অনুবাদ কবিতা : রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

পিটার গিজ্জি ও বাস্তবতার লিরিক্স
মার্কিন কবি পিটার গিজ্জি, যাঁর কবিতায় আছে সেই গীতল বাস্তবতা, অথচ কৃত্রিম ছন্দ নেই, শুধু শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে ধ্বনিত হয় এক রিদ্ম, শোনা যায় তার স্পন্দন ও প্রতিবাদ। চিহ্ন ও চিহ্নিতের সম্মিলনে উচ্চারণ করেন সেই চিহ্নকটি যা তাঁর ভাষার সূত্র। পাঠকের কবিতা ভাবনাকে ট্রিগার করেন ধ্বনির সম্পাদনে, সচল ধ্বনিচিত্র নির্মাণে। নিজের জীবন খুঁড়তে খুঁড়তে কবি চলেছেন কবিতার খোঁজে যা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ভ্রমণ; যে কক্ষপথের সান্নিধ্যে শোনা যায় বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর বাবার মৃত্যুদৃশ্যের বিষাদগ্রস্ত বাস্তবতা; যার সামনে দাঁড়িয়ে কবি উপলব্ধি করেন জীবনের সেই একমাত্র সত্যটিকে, যার নাম মৃত্যু। আর সেই বাস্তব গীতলতাকে অনুভব করেছেন ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতো প্রকৃতির মধ্যে, যা এক বিলীন প্রক্রিয়ায় মানুষকে দেয় তার জীবন ও মৃত্যুর, তার নিয়তি ও মুক্তির এক নতুন দর্শন। প্রকৃতির প্রাণের ভেতর প্রবেশ করে নিজের আবিষ্কারের সংকেতগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন আর শব্দ ও ধ্বনিসংযোগে সেই সংকেতের দিকে ছুটিয়ে দিয়েছেন পাঠককে। কোনো ইজম্ নয়, কোনো প্রতিষ্ঠিত ফর্ম নয়, বরং প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে আপন ভাবনার উপযোগী কবিতার এক নতুন ফর্ম সৃষ্টি করেছেন, যেখানে স্থাপিত হয়েছে বর্তমান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুহূর্তের এক অভূতপূর্ব সাউন্ডট্র্যাক; বিষয়হীন সমাবেশে, সংযোগহীন রিদ্মে। পিটার গিজ্জি[1] (জন্ম ১৯৫৯) বর্তমানে আমহার্স্টের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি সাতটি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। ২০১৬ সালে তাঁর কাব্যগ্রন্থ Archeophonics ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ডের জন্য চূড়ান্ত পর্বে নির্বাচিত হয়। এছাড়া তাঁর বহু আলোচিত বইগুলি: In Defense of Nothing: Selected Poems 1987-2011 (২০১৪), Threshold Songs(২০১১)। পিটার গিজ্জি ১৯৯৪ সালে অ্যাকাডেমি অফ অ্যামেরিকান পোয়েটস দ্বারা প্রদত্ত Lavan Younger Poets Award এর প্রাপক। তাঁর প্রাপ্ত কবিতার ফেলোশিপ: The Rex Foundation, The Howard Foundation, The Foundation for Contemporary Arts, The John Simon Guggenheim Memorial Foundation এবং কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাপ্ত The Judith E. Wilson Visiting Fellowship. তাঁর সম্পাদিত প্রজেক্ট: o-blek: a journal of language arts, The Exact Change Yearbook, The House That Jack Built: The Collected Lectures of Jack Spicer and, with Kevin Killian, My Vocabulary Did This to Me: The Collected Poetry of Jack Spicer.

