কাক ও টাওয়েল : তুষ্টি ভট্টাচার্য
একটা কাক। একটা কাক জানলার কার্নিশে বসে আছে। বসেই আছে। বসে বসে ঘাড় ঘোরাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঝিমোচ্ছে। বসে আছে তো বসেই আছে। বসে বসে হাই তুলছে। আবার ঘাড় ঘোরাচ্ছে। একটা কাক…
আরে আগে বাড়! সেই তখন থেকে একটা কাক, একটা কাক…নিকুচি করেছে তোর কাকের! এটা একটা গল্প হল! আচ্ছা, তাহলে এটা থাক, আরেকটা গল্প বলি।
শোন তবে! কাক কিন্তু অবভিয়াস। থাকবেই। একটা কাকের সঙ্গে একটা মানুষের খুব ভাব হয়েছিল একদা। একটা মানুষের সঙ্গে একটা কাকের খুব ভাব হয়েছিল একদা। তাদের বন্ধুত্ব নিয়ে কাক ও মনুষ্য, উভয় প্রজাতির ঘোরতর সন্দেহ ছিল। একজন জানলার কার্নিশে বসে কা কা করত, আরেকজন জানলার পাশে চেয়ারে বসে হাই তুলত, আর কখনও সখনও বিড়বিড় করে কিছু বলত। হ্যাঁ, হাই তোলাটাও অবভিয়াস এই গল্পে।
হুঁ, বুঝলাম। তারপর?
তারপর আর কী? এভাবেই দিন কাটতে থাকল, কাটতে থাকল, দিন কাটতেই থাকল…
উফ! রেহাই দে বাপ! তোকে আর গল্প বলতে হবে না।
ওকে। নিশ্চিন্তে ঘুমোই তবে, তুই কেটে পড় এবার। হাইইইইইই…
এই ঘটনা আমাদের। অর্থাৎ আমার আর বাপির। আমরা দুজন হরিহর আত্মা যাকে বলে। বাপি আগে খুব গল্প বলতে পারত। পুরো আড্ডা মাতিয়ে রাখত মারাত্মক টাইপের সব গল্প শুনিয়ে। যেহেতু ও এখন কর্মসূত্রে বাইরে থাকে, আজ অনেকদিন বাদে ওর সঙ্গে দেখা। এবারে টানা কদিন ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছে বলে একটা রোববার গিয়ে পড়লাম ওর কাছে। আর তার রেজাল্ট হল ওই। খুব অভিমান নিয়ে বাড়ি এলাম। বুঝলাম কেউ কারুর নয় এই পৃথিবীতে। চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল। টুকিটাকি কাজ সারছিলাম গম্ভীর মুখে। দুপুরে একটা হাল্কা ভাতঘুমে ঢলে পড়ছি, এমন সময় একটা কাকের চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি বাপির গল্পের মতোই কাকটা জানলার কার্নিশে বসে আমাকে দেখছে। আমি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে ওকে বললাম, এখানে কোন লাভ হবে না ভাই। আগে বাড়! আমার একটা পাতিকাকের সঙ্গে ভাব করার কোন ইচ্ছেই নেই।
রাগী রাগী গলায় কাকটা বলল, ও তাহলে তুমিও পেটি বুর্জোয়া!
রাগে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গেল। কী আমাকে বুর্জোয়া বলল! এত্ত সাহস একটা সামান্য কাকের!! হেই হ্যাট, হ্যাট, হুস, হুস…যা, যা ভাগ, ভাগ!
কিছুতেই নড়ল না তবু কাকটা। উলটে খিকখিক করে হেসে বলল, হ্যাঁ, জানতাম, তোমার থেকে এরকম রিঅ্যাকশনই আসবে। বুর্জোয়া মনোভাবাপন্ন লোকেরা অন্যদের পাতি ভেবে আনন্দ পায়। আর এরপরেও যখন ওই ‘পাতি’গুলো তাদেরই নাকের ডগায় স্টিল বিলং করে…করতেই থাকে, করতেই থাকে, তখন তুমি যেভাবে হুস হুস, হ্যাট হ্যাট করলে, ঠিক সেভাবেই তাড়াতে আসে। আর আমরা অর্থাৎ পাতিরা খিকখিক করে হাসি তোমাদের বোকামো দেখে।
আচ্ছা বাবা, ঘাট হয়েছে। এই আমি হাতজোড় করছি। এবারে মানে মানে কেটে পড় তো পাতিবাবু।
হু ইজ পাতিবাবু? অ্যান্ড হোয়াই আর ইয়্যু অ্যাক্ট লাইক আ ডার্টি পোলিটিসিয়ান?
