কমিউনিস্ট আন্দোলনে একতা প্রসঙ্গে : দেবাশিস দত্ত

[গত ২১-২২শে জুলাই ২০১৯ উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতে ‘তিতুমীর সভাগৃহ’-এ সিপিআই(এমএল)-এর আহ্বানে ‘বামপন্থী ঐক্য’ শীর্ষক সেমিনারে বিভিন্ন বামপন্থী-কমিউনিস্ট রাজনৈতিক দলগুলির সাথে বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রিত ছিলেন ‘চেতনা ট্রাস্ট’ তথা ‘অপরজন’ পত্রিকার সম্পাদক দেবাশিস দত্ত। প্রসঙ্গত ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ‘অপরজন’-এর নিবেদন ছিল ‘কমিউনিস্ট আন্দোলনে একতা’ সংখ্যা। সেই সংখ্যা প্রকাশের প্রায় দেড় বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর সেমিনারে দেবাশিস দত্ত যে লিখিত বক্তব্য পেশ করেছিলেন তা আমরা এখানে প্রকাশ করলাম।
সিপিআই(এমএল) সেমিনারে সকল সংগঠনের প্রতিনিধিদের লিখিত বক্তব্য পুস্তিকাকারে প্রকাশ করবে।]
প্রিয় সভাপতি, সঞ্চালক ও ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধুগণ,

বর্তমান পরিস্থিতিতে সিপিআই (এমএল) আহুত আজকের এই আলোচনা সভায় ‘চেতনা’র পক্ষ থেকে আমি প্রথমেই সংগঠকদের অভিনন্দন জানাই। স্মরণ করি কৃষক আন্দোলনের অন্যতম ‘পীঠস্থান’ বারাসাত এবং অভিবাদন জানাই কৃষক আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক তিতুমীরকে।

