সম্পাদকীয়
অনুভব করলাম সাদার বদলে কালো — এইমাত্র! আর সব একই। বৃথা অন্য কিছুর অন্বেষণ। কান্না থামেনি। কেউ থামায় নি। থামার কথাও ছিল না, ওটা ছিল চলার গল্প। ওটা ছিল অ্যাম্বিশান।
স্বাধীনতা। অনেকের কাছে উদযাপন, হতে পারে সেটা লাল কেল্লায় বা রেড রোডে বা অন্য কোথাও— কোন ঝুপড়িতে ন্যাংটো পোঁদে ছেলেটার এক হাতে পাটকাঠিতে তিরঙ্গা অন্য হাতে নেতার দেওয়া বিস্কুট বা ক্যাডবেরি, আনন্দে খোলা আকাশে সারাটা দিন গায়ে রোদ্দুর মেখে দৌড়ে বেড়ানো অথবা সেই আদিবাসী মহিলা যিনি পতাকা উত্তোলন দেখতে এসে ‘কুনটা স্বাধীনতা’ খুঁজতে খুঁজতে একটা কাপড়ের টুকরো স্বাধীনতা হতে পারে না বলে নিজেই বাতিল করে। তাহলে কি দড়িটা? না তাও নয়। দড়ি দিয়ে গোরু বাঁধে— সেটাও স্বাধীনতা হতে পারে না বলে বাতিল করে দেবার পর শেষমেশ পড়ে থাকা বংশ দণ্ডটাকেই স্বাধীনতা বলে চিহ্নিত করেন। কারণ দড়ি, এক টুকরো রঙিন কাপড় আর যাই হোক স্বাধীনতা ‘হবেক লাই’। ‘অপরজন’-এর কাছে স্বাধীনতা আজও পালন নয়, উদযাপন নয়— অন্বেষণ।
স্বাধীনতার অপর পিঠে আছে পরাধীনতা। অথবা স্বাধীনতা এবং পরাধীনতা একই পিঠে বিচরণ করে যেমন দিনের পর রাত আর রাতের পর দিন। জোয়ার ভাঁটার মত— একটা যায় একটা আসে। স্বাধীনতা যাচ্ছে পরাধীনতা আসছে। এতেও মজা! স্বাধীনতার জন্যে অনেকে সংগ্রাম করে। পরাধীনতার জন্যে কেউ সংগ্রাম করে না। সেটা হিডেন! আপনা আপনি এসে যায়। আবার আপনা আপনি কিছুই আসে না। স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে! কেউ বাঁচতে চায় না, অথচ বাঁচতে হয়–কেউ উদযাপন করে না। ‘অপরজন’ প্রত্যক্ষ করে বাহাত্তর বছর স্বাধীনতার পর কীভাবে পরাধীনতা এলো বা আসছে।
এই সেদিন বাঙ্গালোর আসছিলাম ‘দুরন্ত’য় ফার্স্ট ক্লাসে! রেল এখনও সরকারী। অবশ্য পুরোটা নয়। শোনা যাচ্ছে আরও কিছু মানুষকে ‘স্বাধীন’ করা হবে। শুরুটা ক্যাটারিং দিয়ে, সইয়ে সইয়ে। ওঁরা হাতে পাবে পুরো একটা ট্রেন বা জোন! যোগ্যতাই একমাত্র মাপকাঠি! বোঝাই যাচ্ছে অনেক মানুষ ‘পরাধীন’ ছিল। প্রতিটি মুহূর্তে মানুষ ‘স্বাধীন’ হয়ে চলেছে! টেন্ডার হয়! পাশ করতে হয়! আসতে আসতেই কথা হচ্ছিল সেই ট্রেনের অ্যাটেনডেন্টের সঙ্গে। অ্যাটেনডেন্ট সরকারের অধীন নয়। ওঁর মনিব আছে। সেও ‘স্বাধীন’! মাইনে কত পাও— জবাবে বললে পার ট্রিপে বারোশো টাকা। ট্রিপ মানে আসা এবং যাওয়া। অর্থাৎ চার দিন। চার দিনে বারোশ’ টাকা। ডিউটি মানে পুরো ঐ চার দিন বাঁধা বারোশ’ টাকায়। দিনে দাঁড়াল তিনশ’ টাকা। খাওয়া থাকাটা ট্রেনেই! হিডেন কষ্ট হাওড়া-বাঙ্গালোর ভ্রমণ!! আর যাত্রার শেষ লগ্নে টিপস। ওঁরা এসে হাত পেতে দাঁড়াবে। আপনি খুশি হয়ে কিছু দেবেন, ঘুষ নয়, বিনিময়ে একটা ‘সেলাম’ পাবেন! তারপর বাঙ্গালোরে পৌঁছে যেখানে এসে উঠলাম দেখলাম বিস্তর কাজ হচ্ছে— আবাসন নির্মাণ। ব্যাপক কাজ। পরদিন ঘুরতে বেরিয়ে দেখা ফ্ল্যাট রং করছে একদল আঠার থেকে বিশ-বাইশ-চব্বিশ বছরের ছেলে