেল
আমাদের পাথরের দিন
কাটাছেঁড়া ঋতুর ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো
পাখিদের ছায়া ওখানেই পড়ছে
নাভিতে
স্থা এক ধাতু হয়ে
ফ্রিজ
দুধফুল
রঙ ভেবে সম্পর্ক খুলে রাখছে
যে দেহের অতীত
আবার হ্যালো বলছি মাদাম দেবানন্দ বলছি
আর
পাথরের দিনে পাথর হয়ে যাচ্ছি ভালবাসতে বাসতে
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি
লাল
অর্থাৎ
গভীর এই হরফ তোমায় ঔদাসীন্য দেবে…
১৬
— এসব ছাইপাঁশ না লিখে, ভাঁটের কেত্তন না লিখে; শিশুসাহিত্য লেখো বরং…
— শিশুসাহিত্য লিখতে পারব কি না জানিনা; তবে, রূ-প-ক-থা-ই তো লিখছি আসলে… অথবা, কে জানে, রূপকথা আর অরূপকথার মাঝামাঝি কোথাও কিছু একটা লিখছি হয়তো… ছাইপাঁশ… ভাঁটের কেত্তন…
— স্পষ্ট করে কথা বলতে পারো না?
— না না… পারি তো… আসলে…
— তাহলে বলো! স্পষ্ট করে বলো। তা না, রূপকথা… অরূপকথা… মাঝমাঝি… অমুকতমুক… ঝাঁট জ্বলে যায়…
— আহ… বলছি বলছি… মনে পড়ল একটা কথা আসলে… ধ্বনি আর চেতনার মাঝে…
— উফফ, ইউ আর সো প্রেডিক্টেবল! ঠিক জানতাম! এখন ভ্যালেরি মারাবে, তাই তো? সেই যে… কবিতার ডেফিনিশন, নাকি? সামথিং হেজি বিটুইন সাউণ্ড অ্যাণ্ড সেন্স, তাই তো?
— দ্যাখো কী ব্যবহার! দু-চারটে সুখ-দুঃখের কথা বলব ভাবলাম…
— সুখের কথা! তোমার তো সারাক্ষণই দুঃখের কথা লেগে আছে। দুঃখবিলাসী কোথাকার…
— আরে কী বলো! আমি হৃদয়ের, উপস্, সরি সরি, সুখের কথা বলিতে ব্যাকুল…
— আহা! শুধাইলো না কেহ? কেউ না? ভাল হয়েছে। ঠিক হয়েছে।
— কখনও সম্ভব করিও। ভালবাসা অবধি আসিও গো কল্যাণীয়া। বেশীদূর না হইলেও, আমি যতদূর; তাহার দশ শতাংশ অবধি… পাঁচ শতাংশ অবধি… অন্তত… কখনও… একবার… ভাষাতে আসিও গো কল্যাণীয়া…
…
আচ্ছা, ধরো, এই ডায়লগগুলো সব এলোমেলো করে দেওয়া যায় যদি… ধরো, দৃশ্যগুলো যে যার নিজের জায়গায় নেই… সেটা কি একটা এক্সটেণ্ডেড কোলাজ হয়ে উঠবে না? জানো, আমার প্রথম বইয়ের নাম ছিল পীত কোলাজে নীলাব্জ। আর কখনও ওই বইটা লিখতে পারব না…
# * # * #
সন্ধ্যাটি, ক্রমে, ভাষা হয়। স্মিত হয়। আলাপের অনেকটাই টেকনিক্যাল হয়ে ওঠে কখনও কখনও। ঝালার কী হয় তবে? আর… জোড়ের? বাঁধা গতের বাইরে চলে যেতে গিয়ে নর্থ বেঙ্গলে থেকে যাওয়া একটা শৈশবের সঙ্গে হয়তো দেখা হয়ে যায় উত্তর শহরের বা দক্ষিণ শহরতলীর কয়েক বছর পরের অন্য সময়ের আর একটা বা অন্য একটা শৈশবের। আশায় আশায়… কার জন্য স্নায়ু খুলে রেখে হরফে হরফ ঘষে যাই। আর, পাখি অবধি গ্রস্ত হয় এই বেলুনের মরসুম। একটা ঋতুর নাম হয় ভ্যালেনটিনা। স্মৃতি এক অভেদ্য সরণী। নিজে তন্নতন্ন হই। কী তীব্র এই নীরবতার অভিঘাত। দেখি, চাবি-উৎসবের সমস্ত মুহূর্ত আমি হারিয়ে ফেলেছি। একটা নন-লিনিয়ার সকাল ঝরে পড়েছিল। গম্ হয়েছিল একটি চলে যাওয়া ধাতু। মনে, সেপ্টেম্বর পড়েছিল। আরও দেখি, একটাই অস্থিরতা; বাইফার্কেট করছে। অনুরক্ত মাত্রেই কখনও না কখনও টের পায়, ভালবাসা এক ফ্যাসিবাদ। বারবার…
… বারবার কানেক্টিভিটি বলিতে বলিতে সুতীক্ষ্ণ যে বাক্যগুলি ত্বকে আসিয়া প্রবিদ্ধ করিতেছে, তাহারা, প্রকৃতপ্রস্তাবে, ক্ষত না শুশ্রূষা; তাহা অনুধাবনযোগ্য। এবং, তর্কসাপেক্ষও। অতয়েব, আইস, পরস্পরের ছায়া বদল করিয়া লই। মানিয়া লই, নির্বাসন অবধি যে মর্বিডিটি, যে শীতলতায় অস্পষ্ট, কিন্তু, নিশ্চিতভাবে প্লুত হয়; তাহার নাম হৃদয়। এতদসত্ত্বেও, মেদের ন্যায় অতিরিক্ত অনুভূতিও বাঞ্ছনীয় নহে, স্বেদের ন্যায় ঝরাইয়া ফেলাই অভিপ্রেত, কারণ তাহাতে সমাজ ও পরিপার্শ্ব নিশ্চিন্ত হইতে পারে। এ সমুদয় ভাবিতে থাকি। ঋতু কিছু ভাঙিতেছে। ক্রমে, ম্লান ও নিরুত্তর হইয়া আসিল স্টিয়ারিং-দিবসগুলিও। হায়! জীবনানন্দ মনে আসিবেন… ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’… কেমন বিস্ময়! মনে পড়িবেন কিশোরকুমারও… ‘সে যেন আমার পাশে আজও বসে আছে’… বস্তুতঃ, কেহই বসিয়া থাকে না। এ কেবল বিভ্রান্তি। এই মুহূর্তগুলি আপনা হইতে আর গাহিয়া উঠিবে না কদাপি? আমি আর গাহিব না কদাপি? ‘ওপারে থাকব আমি তুমি রইবে এপারে, শুধু আমার দুচোখ ভরে দেখব তোমারে’… এইসব উন্মুখ মুহূর্তগুলো কোথায় যাইবে তাহা হইলে এখন? কোথায় হারাইবে আপনারে… ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন, খুঁজি তারে আমি আপনায়’…
তাহার পর?
(চলবে)
Posted in: Novel, October 2019