পরাধীনতার পরে স্বাধীনতা, না স্বাধীনতার গর্ভে পরাধীনতা? : কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

পরাধীনতা আমার কাছে “গোপন রন্ধ্র থেকে জঠরস্থ ভ্রূণকে নির্মূল করে ফেলার এক ভয়ঙ্কর নিষিদ্ধ দাওয়াই”-এর চল। প্রতিবাদের কন্ঠ রোধ করার এক ঘৃণ্য প্রয়াস। পরাধীনতা আমার কাছে আত্মমর্যাদাহীনতায় বেঁচে থাকা।

পরাধীনতা হল পিঞ্জরে বন্দী ব্যক্তি-জীবন। উন্নতিরোধক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। উৎপীড়কের বিচার সভায় নির্দোষের সাজাপ্রাপ্তি।

পরাধীনতা মানে নীতিহীনতায় আমার নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকা। ভয়াতুর প্রতিবেশ।

আমি মানি অবোধের শাসনে ধিক্কার না দেওয়া, অথবা উদ্বাস্তু জনস্রোতে ভেসে যাওয়াই হল পরাধীনতা। পরাধীনতা মানে রক্তরাঙা ভাইয়ের বুক, অথবা সন্তানহারা মায়ের মুখ। পরাধীনতা আমার কাছে এক ধরনের অনুভূতি যেখানে শেকল পড়ার যন্ত্রণা আছে, অধীনতা আছে, আজ্ঞানুবর্তিতা আছে, আছে অনাহারক্লিষ্ট শৈশবের মর্মর প্রতিমূর্তি।

        ছোট্ট একটা ঘটনার কথা বলি। একদিন দেখলাম একটা ছোট্ট গর্তকে পিল সাজিয়ে তার চারধারে ডজন খানেক কচিকাঁচার দল। তারা খেলছিল কিছু রঙীন কাঁচের বল নিয়ে।

        দখলীকৃত এই দেশটার হয়তো অনেক কল্পনাকে, অনেক স্বপ্নকে “স্বাধীনতার যুদ্ধ” সহজেই মুছে দিতে পেরেছিল। কিন্তু কিছুতেই খেলাধুলো থেকে বাচ্ছাদের তারা সরিয়ে রাখতে পারেনি।

        বোমারু বিমানের লক্ষ্যভেদটা বেশ ভালই হয়েছিল। বোমটা ঠিক ঐ বাচ্চাদের জটলার মধ্যেই পড়েছিল। লোকজনেরা তাদের ঘরদোর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছিল। আর যখন তারা ঐ বাচ্চাগুলোর ক্ষতবিক্ষত দেহাংশগুলোকে জড়ো করছিল, তখন তাদের আতঙ্কিত নিদ্রাহীন লাল চোখগুলো কোঠরের গভীর থেকে আরও গভীরে বসে যাচ্ছিল। তারা সামনের ঐ স্কুলের হল ঘরটাতেই সেই লাশের পাহাড়টা গড়ে তুলেছিল যেখান থেকে বাচ্চাগুলো প্রাণের প্রাচুর্য আর খেলার উচ্ছ্বলতা নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই এখানে খেলতে এসেছিল।

        একজন সরকারী ফটোগ্রাফার এসেছিলেন এবং তিনি তাঁর ক্যামেরায় ঐ বীভৎসতার দলিল চিহ্নটাকে বন্দী করেছিলেন। তবে ঐ দৃশ্যের ভয়বহতা তাঁর ফটোগ্রাফির দক্ষতাকেও অকেজো করে দিয়েছিল।

        জুলিয়াস ফুচিকের চোখ দিয়ে আমি আমার মতো করে এই করুণ ঘটনার সাক্ষী হলাম। আমার চেতনায় এখানে পরাধীনতার একটা বহু মাত্রিক ছবি ধরা পড়ল। আমি দেখলাম পরাধীন নাগরিকের উৎকন্ঠাপূর্ণ দৈনন্দিন জীবনধারা। পরাধীন শৈশবের লাশ হয়ে যাওয়া, অথবা জীবনের পরাকাষ্ঠায় অন্যদের বেঁচে থাকা। আমি দেখলাম পরাধীন কর্তব্য পালকের শিল্পহীন বাধ্যবাধকতা। আমি এও দেখলাম কিভাবে জনগণের স্বপ্নভঙ্গের অনুভূতি পরাধীনতার জ্বালাকে বাড়িয়ে তোলে। সে উত্তাপ বিরুদ্ধতায় শক্তি জোগায়। রক্তে রাঙে শিশুর মুখ।

