স্বাধীনতা তোমায়… : আইভি চট্টোপাধ্যায়

fail

সকালে বাজারে গেছিলাম । ছোট একটা ছেলে আর তার বাবা । পতাকা বিক্রী করছে । জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত দাম?’

সম্ভাব্য ক্রেতা দেখেই ছোট ছেলেটির মুখে হাসি, বাবা বললেন, ‘সকাল থেকে বসে আছি, একটাও বিক্রী হয় নি । আপনি নিন না, আমি কম করে দেব ।’

দোকানে নানা মাপের পতাকা । একেবারে ছোটগুলো তিন টাকা, একটু বড় পাঁচ টাকা, এরকম করে করে সবচেয়ে বড় পতাকার দাম চল্লিশ টাকা । কাপড়ের তৈরী পতাকাও আছে, আছে ফেস্টুন ।

আর আছে তিনরঙা হাতে পরার ব্যান্ড । তাতে লেখা – ইন্ডিয়া । ব্যান্ডগুলো সব গেরুয়া-সাদা-সবুজ নয় । লাল-সাদা-সবুজ । নীল রঙে লেখা – ইন্ডিয়া ।

বললাম, ‘একটাও বিক্রী হয় নি সকাল থেকে?’

বাবা বললেন, ‘তিনদিন ধরে বসছি । ব্যান্ড বিক্রী হয়েছিল কাল, পতাকা একটাও বিক্রী হয় নি । সকালে ক্লাবের ছেলেরা মিছিল করে বলে এসে বসেছিলাম, কেউ একটাও কিনল না ।’

বুঝলাম, প্রভাতফেরির কথা বলছে । বললাম, ‘আচ্ছা, আমি একটা কিনব । কিন্তু তার আগে বলো, এই পতাকা কিসের জন্যে?’

বাবা কিছু বলতে চাইলেন, আমি থামিয়ে দিয়ে ছোট ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম আবার ।

ছেলেটা একটু ভেবে বলল, ‘আজ পরব হ্যায় ।’

‘কি পরব?’

‘পন্দ্রহ আগস্ট । ঝাণ্ডা পরব ।’

‘ঝাণ্ডা পরবে কি হয়?’

ছেলেটা,বছর আট নয় বয়স,ভেবে নিল খানিক । তারপর বলল,’হনুমানজি কা পূজা হোতা হ্যায় ।’

বাবা আর পারলেন না, বলে উঠলেন, ‘নহী রে বুদ্ধু, ইয়ে আজাদী কা পরব হ্যায় । স্কুল মে টিচার লোগ মনাতে হ্যায় ।’ আমাকে বললেন, ‘আমাদের মহল্লায় আজ হনুমানজিকা মন্দির মে ঝাণ্ডা লগাকর পূজা হোতা হ্যায় না? তাই ও ভেবেছে হনুমানজিকা পূজা ।’

ছোট ছেলেটি বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি জানি । স্কুলে টিচাররা ঝাণ্ডা পরব মানায়, বাচ্চাদের লজেন্স দেয়, কোই কোই স্কুল লড্ডু ভি দেতা হ্যায় ।’

‘তুমি স্কুলে যাও না? আজ যাও নি স্কুলে?’

‘আমার স্কুলে ঝাণ্ডা-পরব হয় না । আমাদের টিচার বড় স্কুলে গিয়ে পরব করে । কাল স্কুলে গিয়ে লজেন্স পাব ।’

বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি যে বললেন, আজাদী কা পরব । কিসের আজাদী জানেন?’

‘হ্যাঁ, কেন জানব না? দিল্লী মে লাল কিলা কা আজাদী । দেশ কা আজাদী । টিভি মে হর সাল দিখাতা হ্যায় ।’

‘সে ঠিক আছে । কিন্তু দেশ কা আজাদী হল কখন? কবে?’

বাবা একটু বিব্রত হলেন, পাশের দোকানী আমাদের গল্প শুনছিলেন, একজন রিক্সাচালকও পাশে খালি রিক্সায় বসে শুনছিলেন । পাশের দোকানী বলে উঠলেন, ‘আরে, কংগ্রেস আজাদী এনেছিল । বহুবছর আগে । আর এই তো দু’ বছর হল মোদীজি আজাদী আনলেন ।’

বাবা বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, মোদীজি । প্রথমে কংগ্রেস, ফির মোদীজি ।’

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘দেশ তার আগে পরাধীন ছিল তো? কার হাত থেকে আজাদ হল?’

