গদ্য : দীপ শেখর চক্রবর্তী

রাতভোরের চিঠি

রোহিণী

শীতের এই ভোররাতে নিজের হৃদয়ের ক্রমাগত কম্পন শুনতে শুনতে মনে হয় আমি কেমন বিপন্ন ভাবে বেঁচে আছি। এই একটা ঘড়ির ছন্দোময় হেঁটে যাওয়া, মাঝে মাঝে ধূলো উড়িয়ে চলে যাওয়া ট্রাকের খুব মসৃণ একটা দাগ আর আমার নিঃশ্বাসের শব্দ মিলে একটা অদ্ভুত জ্যামিতিক পৃথিবী গড়ে উঠেছে আমার চারিদিকে, আমি তাকে দেখি, বুঝি অথচ কোন না ধরা দেওয়া কাঠবেড়ালির মতো তাকে ছুঁতে পারি না। তাহলে কি মানুষের বেঁচে থাকা কিছু শব্দ সমষ্টি ছাড়া অন্য কিছু নয়? কিন্তু তুমিও জানো শব্দের একটা নির্দিষ্ট গন্ডি রয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শব্দ খুব বোকা। ঠিক চারটে বাজলে একটা ছোট ট্রাক কেমন শব্দ করে চলে যায় আমার জানলার পাশ দিয়ে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোরের আজান শোনা যায়। এরা দুজনেই শব্দ করে আমার হৃদয় দাবী করে কিন্তু প্রথম জনের শব্দে তার কোন গন্তব্যস্থল জানা যায় না, দ্বিতীয়জনের শব্দের উৎসস্থল। এই যে আমি কখন ঘুমিয়ে পড়ি ঠিক সেই মুহুর্তটা জানার যেমন আমার খুব ইচ্ছে। যেমন ভাবে ইচ্ছে করে এটা জানতে যে ঠিক কবে তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম। অথবা কবেই বা এতটা কাছে এসে একে অপরের বিপন্নতাকে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম, সেই মুহুর্তটাকে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আমার বিশ্বাস সেই মুহুর্তটার এক অপূর্ব শব্দ আছে। যেমন ধানের মাথা দোলানোর শব্দ, দইওয়ালার গোয়ালপাড়ার লাল রাস্তা ধরে ঘরে ফেরার শব্দ, তাকে যে চাঁদ অনুসরণ করে তার টুপ করে জলে ঝাঁপ দেওয়ার শব্দ। তেমনই আমার এই পাগলামো, এই বিপন্নতা, এই অসুস্থতার একটা শব্দ নিশ্চয়ই আছে। অর্ধকুড়ি বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পর অনেক কিছু শিখে নিতে হয় রোহিণী, যেমন কোথায় কতক্ষণ কথা বলা যায়, কার সাথে কতটা পথ চলা যায় এবং বারবার নিজের হাত দেখে দেখে বড় হয়ে গেছি- মানতে না পারা মনটাকে ঢেকে দিতে হয় ছদ্ম গাম্ভীর্যতায়। অথচ মন কী মানে? যে নিঃশব্দ প্রজাপতি আমার এই বালক মন নিয়ে খেলতে খেলতে নিয়ে গেলো পাহাড়ের গায়ে তাকে যদি বলতে চাই থামো, সেকি আদৌ থামে? অথচ রোহিণী তুমিই তো জানো কতকালের পিপাসা আমার বুকে আর গলাভর্তি বালি নিয়ে আমি বসে আছি একটা শাদা পাতার মতো জীবনের পাশে। ধীরে ধীরে বুকের ভেতরের সমস্ত জট খুলে ফেলতে গিয়ে আমি দেখছি আরও আরও পাকিয়ে যাচ্ছে সব।

আমার মনে হয় রোহিণী আমি সেই ছোটবেলাতেই মরে গেছি এই শরীর, এ আমার কবর ছাড়া কিছুই নয়। আমি যা লিখছি তা আসলে সেই কবরের ভেতর থেকে তোমাকে কানে কানে বলা আমাদের মায়াভরা আঁকড়ে ধরার কথা।

আজ এক দীর্ঘ শীতল পথ দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে খুব তোমার কথা মনে পড়ছিল। সেই কেমন আমরা একটা শুকনো গাছের ডাল নুয়ে জলের কপালে টিপ দিয়ে দিতাম। এমন শীতের  ঘাসে গড়াগড়ি খেতে খেতে আমরা কেমন ছদ্মনাম নিতাম শিশির। এমন ঠিক এমন রাতেই দুজনে একটা রূপকথার গল্পের বই, রুটি, লাল মাংস আর পানীয় নিয়ে লেপের ঘর বানিয়ে তার নীচে বসে খেয়েছি। ভালোবাসা কী চমৎকার রোহিণী, তা শীতের রাতে একটা উষ্ণ বুক হয়ে যেতে পারে, হয়ে যেতে পারে আদিবাসী গ্রাম, দ্রিম দ্রিম মাদল বাজে আবার প্রচন্ড গরমে তা লাল রঙের বসতবাড়ির মেঝের মতো, চাপকলের শরীরের মতো ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে।

