পাঠ প্রতিক্রিয়া: ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ প্রসঙ্গে উমাপদ কর

Aparjan May 2019, Cover‘কোয়ার্ক পাবলিশার্স’ থেকে প্রকাশিত কবি, গদ্যকার দেবজ্যোতি রায়ের ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ পড়ে চিঠিতে এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন কবি উমাপদ কর। আমাদের মনে হয়েছে কবি উমাপদ করের পাঠ ও লেখনী কেবলমাত্র ব্যক্তিগত চিঠির পরিসর অতিক্রম করে এক মগ্ন পাঠকে প্রকাশ করেছেন। ‘অপরজন’-এর পাঠকদের জন্য চিঠিটি প্রকাশ করা হল।

 

নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ  / দেবজ্যোতি রায়

প্রিয়
এপ্রিল ২৮। ২০১৯। রবিবার।
এইমাত্র তোমার বইটা (নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ) পড়া শেষ করলাম। এখন ঠিক সকাল ৯-৫০। বহরমপুর। তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দুপুর দুটোয় তাপমাত্রা ৪১/৪২ পারদ ছোঁবে। আমার বাড়ি থেকে ভাগিরথী নদীর দূরত্ব পথ বেয়ে ১ কিমি। বাড়িঘর দোকানপাট ভেঙে সোজাপথে তা ৬০০ মিটারের বেশি নয়। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি। তবে জানি, সন্ধের দিকে একটা হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করবে, কিন্তু তা এসে কোনোভাবেই আমার বাড়ির ছাতকে ছুঁয়ে দিতে পারবে না এতটুকু।

এই বই পড়ে কী লিখতে পারি আমি? কী লেখা যায়! আর অন্য পাঁচ-জনই বা কী লিখবে। যা লিখবে, তা-তো বাইরে থেকে লিখবে। একাত্ম হয়ে নৈব নৈব চঃ। অনেক ভাবে উদ্বেলিত হলেও, অনেক নস্টালজিয়ায় স্নান সারলেও, প্রায় একই ধরণের সামান্য পড়াশোনায় লিপ্ত হলেও, অনেক অনেক যন্ত্রণা মেশানো স্তব্ধতার কাছে এসে কখনো-সখনো দাঁড়ালেও, কী লিখব আমি এখনো ঠিক করতে পারিনি। হয়তো বা তাই এত বাড়তি কথার অনুষঙ্গ। আবার এমনও হতে পারে, যা বলব বলে ঠিক-বেঠিক ভাবনা এসে নূপুর বাজায় তার স্বর, সুর, তীক্ষ্ণতা আমার অধিগম্যতার মধ্যে পড়ে না। আমার মেধা (মধ্য) বলছে, লিখতে যেয়ো না কিছু, এটা জাবেদার পুনর্পাঠ নয়। আবার আমার আবেগ (শুদ্ধই ধরা যাক) বলছে, না না, লেখো। বলো তোমার ভাবনার অনুরণনগুলো, না হয় নিজেও বাইরে থেকে দেখা নিয়ে কিছুটা ঢুকে পড়বে, তবু লেখো। একটা সেতার মগ্নতার সঙ্গে বেজে চললে একসময় পাশে ছড়িয়ে থাকা সেতারুহীন সেতারগুলোও বেজে ওঠে। রেজোনেন্স যাকে বলে। এমনই এক টানাপোড়েনের মধ্যে একটুকরো অনির্বচনীয়কেও বচনীয়তায় আনার চেষ্টা একচুয়ালি হয়তোবা আমার আরেক বোকামির সামিল। রে বোকা!