রিক্সাচালক একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছেন,বললেন, ‘এ তো সবাই জানে। মুসলমানদের হাত থেকে আজাদী। পাকিস্তান সে আজাদী ।’

আমি একবার ভাবলাম, স্বাধীনতার ইতিহাস আমি যেটুকু পড়েছি বলব কিনা । তারপর মনে হল, আমিই কি জানি, স্বাধীনতা কাকে বলে! আমার দেশ সত্যিই স্বাধীন কিনা! আমিই কি ঠিক ঠিক জানি, স্বাধীনতা মানে শুধুই ক্ষমতার হস্তান্তর কিনা ।

একটা পতাকা কিনে বরং বাড়ি ফিরে যাই ।

স্বাধীনতা । স্ব-অধীনতা । ভারি চমত্কার শব্দ । জোরালো শব্দ । স্বাধীনতা.. মনে মনে উচ্চারণ করলেও কেমন একটা জোর আসে । আলো আলো ভাব । যদিও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই আলোটার মানে বদলে বদলে যাচ্ছে । কিশোরবেলায় স্বাধীনতা শব্দের দ্যোতনায় দেশ সমাজ সংসার নির্মল উজ্জ্বল আলোয় হেসে উঠত । এখন অন্যরকম নানা বোধ সম্ভব-অসম্ভবে জড়িয়ে নতুন নতুন উপলব্ধি । এখন মনে হয়, স্বাধীনতা এক চোখ-ধাঁধাঁনো আলো, যা শুধু নিজেকেই দেখায় । আর ঢেকে দেয় অন্য সব ।

তাই বুঝি স্বাধীনতার তিয়াত্তর বছরের জন্মদিনে আলো প্রায় বিলীয়মান, চোখে পড়ে যাচ্ছে নানা যন্ত্রণা, বঞ্চনা ।

তাহলে কি এই আলো তিমিরবিদারী ছিল না কোনদিনই? নাকি আলোর বৃত্তের বাইরের অন্ধকার ঘিরে ধরল আলোকেই?

সেই ফ্রক-পরা ছোটবেলায় পাশের বাড়ির রণদার আবৃত্তি শুনেছিলাম । ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে… কে বাঁচিতে চায়…’ বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতা । আমাদের ছোটবেলার কালে অবশ্যপাঠ্য একটি কবিতা ।

ঠাকুমার অনেক পুষ্যি ছিল । চারটে ছাগল, দুটো গরু, একটা কুকুর, ডজনখানেক খরগোশ । রণদার আবৃত্তি শুনে কি যে হল সেদিন, দড়ি খুলে আগল খুলে সব পুষ্যিদের ছেড়ে দিলাম । ‘যাও, তোমরা সবাই স্বাধীন ।‘

ঠাকুমা ছুটোছুটি করে সবাইকে ধরে ধরে আনলেন, ‘ওরে বোকা মেয়ে, অমন করে ছেড়ে দিতে হয়? দ্যাখ, রুপু খরগোশের চোখটা কেমন পাখিতে খুবলে দিয়েছে । আহা, ভোম্বলকে কেমন কামড়ে দিয়েছে রাস্তার কুকুর । আর লালি ছাগলটা? আহা । মা হবে যে কোনোদিন… এ সময় ওকে বাড়ির বার করে দিতে হয়?’

আমাকে ‘বোকা’ বললেন ঠাকুমা, কিন্তু আমি অবাক হয়েছিলাম বোকা প্রাণীগুলোকে দেখে । কেমন নিশ্চিন্তে মুখ নামিয়ে ঠাকুমার আদর খাচ্ছে । ‘স্বাধীনতা’ নামে কত বড় জিনিসটা দিয়েছিলাম আজ, একটু বুঝল?

