অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার

চতুর্থ কিস্তি

“পথ খুঁজবো কী ভাবে?”—লাল দেদ-এর নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ

বর্তমান কাশ্মীরের যেকোনো বিষয়ের মত লাল দেদও একটি বহুস্তরীয়, পরস্পর বিরোধী মতামতের সংলাপ অঞ্চল। কাশ্মীরি শৈবরা তাঁকে ডেকেছেন লালেশ্বরী, কাশ্মীরি বৌদ্ধ তান্ত্রিকরা ডেকেছেন লাল্লা যোগিনী, কাশ্মীরি মুসলিমদের কাছে তিনি লাল আরিফা। নিজের অস্তিত্ব দিয়ে এইভাবে কাশ্মীরের বহুত্ববাদকে ধারণ করতে আর কেউই বিগত সাতশ বছর ধরে পেরেছেন বলে মনে হয় না। কাশ্মীরের ইতিহাস লেখার ধারা সংস্কৃত ও পার্সিতে ত্রয়োদশ খ্রিষ্টিয় শতাব্দী থেকে নিয়মিত ভাবে চর্চা হলেও শ্রীভর, প্রজ্ঞাভট্ট, শূক, হায়দার মালিক, হাসান বিন আলি কাশ্মীরের মত ইতিহাসবিদরা কোনো অজ্ঞাত কারণে (যা পিতৃতন্ত্রের ‘স্বাভাবিক’ তাচ্ছিল্য হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট) লাল দেদের নামের উল্লেখ অবধি করেন নি পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ খ্রিষ্টিয় শতাব্দী অবধি। লাল্লার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মোল্লা আলি রায়নার “তধকিরাত উল-আফরিন” (১৫৮৭)  বলে একটি বইয়ে। বইটির বিষয় ছিল জনশ্রুতিতে কাশ্মীর উপত্যকার সাধু, তান্ত্রিক, সুফিদের গল্প।  একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন লাল্লা। লাল্লাকে পাওয়া যায় কাশ্মীর উপত্যকার বনে এক সুলতানের ছেলের হাতে এক পেয়ালা তরল তুলে দিতে আসা নারী হিসেবে, যে তরল পানের পর ফারাক থাকে না সুলতান আর সাধারণ মানুষে,  হিন্দু, বৌদ্ধ আর মুসলমানে, পোশাক ও পোশাকহীনতায়, এবং ফারাক থাকে না নারী ও পুরুষে, শিব তখনই দেখা দেন। ১৬৫৪ খ্রিষ্টাব্দে বাবা দাউদ মিশকাতির “আস্রার উল-আকবর” বইয়েও লাল্লার উল্লেখ একই ভাবে পাই আমরা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে এই একই গল্প প্রজ্ঞাভট্ট তার ‘ক্রনিকলে’ করেছেন; শুধু লাল্লার জায়গায় উল্লেখ রয়েছে নামহীন এক দেবী। আমরা কি দেখতে পাচ্ছি কীভাবে পিতৃতান্ত্রিকতার ধারা একজন মানুষীকে ‘দেবীত্ব’ প্রদান করে, এবং ‘নামহীন’ করে নারীবাদকে অপর করে চলে?

লাল দেদকে যদি শৈববাদ, বৌদ্ধ তন্ত্রবাদ, সুফি এই সমস্ত প্রেক্ষিত থেকে দেখার আগে আমরা ‘লাল দেদ’  শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ দেখি লোকায়ত কাশ্মীরিতে, তাহলে নারীবাদের এক অপার বিস্তার চোখে আসে। লোকায়তে ‘লাল দেদ’এর একটি অর্থ ‘লাল মাতামহী/পিতামহী’ এবং আরেকটি অর্থ ‘লাল গর্ভ’। এই প্রেক্ষিত থেকে লাল দেদের প্রতিটি কবিতা যা লোকায়ত কাশ্মিরিতে ‘ভখস’ বলে পরিচিত তা একইসাথে চিরায়ত ভাবে চলে আসা নারীর কবিতা এবং আবহমানকালের নারীর গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া কবিতা হয়ে ওঠে। “Pen is   Penis”-এর মত পিতৃতান্ত্রিক স্লোগানের প্রাক-ঔপনিবেশিক প্রতিস্পর্ধা হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকেন লাল দেদ। তার  কবিতা পড়ার আগে আমরা যদি খুব সংক্ষেপে তার জীবনের যাত্রাপথটুকু জেনে নেই, তাহলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হবে যে কেন লাল দেদ ভারতীয় নারীবাদের শক্তিশালী স্বরগুলির অন্যতম।