আগেই বলেছিলাম (নির্দ্বিধায়) আমি প্রথমে কলকাতাতেই বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম। কিন্তু দু-চার পৃষ্ঠা পড়ার পরই বুঝেছিলাম, এই বই এভাবে তাড়ার মধ্যে পড়া যাবে না। এ-বই আরও অভিনিবেশ দাবি করে। বন্ধ করেছিলাম পড়া। এবারে যখন দিনকয়েকের জন্য বহরমপুর আসি, জানতাম, নিভৃতি মিলবে, জানতাম এখানেই আমার শৈশব, কৈশোর, প্রথম যৌবনের সুতোগুলো কিছু মাঞ্জা দেওয়া, আবার না-দেওয়াও কিছু। হয়তো বা তাতে মরচে পড়েছে, জটগুলো জীর্ণ হয়েছে, তবু তাতে এখনও টান দেওয়া যাবে, যাবে এই সূত্রে। জট ছাড়ানো যায় না, কিন্তু স্থানমাহাত্ম্যে তাকে আলতো ছুঁতে পারব কোনো ভান-ভনিতা ছাড়াই।

তর সয়নি। যাত্রাপথেই (ট্রেন) নরকের থেকে। ট্রেনকে নিভৃতি গ্রাস করতে না পারলেও কেমন করে যেন আমাকে গ্রাস করেছিল। ৯ থেকে ৩০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত টানা পড়ে (আসলে দু-বার করে পড়তে হচ্ছিল) থামলাম। থামতেই হতো। মাথা ঝনঝন করছিল। একটু ভাবতে থাকলাম—

আত্মকথন

যে কোনো লেখাই আত্মজৈবনিক। তিনটে রকম থাকতে পারে তার। এক) সচেতনভাবে, দুই) সচেতনতা-অসচেতনতার মিশ্রণে, তিন) অসচেতনভাবে। এ-যে এক নম্বর শ্রেণীভূক্ত, এ-কথা অনুধাবন করতে ৩০ পৃষ্ঠাই কাফি মনে হলো, যা থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা গেল— সচেতন প্রয়াস। আবার আত্মজৈবনিকের দুটো দিক থাকতে পারে— এক) আত্মকেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে, দুই) বাইরে বা পরিধি থেকে আত্মকেন্দ্রর দিকে। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। কারণ, এ-যে কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে যেমন, তেমনই বাইরের ঘটন-অঘটন থেকে আত্মকেন্দ্রর দিকেও। দুটো দিকই একসঙ্গে ক্রিয়াশীল, চলমান, ভাঙা, ভেঙে ফের গড়ে তোলা, কেন্দ্রচ্যূত হয়ে পড়েও কেন্দ্রাভিমুখী গমন, যুগপৎ। ফলে সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল হলো, গতিমুখটা ঠিক কী? ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্তে আসা গেল, এ তৃতীয় এক দিক, যা উভমুখী, যা কোনো প্রতিষ্ঠিত লজিককে মেনে চলবে না। আত্মানুভব তৈরি হবে নিদেন ঘটনাস্রোতে, ঘটনা মুখ্য হবে না। আবার ক্রিয়া-কর্মের স্রোত ভেঙে দিয়ে ফের গড়ে তুলবে আত্মানুসন্ধানের মূল অভিমুখটিকে। ফলে, শুধু প্রচলিত ধ্যান-ধারণা নিয়ে, আর অগ্রজ দার্শনিকদের কথানির্যাস বা কবির অনুভবরাজিকে পাথেয় করেই এ-লেখা লিখিত হবে না। তারা আসবে রেফারেন্স হিসেবে নিজের ভাবনার সঙ্গে একবার মিলিয়ে দেখে নেওয়ার অনুষঙ্গে। আমি জানি, এই তৃতীয় দিকটি একবগ্‌গা নয়, এবং আমার মধ্যেও এক ভাঙচুর শুরু করবে। তা করুক। আমি না হয় সাহসে ভর করে অগ্রসর হব।