        পরাধীনতা ভবিতব্যের বাণী শোনালেও ভব্যতার গন্ডি মানে না। ভদ্রতার বানী শোনায় না। নৈতিকতার তোয়াক্কা করে না। মূল্যবোধের পরিমাপ সেখানে শাসকের ইচ্ছানুসারে চলে যা প্রকাশহীন চিন্তারাশির হানাহানিকে অনিবার্য করে তোলে। বিরুদ্ধাচরণ স্বাধীনতায় উঁকি দেয়। 

স্বাধীনতা শব্দটা আক্ষরিক অর্থে মুক্তির কথা বলে। স্বাধীনতায় সুখ আছে, শান্তি আছে, আছে এক ধরণের আনন্দ। স্বচ্ছন্দতা, বাধাহীনতা, স্বাতন্ত্রতা এবং জুলুম থেকে নিষ্কৃতিপ্রাপ্ত অবস্থা বোঝাতে, মুক্তি অর্থে আমরা তাই স্বাধীনতা ধারণাটি ব্যবহার করি। একসঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক আর সাংস্কৃতিক মুক্তিই সেখানে কাম্য, এবং কাঙ্খিত।

স্বাধীনতাহীনতায় বিরোধ একটা স্বতঃসিদ্ধ সত্য। সেই লক্ষেই প্রাক্-বৈজ্ঞানিক যুগে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষকে লড়াই করতে হয়েছে। অন্য কোন কৌম গোষ্ঠীর পরাধীনতা মানবে না বলেই তাকে রক্ত ক্ষয় করতে হয়েছে। অন্য জাতি, অন্য ধর্মের অধীনতা সে মেনে নিতে পারেনি। অধীনতা না মেনে নেওয়াটাই মানব চরিত্র প্রসঙ্গে একটা অঙ্গীকারোক্তি। তবুও মানুষ হয়েছে মানুষের কাছে পরাধীন। সে পরাধীন থাকতে বাধ্য হয়েছে। এই কারণেই অন্যান্য ভূখণ্ডের মতো এই ভূখণ্ডেও নানা জাতি, সম্প্রদায়, ভাষা ও আচার-বিচারের নিরিখে বাসিন্দাদের জীবনধারাও সময়ের অন্তরে অত্যন্ত জটিল হয়েছে।

প্রাচীন ভারত স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন – এই ধারণা আমরা সহজেই করে নিই। আদপেই তা নয়। এই প্রাচীন ভারত বহু ছোটবড় রাজার অধীনে ছিল। আবার সকল রাজাই যে ক্ষত্রিয় ছিলেন – তেমনটাও নয়। রাজা অন্তঃপুরবাসী হলে রাজ্যের দুরবস্থা। এই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা পরাধীনতারই সমরূপ। রাজা নিষ্ঠুর হতে পারেন, অর্থগৃধ্নু হতে পারেন। উভয়ক্ষেত্রেই সুশাসনের ইঙ্গিত থাকে না। সেও এক ধরণের পরাধীন অবস্থা যা উন্নয়নরোধক।

ইসলাম-পূর্ব এই ভারতে জাতির ওপর জাতির প্রভুত্ব তেমন ভাবে না থাকলেও, বর্ণপীড়ন ছিল। ব্রাহ্মণ তার পাণ্ডিত্যে, সুশিক্ষায়, কার্য্যক্ষমে বর্ণশ্রেষ্ঠ, এবং রাজপুরুষপদে বাচ্য। ফলে সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী সে নিজে। ব্রাহ্মণকে কারুর আজ্ঞা মেনে চলতে হয় না। সে নিজেই বিচারক। দেশে ক্ষত্রিয় রাজার আধিক্য থাকলেও ব্রাহ্মণেরই শেষ কথা। প্রাচীন বিচার ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণের বিচার শূদ্র করতে পারে না। এই বৈষম্যই সংখ্যাগুরু শূদ্রের অধীনতা, আজ্ঞাবহতার চিহ্ন রেখে যায়।   

