চাকা আবিষ্কার ও অন্যান্য : নীলাব্জ চক্রবর্তী

  • বাবা, কারফিউ মানে কী ?
  • ঠিক জানি না, বোধ হয় নিজের ইচ্ছেগুলোর বাইরে গিয়ে কোথাও দাঁড়ানো… প্রশ্নগুলোর বাইরে গিয়ে দাঁড়ানো…
  • কোথাও মানে ? কোথায় দাঁড়াতে হয় ?
  • সেটাও অন্য কেউ ঠিক করে দেয়। নিজের ইচ্ছের বাইরে…
  • ইচ্ছের বাইরে ? কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ওখানে ?
  • যতক্ষণ না কারফিউ উঠে যাচ্ছে… হয়তো সারাজীবন… আমরা হয়তো জানতেই পারি না আমরা আসলে সারাজীবন কারফিউয়ের মধ্যেই আছি… এমন অভ্যাস হয়ে যায় আসলে…
  • আর প্রশ্নের বাইরে গিয়ে দাঁড়ানো মানে কী ? উত্তর ?
  • না, প্রশ্নের বাইরে গিয়ে দাঁড়ানো… মানে, আমি বলতে চাইছি, এমন একটা জায়গা, যেখানে কেউ কোনও প্রশ্ন করতে পারবে না। তর্ক করতে পারবে না। সব মেনে নিতে হবে…

# * # * #

দাঁতে দাঁত চেপে

চৌকো একটা দিনের ভেতর

বসে বসে

আমি খুব সাদাকালো কবিতা কবিতা

ভাবি

স্বাধীন আর অধীন

এই দুই চলরাশির কথায়

ভালবাসা নামের একটা পারস্পেক্টিভ

দেখছে

আমাদের অর্থগোনাল অক্ষরেখাদুটিতে দীর্ঘ হয়ে

অপেক্ষকগুলির নড়াচড়া আসে

অর্থাৎ

স্মৃতি ব্যবহারের এক গাছ

আমাদেরই হাতের রেখা বরাবর

মন

কেমন

ওঠানামা করছে…

# * # * #

  • হ্যাঁ রে, ওর খবর কী ? অফিসে কীসব ঝামেলায় পড়েছে শুনলাম…
  • আর বলিস না… পাগল একটা… কোম্পানীর ডিরেক্টরকে জ্ঞান দিতে গেছিল… যথারীতি ওর ওইসব ভুলভাল কথা আর কী… ফ্যাসিবাদ কাকে বলে, মেশিন-ছাঁচ-সমাজ, রাষ্ট্র মানেই প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান মানেই রাষ্ট্র, রাষ্ট্র আর প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি পদক্ষেপকে সন্দেহের চোখে দেখা উচিত, ক্ষমতার কাছে যুক্তি অসহায়… অমুকতমুক… এগুলো কেউ বলে ?
  • সে কী ! তারপর ?
  • কী বলব… ওই লোকটি শুনেছি… যাক গে… ও তো এখন বলছে চাকরী ছেড়ে দেবে…
  • যাহ ! এটা একটা সল্যুশন কোনও ? সামলাতে পারবে ? ওকে বোঝা… দরকার হলে কাউন্সেলিং করা…
  • হুঁ… সে তো বলেইছি… আবারও বলব… তবে, ও কারো কথা শুনলে হয়…
  • হ্যাঁ, তা ঠিক, তবে, মানে, হঠাৎ কী হলটা কী ? এই তো কিছুদিন আগেও দেখা হল… কিছুই তো বলে না…
  • আরে, হঠাৎই তো… কিছুদিন ধরেই ওদের একটা কী প্রজেক্ট নিয়ে বলে হেভি চাপ যাচ্ছিল… ছুটির দিনেও দেখি অফিস যায়, নর্মাল দিনেও দেখি অনেক রাতে ফেরে… তো সেটার কীসব ডকুমেণ্ট পাঠাবার লাস্ট ডেট ছিল ১৬ই অগাস্ট, তো ও ১৫ অগাস্টও সারাদিন বাড়িতে বসে অফিসের কাজ করেছে… তারপর সেসব ১৬ তারিখ জমাও হয়েছে শুনেছিলাম… তার ঠিক পরে পরেই কী একটা গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়ে ওই ডিরেক্টর ভদ্রলোকের সাথে… শুনেছি কাজ-রিলেটেড কিছু নয়…

