লড়াই ছোড়াব নাহি… : সুদর্শনা চক্রবর্তী

বিরাট বড় আবাসন। দামও আকাশছোঁয়া, উচ্চতার মতই। আধুনিক সব স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাসিতার পাশাপাশি বাসিন্দাদের জন্য উপহার হিসাবে ‘প্রকৃতি’ও থাকছে। মানে জল টলটল সুইমিং পুল, কিংবা আরও উদার মনের আবাসন নির্মাতা হলে এমনকি মাছ ধরার ব্যবস্থা পর্যন্ত থাকে। তাছাড়া আবাসনের কংক্রিটের চৌহদ্দির মধ্যে এঁটে যেতে পারে এমন সবুজ মাঠ, যত সংখ্যক গাছ লাগালে নিজেকে বেশ ‘সমাজের উন্নতি করলাম’ ধরনের কেউকেটা মনে হতে পারে, তেমন সংখ্যায় গাছ, সঙ্গে পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ভাঙার কথা দেওয়া ইত্যাদি তো থাকেই। মানে আপনার পা মাটিতে না-ই পড়তে পারে, কিন্তু কিঞ্চিৎ মাটি আপনি উপহার পেয়ে যাবেন। শিশুরাও প্রকৃতি চিনে যাবে চমৎকার। আপনি বুঝতেও পারবেন না কখন বন্দী হয়ে গেলেন।

এমন কিছু কঠিন ছিল না আমাদের শৈশব, কৈশোরে বাড়ির আশেপাশে খেলার মাঠ, পুকুর, বড় বড় গাছপালা দেখা। সেটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক ছিল। কোথাও চোখে পড়ে গেলে এখনকার মতো অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকার দরকার হত না। বিভিন্ন স্কুলের হাতের কাজ বা বিজ্ঞানের ক্লাসে নানা গাছের পাতা, ফুল ইত্যাদি খাতার পাতায় লাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চল ছিল। তারজন্য মাথায় হাত পড়ে যেত না। কারণ একটু খুঁজলে বাড়ির আশেপাশেই সেসব দিব্যি অনায়াসে পাওয়া যেত। শৈশব থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে বেশ একটা তালমেল তৈরি হয়ে যেত। বৃষ্টিতে ভিজে কাদামাটি মেখে ফুটবল খেলা কেবল টেলিভিশনে জামাকাপড় কাচার সাবানের বিজ্ঞাপনের জন্য বরাদ্দ ছিল না। বাস্তবই ছিল। অন্তত তখনও।

ছবিটা বদলাতে থাকে নব্বইয়ের শেষাশেষি থেকে। ‘প্রমোটার রাজ’ নামক একটা আজব শব্দের সঙ্গে পরিচয় হয় আমাদের। চোখের সামনে সব পুরনো বাড়িগুলো ভাঙার কাজ শুরু হল, খেলার মাঠগুলোতে ঘাড় অনেকটা উঁচু করে তাকিয়ে থাকতে হয় এমন সব লম্বা লম্বা বাড়ি তৈরি শুরু হল, পুকুরগুলো কয়েক দিনের মধ্যেই বুজে যেতে থাকল, চারপাশে তাকালে বেশ বোঝা যেত গাছের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে অনেক। আসলে যা দেখছিলাম তার আড়ালে উন্নয়ন ঘটছিল। মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তাকে তো সবটুকু গ্রাস করে নিয়ে মাথা গুঁজতে হবে। বাড়ি বানাতে হবে। চাকরির সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান হোক না, বিরাট বিরাট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পেল্লাগি আকৃতির অফিস বানাতে না পারলে সমাজের সার্বিক উন্নতি বোঝা যায় না কি! তারজন্য অমন একটু-আধটু প্রকৃতি-ট্রকৃতি ধ্বংসের মতো ঘটনা ঘটতেই পারে। গায়ে মাখতে নেই।

আসলে প্রচুর টাকা ঢুকতে শুরু করে দিয়েছিল সেই সময় থেকেই। দেশের অর্থনীতি বোঝার জন্য সব সময়ে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। রোজকার বাজারে বেরোলে, যানবাহনে চাপলে বা ওই যে নিজের একটা বাড়ি বা নিদেন দু’কামরার ফ্ল্যাটের কথা ভাবলেই তা দিব্যি বোঝা যায়। নব্বইয়ের শেষের দিক থেকে মধ্যবিত্ত নামক শ্রেণীটি বিলুপ্তপ্রায় থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল। রয়ে গেল দু’টি শ্রেণী। এক দলের হাতে অনিয়ন্ত্রিত অর্থ, আরেক দল নিম্নবিত্ত, প্রান্তিক। আর এই দুই তরফের মধ্যে যে ব্যবধান তা অনতিক্রম্য হয়ে উঠতে লাগল ক্রমশই। এই বাড়-বাড়ন্তের মাঝে প্রথম কোপটা পড়ল আশপাশের গাছপালা, মাঠঘাট, পুকুর-নদীর উপরেই। নইলে ভাবা যায় শান্তিনিকেতনে কোপাই নদী বিক্রি করে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন এক বাঙালি শিল্পপতী তথা রিয়েল এস্টেট মালিক!