        অর্থনৈতিক ও সামাজিক এই পরাধীনতায় ইসলাম শাসনের রাজনৈতিক পালা বদল ভারতবাসীর মনে দাগ কাটেনি। দেশীয় রাজার অধীনে থাকা, অথবা দিল্লীর সুলতানের অধীনে বাঁচা, সাধারণ নাগরিকের তাতে কিছু আসে যায়নি। পরাধীনতার আঁচ লেগেছে ধর্মীয় অনুশাসনে, ধর্মীয় সংস্কৃতিতে। হিন্দু জীবনধারায় স্বাধীনতার নামে সেই পন্থা আরও কট্টর হয়েছে। জাতিভেদের গোঁড়ামি উচ্চবর্ণের কর্তৃত্বমূলক অবস্থানে থাকা প্রচলিত বৈষম্যকেই বাড়িয়ে দিয়েছে। নিচু জাতের মানুষ জন্মসূত্রে প্রাপ্ত পরাধীনতার বেড়া ভাঙতে চেয়েছে। ইসলামের প্রসারে তা যেমন সুবিধা করেছে, তেমনি ধর্মান্তকরণের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্খাপূরণের চেষ্টা সফল হয়েছে। তবুও কোথাও এই জনসমাজ এই মাটিকেই ভালোবেসেছে। তাকে আঁকড়ে ধরেই সুখ খুঁজেছে।

        খ্রিস্টান শাসন, ইতিহাসের বয়ানে ইংরেজ পরিচিতি পেয়েছে। ধর্মের পরিবর্তে প্রশাসনিক শাসন যন্ত্রকে স্পষ্টভাবে তারা সামনে রেখেছে। খ্রিস্টান শাসনে ধর্মান্তকরণকে সুকৌশলে এবং সুনিপুণভাবে আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার নিজের সুবিধার্থে যখন ভারতীয় উপনিবেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাইল, তখনই ফল হল উল্টো। পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতে ভারতের জনসমাজ তার নীরবতা ভাঙলো। পূর্ণ-স্বাধীনতার আহ্বানে ও হিল্লোলে জনজাগরণ ঘটলো। মুক্তির লক্ষ্যে এলো জাতীয় চেতনা। সেই চেতনা প্রগতির নিশান উড়ায়। ফলে এই পর্বে স্বাধীনতা হয়ে উঠলো প্রগতির সূচক।

        ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের অবসানে মাঝ রাত্তিরে ভারতবাসী স্বাধীন হল। দেশভাগের ফলে স্বদেশের মাটিতে বিদেশী তকমা স্বাধীনতার রক্তস্নাত নোনতা স্বাদকে তিতকুটে করে তুলল। খন্ডিত স্বাধীনতার ঘ্রাণে দুর্বিষহ হল সমাজ জীবন। আবার এই স্বাধীনতা কিভাবে প্রগতির সেই কাঙ্খিত সূচকের সঙ্গে মিলবে তা ভারতবাসীর একটা অংশ বুঝতে পারলো না। সম্প্রদায় ভেদে ইতিহাসের যে পশ্চাৎপসারণ ঘটে তা সেই অংশ নীরবে মেনে নিতে বাধ্য হল। মানবতার কল্যাণ ছাড়াও যে স্বাধীনতা পাওয়া যায় তা চাক্ষুষ করলো আপামোর ভারতবাসী।

        দেশভাগের সেই কষ্ট কাহিনী বাদ দিলে ভারতবাসীর কাছে স্বাধীনতা মানে দারিদ্র, অশিক্ষা, রোগ, আসাম্য ও সম্প্রদায়গত হানাহানির অবসান। স্বাধীনতা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। বাক্-স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে। অনুন্নত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষায় অঙ্গীকার বদ্ধ হয়। সুযোগ-সুবিধায় সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সর্বোপরি সার্বভৌম সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়, যেখানে জনসাধারণের সমবেত ইচ্ছাই শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হওয়ার কথা।

        সবটা কি তাই হয়েছে? ষোল আনা স্বাধীনতা কি আমরা ভোগ করছি?

        যদি ভোগ করে থাকি, তবে অসন্তোষের আগুন আজও জ্বলছে কেন? কেন আজও রাষ্ট্রকে দমনমূলক নীতির আশ্রয় নিতে হচ্ছে? কাঁদানে গ্যাস, গুলি চালানো আমরা এখনও থামাতে পারিনি কেন? দেশভক্তি ‘কম পড়িয়াছে’ কি?