১৩০১ থেকে ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে লাল্লা জন্মগ্রহন করেন। জন্মস্থান হয় প্যাম্পোরের কাছ সেম্পো্রে, অথবা, শ্রীনগরের কাছে পান্ড্রেনথান নামের একটি জায়গায়।  ১৩৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারা যান বলে মনে করা হয়। কোথায় মারা গেছিলেন এই নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট  মত নেই। বিজবেহারার কাছে যে কবরটি লাল দেদের কবর বলে পরিচিত তা নিয়েও বহু তর্ক রয়েছে। ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে লাল্লার বিয়ে হয় বারো বছর বয়সে। বিয়ের পর তার নাম রাখা হয় পদ্মাবতী, কিন্তু এই নাম গ্রহন করতে তিনি অস্বীকার করেন এবং সর্বদা নিজের নাম লাল্লা বা লাল বলেই উল্লেখ করতেন। গৃহস্থালির জীবন ছিল অশান্তিতে ভরপুর।  লাল্লার যখন ইচ্ছে বনে চলে যাওয়া,  শিবের মন্দিরে গিয়ে দিনের পর দিন ঘরে না ফেরা, শাশুড়িকে সেবা না করা, স্বামীকে রোজ খাওয়ার বেড়ে না দেওয়া; এই সমস্ত কারণে লাল্লাকে স্বামীর হাতে প্রায়ই মার খেতে হত, শাশুড়ি লাল্লাকে সুযোগ পেলেই অভুক্ত রাখতেন। চোদ্দ বছর কোনক্রমে এইভাবে ঘর সংসার টিকিয়ে রাখার পর লাল্লা বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে যান, কোনোদিন ফেরেন নি আর। দীক্ষা নেন শৈববাদে, সিদ্ধা শ্রীকান্থের কাছে। দীক্ষা শেষেও লাল্লাকে ঘিরে গড়ে ওঠে এক আজব সমস্যা। কাশ্মীরি শৈববাদী সাধকরা প্রত্যেকে ছিলেন পুরুষ এবং সংসারী। কূট তর্কের সূচনা হয় একজন নারী কি শৈববাদের গুরু হয়ে উঠতে পারেন? লাল্লা বলেন যে তিনি ‘সংসারে’ বিশ্বাস রাখেন না, তাই তিনি নারী/পুরুষ এই দ্বন্দের বাইরের অস্তিত্ব। শৈববাদের যে সামাজিকতা  নারীকে গ্রহন করতে পারছে না গুরু হিসেবে তা থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি বলে ওঠেন,

“আমাকে চাবকেছে তারা অপমানের চাবুকে, অভিশাপ দিয়েছে সবসময় ।

তাদের ঘেউঘেউ আমার কাছে অর্থহীন।

তারা যদি ফুল নিয়েও আমার শরণে আসত,

সেই জয়ধ্বনিও হতো একইরকম অর্থহীন।

এগিয়ে চলি, স্থিরচিত্ত।”

সাধন শেষে হয়ে ওঠেন পরিব্রাজিকা। পুরো কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে বিস্তৃত তার সাধনভূমি। এই সময় থেকেই লাল দেদের কবিতা যাত্রা শুরু, ভারতীয় নারীবাদের এক শক্তিশালী স্বরেরও শুরুয়াত ।

অনুবাদের সময় সোর্স টেক্সট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে রঞ্জিত হোসকোট কৃত লাল দেদের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ।

***

কোন দিক থেকে এসেছি আমি? কোন পথে?

কোন দিকেই বা চলেছি? পথ খুঁজবো কী ভাবে?

আশায় আছি একটা মানচিত্র পাবো,

অনেক দেরি হওয়ার আগেই পাবো।

নাকি সব শেষ হয়ে গেছে?

সবটুকু শ্বাসই খরচ হয়ে গেছে?

***

তাঁকে খুঁজতে গিয়ে নিজেকে দীর্ণ করেছি।

সব শক্তি নিঃশেষ হওয়ার পর,

খুঁজে পেয়েছি আরেক শক্তিকে।

দোরগোড়ায় এসে দেখি তাঁর দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।

চোখ দিয়ে সেই দোর বন্ধ করে,

আমি তার চোখে চোখ রাখলাম।

***

নিজেকে খুঁজতে গিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়েছি।

কেউ করেনি এত নিয়ম ভাঙার জন্য;

নিজের মাঝেই নিজেকে হারিয়েছি।

খুঁজে পেয়েছি এক মধুভাণ্ড; বলছি তোমায়,

রাশি রাশি উপচানো কলস,

কেউ নেই পান করার!

***

নিজেকে ঢেকে, আমার ভিতরেই লুকিয়ে ছিলে!

সারাদিন খুঁজে গিয়েছি তোমায়।

আর যখন নিজের ভিতরেই তোমায় খুঁজে পেলাম,

উন্মাদ হয়েছি!

কখনো বা আমি তুমি হয়ে যাই ,

কখনো তুমিই আমি!

***

যাও মেয়ে! উপাচার সাজাও,

মদ, মাংস, মিষ্টান্ন যা তোমার ঈশ্বর ভালোবাসেন।

যদি জানতে আসল রাস্তাটি

সব নিয়ম ভেঙেই পৌঁছবে প্রজ্ঞার কাছে!

