আপোষ কিংবা দ্রোহ- স্বস্তিক্ষেত্র না থাকাই ভাল : প্রবুদ্ধ ঘোষ
“The city of mirrors (or mirages) would be wiped out by the wind and exiled from the memory of men at the precise moment when Aureliano Babilonia would finish deciphering the parchments, and that everything written on them was unrepeatable since time immemorial and forever more, because races condemned to one hundred years of solitude did not have a second opportunity on earth.”- Gabriel Garcia Marquez
পরাধীনতা মানেই যা অবশ্যম্ভাবী, তা হচ্ছে উপনিবেশ; কলোনি না থাকলে পরাধীন করার ডমিন্যান্ট স্বাদ পায়না ঔপনিবেশিক। আর, পরাধীনতার ইতিহাসে দু’টো ধারা থাকে- মেনে নিয়ে, মেনে নিতে শিখে সেই ‘ব্যাঙ সেদ্ধ’ করার থিওরিতে বিশ্বাস করে যারা এবং পরাধীনতার রাতদিনে অবাধ্যতায় না-মানতে-চাওয়ায় জেগে থাকে যারা। কলোনি’তে এই দুইই থাকে। ইতিহাস শেষপর্যন্ত কে লিখবে, সেই নিয়েই তৈরি হয় বাকি ইতিহাস। যারা পরাধীনতায় উথলে ওঠা জ্যোৎস্নাকে আরও একটু উজ্জ্বল দেখে, তাদের ইতিহাসে ডমিন্যান্টদের শিল্পগুণ বড় মহিমান্বিত হয়; ঔপনিবেশিকের পদ্ধতি ধারকর্জ্জ ক’রে তৈয়ার হতে থাকে শিল্প, নিরবচ্ছিন্ন শিল্পোৎপাদন। তা বেশ মসৃণ, তা বেশ রঙ্গিন ও সুখশান্তির ‘এরপর তাহারা সুখে বসবাস করিতে লাগিল’ কমনবাক্য। দ্বিতীয় পক্ষের দুয়োরানিরা বুঝে যায়, ‘কী যে বীভৎস মজা’ শিল্পোৎপাদিত হয়ে চলেছে হয়ে চলেছে আর জেগে থাকবার সাধটুকুকে নুনজারিয়ে বয়ামে বন্ধ ক’রে রাখছে। অথচ, কিছু অন্ততঃ একটা জগৎ ফর্দাফাঁই করার সাধ থাকলেও এদের হাতে বিস্ফোরণ ঘটানোর মালমশলা খরিদ করার পয়সা নেই। অগত্যা যা থাকে তা ওই কিছু অক্ষর, কিছু আখ্যান, কিছু চরিত্র আশপাশ থেকে ছেনে তোলা আর রাগী রাগী স্বপ্নগুলো যারা ক্ষয়াটে শরীরেও কী এক জ্বলজ্বলে চোখে জাগিয়ে রাখে প্রতিস্পর্ধা। পরাধীনতার আনদবাসরে কিংবা নয়াপরাধীনতার বিশ্ববাজারে এদেরকে বিবেকের রোলে নামিয়ে দিতে দ্বিধা হতে পারে বটে, কিন্তু এরা বর্তমান নিংড়ে ভবিষ্যতের বারুদ কিছুটা জমিয়ে রাখে বলেই অন্য ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়, পোকায় কাটা বা ঔপনিবেশিকরা তা খানিক পুড়িয়ে দিলেও। রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বাস্তু বা নয়া পরাধীন বা ছিন্নমূল বা বেগাঁউয়া লোকেদের এই স্থিতিশীলতাকে ঘেন্না করার একটা ক্ষ্যাপাটে বর্ণনার ঝোঁকে লিখছেন- “এরাও পালাচ্ছিল। মুছে ফেলেছিল, অস্বীকার করছিল বর্তমান। বর্তমান, যা তাদের জীবন, প্রতিদিনের বাঁচা- সেখানে ঘেন্নায় থুতু ফেলছিল, শাপশাপান্ত করছিল… স্বাধীনতা এক মৃত ভারতবর্ষ প্রসব করেছে।”
বর্তমানকে অস্বীকার!? অথচ ধর্মগ্রন্থ থেকে ধর্মগুরু থেকে স্কুলম্যাস্টর থেকে চকচকে ডাক্তার- সকলেই তো বলে বর্তমানকে জাপটে বাঁচার কথা। কারণ, আদতে কেউই এমনকি সেইশব জ্ঞান দেওয়া লোকলস্করগুলোও কেউই বর্তমানে বাঁচে না। সাহিত্যই বা কী ক’রে বাঁচে? পাঠকের সঙ্গে অথ্রের নিবিড় সেতু যদিও বর্তমান, কিন্তু সেই সেতুটা পাঠের ভেতরের পথে পথে উবে যায় একটু একটু ক’রে। অথর্ দু’ভাবে টানতে পারে তার পাঠককে- অতীতে আর ভবিষ্যতে। পরাধীন সময়ে কেউ কেউ, ভবিষ্যতের দিকে একটু গোড়ালিতে ভর দিয়ে কপালের নিচে চোখের ওপরে হাত রেখে, একটু দূরে দেখে বলে, “The fact is that the prevalence of Blank-verse in this country, is simply a question of time. [Bengali Readers] will soon swear that this is the noblest measure in the language.” পরাধীনোত্তর দেশিশাসক-পরাধীন পরিস্থিতিতে কেউ কেউ তাঁদের সাহিত্যভাষাকে চেঁছে ছুলে লিখে রাখেন ‘কখন