আমার মনে হয় দেশভক্তি কম পড়েনি। আজও আমরা এই মাটিকেই ভালোবাসি। তার জন্য নিঃশর্তে রক্ত দিতে রাজী হই। বৈচিত্র্যের সহাবস্থানের গুণে এখানেই জন্মাতে ও মরতে চাই। তাই আমাদের চেতনায়, অনুভবে, বিচক্ষণতায়, দায়িত্বশীলতায়, প্রজ্ঞায় আমরা কোথাও শেকলে বাঁধা পড়ছি। স্বাধীনতার এই “স্বর্ণ শৃঙ্খল”, আমাদের পরাধীন করে তোলে নিজের চেতনার কাছে, বিচক্ষণতার কাছে, দায়িত্বশীলতার কাছে। আমাদের অর্বাচীন মন অন্যের স্বাধীন পরিসরে হস্তক্ষেপ করে। এটা ব্যাপকতা লাভ করে যখন মানুষের জীবন-জীবিকায় অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। মানুষের পেটে টান পরে।

এমনটা ঘটছে, এখনও ঘটে চলছে। কেন্দ্রীয় নীতির কারণেই সেটা হচ্ছে। বিজাতির শাসন থেকে স্বজাতির শাসনে ভারত যে জনকল্যাণের নীতি গ্রহণ করেছিল, স্বয়ম্ভরতার কথা বলেছিল, সেখানে বদল ঘটে যাওয়াতেই এই বিপত্তি। স্বাধীন ও সার্বভৌম শাসন-প্রণালীতে রোগ ধরার কারণেই এমনটা ঘটেছে, এবং এখনও ঘটে চলেছে। যে প্রতিনিধিকে স্বাধীন ভারতবাসী তার শাসকের ভূমিকায় নির্বাচিত করেছিল সেই শাসকের নির্বুদ্ধিতার ফাঁস আজ দেশবাসীর গলগ্রহের কারণ হয়ে উঠেছে এবং উঠছে। ফলে ভারতবর্ষ আজও স্বাধীন হয়নি। আমরা এখনও পরাধীন আছি। এই পরাধীনতা শোষণ ও বঞ্চনার, এই পরাধীনতা দুর্নীতি আর কালোবাজারির, এই পরাধীনতা অন্যায় ও অবিচারের, এই পরাধীনতা অশিক্ষা ও অন্ধকারের, এই পরাধীনতা দারিদ্র ও অপুষ্টির, এই পরাধীনতা অসাম্য ও সাম্রাজ্যবাদের, এই পরাধীনতা এ দেশের মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার, জীবনযন্ত্রণায় দগ্ধে যাওয়ার।

একটি সমাজ কতটা স্বাধীন তা বুঝতে সে সমাজের মেয়েদের অবস্থা অবশ্যই দেখা দরকার। উত্তরাখন্ডের উত্তরকাশী জেলার ১৩২ টি গ্রামে গত তিনমাসে জন্ম নেওয়া ২১৬ টি শিশুর একটিও মেয়ে না হওয়ায় প্রযুক্তির অপব্যবহারে পঙ্গু নৈতিকতার মানবজীবন অনুধাবনে আমাদের অসুবিধা হয় না। সিদ্ধান্তগ্রহণে ক্ষমতাহীন মেয়েরা তবে কিসে স্বাধীন? কাশী, বারাণসীর পুর্নাথীরা যদি সমাজ সচেতনার কাজে পুর্নার্জন করতে পারতেন তা হলে মুক্তির পথে ভারতীয় সমাজের উত্তরণ ঘটতো। ৭৩তম স্বাধীনতার মানহানি হত না। 

বিষয়টা বুঝতে আরও একটু উদাহরণের প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে ১৯৯১ সালের নয়া-অর্থনৈতিক নীতির কথা ধরুন। আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডারের ও গ্যাট চুক্তির নীতি মেনে নেওয়ায় ভারতবর্ষ তার নিজের মুদ্রার দাম একুশ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটাতে রাজী হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার দাম এইভাবে নীচে নামানোয় প্রতিটি ভারতবাসীর “নির্ভরতা হার” বেড়ে যায়। দুই ভাবে বিষয়টিকে দেখা যায় – এক, আগে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদের বিনিময়ে যে পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব ছিল, এই ঘটনার পরে তা কমে যায়। অর্থাৎ একই পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা অর্জনের জন্য এখন দেশীয় প্রাকৃতিক সম্পদ বেশী পরিমাণে গচ্চা দিতে হয়। প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয় নিশ্চিত করায় নির্ভরতা হার বাড়তে বাধ্য। দুই, আমদানির স্বার্থে যে পরিমাণ সঞ্চিত বিদেশী মুদ্রাকে পুঁজি করা হচ্ছিল, সেটাও গরিবের ধন হয়ে যায়। স্বভাবতই অভাব সৃষ্টি নির্ভরতা হার বাড়িয়ে তোলে।

