গল্প: জিয়া হক

প্যান অপটিকান


লোকটা চুপ করেই ছিল। সাদা লিনেন প্যান্ট, নীল টি শার্ট, স্লিপার্স জুতো, হাতে সোনাটা ঘড়ি। চোখে চশমা নেই। চুল খুব পরিপাটি নয়, তবে আগোছালোও নয়। চুলে হালকা পাক ধরেছে। জুলফির ধারটা প্রায় সাদা।

তিনি বেশ মৃদু ভাবে বললেন, তোমাদের এমনটা মনে হচ্ছে কেন?

কফিশপটা ছোট। সবাই সবাইকে দেখতে পায়। সোফা দিয়ে ছোট ছোট ঘেরাটোপ করা। সোফার সামনে একটা করে কাচের টি টেবল। তাতে সুন্দর ফুলদানি। অজানা ফুল ঘাড় ঘুরিয়ে রয়েছে।

একজন বেশ বিস্মিত হয়ে বললেন, মানে?

বিস্মিত হওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। প্রতিবেশি টেবিল থেকে কেউ হঠাৎ আগ বাড়িয়ে আলোচনায় ঢুকে পড়লে অবাক হওয়া যায় বৈকি।

লোকটা বললেন, আমি আপনাদের আলোচনা মন দিয়ে শুনছি অনেকক্ষণ ধরে।

পাশের ঘেরাটোপে তিন জন বসেছিলেন। শুভঙ্কর—একজন সাংবাদিক। প্রমোদ—একজন স্কুল শিক্ষক। জয়—একজন কলেজের অধ্যাপক। প্রথম কথাটি বলেছিলেন শুভঙ্করই।

আমাদের ভাবনায় সমস্যাটা কোথায়? জানতে চাইলেন প্রমোদ।

লোকটা বললেন, কফিশপে এসব নিয়ে আলোচনা আমি করতে চাই না। একদিন আমার বাড়িতে আসুন আপনারা।

ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করলেন, আর কি কিছু লাগবে আপনার?

না, বিল দিয়ে দিন, বলে উঠে পড়ার আগে তিনটে ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিয়ে গেলেন শুভঙ্করের হাতে।

শপের দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলে কার্ডের দিকে নজর দিল তিন জন। তাতে লেখা—অনির্বাণ মুখার্জি, ১২ বি ফুলতলা রোড, কলকাতা ৩২। লোকটা কী করেন, কী পড়াশুনো করেছেন, যোগাযোগের ফোন নম্বর—কিছুই লেখা নেই। অদ্ভুত একটা ভিজিটিং কার্ড।

তিন জন পরষ্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

কোনও মানে হয় না। প্রমোদ বললেন।

জয় জানতে চাইলো, মানে?

মানে, ওর বাড়ি যাওয়ার কোনো মানেই হয় না।

তিন জনই সায় দিল—নাহ, এভাবে কোথাও, কখনও যাওয়া অনুচিত।

পরের দিন শনিবার। আকাশ পরিষ্কার। শরৎকালের আকাশ। গাভীর মতো মেঘ চরছে আকাশে তবে সেই মেঘ দুগ্ধবতী নয়।

অনির্বাণবাবু তখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেননি। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন, কে আসতে পারে আজ? সেদিনের কফিশপের চশমাপরা ছেলেটিই আসবে।

কলিংবেলের আওয়াজ শোনা গেল।

দরজা খুলে বেরিয়ে দেখলেন, গেটের খাঁজে খবরের কাগজ গোঁজা আর ঠিক গেটের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে চশমাপরা ছেলেটা।

গুড মর্নিং, শুভঙ্কর বললেন।

সুপ্রভাত। দাঁড়ান, গেট খুলছি, বলে ভেতরের গেটটা প্রথমে খুললেন অনির্বাণবাবু।

সকালে এখানে গরম সিঙাড়া ভাজে দেখলাম, তাই আপনার জন্য কয়েক পিস নিয়ে এলাম, সিঙাড়া খেতে আপত্তি নেই তো? শুভঙ্কর জানতে চাইলেন।

মৃদু হেসে অনির্বাণবাবু বললেন, একেবারে অপরিচিত লোকের আনা জিনিস তো আমি খাই না শ্রী…

আমি শুভঙ্কর। শুভঙ্কর মজুমদার।

আসুন শুভঙ্করবাবু। আমার এই কুটিরে আপনাকে স্বাগত।

খবরের কাগজটা টেবিলের ওপরে রাখলেন ভদ্রলোক। ঠিক দুই গ্লাস জল খেলেন। তারপর নিজের বিছানায় পা মুড়ে বসে গায়ে একটা ফিনফিনে সাদা চাদর জড়িয়ে বললেন, আমি জানতাম আপনি আজ আসবেন।

সিঙাড়াটা তখনও হাতে ধরে রয়েছেন শুভঙ্করবাবু। মুখে খানিকটা বিস্ময়,  আপনি জানতেন আমি আসব?

হ্যাঁ, আপনাকেই আগে আসতে হতো।

এবার শুভঙ্করবাবু তাঁর সাংবাদিকসুলভ ভঙ্গিতে ফিরে গিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে আরো দু জন ছিল। তারা নয় কেন?

অনির্বাণবাবু বললেন, সিঙাড়াগুলো টেবিলে নামিয়ে রাখুন। চা খাবেন?

অপরিচিত কারো কাছে আমি চা খাই না, শুভঙ্করবাবু বললেন।

আপনি আমাকে নকল করছেন শুভঙ্করবাবু। বি ইয়োরসেলফ। মুচকি হাসলেন অনির্বাণবাবু।

আপনি এখনও আমার কথার জবাব দিলেন না।

দাঁড়ান, তার আগে চা-টা বসিয়ে দিই। আমার কোনও কাজের লোক নেই।

বিয়ে করেননি?