বড় হয়ে বুঝেছি, স্বাধীনতা দেবার জিনিস নয় । অর্জন করতে হয়, অর্জনের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় । অন্তর বাহির মিলিয়ে একটা লড়াই করতে হয় ।

‘স্বাধীনতা’ শব্দে গায়ে কাঁটা দেওয়া অনুভুতি এল আরো একটু বড় হয়ে । ইতিহাস পড়ি তখন । আমার শস্যশ্যামলা সমৃদ্ধ ‘মা’ বিদেশী শাসনে পরাধীন,সেই ইতিহাস। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস । সিপাহী বিদ্রোহ, সিরাজ-উদ-দৌলা,টিপু সুলতান থেকে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন,নোয়াখালির দাঙ্গা । আমার চেতনে পনেরই আগস্ট হয়ে ওঠে এক পবিত্র দিন, আলোর দিন ।

ভোর ভোর প্রভাতফেরি । সাদা জামা, সাদা স্কার্ট । মিছিলে হাঁটায় অনির্বচনীয় আনন্দ । মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, বড়রা মিছিল ছেড়ে গাছের তলায় জড়ো হন, আমরা ছোটরা হাসিমুখে ভিজি । জোরগলায় গাই, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান…’ কত রক্তক্ষয়, কত প্রাণের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা.. বৃষ্টির ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে চলে?

স্কুলে ঢুকতেই ছেলেমেয়েদের ড্রাম-বিউগিলের শব্দ । মার্চপাস্টের দলে গিয়ে দাঁড়াই । প্রধান অতিথির হাতের টানে দড়ি খুলে আকাশে ছড়িয়ে পড়ল গৈরিক সাদা সবুজ পতাকা.. ছড়িয়ে পড়ল কুচো কুচো অজস্র রঙিন ফুল.. টানটান দাঁড়িয়ে স্যালুটরত আমরা সবাই… দীপ্তিদি গানের দল নিয়ে গাইছেন, ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে…’

আমার গলা ব্যথা করে ওঠে, চোখের কোণ শিরশির, এখনই জল নেমে আসবে, গায়ে কাঁটা দেয় । দেশপ্রেম, এক অপূর্ব অনুভুতি । ‘স্বাধীনতা দিবস পালন’ এক অনন্য অভিজ্ঞতা ।

খুঁজে খুঁজে পড়ি স্বাধীনতা-সংগ্রামের শহীদদের কথা । ক্ষুদিরামের ফাঁসির গান ‘একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি’ গাইতে গিয়ে চোখের জলে ভাসি । বাড়ির খোলা ছাতে মায়েদের রঙিন শাড়িতে মঞ্চ, নাটক করি আমরা… ‘বুড়িবালামের তীরে’… বাঘা যতীনের জীবনের শেষ ক্ষণে মায়েরাও চোখে আঁচল চাপা দেবেন । ক্লাবের অনুষ্ঠানে গ্রুপগানের দলে ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে…’ চারণকবি মুকুন্দদাসের সঙ্গে এইভাবেই আলাপ হয়ে যাবে ।

আরেকটু বড় হয়ে দেখাগুলো, বলা ভালো মানেগুলো বদলে বদলে যাবে । পরপর পড়ে ফেলব ‘ফ্রীডম অ্যাট মিডনাইট’… ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’… স্বাধীনতার পরিভাষা বদলায় রোজ । নতুন একটা কথা পড়ি, ‘এ আজাদী ঝুঠা হ্যায়’… দেখতে শিখছি বর্ণময় শব্দময় স্বাধীনতার আলোর সঙ্গে জমাট-বাঁধা অনেক কান্না, শোষণ, বঞ্চনা ।

রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতার যোগ খুঁজতে ইচ্ছে হয় । নতুন করে বুঝি, স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় অনেক মূল্য দিয়ে ।

তবু চোখে পড়ে কিছু কিছু, বোধেও ধরা পড়ে । আমার স্বাধীনতাবোধের সঙ্গে আমার বাড়ির কাজের মেয়েটির বোধ মেলে না । সেই মেয়ের কাছে স্বাধীনতা মানে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার, খাবারটুকু জোগাড় করার জন্যে রোজগার করার স্বাধীনতা। ‘দেশ’ মানে কি পুরোপুরিই ধারণা নেই । তবে পনেরো আগস্ট ‘টিভিতে স্বাধীনতা দেখাবে’ তা জানা আছে । কাশ্মীর আর পাকিস্তানী দুশমন, মার্চপাস্ট করে যাওয়া জওয়ানরা, আকাশে বায়ুসেনার বিমানের আল্পনা আর ক্যাম্পাসের পতাকা-উত্তোলনের সময় লজেন্সের প্যাকেট । স্বাধীনতা মানে এই ।