জনগণ যে সরকারকে নির্বাচিত করেছিল তার স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার শর্তে দেশের স্বার্থ ভুলন্ঠিত হয়। অর্বাচীন নির্বাচিত সিদ্ধান্ত-গ্রহনকারীর সমাহার দেশ বিক্রির পথে নামে। স্বাধীনতা মানে যে স্বাবলম্বী হওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল তে অর্থহীন হয়ে পড়ে। বিলগ্নীকরণের নামে দেশের সম্পদ বিক্রি হতে থাকে। বিদেশী পুঁজি নতুন পথে শোষণের শেকড় চারায়। ভারতবাসীর শ্রম, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভবিষ্যৎ চুষে নেওয়া শুরু হয় নতুন মাত্রায়। অরক্ষিত স্বাধীনতা পরাধীনতায় পর্যবসিত হয়। ঋণ নীতির ফাঁসে আটকে যায় ভারতের স্বাধীনতা। স্বাধীন নাগরিক ঋণের বোঝা নিয়ে জন্মায়, বড় হয় এবং মারা যায়। ধনি-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ে। সামাজিক অসাম্য প্রকট হয়। নয়া-উপনিবেশবাদের অনুচরেরা তাদের অনুশাসনে আজ ভারতবাসীকে চলতে বাধ্য করে।

তথ্য জানার অধিকার আপামোর জনগণের দরকার নেই – সরকারের এই মনোভাব স্বচ্ছতার প্রশ্নে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার বাধ্যবাধকতাকে লুকিয়ে রাখে। অধিকারহীন বেঁচে থাকায় স্বাধীনতা বিস্বাদে, বিবর্ণে পাংশুটে চেহারাকেই প্রকট করে। স্পষ্ট হয় স্বৈরাচারের নিদর্শন। সপ্তদশ লোকসভায় পুনরায় নির্বাচিত  হওয়ার পর সরকার যখন সংখ্যালঘুর ভিটেতে ঘুঘু চড়ায়, তখন ধর্মীয় সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। গোপন হিংসা, কপট রাত্রি, সন্দেহের মন পরাধীনতার বাতাবরণ তৈরি করে।

আজকের সরকার এখানের থেমে থাকে না। নরসিংহ রাও-মনমোহন সিং যতটা করার সাহস দেখান নি, সেটা দেখাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহের সরকার।

কি সেটা?

দেশের অর্থভাণ্ডার ঠিক রাখতে বিদেশী লগ্নীকারীদের থেকে বিদেশী মুদ্রাতেই ঋণ নেওয়ার পথে হাঁটতে চলেছেন তারা। বাজেটে ঘোষণাও করেছেন। দেশের জনগণের ভবিষ্যৎ বিরাট ঝুঁকির সামনে ফেলে দেওয়ার এটি একটি সিদ্ধান্ত। ডলারের দাম আচমকা বেড়ে গেলে সমূহ বিপদ। ঋণের এই ফাঁদে পড়ে বহুদেশ সর্বশ্রান্ত। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো শুধু নয়, তাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়ার বিপর্যয় আমাদের সকলেরই জানা। তবুও আমরা হেঁটে চলেছি সেই পথে। সামায়িক ও কিছু ফাটকাসুলভ লাভের কষ্ট-কল্পিত সুবিধাকে রাজনৈতিক বয়ান করে তুলে সেই ভয়ঙ্কর পথে এগুনোর সরকারি চেষ্টা চলছে।

প্রতিবাদীর স্বর যদি অস্বীকার করা হয়, তবে তো বলবো নাগরিককে প্রায়ান্ধকার প্রান্তরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, যা পরাধীনতার নামান্তর। আর্তের চিৎকারে দীর্ণ এই বিভ্রান্তিমূলক সামাজিক পরিস্থিতির অনুভূতি আর যার কথাই বলুক স্বাধীনতার কথা বলে না। স্বাধীনতা নিশ্চয়তার বার্তাবাহক।