চারপাশ থেকে গাছ কেটে রাস্তা, শপিং মল, স্কাই স্ক্র্যাপার তৈরির দুর্দান্ত ফলটা এবছরের বিভিন্ন ঋতুতেই টের পাওয়া যাচ্ছে। স্কুলের বইতেও যেভাবে ঋতুর বদল, মরশুম পরিবর্তনের কথা বলা থাকে তা যে সম্পূর্ণ বদলে গেছে, প্রকৃতি যে পুরোপুরি উল্টো পথে হাঁটছে এবং তা যে ঘটছে শুধুমাত্র আমাদের আগ্রাসী লোভের কারণে তা বোঝাটা রকেট সায়েন্স নয়। কতটা জমি, কতটা জল-জঙ্গল দখল করলে আমাদের এই ক্ষমতা কায়েমের, প্রবল স্বার্থপরভাবে বেঁচে থাকার খিদে মিটবে তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। আমরা বুঝতে চাইছিই না।

প্রকৃতি প্রসঙ্গে ‘নয়া পরাধীনতা’ শব্দবন্ধটি কীভাবে প্রয়োগ করা যায় তা খুব স্পষ্ট নয়। কারণ প্রকৃতি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিষয়। মানুষের সৃষ্টি সে নয়। মানুষের হাত পড়ে আজকে যখন সে বিপন্ন তখন পরাধীনতাকে ঠিক কোন্‌ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায় তা বোঝা দুষ্কর। মানে, এ যেন অনেকটা নিজেরাই নিজেদের হাতে বেড়ি পরানোর মতো ব্যাপার। আমাদের সামগ্রিক অস্তিত্বই যে বিষয়টির উপর নির্ভরশীল, কোনও কৃত্রিম নির্মাণ যেখানে শেষ পর্যন্ত আমাদের রক্ষা করতে পারবে না সেখানে পুঁজিবাদী অর্থনীতির যাঁতাকলে পড়ে তার থেকে বেরোতে পারার চেষ্টা না করাটা আমাদেরই অস্তিত্ব সংকট তৈরি করছে। কর্পোরেট আগ্রাসন দিনের পর দিন যত শক্তিশালী হচ্ছে ততই প্রকৃতির নাভিশ্বাস উঠছে।

এই পরাধীনতার আবহে স্বাধীনতার লড়াইটা একমাত্র লড়ছেন জল-জমি-জঙ্গলের আদি, অকৃত্রিম ভূমিসন্তানেরা। সেইসব বনবাসী মানুষেরা যাঁরা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বিশ্বাস করেন এই জীবনের জন্য তারা প্রকৃতির কাছে ঋণী। এই সম্পর্কটা শুধু দাতা-গ্রহীতার নয়। এই সম্পর্ক এক আশ্চর্য পারস্পরিক সমঝোতার, যা সর্বদাই মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃতি ও মানুষ কেমনভাবে একে উপরের উপর নির্ভরশীল। দু’জনের বাঁচা-নরাই নির্ভর করে পরস্পরের উপরে। এই সম্পর্কের সমীকরণ কোনওভাবেই নষ্ট হতে দিতে রাজি নন বনবাসী মানুষেরা, ভূমিসন্তানেরা। তাঁদের তো আসলেই হারানোর কিছু নেই। তাঁদের লোভ আমাদের মতো সর্বগ্রাসী নয়। তাঁরা নিজেদের অধিকার জানেন না হয়তো, তবে জানেন যে প্রকৃতি তাঁদের জীবন, যা নিজেদের সবটুকু দিয়ে তাঁরা রক্ষা করার লড়া্টা লড়েন।

সেইজন্যই রাষ্ট্র বারবার চায় বনবাসী মানুষদের তাঁদের বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে। যে আইনি কারণ রাষ্ট্র এরজন্য দেখায় বা তৈরি করে তাই প্রকৃত বেআইন। রাষ্ট্র একটি আইনের আওতায় দেখিয়ে দেয় বনবাসী মানুষেরা নিজেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কী কী করতে পারবেন না। অথচ দায়িত্ব নেয় না এই মানুষগুলিকেই বুঝিয়ে দেওয়ার যে আইন তাদের জল-জমি-জঙ্গলের উপর কি কি অধিকার দিচ্ছে। তাহলেই যে রাষ্ট্রের দখলের রাজনীতি চ্যালেঞ্জের সামনে পড়বে। তবে তারা বোঝাক আর না-ই বোঝাক প্রতিরোধ ঠিকই তৈরি হয়ে যায়। দেশের আনাচে কানাচে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। উচ্ছেদ, জীবিকার উপর আঘাত, প্রকৃতিকে ধ্বংসের করার বিরূদ্ধে এই মানুষগুলিই কুঠার, তীর-ধনুক বা মুষ্ঠিবদ্ধ হাত নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। আজও, এখনও।