***

খাইয়ে দাইয়ে পুষ্ট কর পাঁচ ইন্দ্রিয়।

হাড়িকাঠে নিয়ে যাওয়ার আগে পাঁঠাকে খাওয়ানো হয় যেমন,

তেমনই তোমার পাঁচ ইন্দ্রিয় পুষ্ট মনের মধু দিয়ে,

যেমন তোমার ঈশ্বরের পছন্দ।

তারপর হত্যা করো তাদের,

তাড়াহুড়ো করো না, শুধু পথটা জানা চায়;

সব নিয়ম ভেঙে প্রজ্ঞায় পৌঁছবার।

***

খারাপ খবর, খুবই খারাপ খবর।

পাতাঝরা মরসুমে সব ন্যাসপাতি, আপেলে রঙ ধরবে,

গ্রীষ্মের বৃষ্টিতে পেকে যাবে সব পেয়ারা।

সমস্ত মা ও মেয়ে হাত ধরাধরি করে

বেরিয়ে পড়বে অচেনা সব লোকেদের সঙ্গে,

উদোম দিনের আলোয়।

***

বুরবক! ধর্মগ্রন্থ তোমাকে পথ বাতলাবে না,

তোমার লাশের উপর ছড়ানো আতরও দেবে না কোনো নিশান।

আত্মকে জানো,

শেষ কথা এই।

***

যোগাসনে বসে শ্বাসের হরেক কসরত

তোমাকে সত্যের কাছে আনবে না।

সারাদিনের দিব্যচিন্তা নিয়ে যাবে না মুক্তির দোরে।

যত খুশি নুন মেলাও জলে,

কখনোই তা সাগর হবে না।

***

জ্যোৎস্না ফিকে হতেই,

চেঁচিয়ে ডাকলাম উন্মাদিনীকে ।

তার ব্যথায় আদরের হাত বুলিয়ে

ঘুম ভাঙিয়ে ডাকলাম তাকে।

আমি লাল্লা! লাল্লা আমি!

তার সাথে মিশে গেলাম,

ডুবলাম স্বচ্ছ বিলে।

***

ছয়খানা জঙ্গলের মাঝ দিয়ে পথ হেঁটেছি।

যতদিনে চাঁদ উঠলো ভিতর ঘরে,

আমার ভিতর সুর ফোটালো আকাশের শ্বাস।

শুকিয়ে উঠলো রক্ত মাংসের হাড়,

প্রেমে পুড়িয়েছি হৃৎপিণ্ড,

খুঁজে পেয়েছি শিবকে।

***

এসেছি জন্ম-মৃত্যুর পৃথিবীতে।

মনের আলোয় দেখেছি আমার সত্যি,

কেউ মরবে না আমার জন্য,

আমি মরব না কারুর জন্য।

মরে যাওয়া কী চমৎকার!

বেঁচে থাকা কী অবাক করা!

***

হাজার বার গুরুকে বলেছি,

শূন্যতার একটা নাম দিন!

হাল ছেড়েছি!

কীইবা নাম দেব তাকে?

যেখান থেকে নামের শুরু!

***

যেখানে শিব আর শক্তি প্রেমে ডুবে এক হয়ে আছেন,

আত্মার সেই যুঁইকুঞ্জ থেকে আমি এসেছি।

আমি লাল্লা নিজেকে ছুঁড়ে ফেলেছি মধু সায়রে।

মৃত মানুষী এক, হেঁটে বেড়াই;

কার কীইবা যায় আসে তাতে!

***

গুরু আমায় একটাই মন্ত্র দিয়েছেনঃ

বাহিরকে ভুলে ভিতর পানে চাও।

সেই মন্ত্র নিয়ে আমি লাল্লা!

দিগম্বরী! ঘুরে ঘুরে নাচি!

উলঙ্গিনী! নাচি!

***

গর্ভের অন্ধকারে একটি কথা দিয়েছিলে তুমি।

রাখবে তো সে কথা?

নাকি রাখবে না?

মৃত্যু শিয়রে এসে দাঁড়ানোর আগেই চলে যাওয়া ভালো,

তখন উঠে আসবে সেই কথা।

***

কে দেখে আত্মকে পর, পরকে নিজ?

কে দেখে দিনকে রাত, রাত্রিকে দিন?

এই দুইয়ের মাঝে নেচে বেড়ায় না কার মন?

আদিদেব তিনি, তিনিই মুরশিদ।

***

একাই পেরিয়েছি শূন্যতার মাঠ।

খসেছে একে একে যুক্তি ও বোধ।

হোঁচট খেয়েছি লুকোনো আমিতে,

হোঁচট লেগেছে গোপন সত্তায়, তারপর?

পাঁকে ফুটেছি পদ্ম হয়ে।

***

পান করেছি সিন্ধুর মদ কত!

কত না ভূমিকায় করেছি অভিনয়!

মানুষের মাংস চিবিয়েছি কত!

তবু তো একই আছি,

সেই পুরনো লাল্লা!

কিচ্ছু বদলায় নি।

***

প্রজ্ঞার কাপড় জড়াও,

মনে আনো লাল্লার কথা।

আত্ম দিনের আলোর মত প্রকাশিত হোক;

দেখো,

তুমি মুক্ত!

Facebook Comments

Leave a Reply