ধারাবাহিক উপন্যাস : নীলাব্জ চক্রবর্তী

যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে

 চতুর্থ পর্ব

আমি আর ছোট নেই। সামনের এপ্রিলে ১২ বছর হয়ে যাবে আমার। তারপর আমি আরও বড় হয়ে যাব। কিন্তু আমি এখনও বড়ই। আমি সব বুঝি। ঘুমের মধ্যে আমি বুঝতে পারি বাবা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়… কানের পাশে ফিসফিস করে বলে, ‘গগো গগো… বাবা বাবা’…। বাবা ভাল। কিন্তু বাবা রাগ করে আজকাল খুব। খালি পড়তে বসতে বলে আমাকে। স্লোগান দেয়, ‘গজো ভসো / পড়তে বসো / গজো ভসো / অঙ্ক কষো’… ভাল লাগে না। তাছাড়া তাছাড়া… বাবা আজকাল আর আগের মতো স্নেক-নিম্বু-ওয়াটার খেলতে চায় না বেশী। মোনোপলিও খেলতে চায় না। আর… আমাকে গল্পও বলতে চায় না। বলে, ‘নিজে পড়ার অভ্যাস তৈরী করো।’ হুহ… আমার বাংলা পড়তে মোটেও ভাল লাগে না। রাগ করে বাবা। আচ্ছা, আমি তো বলিনি আমাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াও… তবে ? তাছাড়া… অঙ্ক না পারলে… পড়তে না বসলে… মারেও আমাকে মাঝেমাঝে… আমিও রাগ করি। বাবাকে তখন বলি, ‘তুমি তো আমাকে ছোটবেলায় ট্রেন থেকে ফেলে দিতে গেছিলে’… এটা বললে বাবার মুখ যেন কেমন হয়ে যায়। আমারও কষ্ট হয়। বাবা ভাল। বাবার মন খারাপ। বাবার আর চাকরি করতে ভাল লাগে না। বাবা রোজ অফিস যায় তবু। মানডে থেকে ফ্রাইডে… ভোরবেলা উঠে অফিস চলে যায় আজকাল… খায় না মনে হয় কিছু… ভোরবেলা… অফিস কামাই করে না একদম… আর আর… স্যাটারডে সানডে বাবা কোথায় কোথায় যেন হাঁটতে চলে যায়… অনেক অনেকক্ষণ ধরে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে… আর বাড়ী ফিরে এসে খাটে ল্যাপটপ নিয়ে বাংলায় লেখে খালি। কী হয় লিখে ? এই লেখালেখির টপিকটাই বাজে। ফালতু ব্যাপার। কেন লেখে ? কী পায় বাবা এসব করে ? আমার ভাল লাগে না এইসব। আমার বন্ধুদের বাবারা কি এরকম করে কেউ ? মোটেও না। তবে ? আচ্ছা, ভাল কথা, তোমরা বারীন ঘোষালকে চেন ? মানে, সরি, চিনতে ? সবাই বারীনদা বলে… বাবাও বলে… আমিও… নাকি বারীনদার একটা কবিতার লাইন আছে, বাবা বলে, ‘শরীরের জন্য আমাদের ইভনিং ওয়াক কেন বেড়ে গেল’… শরীরের জন্য মানে কী আসলে ? বাবা রোগা হতে চায়… লুচি খেতে চায় না আজকাল… মিষ্টি খেতে চায় না… সেদিন অবশ্য হঠাৎ একটা সিল্ক ক্যাডবেরি নিয়ে এল… কিন্তু আমার এই ব্যাপারটা ভাল লাগে না… বাবা রোগা হতে চায় কেন… লুচি খায় না… এগরোল খায় না… মিষ্টি খায় না… আমার ভাল লাগে না… আমার মোটাসোটা গোলুমোলু বাবাই ভাল…

এই যে ভাবি, রাস্তায় হঠাৎ যদি কখনও তোমার সাথে দেখা হয়ে যায়… কী হবে এগজ্যাক্টলি ? লাইট… ক্যামেরা… অ্যাকশন বলবে কেউ ? বেহালা বাজবে ব্যাকগ্রাউণ্ডে… চাঁদটা বড় হয়ে যাবে… একটা দুটো রঙিন পর্দা দুলে উঠবে কোথাও… এরকম ? অথচ, স্বপ্নে, স্পষ্ট দেখলাম যে আমরা একটা বিরাট উঁচু আর বড় সাদা দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছি… ওই দেওয়ালটায় বড় বড় কালো হরফে হাতে লেখা আছে, ‘সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি চাই’… আমাদের শীতের পোশাক… আর, আমরা অনেকক্ষণ ধরে মিউচুয়াল মাস্টারবেশন নিয়ে কথা বলছি… বলেই চলেছি… পরে, স্বপ্নটা ভাবতে গিয়ে দেখলাম, নিঃশর্ত শব্দটা, আমাকে নিঃশর্ত ভালবাসার কথা মনে করাচ্ছে আবার। ভালবাসা কি রাজনীতি নয় ? নিঃশর্তভাবে কেউ যদি ভালবাসতে পারে, তবে সেও এক রাজনৈতিক বন্দী তার মানে। তার মুক্তি চাই…

# * # * #

‘কেন লেখো ? কার জন্য লেখো ?’