কষ্ট হয় আমার । ভাবনাও হয় ।

লেখা শুরুর আগে কৌতুহলবশত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম । দুটি মাত্র প্রশ্ন আমার ।

এক, স্বাধীনতা দিবস পালন নিয়ে আবেগ ।

দুই, এ বছর তিয়াত্তরতম স্বাধীনতা দিবস পালন । স্বাধীনোত্তর বাহাত্তর বছরের স্বাধীন ভারত সম্বন্ধে ভাবনা ।

প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগ মানুষ বলেছেন, শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো, জাতীয় পতাকা উত্তোলনের শিহরণ, দেশপ্রেম নিয়ে আবেগের কথা । কয়েকজন বলেছেন, এ দিনটা আলাদা করে তেমন কিছু মনে হয় না…তবে একটা ছুটির দিন, আর এসময় ভালো ইলিশ ওঠে..তাই বেশ ভালো কাটানো যায় ।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বেশি সাড়া পেয়েছি । সরকারী আমলা আর মন্ত্রীদের শিথিলতা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রন্ধরে রন্ধরে দুর্নীতি, ধর্মীয় মৌলবাদ আর সন্ত্রাস । বাহাত্তর বছরের স্বাধীন ভারতের ইতিহাস বলতে এই ।

তবু খেয়াল করছি, ‘দেশ’ সম্বন্ধে ভাবনাটা অনেকটাই সঙ্কীর্ণ । দেশ মানে প্রাদেশিকতা, দেশ মানে নিজের ভাষাভিত্তিক একটা অঞ্চলের ধারণা । স্কুলপড়ুয়া এইট নাইনের ছেলেমেয়েরাও ‘দেশ’ নিয়ে আবেগের কথা বলতে পারে নি । তবে অনেকেই বলেছে, ‘বড়’ হয়ে দেশের জন্যে কিছু করতে চায় । সেই চাওয়াটা কি, তা অবশ্য কেউ বলতে পারে নি ।

আসলে, ওরা শেখেই নি । আমার প্রশ্ন শুনে মূক চোখে চেয়ে থেকেছে । ডাক্তার হয়ে, মহাকাশবিজ্ঞানী হয়ে দেশের সেবা করার কথা বলেছে কেউ কেউ ।

বয়স্ক এবং প্রৌঢ় মানুষ বেশ কয়েকজন বলেছেন, ‘আবার যদি বিদেশী শাসন হয়, ভালো হবে । নিজের স্বাধীন দেশে প্রতিপদে মাথা নিচু করে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করে মানিয়ে থাকার চেয়ে বিদেশী শাসনে থাকলে অন্তত এটুকু জবাবদিহি করতে হয় না যে কেন আমরা নিরুপায়, অসহায় ।‘

সবচেয়ে অবাক হয়েছি তরুণদের কথা শুনে । তরুণ বলতে তিরিশ থেকে চল্লিশ বছরের মানুষদের কথা বলছি । শতকরা একশ’ জন বলেছেন, ‘চাকরি বাঁচিয়ে সংসার চালিয়ে আর দেশের কথা ভাবার সময় নেই ।‘ সুযোগ পেলে বিদেশ চলে যাবার ইচ্ছে জানিয়েছেন প্রায় সবাই । নিজের জীবনে না হলেও সন্তানের বিদেশ-বাস সুনিশ্চিত করতে চান ।

মাত্র একজন আমায় বলেছেন, প্রতিবছর এই দিনটায় তিনি ভেতর থেকে গর্ব অনুভব করেন । ‘একটা শক্তি পাই, জোরালো একটা ইচ্ছে হয় যে সবরকম অন্যায়ের প্রতিবাদ করি, মানে হয় দেশের জন্যে এখনও কিছু করার আছে আমার । এই ভাবটা বেশ কিছুদিন থাকে ।‘

আমি ব্যাকুল প্রশ্ন করেছি, ‘কিছুদিনের জন্যে? সারা বছর এই জোরটা রাখা যায় না ?’