এ-দুটো ভাবনা ও সিদ্ধান্তের পর-পরই বইয়ের নামের আদ্যশব্দদুটো আমাকে হন্ট করাতে বাধ্য করল। ‘নরকের থেকে’। এ-কোন নরক? ভাবনা এগোয়। দান্তের নরক পড়েছিলাম। তার কিছু রশ্মিপাত মগজে ঘুরতে না-ঘুরতেই হিন্দু-পুরাণের, বলা ভালো মহাভারতের মহাপ্রস্থানপর্বের বর্ণিত নরক মনে ভেসে উঠল। ‘সপ্তদোজখ’ শব্দটি জানা, তার বিচিত্রতা আর রূপ-রস সেভাবে খুটিয়ে জানা হয়নি। আবার ‘রৌরব’ নামে একটা সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম বহু বছর। লোকে এমন নাম কেন জিজ্ঞাসা করতেই, রৌরবিয়ানরা বলতাম— না না, এটা নরক নয়, এটা নরক থেকে। সেই ‘নরকের থেকে’ আজও আমাকে দ্বিতীয়বার হন্ট করালো। ‘অনির্বচনীয়’ বুঝলাম, কিন্তু ‘মেঘ’ কেন? ‘এক টুকরো’। ‘আলো’ নয় কেন? একটুকরো আলো তো হতে পারত! কেন নয়, কেন মেঘ, কেন ছায়াফেলা কালোর দ্যোতনা, কেন আলো ঢেকে দেওয়ার মারনাস্ত্র? কেন ছায়াময় অনির্বচনীয়তা, তা বুঝতে গেলে, ধরতে গেলে, আমাকে আরও অগ্রসর হতে হবে, সেই উভমুখী ক্রিয়াশীলতা আর চলমানতায়। গ্রাহ্য করলাম।