কোথায় কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে…’; অর্থাৎ সম্ভাবনার ভবিষ্যত হাতিয়ারটুকুর হদিশ দিয়ে যাওয়া। কিন্তু, বেশিরভাগই তো অতীতবাক্য সাজাতে সাজাতে এবং নস্ট্যালজিয়া তথা স্মৃতিকামুকতা নামক সাহিত্য-আদুরে জ্বোরোজোলো বিষয় নিয়ে দিস্তে দিস্তে লিখে রাখে। স্মৃতি খুবই প্রয়োজনীয়, বস্তুতঃ স্মৃতি ছাড়া কীই বা লেখা যেতে পারে? এক মুহূর্ত আগের লেখা বাক্যটাও এখন সময়ের নিখুঁত হিসেবে অতীত। কিন্তু, স্মৃতিকে যখন শুধু ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ও ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ায় ‘আমাদের সে কী দিন ছেল রে বিশু’ বা ‘আমাদের ছিল সোঁদা গন্ধ, সোনার ধান, শ্রমের আনন্দ আর সংসারে মাখোমাখো শান্তি… আহা রে!’ বিষয়ক মূলবাক্যে বেঁধে ফেলে তা দিয়ে প্রভাবিত ক’রে যাওয়া হয় পাঠকদের এবং সেটাই যখন হয়ে ওঠে শিল্প বিয়োনোর বাঁধা রুটিন- তখনই স্মৃতিকামুকতা তৈরি হয়। গতিশীল, লিবারাল লেখক যখন নস্ট্যালজিয়ায় স্মৃতিপরাধীন হয়ে নিজের শ্রেণিগন্ধ আর গ্যাদগ্যাদে রোঁয়াওঠা অতীতরোমাঞ্চ দিয়ে পাঠককে ছেলেভুলোনো মায়ায় পিছনে টানতে থাকে, তখন স্মৃতিকামুকতা শব্দ বোঝা যায়। জাঙ্কফুডের খাদ্যগুণ কিছু নেই তেমন, টাগরায় ক্ষণিকের স্বাদকল্প তৈরি করা ছাড়া; এর’ম জাঙ্কসাহিত্য ক্ষণিকের পাঠচমকে ডুবিয়ে রাখে পাঠককে- বিকেল মানেই বিষণ্ণ, সন্ধ্যে মানেই টিমটিমে আলোর কুয়াশা, রাত মানেই জলপরী আর অভিসার এবং সকাল মানেই বিদ্যাচর্চা- এই চিত্রকল্পগুলো বারবার বারবার। পাঠমুহূর্তে পাঠকের মনে হয় যেন এটাই তারও বলার ছিল, এইই ত্তো! বা, অদ্ভুত সমাপতনের চরিত্রসমাবেশ আর ছকেগাঁটে মিলে যাওয়া খাপেখাপ ঘটনাবলী দিয়ে তৈরি পুজোসংখ্যার ‘নভেল’! কিন্তু, তারপর? সাময়িক পাঠবিনোদনের পরে, ‘দে লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার’-র অবাস্তব বাক্যপঠনের পরে কী পড়ে থাকে? কেউ কেউ অবশ্য নস্ট্যালজিয়ার চেনা রেসিপি দিয়ে সাহিত্য রন্ধনের কমফর্ট জোন থেকে বেরোচ্ছেন; তাই কখন যেন একটা ব্যর্থ অতীত আর সেট্ব্যাকের দশকের স্মৃতিই হয়ে উঠছে ইস্পাতের ফলা। স্মৃতি ও তৎসহ ঘটনাবলীকে আঁকড়ে থাকা এবং তাতেই বেঁচে থাকা- সেই স্মৃতিগুলোকে নেড়েচেড়ে পিষে শিল্পোৎপাদনের পদ্ধতি। এই স্মৃতিকেই হাতিয়ার করেন নবারুণ, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে। নব্বই দশকের প্রথমার্ধে সদ্য ঢুকতে থাকা গ্লোবালাইজড কালচার এবং আমেরিকান ‘পপ’ ও ভারতীয় ‘পপ’ কালচারের তেল-জলের মিশ্রণে তৈরি নব্যসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রণজয়ের এক অদ্ভুত প্রতিরোধ। যে কিছুতেই তার নিজস্ব অবস্থানকে অস্বীকার করে না, যে কিছুতেই মতাদর্শগত বিদ্রোহের দশককে ভোলে না, তাকে পরাধীন করবে কোন শাসক? কিন্তু, এই প্রতিরোধগুলোই ক্রমশঃ হারিয়ে যেতে থাকে। হারিয়ে যাওয়ার চোরাপথগুলোকে মিশিয়ে দেওয়া হয় বাজারকাটতি সাহিত্যধারার সঙ্গে। বোঝানো হয় যে, ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ আর এক্সিস্ট করে না- বরং আমাদের শান্ত হতে হবে, কেরিয়ারের জন্যে, সাহিত্যের জন্যে, শিল্পের জন্যে এবং জীবনের অধিকারের জন্যে- আরও শান্ত ভদ্র নিয়মানুবর্তী হতে হবে। এক বিখ্যাত বিকৃত দৈনিকের পাতায় বিজ্ঞাপন থাকে, ‘শব্দ থাকুক কাগজের পাতায়, শহর হোক শান্ত’। সাহিত্য ও শিল্পজুড়ে রাষ্ট্র নামক সর্বশক্তিমান এনটিটি কেবলই চারিয়ে দেয় কিছু বেদবাক্য- সবাই সুখে আছে, মধ্যবিত্তের অসুখ নেই আর এবং আমরা এক অলৌকিক উন্নয়নের স্বর্গদরজায় কড়া নাড়ছি। ‘সবাই’ শব্দটির মধ্যে আদানি, অধ্যাপক বিশ্বাস, চটকলের ছকুমিয়াঁ, সলমন খান ও বিদর্ভের প্রান্তিক কৃষক লাজবন্তী সকলকেই ঢুকিয়ে নেওয়া হয়। শান্তরস আর লোপাজেম ট্যাবলেটে শব্দের শৌখিন খেলা খেলতে খেলতে সংযোগহীন শব্দের জাগলিঙে কবিতা লিখতে লিখতে যখন ঘুম ঘুম নিশ্চয়তায় নয়া-উপনিবেশ জাঁকিয়ে বসেছে চারপাশে, তখন কেউ বলেছিল, ‘একটা কথায় ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে পড়বে কবে/ সারা শহর উথালপাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে’।