আমার মুখ থেকে আর বাক্যি সরছিল না কাকের মুখে এহেন বাক্যবাণ শুনে, তাও আবার ইংরিজিতে। তাহলে কি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শ্রেয়? নাকি ব্রেল? হে ঈশ্বর! ও দুটোর কোনটাই আমি জানি না। এই কাক ব্যাটার থেকে আমাকে বাঁচাও। ঈশ্বরও যে নেহাতই বোবা, কালা, অন্ধের বেশি না, সে আরেকবার প্রমাণ করে দিয়ে কাকেশ্বর বাবাজি আমার মনের কথাও পড়ে ফেলল। আর বলল, শোন বাপু, এই আমি এখানে চুপচাপ বসে রইলাম। হয়ত লিখিত, পড়িত ভাবে এ তোমার বাড়ি। কিন্তু বেআইনি ভাবে তোমার বাড়ি দখল করতে এসেছি, এমন কেসও তুমি ঠুকতে পারবে না আমার নামে। আমি নেহাতই এক গোবেচারা কাক। শুধু শুধুই আমার ওপর তুমি মানুষ বলে, বুর্জোয়া বলে, বুদ্ধিজীবী বলে জুলুম করছ। এই অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে আমরাই গর্জে উঠব। দেখতে পাবে হাজারে হাজারে কাক আমার বিরুদ্ধে হওয়া শোষণের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, মানে বসে বসেই তুমুল বিদ্রোহ করবে। তোমার বাড়ির আকাশ ছেয়ে যাবে কালো, মাঝারি কালো, ফ্যাকাসে কালো কাক আর কাকে। আমি আর কিছু ভাবতেও ভরসা পাচ্ছি না। এ বিদ্রোহী হুলকে আমি কী’করে ভাগাব, সেই উপায় চিন্তা করারও সাহস নেই আমার একফোঁটা।
থম মেরে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর অবস্থা একটু শান্ত হয়েছে দেখে ওকেই মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই কাক, তোমার কাকিনী নেই?
কাকটা যেন একটু আড়চোখে, একটা ভ্রূ একটু তুলে আমাকে জরিপ করার চেষ্টা করল।
আমি আবারও সভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মানে বলছিলাম কী…ভাই তোমাদের কি বিয়ে থা করতে নেই? আমি তোমাদের রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন কিছুই জানি না কিনা, তাই জিজ্ঞেস করছি। দোষ নিও না ভায়া। এবার দুপায়ে নেচে নেচে কাকটা উল্টোমুখো হয়ে বসল। মানে আমি এখন ওর লেজটা দেখতে পাচ্ছি। অবশ্যি হাগলেও ক্ষতি কিছু নেই আর। একটা সামান্য পাতিকাকের কাছে যা হেনস্থা হয়েছি, এর চেয়ে মুখে হেগে দিলেও বোধহয় প্রেস্টিজ বজায় থাকত।
তবে যেহেতু আমার মুখ দেখেনি ও তাই বোধহয় আমার ভাবনা পড়তে পারেনি। দূরের দিকে তাকিয়ে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। বিকেলের আলো মরে এসেছে প্রায়। কেমন একটা বিষণ্ণ লাগে এই সময়ে। কাকটাকেও কিঞ্চিৎ বিষণ্ণ মনে হল। এরপর ও আমার দিকে ঘুরে বসল। তাকিয়ে দেখি সেই কাক আর নেই গো! আমূল বদলে গেছে। একচোখে জলের ধারা নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, বুঝলেন, আমি কিন্তু এর আগে এমন বিদ্রোহী টাইপের ছিলুম না, বিশ্বাস করুন!