তাই সমুদ্রের ধারে যখন সরকার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির প্রকল্পের কথা ভাবে তখন একবারও তারা চিন্তা করে না ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের কথা। তাঁদের বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে তৈরি হয়ে আসা একটা পেশাগত দক্ষতা যা সম্পূর্ণতই প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল আর প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত তা নষ্ট করার পরিকল্পনা করে। টোপ দেয় পরের প্রজন্মকে শ্রমিক তৈরির। যারা অদক্ষ শ্রমিক হবেন ও নতুন করে শোষনের চাকায় যুতে যাবেন। তবে এই মৎস্যজীবী মানুষেরা যে সকলেই সরকারের এই সুবর্ণসুযোগকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে রাজি তা একদমই নয়। দেশের নানা প্রান্তে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় উপকূল সংলগ্ন এলাকার উন্নয়ন নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলছেন, রুখে দাঁড়াচ্ছেন।

ধরা যাক, সেই পাহাড়ের কথা, যেখানে স্বাভাবিক নদী-নালার গতি রুদ্ধ করে সরকার, বিদেশি কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে চুক্ত করে প্রকৃতি-পরিবেশের উপর তার প্রভাবের খতিয়ান না করেই, আঞ্চলিক মানুষের জীবন-জীবিকা, সামাজিক যাপন, ধর্মীয় বিশ্বাস সব কিছুর উপর কী আঘাত আসতে পারে তার পরোয়া না করেই বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করে ও আরও প্রকল্প পরিকল্পনা করে। তখন তো সেই আদিবাসী মানুষগুলির সরকার বিরোধী হয়ে প্রতিবাদে পথে নামা, আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া পথ থাকে না। আর তাঁরা সেটাই করে দেখিয়েছেন। তাঁদের লড়াই সরকারী প্রকল্পের উপর আদালতের স্থগিতাদেশ জারি করতে পেরেছে। এই ছবিটা বিশ্বের সর্বত্র এক।

যেমন সাহিত্যসভায় একটা গাছের চারা উপহার দেওয়াটা শহুরে শৌখিনতা হতেই পারে, কিন্তু যে মানুষগুলি একথটা গোটা অঞ্চলের গাছ বাঁচানোর জন্য ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের স্নেহধন্য ক্ষমতাশালী লোকজন, পুলিশ, প্রশাসনের বিরূদ্ধে দাঁড়িয়ে বুক দিয়ে গাছ রক্ষা করে, গাছ বাঁচাতে রাতপাহারা দেয়, যারা বিভিন্ন এলাকা, স্কুলে গিয়ে বিনা স্বার্থে পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা তৈরি করে – সেই মানুষগুলোই ধরে নেওয়া যাক এই স্বাধীনতার লড়াইয়ের বিপ্লবীর দল।

কৃষকদের রক্তাক্ত পায়ে হেঁটে রাজপথ বন্ধ করে দেওয়া লং মার্চ-এর ছবি আমাদের প্রগতিশীলতায় এক দারুণ ধাক্কা দেয়। ঐ মানুষগুলোর ক্ষয়াটে অথচ সাহসী মুখ মনে করিয়ে দেয় তাঁদের দেওয়া অন্নে বেঁচে আছি। এই মাটি তাঁদের হাতে লালিত হয়, শষ্য দেয়। আর মায়ের মতো সেই মাটিকে আগলে রাখেন এই মানুষগুলো। শস্যের দাম না পেয়ে যখন অগুন্তি কৃষক আত্মহত্যা করেন, তখনও দেশের কোথাও না কোথাও জন্মে যায় সংবাদপত্রের পেজ থ্রি-তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা রেঁস্তোরা। এখন আর সেসবের দাম দেখে চোখ কপালে ওঠে না আমাদের। শুধু সেই কৃষকের জন্য ‘আহা রে’ শব্দটা বাঁচিয়ে রাখি। আর নয়া পরাধীনতার বিরূদ্ধে দাঁড়িয়ে পরের দিন সূর্য ওঠার আগেই ক্ষেতে পৌঁছে যান সেই কৃষকের পরিবার, কোনও রাজনৈতিক দলের আশ্বাসের পরোয়া না করে, নিজের বেঁচে থাকার লড়াইটা নিজেই লড়ে নেওয়ার তাগিদে।

কোথাও যেন শোনা যায় – ‘গাঁও ছোড়াব নাহি/জঙ্গল ছোড়াব নাহি/মায় মাটি ছোড়াব নাহি/লড়াই ছোড়াব নাহি’।

[লেখক – স্বাধীন সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা।]

Facebook Comments

Leave a Reply