বৌকে কি কাজের লোক মনে করেন?

এমন আসতে পারে শুভঙ্করবাবু বুঝে উঠতে পারেননি। তিনি একটু অপ্রস্তুতের হাসি হাসলেন।

রান্না, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার করা, বাজার যাওয়া—সব আমাকেই করতে হয় বলে আমার ঘরে সব জিনিস দেখুন অল্প। আমরা তখনই সব অতিরিক্ত করি যখন আমাদের অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়ার সামর্থ্য থাকে।

শুভঙ্করবাবু এবার নিজের ফর্মে ফিরে এলেন। বললেন, সব ঠিক আছে কিন্তু আপনার সব একটু আমার অদ্ভুত ঠেকছে মশাই।

নির্বিকার মুখে মন্থরভাবে অনির্বাণবাবু বললেন, এর জন্য দায়ী সেট থিয়োরি।

সেট থিয়োরি? আলগা কৌতূহল জেগে উঠল শুভঙ্করবাবুর মুখে।

এটা এমন কিছু নয়, খুবই সিম্পল। আসলে জগৎ সম্বন্ধে আমাদের ধারনাগুলো ধীরে ধীরে এমন বাঁধাধরা হয়ে যায় যে তার বাইরে কোনও কিছু দেখলে তাকে অদ্ভুত মনে হয়। আমারও এমন মনে হত।

এখন আর হয় না বলছেন?

না।

একটা অবিশ্বাস ফুটে উঠল শুভঙ্করবাবুর চোখে।

অবিশ্বাস্য ঠেকছে তো? অস্বাভাবিক নয়। এটা একটা প্র্যাকটিস। এর জন্য একটু উদাসীনতা দরকার। আর কী দরকার জানেন?

কী? বেশ গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করলেন শুভঙ্করবাবু।

সব কিছুকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা বন্ধ করা। অনির্বাণবাবু তার ইলেকট্রিক কেতলি থেকে কাচের কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিলেন শুভঙ্করবাবুর দিকে।

পারফেক্ট টি বললে কম বলা হয়। যথাযথ চিনি, যথাযথ লিকার। দুধ নেই। দুধে বায়ুরোগ হয়।

আপনি কি সাইকোলজিস্ট? আপনার কার্ডে তো কিছুই লেখা ছিল না… আমতা আমতা করে শুভঙ্করবাবু জানতে চাইলেন।

না, আমি সাইকোলজিস্ট নই, আমি সাইকায়াট্রিস্ট। হেড স্রিঙ্কারও বলতে পারেন, এই বলে মুচকি হাসলেন অনির্বাণবাবু।

হেড স্রিঙ্কার কেন হতে যাবেন?

না, ইউরোপ, আমেরিকায় সাইকায়াট্রিস্টদের এই নামে ডাকার চল রয়েছে। যাইহোক, আপনি তো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াতে চেয়েছিলেন?

এই কথা শুনে শুভঙ্করবাবু নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ অনির্বাণবাবুর মুখের দিকে। সত্যিই তো তিনি কখনও সাংবাদিক হতে চাননি। হতে চেয়েছিলেন প্রফেসর। নামের আগে ডক্টর ডিগ্রি। শুধু প্রফেসর নয়, জনপ্রিয় প্রফেসর হতেই তো চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হল কই। কয়েকবার নেট-সেট দিয়েও পেলেন না। তেমন যোগাযোগও ছিল না। কিন্তু এ সব কথা ইনি জানলেন কী করে। নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললেন, আমি যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই না তা কি করে জানলেন?

না, তা হতে পারে না, আপনাকে যতটুকু স্টাডি করেছি তাতে এটুকু আমি নিশ্চিত, তবে সরি, আজ আমাকে এখন উঠতে হবে। পরে কখনও কথা হবে।

চেম্বারে যাবেন নাকি?

না, আমার কোনও চেম্বার নেই, তবে চেম্বারের বাইরেও প্রচুর পেশেন্ট থাকতে পারে। থাকতে পারে কেন বলছি, আছে।

তবে আমি কী করি তা তো আপনি বললেন না।

সেটা বলা আমার কাজ নয়, আমি মিসির আলি নই। তবে লেখালেখি সংক্রান্ত কোনও কাজই করেন।

শুভঙ্করবাবু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমি সাংবাদিক। আরম্ভ কাগজে আমি ক্রাইম বিট-টা দেখি।

আরম্ভ এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় আর বহুল প্রচারিত প্রথম সারির দৈনিক কাগজ। শুভঙ্করবাবুর বেতন কম করে ৪৫ হাজার টাকা।

আপনি যে এসেছিলেন, সে কথা আপনার বন্ধুদের বলবেন না। বেশ গাঢ় স্বরে বললেন ভদ্রলোক।

একটু অবাক হয়ে শুভঙ্করবাবু বললেন, কেন?

বললাম তো, বলবেন না। ব্যাখ্যা দিতে পারব না। তবে তারা আপনার ভালো চায় না। এতটুকুই। এর বেশি আর কিছু জানতে চাইবেন না। শুধু বলি, তাঁরা দুজনেই এসেছিলেন এবং তাঁর সম্বন্ধে খুব নিন্দেমন্দ করে গেছেন।

কী বলেছে তারা আমার নামে? আপনি কি সত্যিই এখন বেরবেন?