#
“The sky above the port was the color of television, turned to a dead channel”- William Gibson
‘পোস্টমডার্ন’ নামক শব্দের ভেতরে ভ’রে দেওয়া সময়ে স্বাধীনতা ও পরাধীনতার এক অলৌকিক ধোঁয়াশা সযত্নে প্রস্তুত করা হয়। ‘আমরা স্বাধীন কারণ আমরা ভাবি’ ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করা একদলের সঙ্গে ‘আমরা স্বাধীন কারণ আমরা অবাধ জ্ঞানসঙ্গম করি’ ভেবেনেওয়াদের সঙ্গে ‘আমাদের সব ভেবেনেওয়া, তথ্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদ’ ভাবা দলের সঙ্গে ‘আমরা কেন স্বাধীন ও কেন নই’ ভাবা তাত্ত্বিকদের মধ্যে লুডোখেলা চলতে থাকে। আর, চলতে থাকে এক্সাম্পল কাউন্টার-এক্সাম্পল এর বিতরণ। পোস্টমডার্নিজম এবং তার বিভিন্ন শাখা বিশ শতক থেকে একুশ শতকে আমাদের নিয়ে এলো দ্বিধার ওপর ভর করিয়ে এবং নিরপেক্ষতার অসম্ভব ভান করে। কোনও তত্ত্বই কোনও চূড়ান্ত সম্ভাবনায় না পৌঁছলেও তত্ত্ব ও সম্ভাবনার জটিলতর বিভিন্ন ক্ষেত্র তৈরি হতেই থাকল, আপ্তবাক্য কোনও কিছুই ভুলও ভুল নয়! সাহিত্যে আমরার ঘনত্বকে ভেঙে আমি হয়ে উঠল প্রবলতর, কারণ আসলে তো আমিই ভাবছি আর আমার মধ্যে বয়ে যাওয়া নিরন্তর বিশ্বায়নী জ্ঞানের প্রতিফলনে সামাজিক প্রিজম ঝকমকিয়ে উঠছে! ব্যক্তিগত সম্ভাবনায় ঢুকে এবং ক্রমে ক্রমে সমাজপরিসর থেকে ব্যক্তিপরিসরে সাহিত্য সেঁধিয়ে গেলে যা হয়, তা হচ্ছে নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া আর ব্যক্তিগত বর্ডারের বিষাদগন্ধে সুখ। উত্তরণের সম্ভাবনাগুলোকে প্রশ্ন করতে করতে পথ খুঁজে না পাওয়ার আর ভেঙে ভেঙে যাওয়ার অসহায় সুখের তত্ত্বরচিত গোলোকধাঁধা। লিওতারের মতে, গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ আর তৈরি হবে না; একধরণের যান্ত্রিক লগ্নতায় ভাঙা ভাঙা টুকরো ছবির বর্ণনা চলবে। জাঁ বর্দ্রিয়ার দেখালেন ভার্চুয়াল রিয়ালিটির সর্বগ্রাসী ক্ষুধা, যার ভেতরে আমাদের বাস্তববোধ, চেতনা এবং ইচ্ছে-স্বপ্ন সবকিছু ঢুকে যাচ্ছে; আমাদের অজান্তে চাওয়ার মধ্যেই টুকরো টুকরো কল্পধর্মী আকাঙ্খায় ভেঙে যাচ্ছি আমরা। ভোগসঙ্গমী বা কনজিউমার-ফেটিশ সমাজে বাস্তবতার মৃত্যু, যৌনতার মৃত্যু ও স্বাধীনতার মৃত্যুর পরে এক অতিবাস্তবতার ক্লান্তিকর অথচ অমোঘ-ক্লোরোফর্মে ডুবে যাওয়া- নয়া-উপনিবেশের বাজারজাত সাহিত্য ঠিক এরকমই ইতিহাসহীন, সমষ্টিহীন জীবনবর্ণনায় মশগুল থাকে। রাষ্ট্রের দেখানো পথে আমরাও পরস্পরকে ‘ট্যাগ’ ও ‘নেমিং’ করতে থাকি, পছন্দমতো লগ্ন আর অপছন্দমতো বিচ্ছিন্ন ক’রে নেওয়ার সাঙ্ঘাতিক খেলাকে শিল্পে পরিণত করি। ডোনা হারাওয়ে যে ‘সাইবর্গ’ প্রজাতির কথা বলছেন, সেও তো একরকম নয়া-উপনিবেশিত মানুষের কথাই। প্রযুক্তিবিজ্ঞানের তুখোড়ে পৌঁছে অথচ শুধুই বহু বাইনারি-অপোজিটের ভাঙ্গা-অস্তিত্বের সমাহারে তৈরি ব্যক্তি। আমাদের সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশ আর প্রযুক্তির উন্নয়নে তৈরি অত্যাধুনিক যন্ত্রসমূহ- এক ভয়াবহ দ্বন্দ্বের অবতারণা করে। ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রবল জয়গান গাওয়া সময়েই উন্নততর প্রযুক্তি রাষ্ট্রকর্তৃক ব্যবহৃত হয়ে ব্যক্তি ও স্বাধীনতাকে দুই বিপরীত মেরুতে নির্বাসন দিচ্ছে!