Archeophonics অর্থাৎ প্রত্নধ্বনিতত্ত্ব, তাঁর বহু আলোচিত কাব্যগ্রন্থ। নামকরণ কবির উদ্ভাবিত এক নতুন শব্দে, Archaeology (প্রত্নতত্ত্ব) এবং Phonics (ধ্বনিতত্ত্ব) শব্দের সন্ধিকরণ। আর্কিওফোনিক্সের অন্দরমহলে আছে এক প্রাচীন টেকনোলজি ফোনাটোগ্র্যাফির ইতিহাস। “Au Clair de la Lune,”(“By the light of the moon”) এক ফরাসি লোকসংগীত। ফরাসি বুকবিক্রেতা স্কট দে মার্টিনভিলে ১৮৫৭ সালে আবিষ্কার করেন ফোনাটোগ্র্যাফির এই যন্ত্রটি, যেখানে শব্দের প্রতিঘাতে চলা একটি স্টাইলাস তৈরি করে শব্দতরঙ্গের ভিসুয়্যাল রেকর্ডিং এবং এই পদ্ধতিতে তিনি রেকর্ড করেন ওই লোকসংগীতটি। তিনি একটা সিলিন্ডারের ওপর কাগজ মুড়ে সেটা লন্ঠনের ওপর ঘোরাতে থাকেন, যতক্ষণ না তা লণ্ঠনের ভুসোকালির ধোঁয়ায় কালো হয়ে যায়। তারপর দুটো স্টাইলাস চালনা করেন সেই ভুসোকালির ওপর। একটা স্টাইলাস চলে টিউনিং ফর্কের কম্পনের দ্বারা আর অন্যটি একটি পর্দার ভেতর দিয়ে বাহিত কোনো ব্যক্তির স্বরধ্বনির দ্বারা। তারপর কাগজের ওপর তৈরি প্যাটার্নটি কেমিক্যাল দিয়ে ফিক্স করা হয়। তৈরি হয় শব্দের ভিসুয়্যাল প্রতিরূপ। দীর্ঘ দেড় শতক পর ইতালির এক অডিও ইতিহাসবিদ ডেভিড জিইভানোনি স্কটের তৈরি সেই স্বরধ্বনির প্লেব্যাক তৈরি করেন অপটিক্যাল ইমেজিং ও ভার্চুয়াল স্টাইলাস এর মাধ্যমে। এই সেই প্রত্নধ্বনিতত্ত্ব, শ্রবণমাত্রায় থাকা এক ধোঁয়ার পর্দা যার আড়াল থেকে উঠে আসা স্বরধ্বনি কবি পিটার গিজ্জি পরিদর্শন করছেন, যেখানে জড়িয়ে যাচ্ছে জীবনের অস্থির স্থায়িত্বের প্রশ্নগুলো। ২০১৮ সালে Bridgeable Lines: An Anthology of Borderless World Poetry in Bengali অ্যান্থোলজিতে কাজ করতে গিয়ে মুগ্ধ হই তাঁর শেষতম কাব্যগ্রন্থ নিউ পোয়েমস: দ্য ব্রাদার ইন এলিসিয়ম পড়ে। আর সেই মুগ্ধতা থেকেই এবারের যাত্রা তাঁর আর্কিওফোনিক্স কাব্যগ্রন্থে, সেখান থেকেই কিছু অনুবাদ।
কক্ষপথের সান্নিধ্য যখন বিষাদগ্রস্ত
আমাকে যখন মেসেজ পাঠাও
তোমার শরীরে চিৎকার করে
ওই কিশোরী মাইক্রোওয়েভ।
ঠিক এ সময় তোমাকে চাই
আমার গানে।
অন্ধকার ঘরের ভেতর পথ খুঁজছি
খুঁজছি ভালোবাসার অন্য ভাষা।
বাঁদিক থেকে কিছু বলছে
চিনতে পারি না আমি।
মেঝেটা কেমন সরে সরে যায়
এটা যে কেবল রাতেই হয়
এমন তো নয়
দিনের বেলাও
যখন ভাবতে চাই না তাকে।
আমি দেখেছি একটা রক্তকম্লা গোলা
ধরে ফেলেছে আমার জানলা।
আমি আলোকে শুনছি আর সে বলল, সময়।
আমি সময়কে শুনছি, সে বলল, আহ্।
জরুরি তোমার গর্জে ওঠা এই নিষ্ঠুর চ্ছিন্নভিন্নতায়।
জরুরি ভয় দেখানো তোমার লুকোনো গর্ত থেকে
তার গন্গনে বিশৃঙ্খলতা থেকে।
গোলাটা আমার দখল নিলেও আমি ভালোবাসি তাকে।
ধাতু ও পাথরের অদ্ভুত টুকরোগুলো
শোঁ শোঁ শব্দে ঘিরে ফেলছে আমার ভালোবাসার মানুষজন।
আমি ঘুরি সেও ঘোরে
ঘুরছে সবাই কাছাকাছি।
দূর থেকে এমন শান্ত মনে হয়
মনে হয় ওরা একেই বলে ফিজিক্স অথবা আইন।
ওরা যদি এতই সংগঠিত তবে আমরা এমন কষ্টে কেন?
ভেবেছিলাম দিনটা বোধহয় শুরু হল
এখন দেখি চলে সে গেছে অনেক আগেই।
বাইরে নিষ্ঠুর ডাভের ভেঙে পড়া জানলা।
দিনটা তেমন অনুকূল নয়।
কে তুমি আমার কাছে?
তল বুঝতে চাইছ?
যে তল আমাকে ধরে রাখে
অপেক্ষায় রাখে।
জানি না কোথায় যাবো
মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটায়।
ঘরে, যেকোনো ঘরে থাকার মানে কী?
দেখো হাওয়া কেমন ধাক্কা মারছে জানলায়।
আমি তো জানি ভাঙা শার্সি
সারাই হয় না আর।
কার এত সময় আছে এসবের?
ভাঙনের ধ্বংসের গানে?