না, এখনই বেরব না, প্রথমে পেপার পড়ব। তারপর আরও কিছু কাজ আছে, সেগুলো সারবো, তারপর বেরবো। তবে এবার আপনাকে উঠতেই হবে। আর হ্যাঁ, সিঙাড়াগুলো রেখে যান। আপনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়ে গেছে। এখন খেতে পারি।

আজকের আরেকজন আসবেন। কে আসতে পারে? রবিবার সকালবেলা বিছানায় একই ভাবে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন অনির্বাণবাবু। তাদের ভাবনার সমস্যা কোথায় জানতে চেয়েছিল যে ছেলেটি সে আসবে। তাঁর যা বয়স তাতে করে এই তিন জনকে লোক না বলে ছেলেই বলতে পারেন। বেশি বয়সের কিছু সুবিধা রয়েছে।

কিছুক্ষুণ পরে প্রমোদ এসে ঢুকলো অনির্বাণবাবুর শোবার ঘরে। আগের দিন যেভাবে বসেছিলেন সাদা চাদর জড়িয়ে ঠিক সেইভাবে বিছানায় বসে রয়েছেন ভদ্রলোক। সামনের বেতের চেয়ারে শুভঙ্করের বদলে প্রমোদ। শুরুতেই প্রমোদ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি স্কুলে পড়ান।

কেউ কোনও তথ্য দিলে অনির্বাণবাবু নির্বিকারভাবে শোনেন। কোনও প্রত্যুত্তর করেন না। যেন তিনি সবই জানেন। নতুন করে কেন বলা।

প্রমোদবাবু শুরুতেই বললেন, আমাদের সেদিনের আলোচনায় আপনি দূর থেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

আমি এটা করে থাকি।

অন্যের কথা শোনাকে আড়িপাতা বলে আর আড়িপাতা অন্যায় তা কি জানেন না? প্রমোদ বেশ গড়গড় করে বলে যান।

না, ওটা আড়িপাতা ছিল না।

কেন?

কারণ আপনারা যথেষ্ট উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন। আড়িপাতার সংজ্ঞা একটু আলাদা।

প্রমোদবাবু একটু দমে যান। তিনি এরপরে কী বলবেন মনে মনে সাজাতে থাকেন।

অনির্বাণবাবু এই ফাঁকে বললেন, আমি এরকমটা করে থাকি। তবে আড়ি  পাতি না। তা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। এই বলে ইলেকট্রিক কেতলি থেকে চা ঢেলে প্রমোদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন, এই নিন বৈদ্যুতিন টি।

অনির্বাণবাবু চায়ে সামান্য চুমুক দিয়ে বললেন, আপনি তো স্কুল শিক্ষক কিন্তু হতে তো চেয়েছিলেন কোনও মিডিয়া হাউসের বড় কর্তা।

এই কথা শুনে ঘাবড়ে গেলেন প্রমোদবাবু। এ তো এক্কেবারে ঠিক কথা। স্কুলে চাকরিতে ঢোকার আগে কম করে হলেও চোদ্দটা মিডিয়া হাউসে তিনি পরীক্ষা, ইন্টারভিউ দিয়েছেন। তার মধ্যে আরম্ভ পত্রিকায় তিন বার। প্রতিবারই লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছেন কিন্তু ইন্টারভিউতে গিয়ে কেটে গেছে।

ইতস্তত করে প্রমোদবাবু বললেন, কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?

এ সব জানা খুব বড় কোনও ব্যাপার না। এই বলে আবার চায়ে চুমুক দিলেন অনির্বাণবাবু।

আপনি কি জ্যোতিষ শাস্ত্র চর্চা করেন? প্রমোদবাবু এবার একটু রাগিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন ভদ্রলোককে।

আপনি আমাকে রাগিয়ে দিতে পারবেন না প্রমোদবাবু। এই মানবিক গুণগুলো আমি বহুকাল আগে ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি।

আপনি কি মহাপুরুষ নাকি? একই রকম উত্তেজিত প্রমোদবাবু।

না, সাধারণ মানুষ। আমার বাবা আমাকে মহাপুরুষ হওয়ার শিক্ষাও দেননি কখনও।

পেশা কী আপনার?

পেশা-টেশা কিছু নেই। লোককে স্টাডি করা আমার কাজ। আমি একজন হেড স্রিঙ্কার মানে সাইকায়াট্রিস্ট।

নিজেকে হেড স্রিঙ্কার বলতে সংকোচ হচ্ছে না আপনার?

বললাম যে, এই সব মানবিক গুণগুলো ছেড়ে বহুকাল আমি বেরিয়ে এসেছি।

খুব বড় মতলববাজরা আপনার মতো করে কথা বলে, তা কি জানেন? প্রমোদ ইচ্ছা করেই এই কড়া কড়া কথাগুলো বলছেন যাতে ভদ্রলোক সত্যিই রাগ, ক্রোধ, লোভ, মোহ, কাম, লজ্জা, এইসব বিষয় থেকে বেরিয়ে এসেছেন কিনা তা জানতে।

ঈষৎ শব্দ করে হাসলেন অনির্বাণবাবু। তাঁর হাতের চায়ের পেয়ালাটা কেঁপে উঠল তাতে করে। বিছানার এক পাশে পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে গায়ের চাদরটা আরো একটু আঁটোসাটো করে জড়িয়ে বললেন, মতলব শব্দটির আভিধানিক অর্থ জানেন? জানলে বুঝতেন, সকলেই মতলববাজ। আপনি আমাকে ফেরেব্বাজ বলতে পারতেন। সকলে ফেরেব্বাজ হয় না।

ধীর, শান্ত গলা ভদ্রলোকের। তাতে রাগের লেশমাত্র নেই। কীভাবে সম্ভব এমনটা?

