অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কবিতা

আলোকবৃত্ত ১


ছেলেমানুষি তৈরি করছি ইদানীং

আমাদের বারান্দা থেকে ক্রমশ ভারী হয়ে আসা আকাশ দেখি

ক্রমে সবুজ হয়ে ওঠা পাতাবাহারের দেশ দেখা যায়

বুঝি রাতে ‘বারিশ’ এসেছিল

তারপর বসি সকালের সাক্ষাৎকার নিতে

ল্যাপেল ঠিক করে প্রথম প্রশ্ন ও সংলগ্ন উত্তরের দিকে এগিয়ে যাই

সকালের জীবনী লেখা শুরু হয়

ভাবি হয়তো বা এই বারান্দা জুড়ে একদিন বায়োপিক সিনেমার শুটিঙই করা যাবে এরপর

অনেক লাইট ও অ্যাকশনে ভরপুর

সেসবের ভিত তৈরি করতে থাকি আমার প্রশ্ন জুড়ে জুড়ে

হাওয়া দেয়, অবিন্যস্ত উড়তে থাকে

দু একটা রাজনীতি, দু একটা ব্যক্তিগত কথা

উনি খবরের পাঠ প্রতিক্রিয়া দেন না

উনি রোব্বারে লং ড্রাইভ বিশেষ পছন্দ করেন

আমি বলি কোন রঙ? আমি বলি কোন গান? 

আর সালোয়ার কামিজ পড়া সকাল ক্রমশ হেসে ওঠেন

হাসতে হাসতেই প্রশ্ন জমান

নানা ভঙ্গিতে মন দিয়ে প্রশ্নের অন্তরটুকু শোনা হয় তাঁর

তারপর অকস্মাৎ ফেটে পড়েন

পিছলে আসে লিপস্টিক মাখা উত্তর       

‘যাহ…যতসব ছেলেমানুষি!’




আলোকবৃত্ত ২


রান্নাঘরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই

আলু, পটল, ঝিঙে, বেগুনের পলেস্তরা খসে পড়ে

আমি শুধু মানুষ দেখার চেষ্টা করি তাই নয়

মোচার ভেতর যে পশু, কামরাঙার ভেতর যে পাখি

তাদেরও বার করে আনতে চাই

অবশ্য পরিবারের অন্যরাও যে কেউ কেউ এসব চাননা তা নয়

চাল ধোয়া হলে হেমন্তের শিশিরের বিষাদ আমরা বুঝি

রানাঘাট থেকে উজিয়ে আসা কাঁকরোলের পথশ্রম

সেইসব মাঠের স্যালো পাম্পের শব্দ আর সূর্যাস্তের নিশব্দতা
যে খাবারের মধ্যে ঢুকে গেছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারি আমরা

এমনকি চাষিদের নানা পারিবারিক গল্পগুজবও

আমাদের মধ্যাহ্নভোজে স্বাদবদল ঘটে যায়

আমাদের দিনের ভেতর খুলে দেয় আরেকটি দিন

রান্নাঘরে তাকিয়ে থাকলে দেখা যায়না এমন কিছুই নেই

মাছের পেটের ভেতরে ফারাক্কা ব্যারেজের শব্দ, টমেটোর ভেতর শীতের কাঞ্চনজঙ্ঘা

এমন তো আরো কত কি

আমাদের রান্নাঘর ক্রমশ ভরে যায় ও উপচে পড়ে…এইসব শব্দ, ছবি, অনুভব ও গল্পে

ক্রমশ আমরা বুঝতে পেরেছি বাইরে যা কিছু, তাই আসলে আমাদের রান্নাঘর নির্মাণ করে যায়

আমরা মশলা, চিলিসস, সর্ষেবাটা আর খুন্তি নাড়াবার ভঙ্গি দিয়ে সেসব পাচ্য করে নি শুধুমাত্র

পারি, আবার হয়তো কখনো পারিও না

যেমন ছোটকা। ওর ছিল কাঁচা পেঁয়াজের অভ্যেস

পেঁয়াজের দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে গতবছর ওর ভেতর ঢুকে গেল

মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ চাষির আত্মহত্যা। বারবার

তাদের হতাশা, কান্না, ঘুমের ভেতরের গোঙানি

ছোটকা অস্থির হয়ে পড়ল

ছোটকা হয়ে পড়ল অমনোযোগী আনমনা একজন মানুষ   

একজন পেয়াজ চাষির আত্মা হয়ে বাঁচতে লাগল ও 

পাচ্য বা অপাচ্য, হজম হল না ছোটকার

তাই আমরা বুঝি এখন রান্নাঘরে তাকিয়ে থাকলে সব কিছুই পাওয়া হয়

মানুষের ভেতরে যে মানুষ, পাখির ভেতরে যে পাখি

দিনের ভেতরে যে আরেকটা দিন

এককথায় জগৎ সংসার

Facebook Comments

Leave a Reply