ঘামোকর্তার ভূত এবং দেশপ্রেমের বানান : অর্ক চট্টোপাধ্যায়
বেবাক ছিল সে নগরী। আজব দেশ। তাজব দেশ। দেশ চালাতো প্রবীণ নেতা ঘামো। ঘামোর বেজায় বয়েস। মরণবাবু কাছে। রোগশয্যায় তার ভাইস ক্যাপ্টেন অ-মিট খাঁ তাকে শুধালেন, ‘কর্তামশাই, আপনাকে ছাড়া দেশ চলবে না, আলো জ্বলবে না। আপনি মরলে যে আমরাও না খেতে পেয়ে মরে যাব! কি উপায়?’ ঘামোর বয়েস হলে কি হবে, ছাতি তখনো ছাপ্পান্ন। দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘অ-মিট, তোমরা চাইলে আমি এখানেই থাকবো। কোথাও যাবো না! মরবো বটে, কিন্তু ভূত হয়ে এ দেশ আমিই চালাবো। আমার খালি একটাই শর্ত আছে।’
অ-মিট খাঁ হাত জোড় করে বললেন, ‘বলুন কর্তামশাই, আপনার সব শর্ত সর আঁখো পর।’ ঘামো দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বললেন, ‘তোমাকে দায়িত্ব নিতে হবে যাতে দেশের সব লোক রোজ সকালে উঠে খাতায় বা কম্পিউটার স্ক্রিনে অন্তত পাঁচবার লেখে: আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। যদি এটা করাতে পারো তবে আমি ভূত হয়ে রয়ে যাবো, নয়তো টাটা। আমি ভূত হয়ে থাকাকালীন যেদিন একজন লোকও লেখা বন্ধ করবে বা চারবার লিখবে, আমি দেশ ছেড়ে চলে যাবো, এই বলে রাখলুম।’
অ-মিট খাঁর হলো ঝামেলা। এত বড় দেশে এত লোকের রোজকার দায় নেওয়া কি চাড্ডিখানি কথা। কিন্তু ঘামোর থাকাটা তো দরকার। মানুষ ঘামো যা আচ্ছে দিন এনেছেন, ভূত ঘামো তো তাকে অন্য জায়গায় নিয়ে চলে যাবেন। এ সুযোগ ছাড়া যায় না। কে দেখতে যাচ্ছে সবাই রোজ লিখছে কিনা। ঘামো এতসব খবর পাবেন না, এই আশাতে আশ্বস্ত হয়ে অ-মিট খাঁ প্রমিস করে দিলেন। ঘামো মরলেন কিন্তু ভূত হয়ে তাঁর শাসন অব্যাহত থাকলো। ইন্টারনেট থেকে খবরের কাগজ, ট্রেনস্টেশন থেকে বাসস্টপে মাইক লাগিয়ে ঘোষণা করা হল দেশের সব লোককে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকালে উঠে পাঁচবার ফোন, খাতা, ল্যাপটপ, আইপ্যাড, গাছের পাতা–যেখানে হোক লিখতে হবে: আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। নচেৎ মৃত্যুদন্ড।
নিরক্ষর আর শিশু রেহাই পাবে। তবে তাদেরও সকালে উঠে পাঁচবার মুখে মুখে বলতে হবে, ‘আমি আমার দেশকে ভালোবাসি।’ অ-মিট খাঁর মাথা থেকে বুদ্ধি তো ঘানির তেলের মতো বেরোয়। তিনি নিয়ম করলেন বোবা বা কথা ফোটেনি এমন বাচ্চাদের ক্ষেত্রে পাঁচবার দেশপ্রেমের বাক্যটি মনে মনে ভাবলেও হবে। তাদের ভাববার দায় নিতে হবে পরিবারবর্গকে। নচেৎ মৃত্যুদন্ড।
জনগণের মনস্পটে বিভীষিকা হয়ে রইলো পাঁচবার বলা/লেখা/ভাবা ঐ দেশপ্রেমিকের বাক্য। রোজ সকালে উঠে প্রাত্যকৃত্যের আগে লোকে লিখতে/বলতে/ভাবতে বসে যেতে লাগলো। পেট চেপে রাখলো। কমোডে বসে লিখলো। ইন্ডিয়ান স্টাইলে বসে লিখলো। স্বচ্ছ দেশের অস্বচ্ছ বাথরুমে বসে লিখলো। ঘামো খুশ হয়ে ভূতশাসনতন্ত্র চালাতে লাগলেন। অ-মিট খাঁও করে খেতে লাগলেন দিব্বি। বছরখানেক সব ঠিকঠাক ছিলো তারপরেই ঘটে গেল রহস্যময় সেই ঘটনা।