প্রমোদবাবু এবার কথা ঘুরিয়ে বললেন, কিন্তু সেদিন কফিশপে আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করছিলাম সেখানে ভুলটা কী ছিল?

আজকের মতো আপনার সময় শেষ প্রমোদবাবু। আমাকে একটু বেরতে হবে। পরে কখনও এলে এই বিষয় নিয়ে আলাপ করা যাবে।

প্রমোদবাবু একটু যেন অপমানিত বোধ করলেন। হাতের চা-টা নামিয়ে রেখে বললেন, বেশ, তাহলে আজ উঠি। কখনও এলে আবার কথা হবে কিন্তু আপনি এইভাবে উত্তর না দিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন না।

আমি কী করতে পারি আর কী পারি না সেটা আমাকেই ডিসাইড করতে দিলে ভালো হয়। ধন্যবাদ আসার জন্য। তবে আপনি যে এসেছিলেন সেটা আপনার বন্ধুদের না বলাই উত্তম।

এক চুমুকও চা না খেয়ে কাপ নামিয়ে রেখে বেগে বেরিয়ে গেলেন প্রমোদবাবু। তাঁকে যদি বলা হতো, আপনার আসার কথা বন্ধুদের বলবেন না, তাহলে তিনি হয়ত বলে দিতেন কিন্তু অনির্বাণবাবু যেভাবে নির্দেশটা দিয়েছেন তাতে তিনি আর বলবেন বলে মনে হয় না। কারণ এই নির্দেশের সঙ্গে আরো একটা কথা জুড়ে দিয়েছেন অনির্বাণবাবু। সেটা হল, আপনার বন্ধুরা কিন্তু আপনার মোটেও ভালো চান না। কারণ তাঁরা দুজনেই এসেছিলেন এবং তাঁর সম্বন্ধে খুব নিন্দেমন্দ করে গেছেন।

বিছানার উপর পেপারটা ছড়িয়ে বসে মন দিয়ে পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখতে লাগলেন ভদ্রলোক।

বৃহষ্পতিবার মহালয়ার ছুটি। তৃতীয় বন্ধুটির দেখা নেই। তবে অনির্বাণবাবু জানেন, তিনি আসবেন। আর আজ, এই মহালয়ার দিনেই আসবেন।

একই ভাবে দু জন বসে রয়েছেন—বিছানায় সাদা চাদর গায়ে অনির্বাণবাবু আর তাঁর সামনের বেতের চেয়ারে অধ্যাপক জয়। জয় সরকার। সুন্দর পাঞ্জাবি আর জিন্স। চোখে বেশ বিনয়। হাতটা নমস্কারের ভঙ্গিতে কোলের উপর রাখা। জয়বাবুর কপালটা একটু বড়।

অনির্বাণবাবুই কথা শুরু করলেন, কত দিন কিছু লেখেননি?

হ্যাঁ, অনেক দিন কোনও লেখা আসছে না। কিন্তু রোজ রাত বারোটার পর খাতাপেন নিয়ে বসি। জয়বাবু বেশ লাজুকভাবে বলে গেলেন।

আপনার স্ত্রী চান না আপনি লেখালিখি করুন। নারী আর স্ত্রীয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য।

ঠিক বলেছেন।

আপনার প্রিয় কবি নজরুল ইসলাম। এই যুগে হলে কলকাতাতেই তাঁর ভালো চিকিৎসা হতে পারত।

এবার একটু বিস্মিত হলেন জয়বাবু। তিনি যে নজরুলের কবিতা ভীষণ পছন্দ করেন আর কলেজে নজরুল পড়ান তা তো এই ভদ্রলোকের জানার কথা নয়। তাছাড়া, সবার কাছে তিনি জীবনানন্দের নামই বলেন। খুব ঘনিষ্ঠ মহল ছাড়া তাঁর যে প্রিয়তম কবি নজরুল তা কেউ জানে না।

অনির্বাণবাবু বলে চললেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান কী বলতে পারেন? তারপরও তাঁকে সেই দেশের জাতীয় কবি করার কোনও মানে ছিল? শামসুর রাহমান, আল মাহমুদরা ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, জাতীয় কবি বলে কিছু হয়? সে দেশের জাতীয় সঙ্গীতটাই তো অন্য কবির লেখা।

ইচ্ছা করেই এই সব প্রসঙ্গ তুলে আনছেন অনির্বাণবাবু। আসলে তিনি এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনাই করতে চান না। এটা তাঁর একটা কায়দা। অন্তত অধ্যাপকদের জন্য বিশেষ কায়দা তো বটেই। তাঁরা কিছু ভারি ভারি বিষয় নিয়ে না কথা বলতে পারলে, ভাবতে পারলে মনে করেন সময়টা বেকার যাচ্ছে।

গম্ভীর হয়ে ভাবছেন জয়বাবু। হাতে বৈদ্যুতিন চায়ের পেয়ালা। কাচের পাত্রে মদের মতো রঙ।

আপনি কি চাননি কবি হতে, জয়বাবু? খুব বড় কবি। সব পত্র-পত্রিকাতে আপনার লেখা বেরবে। সম্বর্ধনা পাবেন। কবিতা পাঠের আসরে সভাপতির আসন উজ্জ্বল করে বসে থাকবেন।

একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কখন মাথা নেড়ে ফেলেছেন খেয়াল করেননি জয়বাবু। চা-টা পাশে একধারে রেখে তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে দিলেন। তারপর মাথা তুলে বললেন, ঠিকই বলেছেন অনির্বাণবাবু, আমি কবিই হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিবারিক কারণে কবিতা লেখা ছাড়তে হয়েছিল এক সময়। নেট পাশ করার জন্য দু বছর লাগাতার পরিশ্রম করেছি। তখন শুধু কোন উপন্যাসে কোন কথাটি কে বলেছে, কোন কবিতার বই কত সালে কততম মুদ্রণ হয়েছে, কোন নাটকে কত নম্বর দৃশ্যে কী ঘটেছে—এই শুধু মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করত। কবিতা তখন হারিয়ে যায়। আজও আমি তাকে খুঁজছি।

আপনি শ্রী গুপ্তর কাছে গবেষণা করতে চেয়েছিলেন, তাও হল না।

এবার বেশ বিস্ময়ের সঙ্গে জয়বাবু বললেন, আমার সম্পর্কে এতসব জানলেন কীভাবে বলুন তো?