বক্তব্যের শুরুতে ‘চেতনা’ সম্পর্কে দু’একটি কথা বলা প্রয়োজন। ‘চেতনা’ একটি ‘বর্তমান-সচেতন’ সামাজিক সংগঠন যার নির্দিষ্ট দলগত ‘প্রতিষ্ঠান’ নেই। যার অর্থ অরাজনৈতিক মোটেই নয় ‘চেতনা’—বলা যায় রোজ সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে সাঁঝবাতি জ্বালার দায় থেকে মুক্ত। অরাজনৈতিক হলে আর বর্তমান-সমাজ সচেতন হওয়া যায় না বলে ‘চেতনা’ বিশ্বাস করে। আজ থেকে তিন বছর আগে ‘চেতনা’ সংগঠনটি গড়ে ওঠে কয়েকজনের চেষ্টায় যাঁরা নিজের নিজের জায়গা থেকে অনুভব করছিলেন, যেভাবে ‘যত মত তত পথ’ বিভাজন ‘অনিবার্য’ভাবে উনচল্লিশ বছরের একান্নবর্তী পরিবারকে পৃথগন্ন করেছে এবং তাও প্রায় পঞ্চান্ন বছর ধরে চলে আসার পর প্রশ্নটা উঠেছে এর শেষ কোথায়? নিষ্পত্তি কীভাবে? প্রশ্নের উত্তরটা এখুনি পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং তার জের আরও বেশ কিছু সময় ধরে চলবে। এই প্রশ্নের উত্তর ধরেই উঠে এলো যে ‘বোধ’ তা হল—অনেক হয়েছে, আর নয়—এখানেই থামা দরকার এবং একটা ঐক্যবদ্ধ মঞ্চের সন্ধানে অগ্রসর হওয়া দরকার। অর্থাৎ সেদিনে ছিল মত আর পথের ‘বিরোধ’ হেতু ভাঙ্গনের প্রক্রিয়া আর এতো বছর পরে বর্তমান বাস্তবতায় অংশত হলেও ‘ঐক্য’ গড়ে তোলার একটা আকুতি। এই বাস্তবতা মেনে শুরু হল প্রচেষ্টা। সেই প্রচেষ্টার ফসল ‘অপরজন’ পত্রিকার প্রকাশ। আটপৌরে সাধ্য নিয়ে অনন্তর সন্ধান যেমন হয় আর কি! ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা বইমেলায় প্রথম প্রকাশ। নানা ভাবনা নিয়ে পত্রিকার ওয়েব এডিশন এখন প্রতিমাসে প্রকাশিত হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে বলা দরকার আমাদের এই সংগঠনের পক্ষ থেকেই আজ থেকে কয়েক বছর আগে ২০১৭ সালে কল্যাণী বইমেলায় এই একই মর্মে যে আলোচনাটি সংগঠিত হয়েছিল তারও বিষয়বস্তু ছিল – আজকের বিষয়বস্তুর মতই।আত্মপ্রকাশের এক বছর পরেই ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ‘অপরজন’-এর নিবেদন ছিল ‘কমিউনিস্ট আন্দোলনে একতা’ সংখ্যা। বোঝাই যায় ভাবনা আমাদের একার নয়—আশ্বস্ত হওয়া যায় এই ভেবে যে বিষয়টি নিয়ে অনেকেই ভাবছেন। যেমন ভাবছেন অন্তত সংগঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে সিপিআই(এমএল), যার ফলশ্রুতি আজকের এই আলোচনা সভা। অবশ্য সিপিআই এই প্রশ্নটি উত্থাপন করে আসছে অনেক বছর ধরে, সেই ষাটের দশক থেকেই। আগামী দিনে অনেকের মধ্যে নিশ্চিত এই ভাবনা প্রসারিত হবে। এক সময়ে প্রচেষ্টা একই বিন্দুতে মিলবে এমনটা আশা করাই যায়। চলতে চলতেই উঠেছে একটা প্রশ্ন–‘চেতনা’র এই ভাবনা কতটা সমাজ পরিবর্তনের জন্য ‘বিপ্লবী ভাবনা’ আর কতটাই বা ‘মধ্যবিত্ত-তাড়না’। কারও প্রতি আঙুল না তুলে অকপটেই বলতে চাই, হতে পারে মধ্যবিত্ত-তাড়না। কিন্তু একটা তাড়না, তাড়িয়ে বেড়াতে চায় সমাজের মনন, ভাবনা চিন্তার জগতকে—নিতে আর দিতে—তার সাধ্য দিয়ে যতটুকু পারা যায়। অপ্রয়োজনীয় মনে হলে খেরোর খাতায় ঠাই নেবে! এমন তো কতই হয়!

এবারে আসা যাক মূল আলোচনায়। আজকের আলোচনার বিষয় যা সংগঠকরা স্থির করেছেন তার মূল বিন্দু হল:

(এক)   ‘অসুর’ শক্তির ক্ষমতা দখলে দেশের পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।

(দুই)   একে প্রতিহত করতে সমাজ বদলের শক্তিসমূহের একতার প্রয়োজনীয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে।

(তিন)   বাস্তবতা হল মতাদর্শগত বিরোধের জেরে বামপন্থী ও কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভক্ত;

(চার)   ঐক্যমতে আসা জরুরী এবং তার জন্য প্রয়োজন পরস্পরের মধ্যে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

এই উচ্চারণ নিষ্পাপ। এর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের জায়গা আমরা দেখি না। আমরাও ঐকমত্য ঘোষণা করছি। কারণ আমরাও সকলের মত উদ্বিগ্ন। ক্ষমতায় অসুর শক্তির উত্থানে সবচেয়ে আক্রান্ত হবে মানুষের রুটি-রুজি, সামাজিক নিরাপত্তা-সুরক্ষা, অধিকার থেকে দেশের শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস-পরম্পরা, ভাবনা-চিন্তার মধ্যে যা কিছু ইতিবাচক সবকিছু। উৎসাহ পাবে সুদূর অতীতের সমস্ত নেতিবাচক প্রবণতা। তাই কেউই হয়তো একান্ত কথাবার্তায় আজকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে খুব একটা দ্বিমত প্রকাশ করবেন না। প্রায় সব দলের বক্তব্যও হবে প্রায় একই রকম। অনেক দলই হয়তো বিষয়টি নিয়ে, এই আলোচনা সভার মত, আলাদাভাবে আলোচনা সভা নিজ নিজ দলের মঞ্চ থেকে করছেনও। আবার একেবারে বিপরীত মত সেটাও থাকা স্বাভাবিক। এখনও পর্যন্ত যতটুকু চেষ্টা নজরে এসেছে তাতে কাঙ্ক্ষিত ঐক্যর তেমন কোন সম্ভাবনা নজরে আসে নি। আসবে, বা আসবে না কোনটাই জোর দিয়ে বলা যায় না। গণৎকার তো আমরা কেউ নই। সমস্যাটা হল আমরা সকলেই ভাবতে পারি, ভাবতে রাজি কিন্তু আলাদাভাবে, একসাথে নয়, একসাথে ভাবার কথা আমরা ভাবতে পারি না এখনও। সে শৈলী আমরা আয়ত্ত করে উঠতে পারি নি। এটাকেই আমরা একটা সুড়ঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।