মলিন হেসেছেন তিনি, ‘নানারকম আপোষ করতে হয়, নিজের কাছেই নিজের মুখ লুকিয়ে ফেলতে হয় অনেক সময় । কি খাব, কি পরব, কি বলব তা ঠিক করারও স্বাধীনতা নেই যে দেশে, সেখানে মেরুদণ্ডে জোর থাকে?’

দেশ । আমার দেশ । সন্তান হিসেবে তাকে রক্ষা করতে পারি নি । সন্তান হিসেবে দিতেও পারিনি কিছু। শস্যশ্যামলা সুজলা সুফলা দেশ আমার, বারবার বিদেশী আক্রমণ, লুটতরাজ, দেশভাগ, অন্তর্কলহ। রাজনৈতিক অস্থিরতা । স্বরাজ-এর দাবি নিয়ে গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের পথ চলা ।

তারপর এই বাহাত্তর বছরের ছবিটা কেমন?

শাসকদল নীতি গ্রহণ করেন ‘পলিসি’ হিসেবে, ভোটের কথা মাথায় রেখে । কলকারখানা থেকে অফিস কাছারি, মুনাফায় দেশের মুষ্টিমেয় ধনীরা আরো ধনী । শহর বাড়ছে প্রতিদিন, বহুতল অট্টালিকা, সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের মতো জনসংখ্যা বাড়ছে ।

চাকরির বাজার শূন্য, যাদের চাকরি ছিল তারাও চাকরি হারাচ্ছে । রোজই নানা ক্ষেত্রে হাজার হাজার কর্মী চাকরি হারাচ্ছে । ক্রমবর্ধমান বেকার সংখ্যা । এই সমস্ত বিচ্ছিন্নতা পুঁজিবাদের ফল কিংবা সহায়, আবার এই বিচ্ছিন্নতার জন্যেই সামাজিক সংহতি  দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়ছে।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ । আধিপত্যের নেশায় উন্মত্ত জাতীয়তাবাদ । মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে রাষ্ট্রের দখলদারি । স্বাধীনতার জন্মলগ্নে ধর্ম নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল দেশ, আজ সেই ধর্ম নামক চারাগাছ রাজনৈতিক মদতে বিশাল মহীরুহ ।

ইতিহাস সাক্ষী, জাতিদ্বন্দ্বের ফলে দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হয় । তবু আমরা রোজ দেখি, প্রদেশ-সরকার আর কেন্দ্র-সরকারের দ্বন্দ্ব । আমরা একে একে জন্ম নিতে দেখছি উত্তরাখণ্ড, ছত্তিসগড়, ঝাড়খন্ড, তেলেঙ্গানা । আরো কত দ্বন্দ্বে কত খন্ড হবে আমার দেশ, কে জানে ।

মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব, ভিন্ন ধর্ম ভিন্ন আচার নিয়ে দ্বন্দ্ব । এতটাই অসহিষ্ণু মানুষ যে অন্যকে পিটিয়ে মেরে ফেলতেও হাত কাঁপে না । আবার এই অমানবিক অত্যাচারের পরও রাজনৈতিক মদতে সে মুক্ত বিচরণ করে সমাজে ।

আমাদের গণতন্ত্র আমাদের সম্পদ । তাই প্রশ্ন জাগে, স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর পরেও এক বিপুল সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে কেন । সরকারি নীতি প্রয়োগ যথাযথ হয় নি? তাহলে প্রশাসনিক ব্যর্থতার দায় কার?