সাহিত্য নয়া-অধীনতার সব ব্যবস্থাপনার অভিঘাত সয়ে নিচ্ছে, সয়ে নিচ্ছে পোস্ট-ট্রুথের দ্বিধাগ্রস্থতাও। সত্যের, সমাজের এবং ইতিহাসেরও কোনও ভরকেন্দ্র রাখা যাচ্ছে না আর। আমরা জেনে যাচ্ছি, যে ইতিহাস আমরা জেনেছিলুম, তা ভুল। যে সাহিত্যপঠনে আমরা সমাজ চিনেছিলুম, তা অসত্য। যে সাহিত্যপদ্ধতিতে আমাদের নান্দনিকতায় রসসঞ্চার হয়েছিল, তা ঠিক নয়। সত্যকে চেনার দ্বিমুখী পদ্ধতি চলতেই থাকে; একটা পদ্ধতিতে শাসক তার শাসনের পক্ষে সবকিছুকে সাজাতে গিয়ে পোস্ট-ট্রুথের প্রয়োগ করে; তার অপছন্দের সাহিত্যকে নির্বাসিত করে, তার অপছন্দের ঘটনা মিথ্যে হয়ে যায় এমনকি শাসন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে এমন সমস্ত সম্ভাবনাকে বাতিল করতে সাহিত্যেতিহাসের পদ্ধতি-সংস্করণ বদলে দিতে থাকে। ক্ষমতাশালী শাসকের প্রিয়পদ্ধতি- ইতিহাস ও সাহিত্য সম্পর্কে সংশয় ইনজেক্ট ক’রে দেওয়া গণমনে। আর, এর প্রতিরোধী পদ্ধতিতে গণ-অ্যামনেশিয়ার বিরুদ্ধে সদাজাগরূক থাকার প্রান্তিক চেষ্টা। যেখানে ক্ষমতাশালীর নিয়ন্ত্রিত তথ্য ও সত্যকে খুঁড়েছিঁড়ে প্রকৃতের খোঁজ চলে; বিজয়ীর লেখা ইতিহাসকে প্রশ্ন ক’রে বিজিতের ইতিহাসকে কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়, প্রান্ত থেকে মিছিল ঢুকে পড়ে কেন্দ্রের ক্ষমতাভারকে বিপর্যস্ত করে, বিষ্ণু দে’র ‘পদধ্বনি’ কবিতার মতো- ডমিন্যান্ট সমাজকাঠামোর বিরুদ্ধে দৃশ্য-অদৃশ্য অস্ত্র উঠতে থাকে। আর, সেই কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয় ভাষা। প্রতিরোধের হাতিয়ার হয়ে ওঠার যুগান্তকারী ক্ষমতা বহন করে ভাষা, নিষ্প্রাণ শব্দ-অক্ষরের নৈর্ব্যক্তিকতার মধ্যে ইতিহাস ও সত্যের রাজনীতি ঢুকে সোনাকাঠিতে রূপান্তরিত হয়! এই দ্বিমুখী উদাহরণের সংঘাতেই কোনও বিশেষ সময়ের সাহিত্য রং-রূপ পায়, বেঁচে থাকে।
আমরা তত্ত্বে ‘পোস্ট কলোনিয়াল’-এ পৌঁছলুম; বললুম যে, ঔপনিবেশিক অতীতের পুনর্পাঠ ও পুনর্লিখন করা জরুরি। সাহিত্য ও অন্যান্য শিল্পমাধ্যমে লোকায়ত, দেশজতে জোর দিয়ে পৌঁছতে চাইলুম অন্যলিখন ও অন্যপাঠে। এর থেকে একটা পথ বেরিয়ে ‘সনাতন’-এর, যে পথ গিয়ে মেশে গোঁড়ামিতে যেখানে ভিন্নতা বলে কিছু নেই মূলধারার শাসকানুবর্তী ও প্রতিস্পর্ধার সাহিত্য সবকিছুকেই এক ক’রে দেওয়া- ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রশাসকদের মতাদর্শ ও পরধর্মবিদ্বেষ এদিকে ইঙ্গিত করে, চর্চা করে। আর, অন্য পথ এল অন্যধারার, লোকায়ত সাহিত্যশিল্পের পুনরুজ্জীবনের। ট্র্যাডিশন ও মডার্নিটির এই দ্বন্দ্বে, ‘পুরনো’তে ফেরার আকুলতা থাকলেও, তা কী আদৌ সম্ভব? দেশজ ধারার যা কিছু প্রগতিশীলতার ও উত্তরণের দিকে নির্দেশ করতে পারে, তাকে আধুনিকে নবনির্মাণের অনুশীলন তো বড়ই আয়াসসাধ্য। তবুও কেউ কেউ পরাধীন সময় আর পরাধীনোত্তর নব্যশাসকের দমনসময়ে সেই চেষ্টা করেন; ইতিহাসের পুনর্লিখন হয় ‘খোয়াবনামা’য়। একদিকে ঔপনিবেশিক সময়ে ‘নভেল’ নির্মাণের সময়ে লেখা বিকৃত ইতিহাসের ‘আননন্দমঠের’ বিপ্রতীপ পাঠ আর অন্যদিকে সেই ইসলামি মিথ্ থেকে আসা ঘোড়া, ফকিরের কুয়াশাময় দূরদর্শী শোলোককথন, খাবনামা-তাবিরনামা আর ‘নামা’ সাহিত্যের পুনর্জাগরণ।
