সুপ্রিয় মিত্র-এর কবিতা
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ
১. লেখা নেই
অক্ষত সিগারেটের সাদা ফিল্টার দেখে ভেবেছে
রবার। আগুন ধরালে পেন্সিল সূচাগ্র হবে।
ধোঁয়ার কালিতে তার
কত কত উঁচুনিচু লাইন টানা হয়ে
কুয়াশায় মিশে যেতে দেখা গেছে, ইয়ত্তা নেই।
দূর থেকে তুলসীমঞ্চ দেখে মা ভেবেছে দোয়াত।
হাওয়ার কাগজে
তিনবেলা তাঁকে ধূপের ধোঁয়ায় লিখতে পড়তে
দেখা গেছে –
চাকরি, চাকরি, একটা হিল্লে করে দাও।
কিন্তু উনি কোত্থাও নেই।
এমনকি ধূপের প্যাকেটে নেই কোনও ফুসফুসের ছবি।
২. ম্যাপ
কোনও অকারণ রহস্যে চারদিক ঝিম হয়ে আছে…
শোভাবাজারের গলিতে যে মেয়ে তাকিয়ে হাসছে,
সেই হাসি নন্দনের বইঘরে দাঁড় করিয়ে দিলে
মনে হবে ভালোবাসা ধুয়ে যাচ্ছে ভালো অপেক্ষায়…
পাশে, ভিখিরির ছেলেটির হাত দুটো কাটা
পয়সা ঝাঁকানোর তালিম তাকে তার বাপ দিতে পারেনি।
যেহেতু তার মৈথুনও নেই,
তাকে এক অর্থে বালক ব্রহ্মচারী ডাকতে ইচ্ছে হয়।
ইচ্ছে হয় সন্ন্যাসী বলি, ডাকি পরিব্রাজক।
ময়লা হয়ে যাওয়া প্যান্টে ফুটে উঠেছে
উথলে ওঠা কৈশোরের ছোপ। দূর থেকে দেখতে যেন ম্যাপ।
মেয়েটি আড়চোখে চেয়ে খুঁজে নিচ্ছে কলকাতা?
কত দূরে বর্ডার? বাংলাদেশ?
৩. চলে যাব
গাছের তলায় পাতা জমে আছে হেমন্তের।
আমার মনখারাপের অনুঘটনে তারা আরেকটু তাড়াতাড়ি
পচে গিয়ে মিশে যেতে পারে, প্রায়ই মনে হয়।
তারপর পরোক্ষভাবে গাছ নিজেকেই ভক্ষণ করে।
আমিও তো তোমাদের ভালোবাসি।
জন্ম দেব ব’লে বারবার ভক্ষণ করি।
মনখারাপের ভেতর একটা দুপুর শুধু ক্রিকেট ক্রিকেট।
ব্যাটের গুমোট জায়গায় লেগে সবুজ বল ছিটকে হারিয়ে গেছে সবুজতর ঝোপে।
খেলোয়াড়রা ছড়িয়েছিটিয়ে গেছে।
মনখারাপের ওপর একটা রাত।
স্বপ্নের ভেতর মৃত বন্ধু ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে বলে –
‘চলে আয়… কতদিন ক্রিকেট খেলিনি!’
৪. খুচরো আগুন
এত স্মৃতি এত স্মৃতি
ঘুণপোকা তাতে আসলে পারে…
বাকিটুকু বুঝতে আসে আগুন
সে সমর্পণ জানে।
অঞ্জলির ফুল কোথায় গিয়ে পড়ছে, দেখতে হয় না।
যেথা ইচ্ছা যেতে দেওয়া যায়।
সে খুচরো খুচরো বোঝে, যাতায়াতে যতটুকু লাগে।
সে তোমায় ফিরিয়ে দিচ্ছে
যে শোকে চা দোকানি ফিরিয়ে দেয় দু’ হাজারের নোট…
ভাঙা ছাদ, স্ত্রীয়ের চুড়ি, মেয়ের প্যাড, ছেলের জামা
গরম জল ছলকে পড়ে হাতে। খুচরো আগুন।
৫. দিকভুল
রাস্তার কোনও অন্ধকারই বলছে না, –
কখন ভিখারি-ভিখারিনী রাতের সঙ্গেও গাঢ় হয়।
প্রসঙ্গত, দিকভুল ক’রে তাদের সন্তান পেট চিরে বেরিয়ে পড়েছে।
রাস্তা পীচের হলে ব্ল্যাকবোর্ড,
ইঁট ভাঙলে চক তার আবিষ্কার।
খবরকাগজে যা লেখা তা বাংলা, ইংরেজি বা হায়ারোগ্লিফিক, যা খুশি।
হাঁড়ির পেছন ঘষলে কত যে কালো কালি
দু’হাতে নিয়ে দেওয়ালে লেপ্টে
হয়ে গেছে বইয়ের প্রচ্ছদ।
তারপর ক্লান্তি
দিকভুল ক’রে কত কবিতা যে আসে নিরক্ষর হাতে। কে জানে…
না পারে ফিরতে, বেরোতেও পারে না।
৬. গোপন কথাটি
তবু,
ভালো না থাকার নিয়মে নেই ভালো থাকার শুকনো এঁটো ঘ্রাণ।
প্রকাশ্যে লেখা থাকে – গোপনে মদ এখানে ছাড়ান।
পোস্টারের নীচে লেখা ছোট্ট ক’রে – ঠিকানা-উপগলি।
বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে কতবার যে বলে এসেছি – চলি!
তোমাদের ছাড়তে গেলে,
তোমাদের থাকা প্রয়োজনীয়।
৭. শাক
রোজ রোজ মেলা হ’লে মেলাকে বাজার মনে হত।
উৎসবের ভেতরে আছে কোনও যন্ত্রণার মাছ
যাকে ঢেকে রাখতে হয়।
‘কেন এত কথা কমে গেছে?’
এই নিয়ে সেদিন কত কথা হল আমাদের…

পরিচিতি : সুপ্রিয়র বড়ো হয়ে ওঠা খড়গপুরে। বর্তমানে একটি দৈনিক সংবাদপত্রে কর্মরত। হেঁটে হেঁটে আবিষ্কার করেন কলকাতার গলিঘুঁজি, আনাচ-কানাচ। নেশার মতো ভালোবাসেন মানুষের সঙ্গে মিশতে, কথা বলতে। প্রকাশিত বই- ‘ধরে নেওয়া যাক’ (মাস্তুল, ২০১৬), ‘এসেছ জন্ম পক্ষী দোহাই’ (মাস্তুল, ২০১৭) এবং ‘বেরিয়ে পড়ার ট্রেলার’ (ধানসিড়ি, ২০১৯)।
Posted in: Poetry, September 2019