সর্বাঙ্গীন উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি । রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি । দুর্নীতি আছে বলেই দরিদ্রের কাছে নীতি নির্ধারক নিয়মগুলো পৌঁছয় না, ত্রাণ পৌঁছয় না, সরকারের ব্যয় ঠিক পথে হয় না, রাজস্ব আদায়ও হয় না ।

স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর পেরিয়ে এসেও আমাদের প্রেরণার উত্‍সমুখ বহির্পৃথিবী । আমরা কখনো অনুসরণ করি রাশিয়ান মডেল, কখনো আমেরিকান, কখনো চীনা মডেল । পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা । জাতীয় নিরপত্তার নামে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা প্রতিরক্ষা-খাতে খরচ হয়, কিন্তু সে সম্পর্কিত তথ্যগুলো দেশের মানুষ জানতে চাইতে পারে না। মানবাধিকারের এমন উল্লঙ্ঘন আর কোনো সভ্য দেশে হয় কিনা কে জানে ।

সরকারের ঘোষিত নীতি হল, উন্নয়নের পথ বিশ্বায়ন । দুর্ভাগ্য এই যে, বিশ্ববাজারের সম্ভবনাগুলো কাজে না লাগিয়ে উদরীকরণের হাত ধরে আমরা ক্রমশ দেশীয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের মেজাজ-মর্জির অধীন হয়ে পড়েছি । সরকারের যাবতীয় ক্ষমতা এখন পুঁজিপতিদের হাতে । সমাজের প্রতি স্তরে স্বচ্ছতা নেই, যতই ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানের প্রচার হোক । প্রশাসনের মানুষরা দায়বদ্ধ নন, মন্ত্রী-আমলারা ব্যক্তিগত লাভ ও ক্ষমতা নিয়ে ব্যস্ত ।

যা-ই হোক, আজকের গল্পটা শেষ করি ।

স্বাধীনতা দিবস নিয়ে প্রবন্ধ লিখে ভারমুক্ত হয়ে আমি ঘরোয়া আড্ডায় যোগ দিলাম । বাজারে সকালের অভিজ্ঞতাটা বিশদে বললাম । ভালোই জমে উঠল আলোচনা । দুর্নীতি আর রাজনীতি, বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে সিন্ডিকেটরাজ, দখলের নীতি থেকে বাক-স্বাধীনতা হরণ, সম্প্রতি ৩৭০ ধারা বিলোপ.. নানা দিকে আলোচনার ধারা বইতে লাগল ।

কাঁপা কাঁপা গলায় হঠাত্‍বাবা বলে উঠলেন, ‘সাতচল্লিশের সেই রাত… কি প্রবল উত্কণ্ঠায় প্রতিটি ভারতবাসী জেগে… দরজা জানলা বন্ধ… বাইরে পুলিশ টহল দিচ্ছে… নেতাজীর ভাষণ রেডিওতে… স্বাধীনতা দিবস এলেই সেই দিনটা মনে পড়ে যায় ।‘

একটু ধরে এল গলাটা, ‘স্বাধীন ভারতবাসী হিসেবে কিছুই করা হয়ে উঠল না ।‘

আড্ডার বাকি সবাই, সবার জন্ম স্বাধীন ভারতে । এই আবেগটা আমাদের চেনা নয় । তবু কি করে যেন এই ভাবনাটায় একাত্ম হয়ে পড়ি, স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে কিছুই করা হয়ে ওঠে নি ।

আমার কিশোরী কন্যা স্কুলের পনেরো আগস্টের মার্চপাস্ট করে এসে বড়দের আড্ডায় বসে পড়েছিল। কেমন একটা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক । দেশের জন্যে কিছু করি না তো আমরা কেউ। আজ যখন স্কুলে পতাকা তোলা হচ্ছিল,আমার কেমন কান্না পেয়ে গেছিল।‘

অমনি মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ছোটবেলাটা দেখে ফেললাম । কই, কিছুই তো বদলায় নি । সত্যিই একদিন স্বাধীন আলোয় অসহিষ্ণু ভারতের গোটা অন্ধকারটা দূর হবে? হয়ত নতুন একটা প্রজন্ম এগিয়ে আসবে । তখন আর নিজেকে এমন নিরুপায় পরাধীন মনে হবে না । এই আশাটুকুই ভরসা ।

স্বাধীনতা প্রতিটি ব্যক্তিমানুষকে মুক্ত করুক, এই প্রার্থনায় চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করি আমি । স্বাধীনতা, তোমায় যেন ভেতর থেকে অনুভব করি । ছোট ছোট গণ্ডীতে কিছু কাজ যেন করতে পারি, তোমার কাছে এই অঙ্গীকারটুকু করি আজ ।

Facebook Comments

Leave a Reply