হয়তো প্রাসঙ্গিক সেজন্যেই বলা দরকার যে বিপদটা আজকে ক্ষমতা একচেটিয়া দখলের পরে দেখা দিয়েছে, সেটা যে হতে পারে তার অনুমান নির্বাচনের আগেই করা যাচ্ছিল। স্পষ্ট ছিল যে এই শক্তিকে কোন রাজনৈতিক দল, যতই শক্তিশালী হোক বা না হোক, একা কেউ ঠেকাতে পারবে না। তাই ঐক্যবদ্ধ হবার প্রয়োজন ছিল। সমাজ বদলের শক্তি বলে যাদের ভাবা হচ্ছে তারা কি ঐক্যবদ্ধ হতে পারলো? পারলো না। তাই, আমাদের মতে, সমাজ বদলের শক্তি বলে যাঁদের ভাবা হচ্ছে তাঁরা সকলেই সুড়ঙ্গটি রেখেই অসুর শক্তিকে  ঠেকাতে চাইলেন ফলে ঠেকানোর চেষ্টাটাও ফলবতী হয়ে উঠলো না—এজন্য তাঁদের কাঁধেও এই অসুর শক্তির উত্থানের দায় কিছুটা হলেও বর্তায়।

শুধু নির্বাচনের সময়ের কথাই বা বলব কেন—স্বাধীনতার পর থেকে এই শক্তি নিয়মিত ক্ষমতা দখলের জন্য রিহার্সাল দিয়ে গেছে। মহাত্মা গান্ধীকে দিনের আলোয় খুন এদেশের রাজনীতিতে এই অপশক্তি উত্থানের প্রথম প্রকাশ। খুনি কিন্তু ‘পাপ’ মনে করেনি, খুনি খুনের দায় অস্বীকার করে নি। সদর্পে আদালতে দাঁড়িয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছে। গুলিটা সেদিন মহাত্মা গান্ধীর বুকে লেগেছিল, আর কারও গায়ে লাগেনি। খুনিকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু খুনের কারণকে সাজা দিতে শাসক দল সেদিন তলিয়ে কিছুই দেখেনি। প্রয়োজন বোধও করেনি। এটাই ছিল তালমিল, ক্ষমতার সমঝোতা এভাবেই চলে চলে এগিয়েছে। ‘সামাজিক সংগঠন’-এর নামাবলী গায়ে প্রতিদিন ‘গোকুলে’ এই শক্তি মাথা তুলেছে, নিজেদের সংঘশক্তিকে সংহত করেছে। যখনই সময় সুযোগ পেয়েছে ছোবল মেরেছে। দু’বার ভাবেনি। তাদের ভাবনা ছিল স্পষ্ট। আভ্যন্তরীণ বিরোধ তাদেরও ছিল। তবে ‘বিরোধ’ ভাঙ্গনের পথে হাঁটেনি। দুটো ‘আরএসএস’ তৈরি হয়নি।  বিরোধ সত্ত্বেও এক প্রত্যয়ে এক বিশ্বাসে এক প্রতিজ্ঞায় তাদের কোন জড়তা ছিল না। তারা দেখিয়েছে প্রমাণ করেছে ‘প্রতিবিপ্লবী’ হতে হলে কতটা দৃঢ় হতে হয়! জেনে নিয়েছে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গড়তে গেলে কী কী ভাঙ্গতে হয়! সেই অনুযায়ী তারা এগিয়েছে। অনেক কিছু গুরুত্ব পায়নি। মনে পড়ে সেদিন বৈচারিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও সোমনাথ লাহিড়ী সম্পাদকীয় স্তম্ভে লিখেছিলেন ‘শোক নয় ক্রোধ’। কিন্তু তারপর? তারপর দীর্ঘ অবকাশ, দীর্ঘ শূন্যতা !!