#
“Every Writer is a writer in politics, the question is whose politics”- N’Gugi Wa Thiong’O
বাংলা সাহিত্যের দু’টো উল্লেখযোগ্য সময় ’৩০ এর দশক আর ’৭০ এর দশক। প্রায় ৪০ বছরের ব্যবধানে বাংলা রাজনৈতিক সাহিত্যের অন্দরমহল উল্টেপাল্টে গেল। বাংলা রাজনৈতিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে ’৩০-র দশক যে প্রগতিবাদের সূচনা করেছিল, তা ক্রমশঃ এক বিপ্লবী সাহিত্যের দিকে মোড় নিল। সমর সেনের কথানুযায়ী, নকশাল আন্দোলনের পরের ও আগের সাহিত্য একদম আলাদা। কবিতার শব্দব্যবহার এবং ভাষার উত্তরণ বদলাচ্ছিল এই দুই সময়ে। শিশিরকুমার দাশ যাকে বলছেন কাব্যিক রীতি ও কাব্যিক প্রথা, তা আগের শব্দ-অন্বয়-প্রতীকগত ধারণা থেকে প্রসারিত, নতুন। প্রগতি সাহিত্য ও বিপ্লবাত্মক সাহিত্য নিয়ে বই, আলোচনা, রিসার্চ পেপার, আর্কাইভ অনেককিছুই; বইয়ের তাকে ধুলো জমে। যদিও, এই সত্তরের দশকের অভিঘাতেই জন্ম হল আরেক সাহিত্যধারার, যা ‘অ্যাপলিটিক্স’ বা নিরাজনীতিকরণের মতাদর্শকে মূলধারার সাহিত্যে ঢুকিয়ে ফেলল, নকশালবাড়ি বিদ্রোহের সাময়িক সেট্ ব্যাকের সুযোগ নিয়ে। ফলে, যে সাহিত্যসূচক হয়তো আরও রাজনৈতিক হতে পারত, তা ক্রমেই হয়ে উঠল রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার সাহিত্য। সেখানে ষাট-সত্তর দশকের অভিঘাত ও মতাদর্শগত অভ্যুত্থানকে ‘রোমান্স’ ও ‘এইম্লেস অ্যাডভেঞ্চার’-র কাঠামোয় ফেলে লেখা হতে থাকল; আর, যে রোমান্টিক সাহিত্য ও মধ্যবিত্তের অ্যাডভেঞ্চারিজম্-র বিরুদ্ধে প্রগতি সাহিত্য ও বিপ্লবী সাহিত্যের এগনোর কথা ছিল, সেটাই পুনরায় জেঁকে বসল সাহিত্যিক উৎপাদনে। শাসকের মতাদর্শের অধীনতায় নিরাজনীতি হয়ে উঠল মূল বক্তব্য; ব্যক্তিপরিসর দিয়ে সমাজপরিসরকে অস্বীকার এবং প্রতিস্পর্ধার ভাষা থেকে বাধ্যতার ভাষায় ফিরে আসা।
সাহিত্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রোডাক্টিভ লেবর আর আনপ্রোডাক্টিভ লেবরের ভূমিকাও এসে পড়ে। কোনও এক বড় সাহিত্য-সংস্কৃতি উৎপাদনকারী সংস্থা যখন পুঁজির স্বার্থে পোষা লেখকদের দিয়ে লিখিয়ে নেয় তখনই সেই লেখক প্রোডাক্টিভ লেবর। লুকাচ্ যেমন একদা দেখেছিলেন যে, এই প্রোডাক্টিভ লেবর্রা জীবন ও সমাজকে খণ্ডিতভাবে দেখে, শ্রেণির বোধকে পাঠকমননে গুলিয়ে-ঘেঁটে দেয় সাহিত্যমালিকের স্বার্থরক্ষায়। আর, এই প্রতিষ্ঠানগুলোই হয়ে ওঠে সাহিত্য-সংস্কৃতির ঠিক ভুলের নির্ধারক, ভাষার নিয়ন্ত্রা। তাই, একসময় যে ভাষাকে ‘ইতরজনের ভাষা’ বলে সংস্কৃতি-বিচ্ছিন্ন করেছিল, সেই ভাষার ব্যবহারকেই পুঁজির স্বার্থে দুমড়েমুচড়ে ‘মেইনস্ট্রিম’ সাহিত্যের ভাষা করে তোলে। কাউন্টার-কালচারকে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি করা নিয়ন্ত্রিত ‘কালচার’-র মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে পারলে, অসংস্কৃতকে মেপেজুপে সংস্কৃত-শুদ্ধতায় খাপ খাইয়ে নিলে পাঠকবর্গের সংখ্যায় বিস্তৃতি বাড়ে, সাহিত্যমালিক সেই ব্যবসাবৃদ্ধির সম্ভাবনাটুকুও ছাড়তে চায় না; তা হোক না সাহিত্য-পুনরুৎপাদন, হোক না বিদ্রোহাত্মক ইতিহাসের রহস্য-রোমাঞ্চ ভার্সন, হোক না ‘ব্রয়লার সাহিত্য’, তাতে তো পুঁজিমালিকেরই লাভ! ’৩০ আর ’৭০ দশকের সাহিত্যের মধ্যবর্তী পর্যায়ে বাংলা সাহিত্য ‘অ-শুদ্ধ’ অসংস্কৃত লেখকদের দাপট দেখেছিল, যাদের ম্যানিফেস্টোয় দিগন্ত ছারখারকারী দারুণ স্পর্ধায় বলা হয়েছিল- ‘Poetry is no more a civilizing manoeuvre , a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual Hunger.’