এমন হাঁটতে হাঁটতে ভাবি তুমি তো দূরে নেই, এই তো আমার বুকে কেমন লুকিয়ে নিয়ে চলেছি, কেউ দেখতে পারছে না আর তোমার সাথে এই প্রলাপ  বকতে গিয়ে দেখছি আমার বুকের ভেতরেই সেই প্রজাপতিটা উড়ে বেড়াচ্ছে। তুমি, তোমার ঐ গমের গন্ধ মাখানো চুল আর গলার কাছে উঁচু হয়ে থাকা হাড় সেই আমাকে ক্রমাগত একটা কান্নার দলা করে তুলছে রোহিণী।

এখন আকাশের দিকে তাকাতেই ভয় লাগে। মনে হয় আকাশ আমাকে ডুবিয়ে নেবে। সেদিন ট্রেনে চেপে একটা পুরোনো নদী দেখতে গেলাম আর মনে হল জলের মতো অমন বয়ে যাওয়া আমি কখনো শিখতে পারিনি। যে কোন মোড়ে এলে আমার মনে হয় উল্টোদিক থেকে এসে ধাক্কা মারবে কিছু, প্রতিটি সুইচ টেপার সময় মনে হয় এখুনি বিস্ফোরণে গোটা ব্রহ্মান্ড উড়ে যাবে। আমার কবিতার বইগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করি আর মাঝে মাঝে রুটির মতো চেবাই। মাঝে মাঝে মনে হয় সমস্ত বইপত্র জ্বালিয়ে দিয়ে সেই আগুনে নিজেকে একটা জ্বালিয়ে নি।

রোহিণী, আমার জীবন খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, আমি কাউকে কথা দিতে পারছি না, কারো দিকে সামনে তাকিয়ে হৃদয় ভরে হাসতে পারছি না, বাবার অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখতে না পেয়ে কেমিন হাটু ভেঙে আসছে।

আমি কোথাও কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারছি না রোহিণী, খালি এই বই থেকে শব্দ খুলে খুলে নিজের আত্মায় গেঁথে জীবন তো চলে না। শুধু আমি তোমার অপেক্ষা করে আছি

তুমি আসবে এমন শীতের রাস্তায়, আমার হাত মুঠো করে ঠোঁটের ওপর রাখবে অথবা সেই পুরোনো দিনের মতো দুষ্টুমি করে পথের মধ্যেই চুমু খেয়ে নেবে।

সেই ঠোঁট থেকে আমি তোমাকে একটা গান হিসেবে গাইব। নিঃশব্দ গান যা শুনে হুঁহুঁ করে কান্না পায় না, অথচ একটা রক্তদলা যেন গলার বালি সরিয়ে গিয়ে পড়ে পিপাসায়।

রোহিণী, তোমার বুকের ওপর শুয়ে স্বপ্ন দেখবো একটা রোদের বারান্দায় রঙিন উল নিয়ে খেলা করছে আমাদের পোষা নীল চোখের বেড়ালছানা

আর তুমি আমাকে একটা নীল রঙের সোয়েটার বুনে দিচ্ছ তোমার তুলি ধরার মতো হাত দিয়ে।

ঠিক যেমন সোয়েটার মা বুনে দিয়েছিল বাবাকে, অফিস যেতে ঠান্ডা লাগতো বলে, আজ থেকে আটাশ বছর আগে।

আরো আটাশ বছর তুমি আমি অনন্ত পালিয়ে থাকবো রোহিণী, কেউ আমাদের খোঁজ পাবে না।

তুমি আমি বুক পেতে দাঁড়াব গাছেদের গায়ে যাতে একটি আঘাত আর না আসে।

আমাদের সমস্ত ভালবাসা এক নতুন নক্ষত্রভরা মফস্বলের আকাশ হয়ে উঠবে রোহিণী

তার নীচে দাঁড়িয়ে আমরা হাতে হাত ধরে গাইব ভালবাসার মার্চিং সং।

সমস্ত বিচ্ছেদ, সমস্ত মৃত্যু, সমস্ত আঘাত আমাদের এউ জায়গা ছেড়ে থেকে বাক্স প্যাটরা বেঁধে চলে যাবে দূরে।

আমরা ঠিক যতজন ছিলাম, ততজন থাকব। কেউ কোথাও হারিয়ে যাব না।

রোহিণী শুধু একবার এসো, শুনে যাও, একটা নতুন কবিতা লিখেছি। শব্দ নয়, নৈঃশব্দ্য দিয়ে…

কারণ প্রতিটি শব্দের গায়ে অনন্ত, অতল নৈঃশব্দ্য লেগে থাকে।

Facebook Comments

3 thoughts on “গদ্য : দীপ শেখর চক্রবর্তী Leave a comment

  1. পড়তে পড়তে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধ জগৎ তৈরী হল, যার শব্দ এখনও হয়ে চলেছে, প্রতিটা শব্দ বিলীন হয়ে যাচ্ছে একটা নৈঃশব্দ্যে

Leave a Reply