এই পরাধীনতা নতুন। বিদেশী শাসকের অধীনে থাকার থেকে এখানে জ্বালাটা একটু বেশী। কেউ বলবেন বিদেশী হোক আর স্বদেশী হোক পরাধীনতার জ্বালা সব সময়ই সমান। সেই কথায় আমার আপত্তি নেই। আপত্তি থাকার কথাও নয়। আমি শুধু ভেবে দেখতে বলবো, পরের জ্বালার জ্বলন থেকে ঘরের জ্বালার জ্বলনটা একটু গুরুপাকেরই মনে হয়। সংখ্যাগুরুর ভোটাধিকারে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত নয়, সে যখন বিদেশী শক্তির দালালে পরিণত হয়ে গোটা দেশের মানুষকে পীড়নের মুখোমুখি করে, তখন জ্বালা তো ধরবেই। অনুভূতিতে যে গ্লানি পীড়া দেবে তা শেকল পড়া জীবনের জলছবি। এখানে স্বাধীনতা জাতীয়তাবাদের মুখোশ পড়ে দাঙ্গার রাজনীতিতে ফায়দা তোলে।

প্রতিবাদকে বিদ্বেষের শিল্পকলায় আজ আরও নিপুণভাবে দমিয়ে রাখা হচ্ছে। শ্রমিক-কৃষক নয়া-দাসত্বের নিয়মে বাঁধা পড়ছে। স্বাধীনতার গর্ভ থেকে উঠে আসা নয়া-পরাধীনতা ভারতবাসীকে আজ একক পরিচয়-মাত্রার বিভ্রমে ফেলে দিচ্ছে। এই বিভ্রান্তিকে সুকৌশলে এবং দক্ষতার সঙ্গে শাসক শ্রেণী শুধু লালন করে চলেছে বললে ভুল হবে, সলতে উসকে দেওয়ার কলটাও সে ক্ষমতার দখলে রেখেছে। আর তাতে নির্ভরশীল, গন্ডীতে আবদ্ধ, পীড়াদায়ক, ভীতিমূলক, বৈষম্যযুক্ত, হিংসাত্মক, অবাস্তুতান্ত্রিক এবং দৈন্য সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী-জীবনে স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গ সত্য হয়।

শেষ করবো পরাধীনতা প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপলব্ধির কথা বলে। “ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং পরাধীনতা” শীর্ষক প্রবন্ধে আমার এই কল্পিত জ্ঞাতিসূত্রের গোত্রজাত পুরুষটি পারতন্ত্র্য, পরাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক খুঁজেছেন। সেই প্রসঙ্গে কিছু কথা আমি আগেই বলেছি। এখানে শুধু শাসক ও শাসিতের অবস্থানগত বৈধতায় বৈষম্যের কথা তুলবো। আইন প্রাচীন ভারতের মতো আধুনিক ভারতেও যেমন শাসকের রক্ষাকবচ ছিল, উত্তরাধুনিক, উত্তর-সত্যের ভারতেও তার শ্রেণী অবস্থান অটুট আছে। শাসকের শ্রেণীচরিত্রে বদল না ঘটালে স্বাধীনতার মোড়কে পরাধীনতার অনুভূতিতে শাসিতের প্রতি শাসকের ভাবনার পরিবর্তন ঘটে না। ব্রাহ্মণরাজ্যে ব্রাহ্মণ, মুসলিম শাসনে নবাব-সম্রাট, খ্রিষ্টান শাসনে ইংরেজ, আর আজকের সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনে সরকারের প্রতিনিধি, স্বাধীনতার সজীবতায় বৃহত্তর জনমানসকে নির্জীব, নির্ভরশীল, নিপীড়িত অবস্থানে দাঁড় করিয়ে রাখে, যেখানে স্বাধীনতার নৈতিক বাণী নীরবে নিভৃতে গুমরে মরে।

অনিশ্চয়তার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হাড়জিরজিরে কৃষক, কলের ন্যাংটো শ্রমিক উজ্জ্বল পতাকার পতপতানিতে স্বাধীনতার সুদিন গোনে।

[লেখক এম. এ, পি এইচ. ডি, সহকারী অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, প্রফেসর নুরুল হাসান কলেজ, ফারাক্কা, মুর্শিদাবাদ]         

Facebook Comments

1 thought on “পরাধীনতার পরে স্বাধীনতা, না স্বাধীনতার গর্ভে পরাধীনতা? : কৌশিক চট্টোপাধ্যায় Leave a comment

Leave a Reply