আমি সভয়ে বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব বিশ্বাস করছি। তুমি তো একটা লক্ষ্মী কাক। সোনা কাক। আবার যেন ওর জলহীন এক চোখে আগুন দেখলাম ক্ষণিকের জন্য। তারপরেই রাগ নিভে এলো। বলল, মোক্ষম জায়গায় ঘা দিয়েছেন স্যার! আমার কাকিনী আমায় ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই আমার এই অবস্থা।
তা, কাকিনী তোমায় ছেড়ে চলে গেল কেন শুনি?
এবার আর সামলাতে পারল না কাকব্যাটা। একপ্রস্থ হাউমাউ করে কেঁদে নিয়ে বলল, একটা রুমাল হবে স্যার? আজ এই কান্না আমার থামবে না। এদিকে জ্যোৎস্না উঠবে একটু বাদেই। আমি কাঁদতে কাঁদতে পুরো কাকচান করে যাব। প্লিজ, স্যার, আমার আগের কথায় কিছু মনে করবেন না। আমি অতটা খারাপ কাকও নই, যতটা আপনার মনে হয়েছে।
আমি সত্যিই এবার অভিভূত ওকে দেখে। বললাম হ্যাঁ রুমাল, চাইলে গামছা, তোয়ালে, যা লাগে বল, আমি দিয়ে দিচ্ছি তোমায়।
আচ্ছা স্যার, তাহলে একটা টাওয়েল দিন। দেখবেন আবার অতি ব্যবহারে খড়খড়ে হয়ে যাওয়া টাওয়েল দেবেন না। আমার পালক তো নাজুক সা, কোমল সা…আর আমি কিন্তু বোম্বে ডাইং ছাড়া টাওয়েল ইউজ করি না। ভাবলাম, এই ঘাটের মড়াকে ঘাটে না পাঠালে আমার রেহাই নেই আজ। তাই সদ্য কেনা একটা তিন সেটের টাওয়েল থেকে একটা ওকে বের করে দিলাম। গা কড়কড় করছিল খুউব। কিন্তু ওর হাত থেকে রেহাই পেতে আর কোন উপায় দেখলাম না। টাওয়েল নিয়ে প্রথমেই একবার নাক মুছে নিল ওতে। তারপর বলল, আমার কাকিনী অন্য একটা সাদা কাকের রূপ দেখে স্রেফ ভেগে গেছিল এক জ্যোৎস্না রাতে। সেই থেকে আমি এমন…যাক, আপনি বুর্জোয়া বা বুদ্ধিজীবী নন অন্তত, এটুকু বুঝলাম। আজ তবে আসি স্যার! গুডনাইট! ওঃ! বাঁচলাম। ধপাস করে বিছানায় বডি ছেড়ে দিলাম এবার।
কিছুক্ষণ বাদে গিন্নী এসে এক ধাক্কায় ডেকে দিল আমাকে। বুঝলাম, এতক্ষণ তাহলে কাকের ব্যাপারটা স্রেফ স্বপ্ন ছিল। হাসিমুখ আরও প্রসারিত হল আমার। গিন্নীর পাশেই দেখি, বাপি এসে দাঁড়িয়েছে। যাক! রাগ, অভিমান ভুলে ওকে বললাম, বস্, বাপি। আমি একটু স্নান সেরে নিই। ততক্ষণে চা রেডি হয়ে যাবে। তারপর তোকে একটা সত্যি কাকের গল্প বলব। এই বলে তিনসেটের টাওয়েল থেকে একটা নিতে গিয়ে দেখি, দুটো পড়ে আছে! চিৎকার করে গিন্নীকে ডাকলাম আবার। সেও এসে টাওয়েল কম দেখে আরও জোরে চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিল। কিন্তু এ কী করে সম্ভব! এই তো আমি প্যাকেট খুললাম! তাহলে? একটা টাওয়েল স্রেফ গায়েব? টাওয়েল কাণ্ডে আমার স্নান মাথায় উঠল। সন্ধে গড়িয়ে গেছে অনেকটাই এরই মধ্যে। আর এসবের মাঝে জ্যোৎস্নাও ফুটে উঠেছে বেশ। জানলার দিকে চোখ গেল আচমকাই। একটা কাক আকুল হয়ে ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে স্পষ্ট দেখলাম। আর ওর গায়ে জড়ানো আছে আমারই কেনা বম্বে ডাইং-এর টাওয়েল।
Posted in: Cover Story, July 2019