- এঁদের সাহিত্য বহুপুরনো এক বিতর্ককে উস্কেও দিল ফের- শ্লীল-অশ্লীলের টানাপড়েন। ঔপনিবেশিক ও ক্ষমতা-হস্তান্তর পরবর্তী নিয়মবদ্ধ সাহিত্যরচনার প্রতি ভীষণ ক্রোধ তাঁদের- তাই বহুল অকাব্যিক শব্দ দিয়ে, নন-এস্থেটিক কাব্যরীতি (অন্বয়-চিত্রকল্প-শব্দসংকেত) দিয়ে ‘এলিট’ ‘হাই কালচারের’ কাব্যতত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানো। বড় বড় সাহিত্যহাউজ যারা প্রথমে ‘বিদ্রোহাত্মক’ নতুনকে মেনে নিতে পারে না, পরে তারাই এই শ্লীল-অশ্লীলের বিতর্ককে হাউজের বাঁধাসাহিত্যিকদের লেখায় ঢুকিয়ে দিতে থাকে। যে নবারুণের ‘হারবার্ট’ বা ‘কাঙাল মালসাট’-এর ডিনামাইট-সম্ভাবনাকে হাজার প্রলোভনেও কিনে নিতে পারেনি, সেই নবারুণের মৃত্যুর পরে এক পুজোসংখ্যায় সেই নবারুণীয় ‘ফর্মুলা’ বানিয়ে উপন্যাস লিখিয়ে ও ছাপিয়ে নেয় তারা। পণ্যসাহিত্য কেমন ক’রে পাঠকের সহজপাচ্য ও প্রতিবছরের সুস্বাদু কমলাভোগ হয়ে ওঠে, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সহজেই একটা ‘রেসিপি’ বানিয়ে নেওয়া যায়- ভেবে নিতে হবে কিছু অদ্ভুত ‘আন্কমন’ নাম। ক-র সঙ্গে ঘ, চ-র সঙ্গে গ, চ-র সঙ্গে খ, খ-র সঙ্গে ঘ- এর’ম করে ক’টা সম্পর্ক বানিয়ে তুলে, সাদা-কালো ছকে ফুটিয়ে নিতে হবে।
একটা থাকবে বদ বড়লোক যে অবধারিত ভিলেন, মন-টন নেই। একজন থাকবে মধ্যবিত্তের ছুপা রাজকুমার, যে প্রোটাগনিস্ট। বড়লোকের মেয়েরা খুব কুচুটে চরিত্রের হবে। বনেদি বড়লোক দুটো-একটা চরিত্র থাকবে, যারা অবস্থার ফেরে পড়েছে এবং সচ্চরিত্র। ২৫% চরিত্রের বয়স হবে ১৮-২৪, ৫০% চরিত্র হবে ২৫-৩৫, ২০% হবে ৩৬-৫৫ আর, ৫%-র বয়স হবে >৬০। দাদু বা ঠাম্মা প্রাজ্ঞ, ভুয়োদর্শী এবং ‘আধুনিক অথচ সংস্কারী’ মনের হবেন। প্রোটাগনিস্ট যে ছেলেটি বা মেয়েটি, সে স্বচ্ছল বা অতি-স্বচ্ছল বিত্তের এবং বারবার ভাগ্যের যাঁতাকলে পড়েও তা কাটিয়ে উঠবে উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদে! পুরনো সম্পর্ক সিনেমার মতো ফ্ল্যাশব্যাকে ও কোইনসিডেন্টালি ফিরে ফিরে আসবে। ছেলেটি ও মেয়েটির মধ্যে ‘কথার পিঠে কথা’ দিয়ে অবধারিত ভুল বোঝাবুঝি হবে বা ‘টাইমিং’-এর ভুলে তারা আপাত ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়বে। প্রেম ভাঙা এবং প্রেম গড়া- উপন্যাসের মূল ক্রাইসিস বা সংকট বা মোটিফ এটাই হবে। দুই থেকে ত্রিকোণ হয়ে ফের দুই- এর’ম প্রেম এবং সরল আখ্যানকে জটিলতম ক’রে তুলতেই হবে! খুচরো কিছু সংকট থাকবে যেমন রাজনৈতিক ‘কুচো’ ঝামেলা, নিদারুণ ব্যাধি বা আর্থিক টানাপড়েন; তবে সেগুলো ওই থাকতে বলেই থাকবে। সেইসব সংকটাপন্ন চরিত্ররা ‘এক্সট্রা’-র ভূমিকায় থাকবে। মূল সুতো নাচবে সমাপতনের ওপর, আচম্বিতে মিলে যাবে সব মিলে যাবে! আর হ্যাঁ, ‘রাজনীতি’ বা বৃহত্তর সমাজবোধ ব্যাপারটা গুলিয়ে দিতে ইচ্ছে ক’রে বা আলকাতরায় ঢেকে দিতে হবে কারণ ‘হৌস’ সেরকমই চায়!