মেয়ের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলাম, ভাষার জটিলতা পেরিয়ে, কোথা থেকে ওঁরা এসেছে। বললে হাম সব জগাহ সে হ্যাঁয়। কেউ কেরালা কেউ তামিলনাডু, কেউবা … জিজ্ঞেস করলাম কিতনা মিলতা হ্যাঁয়। বারাহ ঘণ্টা ছ’শ’ রুপায়া। ঘণ্টায় পঞ্চাশ টাকা। আট ঘণ্টার স্বাধীনতা ওঁরা দেখেনি, বারো ঘণ্টা থেকেই জীবন শুরু! ‘স্বাধীনতা’ খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। স্বাধীনতা বা পরাধীনতা একা থাকে না। একে অপরকে জড়িয়ে জাপটিয়ে থাকে। আলাদা করা যায় না! আমাদের এই ‘স্বাধীন’, ‘সার্বভৌম’, ‘গণতান্ত্রিক’, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশে ‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের শাসনে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ মানুষ অসহায়, পরাধীন প্রায়। বাক স্বাধীনতা, ধর্মাচরণের স্বাধীনতা, বিরোধিতার স্বাধীনতার অধিকার দেশে আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে। আধিপত্যবাদের সংস্কৃতি স্পষ্ট হচ্ছে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিসরে।
মনে পড়ছে সেদিনের ব্রিটিশের কৌশলী বিভাজন মন্ত্র! স্বাধীনতার সংগ্রামকে এক লহমায় পরস্পরের মধ্যে পুঁতে দিল অবিশ্বাস, অসহিষ্ণুতা আর ঘৃণার জেরে বয়ে গেল এক নদী রক্ত…অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে হাসল কেউ… তারই মধ্যে ক্ষমতার হাত বদল…আর তারই মধ্যে সাতচল্লিশের মধ্যরাতে নেহেরুজীর সেই কাব্যিক অভয়বানী— “Long years ago we made a tryst with destiny, and now the time comes when we shall redeem our pledge, not wholly or in full measure, but very substantially. At the stroke of the midnight hour, when the world sleeps, India will awake to life and freedom ….. The service of India means the service of millions who suffer …. the ending of poverty and ignorance and disease and inequality of opportunity. The ambition … has been to wipe every tear from every eye … have to build the noble mansion of free India where all her children may dwell.”
দুনিয়া যখন ঘুমায়ে রয়, আমরা জেগে রইলাম রক্তাক্ত কাঁথা গায়ে— স্বাধীন হলাম কই? পরাধীনই বা রইলাম কই! আর মনিব— অনুভব করলাম সাদার বদলে কালো এইমাত্র! আর সব একই। বৃথা অন্য কিছুর অন্বেষণ। কান্না থামেনি। কেউ থামায় নি। থামার কথাও ছিল না, ওটা ছিল চলার গল্প। ওটা ছিল অ্যাম্বিশান। এন্ডিং অব পভার্টি অ্যান্ড ইগনোরেন্স অ্যান্ড ডিজিজ, অ্যান্ড ইনইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটি— সব গপ্পো ছিল। তাই চোখে চোখে জল। আজও অভিসার চলছে। বিদেশি বানিয়ারা প্রথমে এসেছিল সুরাটে। তাই এলাহবাদের পরিবর্তে এখন সুরাট থেকে নতুন যাত্রা শুরু…এই তো স্বাধীনতা…বাঁচার নতুন ঠিকানা? সব কিছু আমাতে সমর্পণ করা!

Posted in: August 2019, Editorial