এ-সময় কি একটু আবেগতাড়িত হয়ে নস্টালজিয়াতে আক্রান্ত হলাম? হ্যাঁ, হলাম। বললাম না, আলোড়িত আমি। ফিরে দেখা। নিজেরটুকু। ’৬৮, ’৬৯, ‘৭০। আমি ১৩, ১৪, ১৫। এইট-নাইন-টেন। হ্যাঁ হ্যাঁ, অসম্ভব বোমাবাজির মধ্যেই হায়ার সেকেন্ডারি পরিক্ষা দিয়েছিলাম ’৭১-এ। এই-তো সেদিনের কথা। সবাই বলে টিন-এজটা বড্ড মারাত্মক, বড়ো স্পর্শকাতর, আর স্বপ্নরঙিন। বলে, বয়ে যাওয়ার আর আত্মহননের মহাসময় এটা। আর আমার ভাবনায় এসবের কিছুই ছিল বলে মনে পড়ে না। স্বপ্ন? হ্যাঁ ছিল। কিন্তু কোনো গোল(Goal) ছিল না। স্পর্শকাতর? হ্যাঁ, ছিলাম। কিন্তু তা এত জোরালো ছিল না যে অন্যের বাড়া ভাত নষ্ট করব বা নিজের বাড়া ভাতে লাথি কষাব। মনখারাপ হয়ে যাওয়াটাই প্রধান ছিল, যাকে কৈশোরোত্তীর্ণ যন্ত্রণা হিসেবেই এখনও জানি বা মানি। শৈশব-কৈশোর— শৃঙ্খলার মধ্যেও অবাধ ছিল। খেলাধূলা হুল্লোড়ের মধ্যে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে পড়ার ঝোঁক ছিল, বাছবিচারহীন গোগ্রাসে গেলা। শহরের উপকণ্ঠে গ্রামের খোলামেলা জীবন, আবার শহরের সব ছোঁয়া। লণ্ঠনে পড়া, তালপাতার পাখায় বাতাস, দুটো ইজের-জামায় স্কুল, উদ্বাস্তু এবং তৎকালীন স্কুলশিক্ষক বাবার সংসারে সাচ্ছন্দ্যের প্রশ্নই ছিল না, হয়তো প্রাণ ছিল, আবার ছিল অকারণ মনখারাপ হয়ে যাওয়ার বিলাসিতা। মফস্বল শহরের কানাচে, প্রায় নিরুত্তাপ গ্রামের চৌহদ্দিতে থেকেও একটা গুঞ্জরণ কিন্তু শুনে চলেছি এইট থেকেই। একটা গন্ধও কি বাতাসে ছড়িয়ে গিয়েছিল? নয়তো গুঞ্জরণ আর গন্ধ নিয়ে তখন থেকেই কৌতূহল বেড়ে চলল কেন? কেন নিত্য নতুন বহরমপুর থেকে ভেসে আসা নানান খবর, খবরের অধিক মনে হত? রেডিও শুনি, কিছুই তো নেই। পত্রিকা পড়ি, কই সেভাবে কিছুই খোলসা করা নেই। স্কুলের বন্ধুরা যথাযথ, যথাযথ ফুটবল, আবৃত্তি, আর অনুরোধের আসর। কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে স্কুলশিক্ষকদের কিছু ফিসফাস, বড়ো দাদা ও তার বন্ধুদের কিছু হয়তোবা কিছু অতিশোয়ক্তি কথা, বা আমাদেরই এলাকার মেজদার বন্ধু দু-চারজন তরুণের হাল-গতিক নিয়ে কথা উঠে পড়া, সেই কৈশোরে এক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল, পরে যা বিস্ময় ভয় আর একধরণের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছিল, অনেকটা এইভাবে—নাইন। একদিন স্কুলে ঢোকার গেটের বাঁপাশের দেয়ালে কারা যেন আলকাতরা দিয়ে কাঁচা অক্ষরে লিখে গেছে “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান”- সি-পি-আই (এম-এল)। রাতের অন্ধকারে হবে। সারাদিন স্কুলে এক চাপা উত্তেজনা। আমার বাবাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। কারা করল এ-কাজ? এর অর্থই বা কী? জটলা একটু বড়োদের মধ্যে। সন্ধ্যায় পাশের লাইব্রেরি-ক্লাবেও গুঞ্জন। আমার কাছে ধীরে ধীরে পরিস্কার হতে লাগল উত্তেজনার বিষয়টা। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী চিরকালীন কংগ্রেসী বাবা রাতে বড়ো দাদাকে শুনলাম বললেন— ‘কথাটা ভুল। চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান হতে পারে না। কিছুদিন আগেই এই চীন হঠাৎ ভারত আক্রমণ করেছিল। লাহিড়ী বাড়ির দিলুটা যুদ্ধে মারা গেল।’ এটুকুই ব্যস্‌। রাতে শুয়ে ভাবলাম, হাতের লেখাটা খুব চেনা মনে হচ্ছে। মেজদার বন্ধু পন্তুদা বা কালুদা নয়তো? ওরা কি তবে বিপ্লবীদলে ঢুকেছে? বিপ্লব করবে? অস্ত্র ধরবে? শ্রেণীশত্রুকে খতম করবে? বাব্বা, ভাবা যায় না, এমন এক উত্তেজনা। ভেবেছিলাম বাবা কালই লেখাটা কাউকে দিয়ে মুছে ফেলবে। বাবা কিন্তু তা করলেন না। বাবা কি ভয় পেয়েছেন? আমাদের কথা ভাবছেন? কোনো উত্তর নেই আমার কাছে। কিন্তু গুঞ্জরিত হচ্ছি, পল্লবিত হচ্ছি, নানান তাপবর্ধক খবরে, অজানা এক উত্তাপে মনে একটা ঝড়ের আভাস। গল্পের মতো অনেক কথা, কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়ছে কান থেকে কানে আর বিশেষত সিপিএম করা মাষ্টারমশাইরা যে কোনো সুযোগেই বারবার আমাদের সাবধান করছেন যেন এ-এক সর্বনাশা খেলা। তাঁরা এর বিরোধী। আর রোজই বহরমপুর থেকে বার্তা সমাচার আসছে টেক্সটাইল কলেজ ( এম-এল এর ঘাঁটি, এবং আঁতুড়ঘরও বটে), কে-এন কলেজ, আর-কে-এন ইত্যাদি থেকে। ওই বয়সেই বুঝলাম এ-এক দ্রোহকাল, এ-এক সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে নতুন করে গড়ে তোলার ডাক। চারু মজুমদার যার প্রধান সেনানী। আরও আছেন কানু সান্যাল, আজিজুল হক, অসীম চ্যাটার্জী। যুদ্ধ, যুদ্ধ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, যত ভান-ভণ্ডামি, শোষন-শাসন, পার্লামেন্ট-এসেমব্লি, গণতন্ত্র-ধনতন্ত্র, এমনকি সিপিএম সিপিআই আর-এস-পি নামধারী সমাজতান্ত্রিকদের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম লড়াই যুদ্ধ, প্রাণান্ত। ওপর থেকে বুঝলাম, ভেতর থেকে ততটা না, তবু একটা আকর্ষণ, একটা টান, উত্তেজনা, কৌতূহল, তাদের প্রতি একটা কীরকম যেন বোধ, ভালোবাসা কিনা জানি না। ব্যস্‌ ওই পর্যন্তই। আমার দৌড় এর বেশি কিছু ছিল না।