দিনের শেষে কাঠের দানার ওপর
টলটলে আলো।
কম্লার একাকিত্বে।
কম্লার কমনীয়তায়।
—————-
অন্ধকারকে মুক্তি দাও
নতুন মিথোজীবীতে
আমি কিন্তু একটা পথ পেয়েছি ‘না’ বলার
বাড়ির এই কাঠগুলোকে
কেবলই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ
কথা বলা বন্ধ হয় না তার
‘না’ বলার একটা পথ পেয়েছি আমি।
আমাকে অপেক্ষা করতে হবে
রৌদ্রপ্রণীত বনের উষ্ণতায়
নিজেকে বিলীন করতে হবে
নয়তো এইসব অন্যভাবে
আমি হারিয়ে গেছি, তা কি বলেছিলাম
আলোর ঝালরটাকে
এপথে হাঁটতে দেখেছি আজ
তুমি কি শুনতে পাচ্ছো
পাইনপ্রশাখার ওই মর্মরধ্বনি
বনের গভীরে
এ কি হাওয়া না কি কোনো জীব
আমি কি এখানে না কি সে-ই এসেছে
এই তো প্রথম দিন
কিছুনার দিন
কিছুনা বছরে
সে আমাকে সাহস দিয়েছিল
আভাস দিয়েছিল নীলের,
মেঘের, বিদ্যুৎময়
আর নৃত্যরত
এমন ঝলক
আমি দেখিনি কখনও
নীচে নেমে এল
এইসব ছুঁয়ে দিতে
এমনই ছিল প্রথমদিন
——————
গুগুল পৃথিবী
প্রশস্ত স্থান থেকে পৃথিবীকে দ্যাখে; তার অসম নীল; আমিও ভাবছি তোমার মুখ, চিরবন্য তার অন্ধকার, তার জ্বলন্ত গনগনে ক্ষত; এটা ঠিক আকাশ ছিল না, অনেকটা যেনবা তিরবেঁধা আকাশ; একসময় লিখেছিলাম আমি শুধু তোমারই মুখ দেখি; পৃথিবীটা ভেঙে পড়েছে আজ রাতে, যখন তুমি অনেক দূরে সমুদ্র আমার ভালো লাগে না, এই মেঘগুলোও না, এইসব গাছেদের সামিয়ানা, দূরত্ব মহিমায় রাখা এই স্পর্শ-পর্দা আমার ভালো লাগে না।
——————-
স্নায়ুকোষ সংযোগে বাক্য সমাহার
ধ্বনি চেয়ে আমি
ধ্বনি খুঁড়েছিলাম
বরফ আর রক্তের জন্য
আসব ও আয়নার জন্য
ইলেকট্রন
আর তড়িতশক্তি
আবর্জনার জন্য
ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পের জন্য
আমাদের
যৌথ ভাগ্য
ভবিষ্যৎ
যতদিন সৈন্য আছে
সেখানে
কবিরা থাকবে
যতদিন কবিরা আছে
সেখানে একটা সেতু্ও থাকবে
নৈঃশব্দ্যের ভেতর একটা ঘর গড়তে চেয়েছিলাম
আবর্জনার জন্য তরঙ্গে ভেসে গেল
কণাদের জন্য যেমন এক তড়িতাধান
এর অবিশ্বাস্যতাও
বেঁচে থাকার জন্য
এগুলোর জন্য ওগুলো বলাই যায়
যতক্ষণ না
রহস্য হয়ে ওঠে এলিজি
মার্চ যেমন এপ্রিলের দিকে যাচ্ছিল
দিনটা তেমন কথা বলছিল দিনের সঙ্গে
তুমি যা ভেবেছিলে
তার জন্য
তুমি যা কবর দিলে
তার জন্য
তুমি কে
[1] https://www.petergizzi.org/
[অনুবাদক: কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথাবিরুদ্ধ বাক্, সংস্কারবিরুদ্ধ রীতি তাঁর নির্মাণের ব্যসন, যেখানে দেয়াল ভাঙার মন্ত্রণা ঘরের ভেতর ঘর বাঁধার গল্প বলে। আর সেই বাক্রীতির খোঁজে যেমন ঘর বেঁধেছেন বাংলা বইকুণ্ঠে তেমনি খোঁজ করেছেন বিদেশী কাব্যতত্ত্ব। শূন্য দশকের কবি কলকাতায় বড় হয়ে উঠলেও আজ ২০ বছর মুম্বাইতে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ: ৪টি কাব্যগ্রন্থ, ২টি গল্প, ১টি পাঠপ্রতিক্রিয়া, ও একটি গদ্যসংকলন। ২০১৯ এর বইমেলায় প্রকাশিত হয় একটি অ্যান্থোলজি, Bridgeable Lines: An Anthology of Borderless World Poetry in Bengali. ইংরেজি ভাষায় সদ্যপ্রকাশিত তাঁর Nocturnal Whistle(২০১৯) বইটি Recurring Poetry-র এক নতুন কাব্যশৈলী। এই কাব্যশৈলীর অনুসরণে ২০১৭ সালে বাংলা ভাষাতেও প্রকাশিত হয় তাঁর “তামসের আলোকভ্রমণ”।]
Posted in: August 2019, Translation