আপনার গবেষণার বিষয় ছিল বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে নগর।

কী করব, কবিতা নিয়ে সুখময়বাবু কাজ করাতে রাজি হচ্ছিলেন না। তাই যেটা পাওয়া গেল তাই নিয়েই শুরু করলাম কাজ। কিন্তু আপনি কীভাবে…!

আপনাকে আজ উঠতে হবে জয়বাবু। অন্য কখনও এলে আবার কথা হবে। আমাকে একটু বেরতে হবে। তবে আসার জন্য ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল।

আরেকটু সময় কথা বলা যায় না অনির্বাণবাবু? গলায় ভীষণ কাতরতা জয়বাবুর।

না, আজ আর নয়। আপনি আসুন। তবে আপনি যে এসেছিলেন তা যেন বাকি বন্ধুরা না জানে। কেননা তাঁরাও এসেছিলেন আর আপনার সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ভীষণ কুৎসিত। যাইহোক, ভালো থাকবেন।

আমি আবার আসব।

জয়বাবু অনিচ্ছুকভাবে বেরিয়ে যেতেই বিছানায় শুয়ে পড়লেন ভদ্রলোক। আজকের মহালয়া। পরের দিন কাগজ বন্ধ থাকবে। একটা কাগজে দু দিন চালাতে হবে।

সেই কফিশপে তিন বন্ধু বসে এস্প্রেসোর অর্ডার দিয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারো মুখে কোনও কথা নেই। অন্য দিন শুভঙ্করই প্রথম নানা বিষয় উত্থাপন করে। আজ তার মুখ বন্ধ। আবহাওয়া নিয়েই কথা শুরু করা ছাড়া উপায় নেই যেন।

কালো কফি এস্প্রেসো এলো।

তিন বন্ধু মুখ বুজে কফি পান করে চলেছে। তাদের চোখ পাশের ঘেরাটোপগুলোর দিকে ঘোরাফেরা করছে। কাউকে যেন খুঁজে চলেছে তিন জোড়া চোখ। কিন্তু আজ কফিশপ বেশ ফাঁকা। এক জোড়া তরুণ-তরুণী একে অপরের নাকের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তাদের গায়ের পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসছে এসির বাতাসে।

প্রমোদই বললেন, কোনও মানে হয় না।

শুভঙ্কর বললেন, সত্যিই কোনও মানে হয় না এর।

জয় বললেন, কী ব্যাপার বলো তো?

ওই অনির্বাণ মুখার্জি না কে, তার বাড়িতে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। এরকম অচেনা ফেরেব্বাজ লোকের অভাব আমাদের শহরে কম নেই। যে লোক আড়ি পাতে অন্যের আলোচনায় সে আর যাই হোক সুবিধের লোক নয়। তাও এমন একটা ভিজিটিং কার্ড যেখানে না আছে তার ডিগ্রি, না আছে তার প্রফেশন। আজব। এক নিঃশ্বাসে বলে থামলেন প্রমোদ।

জয় বললেন, ঠিক কথা। এই রকম আনকেনি লোকের খপ্পরে না পড়াই ভালো।

শুভঙ্কর হঠাৎ বললেন, আমরা এক সঙ্গে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম, মনে আছে তোমাদের?

জয় বললেন, সে আর মনে থাকবে না? এই তো বছর খানেক আগের কথা।

ঠিক, বছর খানেকই হবে। সেখানেই আমাদের আলাপ। তার আগে কিন্তু আমরা কেউ কাউকে চিনতামও না। সূর্যতোরণ হোটেলের লবিতে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে আলাপ।

প্রমোদ বললেন, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তখনও কেউ কাউকে ভালো ভাবে চিনিও না।

সবাই চুপ হয়ে গেলেন।

শুভঙ্কর নৈঃশব্দ ভেঙে দিয়ে বললেন, আজও কি আমরা পরষ্পরকে ভালো ভাবে চিনি?

এই কথায় আড্ডা আরও শান্ত হয়ে গেল। সত্যিই কি তারা সবাই সবাইকে প্রকৃত চেনা বলতে যা বোঝায়, সেভাবে চেনে? তারা কি এত দিন শুধু বোকার মতো সময় কাটিয়ে এসেছে এক সঙ্গে? শুভঙ্কর যেদিন আরম্ভ পত্রিকায় প্রমোশন পেয়ে ক্রাইম বিটের হেড হল সেদিনের পার্টিতে বাকি দুই বন্ধুর মুখ কি একটু ফ্যাকাশে হয়ে ছিল? যেদিন জয় কলেজের বিভাগীয় প্রধান হল, সেদিন শুভঙ্কর, প্রমোদের মনের অবস্থা কেমন ছিল? সাহিত্য পত্রিকায় যখন প্রমোদের গুচ্ছ কবিতা বেরিয়েছিল, তখন? সবাই মনে করার চেষ্টা করে, কোথাও কি কোনও সমস্যা রয়ে গিয়েছে?