খুব বেশি ইতিহাসে গিয়ে লাভ নেই। মানতে হয়–‘তালাবন্ধ’ রেখেই প্রতিবিপ্লবীদের ক্ষমতার বিরামহীন উপাসনা চলেছে। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত অনেক কিছু করার অপেক্ষা ছিল, যা করা হয়ে ওঠেনি। এমনকি সমাজ বদলের শক্তি যারা সেদিন ছিলেন তাঁরাও বিষয়টিতে তেমন আমল দিয়ে উঠতে পারেননি। জড়িয়ে পড়েছিলেন ‘মতাদর্শগত’ নামক বিতর্কে। অবশেষে বিতর্কের সমাধান ঘটল ‘পৃথগন্ন’ হয়ে। ‘একটা প্লেট ওপর থেকে পড়ে গেলে ক’টুকরো হবে কে বলতে পারে—আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন লাহিড়ীদা (সোমনাথ)। পরে গড়ে উঠল অনেক ‘পীঠ’। প্রত্যেক পীঠের দাবি, চাবি তাঁদের হাতে, তাঁরাই ‘সঠিক’। কিন্তু তালা খুলল না। কত রক্ত গেল, কত মেধা গেল, কত স্বপ্ন গেল—এখন এক দুর্ভাগ্য নিয়ে সমাজ পরিবর্তনের শক্তি হাঁটছে পঞ্চান্ন বছর। সময়ের বিবর্তনে সুড়ঙ্গটাই বড় হয়েছে। আর সেই সুড়ঙ্গ দিয়েই ‘অসুর শক্তি’ আজ একচেটিয়া ক্ষমতায়। তবু ‘মিল করে দে’ এমন তাগিদ সবার নয়, সবার তাগিদ সমান নয়। তারও হয়তো কারণ পৃথগন্ন হওয়ায় সবটাই যে লোকসান তা আবার নয়। কারও কিছু প্রাপ্তিও ঘটেছে। সে কারণে বোধও পাল্টেছে। ‘প্রতিষ্ঠান’ যাঁদের আছে তাঁদের প্রতিষ্ঠান বিরোধী হওয়া বা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আসা সহজ নয় এবং সেকারণে সবার অনুভব, অবস্থান এক রকম হবে সেটাও আশা করা যায় না। তবে প্রতিটি পরীক্ষার—সেটা সাফল্য বা ব্যর্থতা যাই হোক ফলাফল থেকে, শিক্ষা গ্রহণের একটা স্পেস পাওয়া যাবে। অবশ্য এই অবস্থায় ভিন্নভাবে ভাবার হয়তো অবকাশ আছে।

ধরা যাক না একসময়ে আমাদের প্রত্যেকের পরিবার একান্নবর্তী ছিল, আজ নেই। পরিবর্তিত বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সকলকেই সংগ্রাম করতে হচ্ছে। যে যেখানে থাকুন যেভাবেই থাকুন তাদের প্রত্যেককে কোন না কোন ধরণের লড়াই-সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সেই ‘প্রত্যেককে’ এই সংগ্রামের এক্কেবারে শুরুতে একটা মূল্যবোধের বীজ বপনের কাজ করা যায় কিনা যা পরেও যে কোন প্রেক্ষিতে কার্যকর হবে কোন না কোন ভাবে! এই কল্পনাটা হয়তো একটু বেশি স্বপ্নিল ঠেকতে পারে! সেক্ষেত্রে অন্য বিকল্প ভাবা যেতে পারে। এভাবেও তো ভাবতে পারা যায়, পৃথগন্ন না হলেও অসুর শক্তির ক্ষমতায় আগমন বা আরোহণ অনিবার্য ছিল! এবং তাতে সমাজ বদলের কাজটা কোনমতেই খাটো হয় না। যাঁরা সমাজ-কাল-বদল করবেন তাঁদের দায়টা নিশ্চিতভাবেই বাড়ে। যদি একসাথে হয় ভালো না হলে আলাদাভাবেই হোক–কিন্তু হোক।