কিছু অ্যাডেড ফ্লেভার দিতে হবে যেমন ইংরেজি কবিতা (রোম্যান্টিক পোয়েটস্ ফেভারেবল্) দু’এক ছত্র কোনো অনুচ্ছেদের শুরুতে। বিশেষতঃ মেয়েরা দারুণ দ্ব্যর্থবোধক কথা বলবে, ‘হিউমার’ এবং কমিক পাঞ্চ মারাত্মক! আচ্ছা, যে ছেলেটি/মেয়েটি কম বিত্তবান বা নিম্নগোত্রের বা অন্ধকার-সমাজের, তারা কিন্তু প্রেম পাবে না বা মারা যাবে! একদম শেষ পরিচ্ছেদ অতি-অধিবাস্তবোচিত ক’রে দেওয়া জরুরি এবং শেষে লেখা, “সব কিছু কাল্পনিক”! এই রেসিপিকে আরেকটু ঘষামাজা ক’রে এবং অবধারিত ভাবে একটি ‘নকশাল’ চরিত্র বা ‘আদর্শবান’ বিপ্লবচ্যুত রাজকুমারসদৃশ চরিত্রকে প্রোটাগনিস্ট বা সেকেন্ড-লিড ভূমিকায় নামিয়ে দিলেই ‘রাজনৈতিক উপন্যাস’ গজিয়ে যাবে! বামপন্থী রাজনীতির ভুল, নোংরা সমাজ আর সিস্টেমকে মেনে নিয়ে কংগ্রেস-আরেসেসবাদী পদ্ধতিতে রাজনীতিকে তুলে ধরাই এর’ম উপন্যাসের উদ্দেশ্য। কিন্তু, পাঠক? আমাদের কেন ভাল লাগে এই ধাঁচার ‘ফিল গুড’ সাহিত্য? কারণ, আমদের দৈনন্দিন ডিসকমফোর্ট, প্রতিদিন বেড়ে চলা দমবন্ধ বাস্তবে ‘এস্কেপ রুট’ তৈরি ক’রে দেয় এগুলো; রোম্যান্টিক ফ্যন্টাসির চকোলেট মুড়ে বাস্তব খেতে কে না চাই? আর, সেই বাস্তব যদি হয় আমারই শ্রেণিঅবস্থানের, সেই বাস্তব যদি পাঠকের শ্রেণিচেতনাকেই মহান করে খ্রিস্টের সম্মান দান করে, তাহলেই তা হট্ কেক। পাঠক, মূলতঃ মধ্যবিত্ত বা স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পাঠক দোদুল্যমান অবস্থান থেকে উত্তরণের যন্ত্রণা ভোগ না ক’রে সেই অবস্থানের বিষাদরোমাঞ্চে সুখে জলকেলি করে- কমফোর্ট জোন তৈরি হয়ে যায় সাহিত্যে শিল্পে। আর, এই মানসিক ও শ্রেণিগত পরাধীনতার বিপ্রতীপে যে উপন্যাস-কবিতারা থাকে, পরাধীনতাকে সুখ না-ভাবতে চাওয়ার যে ফর্দাফাঁই লেখাগুলো থাকে, তারা জন্মানোর পরেও বহুদিন অপ্রকাশ্য। ‘চাঁদ-নদী-ফুল-তারা-পাখি দেখা যাবে কিছুকাল পরে/ কেন না এ অন্ধকারে শেষ যুদ্ধ বাকি, এখন আগুন চাই আমাদের ভাঙা কুঁড়েঘরে’ বা, ‘সাহিত্য বলে লেখা হয় যত ভাট, মিডিয়াবণিক মগজের গায়ে সাঁটছে/ চেতনার ঘুড়ি কেটে গিয়ে খায় লাট/ তখনও তো কারা রাইফেল কাঁধে হাঁটছে’- এইরকম কবিতাগুলো স্বস্তি পেতে দেয় না; বসাই টুডু বাতাসের গলা মুচড়ে মুচড়ে ‘বাবু’দের নীতিকৌশলের অসারতার মুখোশ খুলে দিলে বিপ্লবের সঙ্গে উচ্চবর্গের নিরাপদ দূরত্ব বিপদগ্রস্ত হয়। বাঘারু রায়বর্মন সাংস্কৃতিক জলসায় শ্রীদেবীর নাগিন নাচের মধ্যে হঠাৎ কালোকোলো অমার্জিত শালপ্রাংশু দেহ নিয়ে নেংটি পড়ে ঢুকে পড়লে, তা নান্দনিকতার চেনা স্বস্তিক্ষেত্রকে বিড়ম্বিত করে। ‘কলকাতার নিচের তলায় থাকা’ মানুষেরা হইহই করে, নয়া-উপনিবেশের ম্যাজম্যাজে ঘোরঘোর চেতনার ভেতরেই আমাদের স্বরচিত যত্নদ্বীপের বিষাদসুখে ঢুকে পড়লে, আদুরে-সংস্কৃতি ব্যথা পায়। কালচার ইন্ডাস্ট্রির উৎপাদন ব্যাহত হয়। আর, তাই রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া মতাদর্শ চায় ভুলে যাওয়া হোক সবকিছু। যা কিছু সময় ও স্মৃতির নিভুআঁচকে খুঁচিয়ে তুলবে, তা ভুলে যাওয়া যাক; নানা পদ্ধতি, নানা কাঠামো, নানা আয়োজন নাগরিক সমাজের সম্মতিক্রমে। উদাসীন, নির্লিপ্ত প্রতিরোধহীন ও প্রতিস্পর্ধার স্মৃতিহীন মানুষেরা ‘ইমহোটেপ’, ‘ইমহোটেপ’ করতে করতে সম্মোহিতের মতো নয়া পরাধীনতায় গড়িয়ে যাবে।