সেদিনের আড্ডা জমল না। কফির দাম মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিন বন্ধু। শুভঙ্কর যাবেন এক মন্ত্রীর আমলার বাড়িতে, কিন্তু বললেন, শরীর ভালো নেই, বাড়ি চলে যাবেন রেস্ট নিতে। প্রমোদের যাওয়ার কথা সুকান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনের বাড়ি, অথচ অক্লেশে বললেন, তাঁর একটু কেনাকাটা আছে, বাজারে যাবেন। প্রমোদ যাচ্ছেন ‘স্বদেশ’ পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু বললেন যে মায়ের শরীর খারাপ, তাই তাকেও বাড়ি যেতে হবে।

প্রত্যেকে যে প্রত্যেককে সন্দেহ করছে তা তাদের চোখমুখ দেখে বোঝা যায়।

আরও দু জন তরুণ-তরুণী কফিশপে এসে ঢুকল। তারা বেরিয়ে পড়লেন।

অন্য দিন, পরের দেখা হওয়ার দিন ফিক্সড করে তারপর তারা বেরোন। আজ তারা ভুলে গেল সে কথা।

চুপচাপ তিন জন তিন জনের দিকে হাত তুলল শুধু।

পাঁচ দিন পর রেজিস্ট্রি ডাকে একটা চিঠি এসে পৌঁছলো শ্রী মুখার্জির বাড়ি। বালিগঞ্জের কোনও একটি এলাকার ঠিকানা উপরে লেখা। দুপুর বেলা। খুব নিস্তব্ধ চারধার।

চিঠি খুলে শ্রী মুখার্জি প্রথমে প্রেরকের নাম দেখলেন। পাঠিয়েছেন শ্রীমতী জয়া সরকার। চিঠির বয়ান খুবই সংক্ষিপ্ত। চিঠিটি এইরকম—

শ্রী অনির্বাণ মুখার্জি শ্রদ্ধাষ্পদেষু,

আমি অধ্যাপক জয় সরকারের স্ত্রী। আপনার কথা আমার স্বামীর কাছে অনেক শুনেছি। আপনি একজন সাইকায়াট্রিস্ট। ভারি বিড়ম্ববনায় পড়ে আপনাকে চিঠি লিখছি। সমস্যাটা আমার স্বামীকে নিয়ে। চিঠিতে কিছু লিখতে চাই না। আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী। অনুগ্রহ করে যদি একটু সময় দেন তাহলে বাধিত হব।

ইতি

জয়া সরকার

চিঠিটা পড়ে শ্রী মুখার্জি মৃদু মৃদু হাসলেন। কিন্তু তিনি তো মহিলাদের সঙ্গে পারতপক্ষে সাক্ষাৎ করেন না। মহিলাদের খুব সন্দেহের চোখে দেখেন। তারা অনেকেই ইকুয়ালিটির কথা বলেন, কিন্তু ইকুয়ালিটিতে তাদের বিশ্বাস নেই। এটা স্রেফ একটা ভড়ং। অধিকাংশ মহিলাই যা বলেন তা বিশ্বাস করেন না। তাদের কোনও প্ল্যান ‘এ’ নেই। কিন্তু প্ল্যান এ-র ভান আছে। অনেক পুরুষ সম্বন্ধেও কথাগুলি খাটে।

দুপুরে আজ রান্নার জন্য জাপানি পুঁটি এনেছেন। জাপানি পুঁটি ভাজা আর ভাত। সঙ্গে একটু ঘি নেবেন।

ইলেকট্রিক কেতলিতে চায়ের জল বসিয়ে তিনি ভাবলেন, জয়া সরকারের সঙ্গে দেখা করা উচিত হবে কিনা। কেননা তিনি জানেন যে জয়বাবুর কী সমস্যা হতে পারে। জয়বাবু কলেজ যাওয়া বন্ধ রেখে গৃহবন্দী হয়ে পড়েছেন। কারও সঙ্গে বাক্যালাপ করছেন না। কফিশপে যাওয়াও বন্ধ। মেজাজ খিটখিটে। স্ত্রীর গায়ে হাত তোলাও অসম্ভব নয়।

চিঠিটা বালিশের তলায় রেখে স্নানে গেলেন। আজ বেশ গরম। এই চিঠির কোনও উত্তর তিনি দেবেন না।

গত পনেরো দিনের মধ্যে তিন বন্ধু আলাদা আলাদা ভাবে শ্রী মুখার্জির বাড়ি এসেছেন। একে অপরের প্রতি এত অভিযোগ জমা হয়েছিল তা তারা নিজেরাও বুঝতে পারেননি। সুখের কথা, জয় সরকার বললেন, তিনি আবার কবিতা ফিরে পাচ্ছেন। দুঃখের কথা, তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দিতে চান। আর কম্প্রোমাইজ ভালো লাগছে না তাঁর। প্রমোদবাবু বললেন, তিনি স্কুল ছেড়ে আবার মিডিয়া হাউসে ঢোকার চেষ্টা শুরু করেছেন। কোনও এক নিউজ পোর্টালে হয়ত একটা চাকরি হয়েও যাবে। শুভঙ্কর মজুমদার বলে গেলেন, যে তিনি আবার পড়াশুনো শুরু করেছেন। তাছাড়া তাঁর এখন অনেক যোগাযোগ। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পি এইচ ডি হয়ে যাবে। তারপর অপরাধজগৎকে বিদায় জানিয়ে কলেজে ঢুকে পড়বেন। একটা ভারি ফ্রেমের চশমার অর্ডারও দিয়েছেন।

জয়বাবুকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন শ্রী মুখার্জি, আপনারা তিন বন্ধু কি কখনও পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন?

