রাণা বসু-এর কবিতা
পেখম
এখন এখানে বসেই আরো একটা গাছের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়। কোনো কিছুর প্রভাব থেকে নিজেকে আড়াল করার কারণ খুঁজতে গিয়ে যখন জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, তখন ভাবি প্রভাব কি শুধু ওরই ছিল, আমার ছিল না ওর ওপর!
এখানে গ্রহ নক্ষত্র নিহারিকা সপ্তর্ষিমন্ডল নিয়ে কথা বলার সুযোগের অপেক্ষায় বহু লোক হাপিত্যেশ করে বসে থাকে, তারপর তাদের দেখা ঘটনার সাথে কেমিক্যাল্ মিশিয়ে তৈরী করে আর একটি ঘটনা। হয়ত সেটা নতুন, হয়ত পুরনো, কিন্তু বাস্তব নয়, পরাবাস্তবও নয়। জাদুবাস্তবতা নিয়ে কথা বলার লোক আমি নয়। ব্যাপারটা কেমন পরাধীন পরাধীন লাগে। বরং এই সময়গুলোতে ছিপ ফেলতে ভালো লাগে, মাছ ধরা পড়লে কাঁটা থেকে ছাড়িয়ে জলে ফেলে দিয়ে আবার ছিপ নিয়ে বসি, ওই একই মাছ ওইদিন আর কখনও পড়ে না। মনে হয়, দিক্ নির্ণয়ের ক্ষমতা মানুষের থেকে পশু-পাখিদের অনেক বেশি।
সারাদিন একা একা থাকার প্রসঙ্গটা মারাত্মক ফেল মেরেছে জানা হয়ে যাবার পর একটু রোগা হয়ে যাবার দিকে ঝুঁকেছিলাম। এখন আরো মোটা হয়ে গেছি, সঙ্গে মোটা হয়ে গেছে আমার চিন্তা ভাবনাগুলো। দেখার শেষ হয় না জেনে যাবার পর দেখাটাই প্রান্তিক হয়ে উঠেছে। একা অর্থে আমি অনেককে পাই। যেমন একা একা আমি ট্রেনে উঠে পড়লাম অথবা একা একটা গাছের পাশে বসে আমি পুকুরের দিকে চেয়ে দেখি রোজ।
শুকনো পাতার মত পুরনো হতে চাই আমি আজ। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা শুকনো গাঢ় খয়েরি রঙের, শিরা উঠে যাওয়া, খসখস শব্দ করার অধিকারসহ, সালোকসংশ্লেষ করার অধিকারবঞ্চিত। সাইকেল বাইক বড় গাড়ির অত্যেচার সহ্য করার ক্ষমতাসহ আমি গাছের একটা অতিরিক্ত অংশের মত গাছের তলায় পড়ে থাকতে চাই।
চামড়ার ওপর করা রঙপেন্সিলের কাজের মত বিবস্ত্র হয়ে একা থাকার অধিকার আমি কেড়ে নিতে চাই রাষ্ট্রের থেকে। অথবা একা করে দিতে চাই রাষ্ট্রকে।
মৃত্যু ও জীবন সংক্রান্ত
একটা লাল ছেলে আর একটা কালো মেয়ে ছাদে দুর্ভিক্ষের মত দাঁড়িয়ে আছে। সকাল সাতটায় এই দৃশ্যটা দেখার সময় ‘আদানপ্রদান’ শব্দটা মাথায় আসেনি। ওরা আদানপ্রদান করছিল। ছেলেটার একটা হাত মেয়েটার কাঁধে, মেয়েটার একটা হাত ছেলেটার অন্য হাতে। ওরা কোনোদিকে তাকাচ্ছিল না, শুধু দাঁড়িয়ে ছিল একে অন্যের দিকে চেয়ে। আদানপ্রদানের যে অংশটা অপ্রয়োজনীয়, সেটা মেয়েটার অন্য হাত দিয়ে বেরিয়ে পড়ছিল ছাদের ওপর। ওরা পড়েই ভেঙে যাচ্ছিল বিন্দুতে, তারপর অনু পরমানু এবং শেষে ওরা তরল হয়ে যাচ্ছিল। কঠিন থেকে তরল হবার এই প্রক্রিয়াটা জানা ছিল না আমার। আমি তাকিয়ে রইলাম হাঁ করে। ওরা দাঁড়িয়েই ছিল। কোনোদিকে না তাকিয়ে। বরং শুধু নিজেদের দিকে তাকাতেই ওদের সমস্ত সময় মরে যাচ্ছিল। আমার সময় নেই, সুতরাং তার আদানপ্রদান বা মরে যাবারও কিছু নেই। তাই আমি তাকিয়ে ছিলাম। বেলা বাড়ল, রোদ উঠল দারুন। ওদের চারপাশে একটা হালকা গোলাপী বলয় তৈরী হল। ওরা ক্রমশ লম্বা হয়ে উঠছিল আর ওদের অপ্রয়োজনীয় অংশ থেকে তৈরী হওয়া তরল গড়িয়ে গিয়ে ছাদের এককোণে থাকা পাইপ বেয়ে নীচে গিয়ে পড়ছিল ঘাসের ওপর।
আমি নেমে এসেছিলাম এরপর। কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা গিয়ে বসেছিলাম আমার বিছানায়, সেখানে যত পেন্সিল আর ইরেজার ছিল সব সরিয়ে প্যালেটের রঙে আঙুল ডুবিয়ে ডুবিয়ে আমি একটা কালো আর্ট পেপারে লাল রঙ দিয়ে একটা ছাদ আঁকছিলাম, বাড়ি ছাড়া শুধু ছাদ আঁকা যে কত কষ্টকর আমি বুঝেছিলাম সেদিন, তারপর গোটা কাগজটাই লাল রঙে ভরিয়ে ফেলার পরও যখন কালো রঙটা পুরো গেল না, আমি ভাবতে লাগলাম গাঢ় কালো অন্ধকারে ল্যাম্পপোস্টের লাল আলোর কথা, একমাথা কালো চুলে একটুকরো লাল সিঁথির কথা, আমার অবিবাহিত জীবনের কালো অংশে তোমার লাল অঙ্গের কথা..
সেদিন আমাদের শ্মশানে অনেকবার লাল আলো জ্বলেছিল, রাতে বাড়ি ফেরার সময় আমি গনগনে কয়েকটা কাঠও দেখেছিলাম পড়ে থাকতে। মানুষ মারা গেলে কোথায় যায়!! স্বর্গ কী!! মারা যাবার পর কি তাকে মানুষ বলা যায়! আকাশের দিকে চেয়ে হঠাৎ মনে হল যেন, মানুষ মারা গেলে মহাকাশে ঘুরতে থাকে। বেশ কিছু বছর পর পর তাই গ্রহগুলোর উপগ্রহ সংখ্যা বাড়তে থাকে। গ্যালাক্সিতে নতুন গ্রহানুপুঞ্জের দেখা পাওয়া যায়। এখন একটাই প্রার্থনা, বাবা যেন পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহের সাথে এই খেলাটা না খেলে।
Posted in: August 2019, Poetry