একটা প্রশ্ন উঠেছে, আগে ক্ষমতা দখল না সমাজ বদল? একটা মত হল ‘ক্ষমতা’ দখল করেই সমাজ-বদলের জন্য এগোনো দরকার। অর্থাৎ তাঁদের মতে এখন ‘ক্ষমতা দখল’-এর জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজ–মতাদর্শগত, সাংগঠনিক ইত্যাদি কাজ করতে হবে। অন্য মতটা হল যা পরিস্থিতি (ইঙ্গিতটা হল বর্তমানের বিভক্তি) তাতে ক্ষমতা দখল সম্ভব নয়, সমাজ বদলের কাজটা করতে করতেই ‘ক্ষমতা দখল’ এর দিকে যেতে হবে। বিষয়টা অর্থাৎ তর্কটা খোলা থাকাই শ্রেয়। চলুক…কিন্তু চলুক।

জানা নেই সবাই একমত হবেন কিনা। তবে খোলা মনেই বলি দেশটার ভিতটা এবং ভেতরটা কিন্তু আগের মত নেই, বদলে গেছে। যেমন ধরা যাক ভিত্তি ছিল—(এক) আমরা কোন যুদ্ধজোটে নেই। কিন্তু আজ ইজরাইল আমাদের ভাল বন্ধু। (দুই) অন্যের সাহায্য নেব কিন্তু অন্যের ‘নিয়ন্ত্রণ বিনা’ নিজস্ব অর্থনীতি গড়ে তুলবো। কিন্তু আজ সবটাই কর্পোরেট, আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির ইশারায় চালিত। (তিন) রাষ্ট্রের কোন ধর্ম নেই। ধর্মপালন নাগরিকের অধিকার। এখন ‘মুসলমানদের’ হিন্দুদের অধীনতা মেনে নিতে হবে ইত্যাদি। সমস্ত বিষয়গুলো এখন নতুন আঙ্গিকে নতুন নতুন সংজ্ঞায় প্রতিস্থাপিত হয়ে চলেছে। ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গঠনের জন্য সব আয়োজন–আত্মিক, ধার্মিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের কাজ ‘অহিংস’ নয়, অবশ্যই সহিংস পথেই চলছে। এরই মধ্যে চন্দ্রাভিযানের মত বিশাল একটা কাজ আমাদের বিজ্ঞানীরা খুব সাফল্যের সঙ্গে করেছেন। কিন্তু উৎক্ষেপণের প্রাক লগ্নে অভিযানের সাফল্য কামনায় ইসরোর শীর্ষ বিজ্ঞানী তথা চেয়ারম্যান কে শিবন তিরুপতি মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে এসেছেন। চন্দ্রযান-২-এর প্রতিরূপও তিনি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। আগেও নাকি তেমনি যাওয়া হয়েছে। এটাই নাকি রীতি! যুক্তি তর্ক বিজ্ঞানে মননে পশ্চাদপদতা দুঃখজনক ভাবে বিদ্যমান। অর্থাৎ আমাদের সমাজটা আছে কোথায়, আমরাই বা আছি কোথায় এটা তারই সঠিক ঠিকানা। এর পরিবর্তন সহজ নয়। বিপ্লবের ৭০ বছর পরে, অনেক সাফল্য অর্জনের পরেও সোভিয়েত ইউনিয়নে ধর্মভীরুতার বিলক্ষণ অবস্থান আমি নিজেও প্রত্যক্ষ করেছি। রাষ্ট্রের কর্ণধাররা সমস্ত পশ্চাৎপদ ভাবনায় শিলমোহর দিয়ে চলেছে। ফলে একটা বুনিয়াদী পরিবর্তন যা কিনা উৎপাদন থেকে মনন পর্যন্ত বিস্তৃত। দেশ তথা দেশের শ্রমজীবী মানুষের কাছে রাষ্ট্রের এসব কাণ্ড কারখানা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ভয় এবং উদ্বেগ দুটো জিনিসই আমাদের মানে আমরা যারা মধ্যবিত্ত তাঁদের অবস্থানগত কারণেই একটু বেশি। অথচ যারা শ্রমজীবী যাঁরা দিন খাটি-দিন আনি- দিন খাই বা সপ্তাহে আনি খাই–যাঁদের কোথাও নাম নেই, কোন সুরক্ষা নেই তাঁদের ভাবনা আচরণ একটু ভিন্ন