খানিকটা অবাক হয়ে তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। মাউন্ট আবু।

আপনার কি মনে হয়নি, কেউ আপনাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে?

আসলে এমন কিছুই হয়নি। তিন জনই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। কে আর কাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলবার চেষ্টা করবে?

কিন্তু সম্মোহিতের মতো জয়বাবু বললেন, হ্যাঁ, আমার একবার মনে হয়েছিল, কেউ যেন আমাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিতে চাইছে।

আপনি আর কখনও কফিশপে যাবেন না, শ্রী মুখার্জি বেশ গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন জয়বাবুকে।

শুধু জয়বাবুকেই নয়, কফিশপে যেতে নিষেধ করেছেন বাকি দুই বন্ধুকেও।

এটা তাঁর একটা খেলা। এবং তিনি জানেন, এরা কেউই আর ওই কফিশপে কখনও যাবেন না।

একদিন সন্ধ্যাবেলা সেই কফিশপে ঢুকলেন শ্রী মুখার্জি। আজ বেশ ভিড়। গমগম করছে। ঘেরাটোপগুলো যেন উপচে পড়ছে। কফিশপের মালিক সম্বিত মিত্র তাঁর পরিচিত। তিনি কাউন্টারে বসেন না। ভেতরে এক ঘুপচি ঘরে তিনি বসে সিসিটিভিতে সব লক্ষ্য রাখেন।

আজ আর সোফায় না গিয়ে সরাসরি মিস্টার মিত্রের চেম্বারে প্রবেশ করলেন শ্রী মুখার্জি।

আসুন, আসুন—সম্ভাষণ জানালেন মিস্টার মিত্র।

কেমন আছেন?

ফাইন, অ্যাজ অলওয়েজ। আপনার খবর কী বলুন?

সব ঠিক আছে। আচ্ছা, যে তিন বন্ধু আপনার এখানে রোজ এসে আড্ডা দিত তাদের তো বেশ কিছু দিন ধরে দেখছি না। কী ব্যাপার?

হ্যাঁ, আমিও খেয়াল করেছি, তারা আর আসছেন না।

আমার সঙ্গে একটা বেট করবেন?

আপনার সঙ্গে আগের বেট-এ হেরেছি। আর নয়। আমার ২৫ হাজার টাকা গচ্চা গেছে। না, আর আপনার সঙ্গে বেট নয়। বেলতলায় বারবার নয়।

এবারে কিন্তু আমি হেরেও যেতে পারি।

বলছেন?

হ্যাঁ, বলছি।

তা, কী বিষয়ে বেট বলুন তো?

ওই তিনটে ছেলে আর কখনও আসবে না আপনার কফিশপে।

ধুর, তা হয় নাকি? ওরা আমার পার্মানেন্ট ভিজিটর। তাছাড়া, আমার এই সস্তার কফিশপ ছাড়া এই শহরে আর আড্ডা দেবেটাই বা কোথায়?

তাহলে ধরুন বেট।

বেশ, রইলো বেট। এবার কত টাকার?

৪৫ হাজার।

আপনি কিন্তু এবার হারছেন। তা হারলে ভালই আমার আগের ২৫টা ফেরত পাবো।

হোক, আপনারই জয় হোক, বলে কফিশপ থেকে বেরিয়ে পড়লেন শ্রী মুখার্জি।

হাফ মাস পরে সম্বিত মিত্রের সঙ্গে দেখা করলেন শ্রী মুখার্জি। এই পনেরো দিনে রোজ কফিশপটায় গিয়েছেন ভদ্রলোক। একদিনও তিন বন্ধু আসেননি।

মিস্টার মিত্রের মুড খারাপ। আবার ৪৫ হাজার টাকা হারার দুঃখে বেশ মুহ্যমান।

শ্রী মুখার্জি সরাসরি কফিশপের ভেতরের ঘুপচি ঘরের দরজা ঠেলে প্রবেশ করে বললেন, কী মিস্টার মিত্র, কোথায় আপনার পার্মানেন্ট ভিজিটর্স?

গালে হাত দিয়ে চুপ করে রয়েছেন কফিশপের মালিক। এবারের টাকাটা প্রায় হাফ লাখ। গায়ে লাগছে। তার চেয়ে গায়ে লাগছে বারবার হেরে যাওয়াটা।

খুব আলগা ভাবে বললেন, বসুন। কফি খেয়েছেন?

নাহ, আজ কফি খেতে আসিনি। আজ টাকাটা নিতে এসেছি। দিন আমার পাওনাগন্ডা।

সে আপনি পাবেন তো বটেই। সম্বিত মিত্রের কথার নড়চড় হয় না, সে আপনি ভালো মতোই জানেন।

মিস্টার মিত্রের সামনের ডেস্কের এপারের চেয়ারে বসে পড়লেন শ্রী মুখার্জি। তাঁর মুখে ঈষৎ হাসি খেলা করছে। তবে হাসিটা চাপার চেষ্টা করছেন। মুহ্যমান লোকের সামনে হাসতে নেই, তাতে তার যন্ত্রণা আরও বাড়ে। আত্মহত্যা করে ফেলাও অসম্ভব নয় এমন অবস্থায়।

বেল বাজিয়ে ওয়েটারকে ডাকলেন মিস্টার মিত্র। দু কাপ কফি দিতে বললেন। তারপর স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ কীভাবে সম্ভব বলুন তো? পর পর দুবার আপনার প্রেডিকশন মিলে গেল। টাকা নিয়ে আপনি ভাববেন না। আপনার টাকা আপনি পেয়ে যাবেন। ক্যাশে নেবেন না চেকে নেবেন, বলুন। কিন্তু আজ আপনাকে বলতেই হবে এটা কীভাবে আপনি করেন।

মুচকি হেসে এবার শ্রী মুখার্জি বললেন, তার মানে এটাই আমার সঙ্গে আপনার শেষ বেট, তাই তো?