‘ঠিক জানি না। বোধ হয় নিজের জন্য।’

‘আর ?’

‘আর… তুমি পড়বে বলে লিখি।’

‘ওহ… আর ?’

‘আর… অনেক অনেকদিন বাদে তুমি হয়তো আরেকবার পড়বে, তাই লিখি।’

১০

– আসুন আসুন… রাজ্য সরকারের মহালক্ষ্মী বাম্পার লটারির টিকিট কাটুন… কার ভাগ্যে কী আছে কেউ জানে না… কালকেই খেলা… ১০০ টাকার এক টিকিটে ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জিতে নেওয়ার সুযোগ…

– ছাড়ো তো ! মোল্লাদের প্রতি এত দরদ কীসের তোমার ? ওদের নিয়ে কিছু বললে হেভি গায়ে লাগে, না ? তোমার কী ? নিজেও তো হাফ-মুসলমান হয়ে গেছ ওই করে করে… আর কী… বাংলাদেশে চলে যাও…

– শোনো মা কাল পুরী যাচ্ছে… তোমার জন্য টেস্ট অ্যাণ্ড ট্যুইস্ট দোকানটা থেকে এক কেজি খাজা নিয়ে আসতে বলি…

– তারপর নীলুবাবু, কোন কোন পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় লিখলে এবার…

– একটা বড় লিকার। ভাঁড়ে দেবেন।

– জানো, এখানে আগে পুকুর ছিল… এই রাস্তাটার জাস্ট পর থেকেই… পাড়ে তিন চারটে বিরাট বিরাট গাছ ছিল… সেই ৯১-৯২ নাগাদ… তখনকার সিপিয়েম কাউন্সিলারের দুই ভাই…

– বলো কী ভাই ! এখান থেকে মিউনিসিপ্যালিটি ষাট টাকা ভাড়া ! থাক, আমার রিকশা লাগবে না… আমি হেঁটেই চলে যাব…

– আরে ওরা ভাবেটা কী ! ওরা একাই হিন্দু নাকি ? আমরাও হিন্দু। আমরা দেখিয়ে দেব ওদের থেকে বড় হিন্দু আমরা। ওরা ২০০ লোক নিয়ে মিছিল করলে আমরা ৪০০ লোক নিয়ে কীর্তন করতে করতে মিছিল করব। ওরা ২০ ফুট উঁচু বজরংবলীর মূর্তি করলে আমরা ৩০ ফুট উঁচু বজরংবলীর মূর্তি বানিয়ে এম এল এ-কে উদ্বোধন করাব…

– এই, তুমি কখনও আমেরিকা-ইউরোপ যাওনি ?

– এই কবি-সাহিত্যিকগুলো সবকটা হারামি। হয় ন্যাকাচোদা, বা দুশ্চরিত্র, বা একসাথে দুটোই…

– তুই নাটক দেখিস ? আমরা রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নতুন করে আজকের দিনের মতো করে করছি… জানিস, সাতরঙা টিভি চ্যানেলে দেখিয়েছে… দুটো খবরের কাগজে রিভিউ বেরিয়েছে… পরের শো জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে… তুই যাবি ?

– তা-ও ভাল যে এখানে ১৪ পারসেণ্ট লোক সিপিয়েমকে ভোট দিয়েছে… না হলে এই সিটটাও তৃণমূল জিততে পারত না…

– তোর বাংলাদেশের মোল্লা বন্ধুদের বলিস রে, ওদের দেশে হিন্দু নির্যাতনের প্রতিবাদে যেন নামাবলী গায়ে জড়িয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে…

– দাদা, বাজার কলকাতা-টা কোন দিকে ? ওই যে শপিং মল… বাজার কলকাতা… এতবার এসেছি… তবু রাস্তা খেয়াল থাকে না… এদিকেই না ?

– বাবু, আজ ডাব ছোট ছোট। পানি একটু কম হবে। আপনি ৩৫ না, ৩০ টাকা দিন…

– আজকাল আর কেউ লক্ষ্মীর পাঁচালী চায় না দাদা। রাখি না। বিক্রি নেই। এখন শুধু হনুমান চালিশা… ব্যাপক সেল… ঘরে ঘরে…

– আরে তুই শোনছস ? অ্যালাকায় তো কাটমানি নিয়া হেবি কাউতাল শুরু হইয়া গ্যাসে… পাশের ওয়ার্ডের কাউন্সিলার বাপ্পাদার বাসার সামনে কাইল সন্ধ্যাকালে ম্যালা লোক জড়ো হইয়া… অগো সিণ্ডিকেটেরই লোক… জড়ো হইয়া… কী চিল্লামেল্লি…

– কী গো ? একা একা এখানে রোদে রোদে ঘুরছ কেন ? লাঞ্চ হয়ে গেছে ?