এতটা জায়গা জুড়ে নিজের কথা ফেনিয়ে কেন যে তোমাকে বলতে গেলাম, তা জানি না। হতে পারে এক আলোড়ন, এই বইয়ের প্রথমাংশের পাঠে। তোমার ষোলো। তোমার স্বপ্নের চোখ বড়ো মাপের। কতটা বুঝেছিলে না-বুঝেছিলে তার আংশিক প্রকাশ রয়েছে। কিন্তু সাহস ছিল, আপাত প্রত্যয় ছিল, ঢুকে পড়েছিলে ভেতরে। কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলে ‘বিপ্লব’ নামক সেই মহাযজ্ঞে, নিবেদিত হয়েছিলে। আজ অনেক পরে এসেও আর পাঁচজনের মতো তোমার পরিতাপ নেই। বরং আছে এক স্বীকারোক্তি— “ষোলো বছর বয়সটা তাতে সকল প্রকারে তীব্র সাড়া না দিলে আজো মনে করি মহা আক্ষেপ থেকে যেত জীবনে”। অর্থাৎ সেই কিশোরবেলায় এই মহাযজ্ঞে বা কুম্ভিপাকে জড়িয়ে না পড়লে তোমার জীবনটা অপূর্ণ থেকে যেত। আফশোষ রয়ে যেত একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসাবেও। তোমাকে সেলাম।