তা কেন হবে? আবার আমরা বেট করব পরে।

কিন্তু আমার ট্রেড সিক্রেট বলে দিলে তো ওই বাজির আর কোনও মানে থাকবে না।

আপনি তো একজন সাইকায়াট্রিস্ট। সেটাই তো আপনার ট্রেড। এসব আবার আপনার ট্রেড হল কবে থেকে? বিস্ময় প্রকাশ করলেন মিস্টার মিত্র।

দেখুন মিত্রবাবু, আমার কাছে সবাই রোগী। না, একেবারে রোগী না হলেও আমার পর্যবেক্ষণের বিষয় মানে এলিমেন্ট। আপনিও কিন্তু তার বাইরে নন।

এই কথায় নড়েচড়ে বসলেন মিস্টার মিত্র, আমিও?

হ্যাঁ, আপনিও।

আপনি তো বেশ বিপজ্জনক লোক মশাই। যতটা ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক গুণ বেশি বিপজ্জনক,–এখন মিত্রবাবুর মুড অনেকটা হালকা হয়েছে। হাস্য সহকারে কথাগুলো বলে কফিতে চুমুক দিলেন।

আমার স্বীকার করতে কোনও অস্বস্তি নেই যে আমি লোকটা বেশ বিপজ্জনকই। তবে আজ থেকে আর আমি আপনার কাছে বিপজ্জনক থাকব না। বারবার একই লোককে হারাতে ভালো লাগে না।

এবার বেশ গুছিয়ে এসিটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে মিস্টার মিত্র বললেন, তাহলে বলুন, কীভাবে আপনি বলে দিলেন যে ওই তিন বন্ধু আর আমার কফিশপে আসবেন না?

ডেটা।

ডেটা? সে আবার কী?

সিম্পল স্টাডি আর ডেটা অ্যানালিসিস। আমি কেন যে কেউই পারবে। তবে ধৈর্য্য দরকার এর জন্য।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না। একটু বিশদে ব্যাপারটা বলুন না,–উৎকণ্ঠা গলায় মিস্টার মিত্রের। তিনি জানতে উদগ্রীব।

শুনুন তাহলে। ওই তিন বন্ধু যে টেবিলে এসে রোজ বসত আমি ঠিক তার পাশের টেবিলে দিনের পর দিন এসে বসতাম। আপনি খেয়াল করেননি হয়ত। এটা খেয়াল করা সম্ভবও নয়। যাইহোক, তারা যথেষ্ট উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলত। সেই কথাগুলো আমি নোট নিতাম। সেখান থেকেই পেয়ে যাই তাদের সম্বন্ধে যাবতীয় ডেটা। কে কী করেন, কী ভালোবাসেন, কার স্ত্রী কেমন, কার ছেলে পড়াশোনায় ভালো, কে কোথায় বাজার করেন, এমনকি তাদের কোমরের মাপও। এই রকম অজস্র তথ্য। আপনার এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে, তা দিয়ে আপনি সবার উপর নজর রাখেন। আমারও একটি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। আমি তা দিয়ে যার উপর চাই তার উপর নজর রাখতে পারি। যাইহোক, এরপর আমি একটা ভিজিটিং কার্ড বানাই। যে কার্ডটা আর পাঁচটা ভিজিটিং কার্ডের মতো নয়। এটা করার একমাত্র উদ্দেশ্য হল কৌতূহল জাগানো। গড়পড়তা জিনিস মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। আর দৃষ্টি আকর্ষণ না করলে মনও আকর্ষণ করে না। আমি তারপর তাদেরকে আমার কার্ডটা দিই। আমি জানতাম সেটা তারা উপেক্ষা করতে পারবেন না। আমার বাড়িতে আসবেনই। এবং এটাও জানতাম তারা এক সঙ্গে আসবেন না কেননা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চরিত্র, ভালো লাগা-মন্দ লাগা, সব ডেটা আমার হাতে। তারা এলেনও। একা একা। আলাদা আলাদা ভাবে। সেটাই ছিল আমার জন্য সুযোগ। আমি একে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছি তারপর। তারা যে আপনার কফিশপে আর আসছেন না সেটা আমিই তাদের মানা করেছিলাম।

আর তারা আপনার নিষেধ শুনলেন?

সে তো দেখতেই পাচ্ছেন।

এটা কীভাবে সম্ভব হল?

কারণ ততদিনে তারা আমার হাতের মুঠোয়। আমি তাদের সম্পর্কে যা বলি সব মিলে যায়। এতে করে তারা আমাকে এক অলৌকিক মানুষ ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমার বলা কথাগুলো তো মিলবেই কেননা তাদের সব তথ্য তো আমার হাতের মুঠোয়।

কী কান্ড মশাই। এ তো দিন দুপুরে চুরি। মানে তথ্য চুরি,–মিস্টার মিত্র উত্তেজিত হয়ে চেকে সই করছেন।

চেকটা হাতে নিয়ে খুব নির্বিকার ভাবে ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ, সিম্পলি এটা ডেটা চুরির গল্প। আর কিছু নয়।

Facebook Comments

Posted in: June 2019, Story

Tagged as: ,

Leave a Reply