# * # * #

অষ্টাদশ শতাব্দীতে সাঁ দোমাগঁ (Saint-Domingue) ফ্রান্সের কাছে একেবারে সোনার ডিম পাড়া হাঁস ছিল। সারা পৃথিবীতে যত ফরাসী উপনিবেশ ছিল, তার মধ্যে এটাই ফ্রান্সকে সবথেকে বেশী বাণিজ্য দিত। সত্যি কথা বলতে কী, শুধু ফরাসী কেন, সমস্ত ইউরোপীয়ানরা দুনিয়ার যেখানে যত উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, মুনাফা দেওয়ার ব্যাপারে তাদের সবার মধ্যে সাঁ দোমাগঁ ছিল একদম ওপরের দিকে। প্রতি বছর প্রায় ৬০০ জাহাজ ভর্তি চিনি, কফি আর নীল; ইউরোপ রওনা হত। জানা গেছে, গোটা ইউরোপের প্রায় অর্ধেক চিনি নাকি আসত ওখান থেকেই! এই পুরো সিস্টেমটা দাঁড়িয়েছিল ক্রীতদাসদের অমানুষিক পরিশ্রমের ওপর। ওইসময়, সাঁ দোমাগঁতে একজন ক্রীতদাসের গড় আয়ু ছিল মাত্র সাত বছর। চালান হওয়ার পর প্রথম বছরেই মরে যেত বহু। পীতজ্বর আর কলেরা তখন কালান্তক। মালিকেরা সবসময় চেষ্টা করত মরে যাওয়ার আগে ওই ক্রীতদাসদের ন্যূনতম খাবার ন্যূনতম থাকার জায়গা দিয়ে কম খরচে যতটা সম্ভব কাজ করিয়ে নিতে হবে, ব্যস। এটাই হচ্ছে, যাকে বলে, একদম পারফেক্ট বিজনেস পলিসি। মরবে মরুক গে, অসুবিধা কী… আবার নতুন ক্রীতদাস নিয়ে এলেই তো হল… দ্য শো মাস্ট গো অন…

# * # * #

অফিসের বড়সাহেবের রোষে পতিত হয়ে কিছু কিছু শাস্তিমূলক ব্যাপার হজম করার খানিকক্ষণ পরে আপনি লিফটের ভেতর একজনকে বলতে শুনলেন একটি প্রখ্যাত বিস্কুট কোম্পানি ১০ হাজার লোক ছাঁটাই করার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে। কিছুদিন আগে আপনি এ-ও শুনেছিলেন, গাড়ি শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রচুর লোকের কাজ হারাবার সম্ভাবনা রয়েছে। আপনার মনে পড়ল, একটা সময় কাগজে রেগুলার বেরত, গঙ্গার দুপারে চটকলগুলি এক এক করে পরপর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে… এক একটা কারখানায় অ্যাভারেজ হাজার তিনেক করে কর্মচারী বোধহয়… মানে, সপ্তাহে তিনটে কারখানা বন্ধ হওয়া মানে, প্রায় ন’ হাজার লোক রাতারাতি বসে গেল… তাদের পরিবারে অ্যাভারেজ চার জন করে লোক থাকা মানে প্রায় ৩৬ হাজার লোকের জীবন রাতারাতি অনিশ্চিত। আপনি প্রথমে ভাববেন, আমি এখনও ভাল আছি, অ্যাটলিস্ট চাকরীটা তো আছে আমার। তারপরেই ভাববেন, ধুর, আর পারা যাচ্ছে না, কাজের চাপের থেকেও বড় কথা ব্যবহার… আর কতদিন এ চাকরী করতে হবে… তারপর ভাববেন, যে লোকগুলোর কাজ চলে গেল / যাচ্ছে / যাবে… তাদের কথা, তাদের পরিবারের কথা… তারপর আপনার মনে পড়বে আপনার মেয়ের স্কুলের ফিজ দিতে হবে সামনের সপ্তাহে। এতক্ষণে আপনি লিফট থেকে বেরিয়ে ফ্লোরে এসে নিজের নতুন সিটে বসে পড়েছেন। অল্প জল খাবেন আপনি। আজ আর কতক্ষণ অফিসটাইম আছে ? কী কী করার কথা যেন… একটা নতুন প্রোজেক্টের স্পেফিকিকেশনের কাজটা একটু এগিয়ে রাখতে হবে… আর একটা প্রোজেক্টের টেণ্ডার ইভ্যালুয়েশনের কাজটা শুরু করতে হবে… ওহহো, কে যেন ফোন করেছিল… ইনডোর আর আউটডোরের লোহার গ্রেটিং-এর সাইজ নিয়ে কী একটা ডিসকাশন চাইছিল… তাকে তো এক্ষুনি একবার কলব্যাক করতে হবে… আচ্ছা, আর একটা কাজও তো ঝুলে আছে অনেকদিন ধরে… সেই যে, সমুদ্রের ধারের সেই পাওয়ার প্ল্যাণ্টটাতে একটা বয়লার কন্ট্রোল রুম হওয়ার কথা, বারবার কনফিগারেশন চেঞ্জ হচ্ছিল, ওই স্ট্রাকচারটার অ্যানালিসিস ফাইলটার কাজটা… ওটা অবশ্য চট করে সেরে ফেলা মুশকিল… সময় লাগবে… তাছাড়া, আর একটা ডিজাইন ক্যালকুলেশনের কাজ শেষ করে ক্লায়েণ্টকে পাঠাতে হবে… হবে ? নাকি আজকেও বাড়িতে নিয়ে গিয়ে…

Facebook Comments

Leave a Reply