ধরণের। তাঁরা মধ্যবিত্তদের মত ভাবেন না। একটা উদাহরণ নেওয়াই যাক: এই দু’দিন আগে (গত রবিবার ১৪ জুলাই’১৯) সালারের হাটপিলখুন্ডিতে এক গ্রিল কারখানার মালিকের কাছে তারই এক শ্রমিক ২০০ টাকা পেতেন। মালিক দিচ্ছিল না। কয়েকদিন ঘোরার পর সেদিন আবার চাইতে টাকাটা না পাওয়ায় সে হাতুড়ি চালিয়ে দেয়। মৃত্যু হয় মালিকের। শ্রমিকটি গ্রেপ্তার হয়েছে, এবার জেলের ঘানি টানবে। সভ্য শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত-সমাজ এক বাক্যে শ্রমিকটি অন্যায় করেছে বলেই সাব্যস্ত করবে, আমার নিশ্চিত ধারণা, মহামান্য আদালত ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারে খুনের জন্য শ্রমিকটিকে যাবজ্জীবন বা সমতুল কারাদণ্ড/সাজা দেবেন যাতে একটা উদাহরণ হয়ে থাকে, ভবিষ্যতে আর না ঘটে। অপরদিকে দেখুন ব্যাঙ্কে রাখা জনগণের অর্থ থেকে যে নাগরিক ১ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করে না–আত্মসাৎ করে, বিদেশ পালিয়ে যায়, আইন তাকে ছুঁতেই পারে না। শ্রমিকটি ঋণ নেয় নি। পাওনা টাকা পাচ্ছিল না। তাঁর পাওনা ২০০ টাকা আদায়ে কি করনীয় ছিল? শ্রম কমিশনারকে জানানো, থানায় ডাইরি করা, আদালতে মামলা করা? এটাই দেশের আইন। শ্রমিকটি আইন নিজের হাতে নিয়ে ফেলেছে! এটা রাষ্ট্রের পছন্দ নয়। রাষ্ট্রের পছন্দ ভীমা-করেগাওয়ে দলিত যুবকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যা চলছে। বক্তব্য এই যে মধ্যবিত্তদের ভাবনা আচার আচরণ আর শ্রমিকের আচার আচরণ একরকম নয়, হবে না। সালারের ঘটনায় একটা বাঁচোয়া শ্রমিক এবং মালিক একই ধর্মভুক্ত—তা যদি না হতো তবে কী হতো বলা মুশকিল।

গোরু এদেশের রাজনীতির কেন্দ্রে। তথাপি সমাজ বদলের সৈনিকদের একীকরণে বিস্তর বাধা। কার সঙ্গে কে কি শর্তে মিলবে—সেগুলো এখনও প্রধান প্রশ্ন। নিজ বর্গের ঐক্য বোঝাপড়ার বিষয়টি এখনও প্রাথমিক নয়। ভিন্ন বর্গের সঙ্গে বোঝাপড়া গড়ে তোলার ঝোঁক প্রবল। এবং ঝোঁকের পক্ষে গেরস্তের ঘরে ‘সাপ আর ছুঁচো’ ঢুকিয়ে দিয়ে বড় বিপদ সাপ মারার জন্য ছুঁচোর সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলার রাজনৈতিক দায়িত্বকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। অথচ ঘরে ঢুকে পড়া—আলাদা নামে দুটো বিষাক্ত সাপ, যার ছোবলে অনিবার্য মৃত্যু—সেক্ষেত্রে নিজের লাঠিটার ওপরেই নির্ভর করা যুক্তিযুক্ত কিনা সে ব্যাপারে  নিরুত্তর। বা যা দৃশ্যমান সেটা হল মাঠে ময়দানের লড়াইতে কোন দাবির ভিত্তিতে বর্গের সকল সদস্যের সমন্বিত পদক্ষেপ যদিচ সম্ভব তথাপি ‘নির্বাচনে’ তা প্রসারিত হওয়া সম্ভব নয়, কারণ সহজেই অনুমেয়। এছাড়াও অনেকেই এখনও রাজনীতির মূল স্রোতের বাইরে অবস্থান করছেন যাঁদের যোগদান জরুরী। এতকাল পরেও বোঝা যায় রাজনৈতিক বা মতাদর্শের প্রশ্নে মতবিরোধ যা ছিল তা এখনও বিদ্যমান। এই অবস্থায় করণীয়টা কি?

