জগন্নাথদেব মন্ডল-এর কবিতা
প্রথম কবিতা
এই একুশ বছরের যুবক-হাঁটু মুড়ে প্রায় সন্ধেয় ঘরের এক নির্জনে বসে নিরামিষ ভাত খাচ্ছি।
সাদা থান আড়াল করে আখায় শুকনো আইড়ীর শাখাপ্রশাখা জ্বেলে প্রেতের জন্য মাছ ভাজছে পিতা।
কুশের আংটি অনামিকায় পরে আতপ চাল, গঙ্গাজল, তিল, কলা চটকে পিণ্ড প্রস্তুত হয়েছে।
সমস্ত পুষ্করিণীতে ফেলে নেয়ে উঠেছি; দই ভাণ্ড মাটিতে আছড়ে ভেঙে গড়াগড়ি দিয়েছি আঙিনায়।
এইভাবে কি সম্পূর্ণ ঠাকুমাকে ভুলে যাব?
অই ঘোলা ঘোলা চোখ, বেড়ালের জন্য মাছ ভাত রেখে দেওয়া ঠাণ্ডা হাত…
হিম দিনে তিনবার স্নানে শোক ধুয়ে গ্যাছে খানিক;
শীতবোধ আর খিদেই বরঞ্চ তীক্ষ্ণ হয়েছে।
মন্ত্র আর শান্তিজল তলতা বাঁশের বেড়া দিয়েছে গৃহের চারিদিকে;
যাতে প্রেত কুয়াশা পেরিয়ে বুড়ী ফিরে এসে মিষ্টান্ন চাইতে না পারে আর…
কীর্তন বসছে নবদ্বীপ থেকে আসা রাধাশ্যাম
সম্প্রদায়ের।
ঠাকুমার পাকা কলায় অরুচি চিরদিন, আতপচালে বিষণ্ণ।
ফিরে যাচ্ছে মুখ নিচু করে।
আমি কি পাত্রে সাজিয়ে পঞ্চ ব্যঞ্জন ভাত কুলের চাটনি নিয়ে যাবে জলার ধারে?
জানুয়ারি মাসের সাঁঝ বেলা নামছে ধীরে লয়ে;
মনে পড়ছে শ্মশানে ঠাকুমা পোড়া ঘ্রাণ;
উঠে আসা ডান পা সপাটে মেরে শুইয়ে দিয়েছিল ডোমের লাঠি।
এক পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঠাকুমা চলে যাচ্ছে ওর প্রতিদিনের শীতল গ্রিলের ঘর, উলকাঁটা, বেড়াল ছেড়ে…
দ্বিতীয় কবিতা
মৃত্যু ঘনিয়ে আসা ইহুদি-চিকিৎসকের মতো সমস্ত ধারদেনা শোধ করে দেব।
চায়ের দোকানদার-৫০। বই কেনার টাকা-১২৫। অঙ্কুর দা পাবে-৩০০।
যেভাবে ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়া বন্যায় ডোবা মানুষ গৃহের জন্তুর দড়ি উপড়ে দেয় সেভাবে ছেড়ে দোব সমস্ত টিউশনির ছেলেমেয়েদের।
বুড়ি মা কাঁদবে, বাপ, দিদিও।
তিনদিনে শোক শেষ হয়ে এলে পড়শিরা বাড়ি বয়ে দিয়ে যাবে আতপচাল, সুমিষ্ট হলুদ কলা, প্রিয় সন্দেশ, চিনি, ছানা…
দ্বিতীয় বইয়ের কথা ভাবা হয় নি। শুধু কানের গোড়ায় শুনতে পাচ্ছি, জ্যাঠামশাই পড়ছেন – হে অর্জুন…।
জলপাত্র ঢনঢন। কেউ মাটিতে তীর গেঁথেও, পাইপ বসিয়েও জল তুলতে পারছে না। স্তর নেমে গ্যাছে।
তাই শুকনো হয়েই মরছি। মরণের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আতাবনের ভিতর দিয়ে জ্বলন্ত উটের পিঠে যাওয়ার সময় সুখস্বপ্ন দেখছি-শুখা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমানের শুকনো গাছগুলির তলায় জলের কুঁজোর গা ঘামছে। সারি সারি টলোমলো দিঘিতে কান উল্টে যাওয়া পদ্মপাতা। জোনাকি নাচছে।
এইবার চোখ উল্টে মরে গেলাম। তেষ্টায় ছাতি ফাটা, শুধু তিল কর্পূর খাওয়া পূর্বপুরুষ হয়ে গিয়ে প্রার্থনা করছি যাতে আমার বংশধর, কলোনির সবাই নলকূপে যথেষ্ট পানি পায়।
হে নাথ, আমার লক্ষযোনি ভ্রমণপ্রিয় আত্মার জলীয় অংশ উষ্ণদেশে বৃষ্টি হয়ে ঝরুক!

পরিচিতি : বসবাস কাটোয়াতে। কবিতা চর্চাই প্রথম ভালোবাসা। নিজের কবিতাকে গ্রাম বাংলার নির্যাস থেকে নির্মাণ করেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ – “মাটির সেতার”।
Posted in: Poetry, September 2019