#
“People here grumble and say that the heart of the poet in Meghanad is with the Rakhsasas. And that is the real truth. I despise Ram and his rabble; but the idea of Ravan elevates and kindles my imagination; he was a grand fellow.”- Michael Madhusudan Dutt
সাহিত্য নিষ্প্রাণ, জড়। সাহিত্য বেঁচে থাকে লেখক ও পাঠকের নিরন্তর সেতুতে। নব্য উপনিবেশ কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে আসে না, খুব সন্তর্পণে হয়তো ঘুমের অগোচরে চলে আসে। শাসক চায় শাসিতের মনোভূমি দখল করে নিতে, রাষ্ট্রপদ্ধতি চায় জনগণের মাথার দখল নিতে। আর, সেই দখলের সেরা পথ সংস্কৃতি, সাহিত্য। তাই, যে সাহিত্য জনগণের মনোভূমিতে ক্ষমতাকাঠামোর উপনিবেশ বানাতে বাধা দেয়, সেই সাহিত্যকে ভয় পায় ক্ষমতা। তখনই সেই সাহিত্য ও শিল্পের পথগুলোতে সংশয়ের ধোঁয়া ছড়িয়ে দেয় আর গুলিয়ে দিতে চায় সাদা চোখে জানাবোঝা ঘটনাগুলোকে। অন্য এক উপনিবেশের বিস্তার হয়ে চলে ভার্চুয়াল রিয়ালিটির পৃথিবীব্যাপী জালের মধ্যে। লেখক-পাঠকের সম্পর্ক একইসাথে সরলতা ও জটিলতার সর্পিলপথ ধরে এগোয়; সোশ্যাল মিডিয়া, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সাহিত্যের প্রকাশভঙ্গি বিবর্তনশীল। ‘জনপ্রিয়তা’-র যে সংজ্ঞা ’৫০ দশকের পরে দেওয়া গেছিল, সে ধারণা বদলাতে থাকে, ‘গ্রেট ট্র্যাডিশন’ ও ‘লিটল্ ট্র্যাডিশন’-এর দ্বন্দ্বও। বিশ্বায়নী আবহে সমসত্ত্ব সংস্কৃতি-সাহিত্যের জবরদখলী প্রচেষ্টায় অপ্রাসঙ্গিক ক’রে দেওয়া হয় ‘অন্য’দের কথন। বহুভাষাভাষী দেশে একটি ভাষাকে শাসনের ভাষা করে অন্য ভাষা-সাহিত্যকে উপনিবেশিত করে দেওয়া হয়। যা কিছু সাহিত্য রাষ্ট্রের কর্মপদ্ধতির প্রতি প্রশ্ন রাখে, সেই সব কিছুই মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অপরায়নের সময়, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নয়া-পরাধীনতা ও নয়া-উপনিবেশ পুনঃগঠনের সময় প্রতিস্পর্ধী সাহিত্যধারা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। উপনিবেশিত সময়ে কোনও সাহিত্য যদি সমকালীন ও ইতিহাসের ক্ষমতাকাঠামোকে পুনর্লিখন করতে চায়, সেখানে প্রকরণ আর বিষয়বস্তুর বৃথাদ্বন্দ্ব অনাবশ্যক, দু’টোই পরিপূরক। উপনিবেশিত সময়ে কবিতাকে যুদ্ধের সাজ না পরালে, কবিতার ছন্দকে দক্ষ সেনাপতির মতো যুদ্ধনিনাদে ফরওয়ার্ড মার্চ না করালে প্রমীলার দাপট বা মেঘনাদ-রাবণের ট্র্যাজিক হিরো হয়ে ওঠা দেখানো সম্ভব কি? নয়া-পরাধীন সময়কে ধারণ করেই তেমনই কোনও ফরওয়ার্ড মার্চের আশায় থাকা যায়, যে আখ্যান আমাদের জাগিয়ে রাখবে, সচেতন রাখবে এবং পাঠকের প্রত্যাশার দিগন্ত বাড়িয়ে দ্রোহসম্ভাবনায় ইঙ্গিত করবে।
[লেখক – যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামুলক সাহিত্য বিভাগে গবেষণারত]
Posted in: August 2019, Cover Story