[ক] সকলের রাজনৈতিক দলিলের বা বিভিন্ন বক্তব্যের সহমতের বিষয়গুলোকে ভিত্তি করে একটি ‘ঘোষণাপত্র’ প্রস্তুত করা। সকলের কাছে পাঠিয়ে মতামত নেওয়া যেতে পারে। যে বা যাঁরাই সেই ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সহমত হবেন তাঁদের প্রতিনিধি নিয়ে একটা মঞ্চ গঠন করা যেতে পারে।
[খ] মতবিরোধ রয়েছে এমন বিষয়গুলো চিহ্নিত করে ঘরোয়া এবং প্রকাশ্য আলোচনা সংগঠিত করা।
[গ] ‘ঘোষণাপত্র’ অনুযায়ী নূন্যতম দাবিপত্র প্রস্তুত করা এবং আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করা।
[ঘ] অত্যাচারিতদের পাশে দাঁড়াতে একটি স্বেচ্ছা-সেবক বাহিনী গড়ে তোলা।
[ঙ] খরচ নির্বাহের জন্য তহবিল গঠন করা’।
[চ] মঞ্চের একটি দপ্তর, একটি সাপ্তাহিক/পাক্ষিক পত্রিকার নিয়মিত প্রকাশের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

ফিরে আসি আজকের আলোচনায় এবং শেষ করি একটা ছবির প্রসঙ্গ দিয়ে, যা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্ট করেছিলাম বেশ কিছু আগে, হাজারের ওপর বন্ধু লাইক অথবা শেয়ার বা দুটোই করেছিলেন। ছবিটা একটা বনের ছবি, যেখানে বনের রাজা প্রাণপণে পালাচ্ছে একপাল বন্য মোষের তাড়া খেয়ে। সাপ ছুঁচোর কেউ ছিল না আশেপাশে। বনের রাজার সাথে পাঙ্গা নিতে বর্গীয় ঐক্য সংহতি গড়ে তোলা প্রাথমিকভাবে আবশ্যিক—একা গেলে পেটে যাবার সম্ভাবনা প্রবল এবং সেটাও একটা বড় ক্ষতি মানতেই হবে। পঞ্চান্ন বছর পৃথগন্ন থাকায় বর্গীয় ঐক্য সংহতি অনেকটাই নষ্ট হয়েছে অথবা প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পড়েছে। তাই গড়ে তোলার কাজটা খুব একটা সহজ নয়। বর্গীয় বৈরিতার বিরুদ্ধে যখন ধর্মীয় বৈরিতা প্রতিস্থাপনের কাজ চলছে—অনেকটাই এগিয়েছে রাষ্ট্রের তদারকিতে—তখন কাজটা আরও কঠিন। আর এই কঠিন কাজটাই কাঁধে তুলে নিয়েছেন আজকের সংগঠকেরা যার জন্যে অভিনন্দন ওঁদের প্রাপ্য। আর্জি এটাই থাকবে আজকের এই অন্বেষণ, খোঁজ তালাশের কাজ সব ধরণের সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এবং প্রকাশ্যেই চলুক—এই আহ্বান এবং সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য শেষ করছি।

Facebook Comments

Leave a Reply