ঘটনার সূত্রপাত ঠিক কার থেকে হয়েছিল তা জানা যায়নি। জানা যাবে না। তবে ঘটনা একটা ঘটলো বটে। কোন এক বিরাগভাজন সকালে কোন এক দুর্মর লেখক কিনা দেশ বানানটা দয়ে ব দিয়ে দ্বেষ লিখে ফেললো। ফলে বাক্যটা দাঁড়ালো: ‘আমি আমার দ্বেষকে ভালোবাসি।’ তারপরেই ঘটে গেল অত্যাশ্চর্যক সে ঘটনা। যেন প্রত্যেকের মাথা একেকটা ভাইরাস আক্রান্ত কম্পিউটার। সবাই কি এক জাদুবলে সেই ভুল বানানটা কপি পেস্ট করে দিতে লাগলো খাতায়, ফোনে, স্ক্রিনে। ধীরে ধীরে সে বানান সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো।
যারা বাক্যটা মনে মনে ভাবছিলো বা মুখে বলছিলো তাদের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল দেশ বানান নিয়ে। তারা কনফিউজড হয়ে গেল। ক্রমে ক্রমে দেখা গেল তারাও জিজ্ঞাসা করলে দেশ বানান দ্বেষ বলছে। দেশের সকল লোক জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে যে বানান লেখে তাকে তো মান্যতা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
কয়েক মাসের মধ্যে একাডেমীর বানান বিধিতেও দেশ বানান বদলে গেল। ঘামো আর অ-মিট খাঁ প্রথম প্রথম ব্যাপারটাকে ততটা গুরুত্ব দেননি। বানানে কি বা আসে যায়! কিন্তু বানানে যে শব্দ আর শব্দার্থ দুটোই বদলে যায় তা কি আর তাঁদের খেয়াল হল। অর্থেই তো চলে দেশ। দ্বেষ। মানুষের মনের দেশও। দ্বেষও।
জনতা যত তাদের বলা/ভাবা/লেখা বাক্যের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে লাগলো, তত তারা দ্বেষচালিত হতে লাগলো। এক জাতি অপর জাতির ওপর, এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের লোকের ওপর আর এক বর্ণের মানুষ অন্য বর্ণের মানুষের ওপর চড়াও হতে লাগলো। সবাই তাদের দ্বেষকেই ভালোবাসতে শিখলো, অন্য কোন কিছুকে নয়। মারামারি এতো তীব্র আকার নিল যে ভূতশাসনতন্ত্র ভেঙে পড়তে লাগলো। ঘামো মিটিং ডেকে ভাইস ক্যাপ্টেনকে বললেন, ‘অ-মিট ভাবছি এবার কেটে পড়ি। আর ম্যানেজ করতে পারছি না। এবার তুমি সামলাও নাকি? মন্দির বানাও আর না বানাও, এই বানানটা বদল কর যেভাবেই হোক। একাডেমী তো সব আমাদেরই লোক।’ কাঁচুমাচু মুখে অ-মিট খাঁ বললেন, ‘আজ্ঞে কর্তামশাই, তা ঠিক তবে জনগণ সবাই যে বানান বলছে, লিখছে, এমনকি ভাবছে তা কি আর বানান বিধির বই বদলে বদল করা যাবে? আপনাকে যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না। শর্তও অটুট রয়েছে। ওরা লিখছে না তা তো আর নয়। বরং বেশি লিখছে। পাঁচের জায়গায় দশবার লিখছে। কিন্তু যা লিখছে তা মাথায় বসে যাচ্ছে আর সারাদিন ঐ লেখাই প্র্যাকটিস করে যাচ্ছে। এরম চললে তো সিভিল ওয়ার স্বয়ং স্তালিনও আটকাতে পারবেন না যা মনে হচ্ছে।’
ভূতের বায়বীয় দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে ঘামোকর্তা বললেন ‘দেখো অ-মিট, শর্ত ভাঙেনি অতয়েব আমার যাওয়াটা তোমার হাতে। তুমি ছাড়লে আমার ছাড়া, তুমি ধরে রাখলে আমার থেকে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।’
অ-মিট খাঁ বললেন, ‘ছাড়তে ভয় করে যে কর্তা’
উত্তরে চিন্তিতমুখে ঘামো বললেন, ‘সেইখানেই তো ভূত। বাকিটা দ্বেষ।’
[গল্পটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লিপিকা গ্রন্থের অন্তর্গত ‘কর্তার ভূত’ গল্পের সমকালীন পুনর্লিখন।]
Posted in: August 2019, Cover Story