– হ্যাঁ, বলছি তো, সিপিয়েম বাড়ির ছেলে হয়েও বলছি… বুকে পাথর রেখে আমাদের বাড়ির সবাই এবার পদ্মফুলেই ছাপ দিয়েছি… কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হবে… তাছাড়া দেশ বাঁচাতে হবে… ধর্ম বাঁচাতে হবে…

– কিশোরকুমারের গান আর গেও না তো ! তোমার গলায় হিমেশ রেশমাইয়ার গান বরং মানাবে…

– ও মালটা তো হিন্দু, বামুনের ছেলে। ও মাঝে মাঝে দুপুরবেলা করে অফিসের গেট-এর উল্টোদিকের ফুটপাথে ওরকম একটা সাদা ফেজ টুপি পরে দাঁড়িয়ে থাকে কেন ? যতসব নাটক…

– আমার জ্বর। গ্ল্যাণ্ড ফুলেছে। ইনফেকশাস। আমরা একটু দূরে দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলি ?

– ঢাকায় এখন আমি যে বাসায় থাকি… আমার ঘর ছয়তলায়, লিফট নাই… সিঁড়ি দিয়া উঠি… পরে ফোন দিব তোমায়…

– তুমি বড় বড় নামকরা পত্রিকায় লেখা পাঠাও না কেন ?

– এই, ফ্যাসিবাদ ব্যাপারটা কী রে আসলে ?

# * # * #

এতক্ষণে তো এটা বোঝাই যাচ্ছে যে এই লেখাটির নানা জায়গায় একাধিক আয়না গুঁজে রাখা হয়েছে… আর, বন্দুকগুলো আয়নাগুলোর দিকে তাক করা… এর মানে কী ? দৃশ্য ভেঙে যাচ্ছে ? মনে পড়বে, ভেঙে যাওয়ার ভয়ে, তখন, আমরা সব দৃশ্য দুবার করে বানিয়েছিলাম… এই পর্যন্ত শুক্রবার, তারপর লেখাটা আপনার সঙ্গে হাঁটতে বের হয়… আর, আপনি ভাবতে থাকেন… নাম বদলে বদলে কনফ্যুসন তৈরী করা, পারস্পেক্টিভ বদলে বদলে কনফ্যুসন তৈরী করা আমাদের ব্যক্তিগত ডায়রিগুলো কেন আরও একটু ফোটোজেনিক হয়ে উঠবে না ? জন্মদিন অবধি ফলো করছে একটা কাঁচ… একটা স্যাণ্ডউইচের ফ্যাকাশে প্যাকেট… অথচ জুলাইয়ের শুরুতে দাঁড়িয়ে ভাবি, একটু অগাস্টের শেষ থেকে ঘুরে আসি, একটু শুক্রবার থেকে ঘুরে আসি… এইভাবে, মুদ্রাদোষের সাথে রাত আসে… আর, তারপর, কলাপাতায় পানের মতো করে মুড়ে রাখা একটা-দুটো দিন… স্তন অর্থে কুয়াশা… এইসব ভাবতে ভাবতে আমরা ঋতু বদলে নেই… আবার নতুন করে ভাবি লাল-কালো-হলুদ ফুটপাথের কথা… ভাবি তুলো ওঠা সময়ের কথা… দেখি, ঠোঁটে এসে ভিজে যাচ্ছে একটা রেশম কাট-এর নীল… ছুঁয়ে থাকতে চাইছে… শরমবাহার… ভাষাফেরত আঙুলেরা একটা একটা মুহূর্ত… ব্লাশ করছে… ‘কিছুই হল না / বাজানো গেল না সময়’… গুণ করছে… কাঁচের এই টেক্সচার অবধি ফুলে উঠছে অভিমান… এতদিনে কে আর না জানে স্বপ্ন এক স্থানীয় সংবাদ… ধোঁয়া অবধি গলে যাওয়া লেন্স… রাস্তা… রাস্তার পর আবার রাস্তা… তারপর আবার… রাস্তা… জ্বালা করছে… পাতার পর পাতায় শুধু ড্রয়ার টানার শব্দ… ভোকাল… ড্রয়ার বন্ধ করার শব্দ… দুটো বিপরীতমুখী ভাবনা, ক্রমে, ঊনসত্তর নম্বর অভ্যাসের দিকে চলে যেতে চাইবে হয়তো কখনও… কার জন্য একটা শ্লীল দরজা… ‘স্মৃতি আমার রবে গো ঝুমকা’

রবে ?

(চলবে)

Facebook Comments

Posted in: July 2019, Novel

Tagged as: ,

Leave a Reply