তোমার এই জীবন-অধ্যায় নিয়ে আগে আমার কিছুই জানা ছিল না। তাই ঝাঁকিটা একটু বেশিই লাগল আর কি। সামলে নিলাম। সাড়া দিয়ে প্রবেশ করেছ এক মহা ঘূর্ণাবর্তে, কনভিকশন থেকে, ষোলোয় যতটুকু জন্মানো সম্ভব। ভয় জয় করা সাহস আর স্বপ্ন-চোখের কাজল তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কী অকপটভাবেই না অনেক পরের সময়ে এসে সেই সময়কার অবস্থান ব্যক্ত করেছ—“নকশালবাড়ির আন্দোলন অন্তত আমার কাছে এই আকাশ ছোঁবার অন্য এক রূপ ধরে এসেছিল যদিও জীবনের কোনো গভীর বোধ যা ‘মলভাণ্ড ছেঁচে উঠে আসে সম্ভাব্য ঈশ্বর’, তা সেদিন আমার কাছে উৎসারিত হয়নি, দিগন্তটা প্রসারিত হচ্ছে হয়ত এটুকুই যথাযথ বুঝেছিলাম।” একেই আমি ষোলোর যথেষ্ট পরিপক্কতা বলে মনে করি। তুলনায় না গিয়েও এটুকু তো বলাই যায়, আমদের বয়সী অধিকাংশর কৈশোরোত্তীর্ণ যন্ত্রণা যখন বাইরে থেকে তাপ সেঁকে ভয়ে দ্বিধায় আশংকায় আরও বেশি যন্ত্রণাক্লিষ্ট অথচ সাবেকি, তুমি তখন ভেতরের গনগনে তাপে পুড়ছ, আর সোনা হচ্ছ। আমরা যখন পরিদৃশ্যমান বদল বাতাসের রেশটুকু নিয়ে আংশিক রোমাঞ্চিত, এক অজানা গল্পগাছার দিকে ধাবিত, নানা রাজনৈতিক খবরাখবর চাপান-উতোর ইত্যাদিতে যথেষ্ট সচেতনতার দাবিদার হয়ে উঠছি, তুমি তখন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, বিপরীবর্ত ক্রিয়া আর সংগঠন, দুঃখ দুর্দশায় নিপীড়িত শোষিত মানুষের পাশে বদলের বার্তা নিয়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছ, একজন কর্মী, যে ত্যাগ করেছে তার অ্যাকাডেমিক লেখাপড়া ও নিরুদ্বিগ্ন জীবনযাপন। তুমি ক্রমে আলাদা হচ্ছ, প্রচল গড্ডল সমাজ থেকে, সমবয়সীর অধিকাংশ থেকে, আর নিজের তথাকথিত স্বাভাবিক বৃদ্ধি থেকে। তোমার কাছে তখন এটাই প্রকৃত বৃদ্ধি আর নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেলাম জানাই সেই ষোলোকে, সেই ‘দিগন্ত প্রসারিত হচ্ছে’ এই বোধকে।

ষোলো, এক প্রবেশদ্বার, এক অনুভূতি, এক বোধ, এক প্রত্যয়, এবং অবশ্যই এক ক্রিয়াশীল সত্ত্বা, যা ঠেলে দেয় ‘অনির্দেশ্যের পথে, বিদ্রোহ ও বিপ্লবের দিকে; তার অসম্পূর্ণতা যতই থাকুকনা।’ একদম শেষ বাক্যটি পরের সময়ের ভাবনার। সে সময়ের নিয়ন্ত্রক চালিকাশক্তি ছিল এমন একটি ভাবনা— “আমরা সৎভাবে চেয়েছিলাম একটা সামাজিক ওলোটপালট সম্পন্ন করতে। এই কাজে যেটুকু সততা ও সাহস প্রয়োজন আমাদের অনেকের মধ্যে তা ছিল। আমরা দাঁড়িয়েছিলাম এক চুতিয়া রাষ্ট্রের সমস্ত হারামিপনা ও সন্ত্রাসের মুখোমুখি।” এই চাওয়া, এবং চাইতে গিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ানো দুটোই নিজ অস্তিত্বকে বিপন্ন করে, সংখ্যালঘু জেনে, আর ‘বিপ্লব’ই একমাত্র পন্থা এই প্রত্যয়ে দৃঢ় অবস্থান তৈরি করে। তাই তখন এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক— “এমনকি যৌনাঙ্গ দিয়েও ফলে আমি অনুভব করেছি তখন— ‘বিপ্লব’।” অর্থাৎ আমি নিজেই শারিরীক মানসিকভাবে এক বিপ্লব। আমার সত্ত্বাটি একটা বিপ্লবী সত্ত্বা।

“প্রায় দিন পনের-কুড়ি অহিংসবাদী রাষ্ট্রের ততোধিক অহিংস অলৌকিক থানায় দিনে-রাতে অসংখ্যবার গুহ্যদ্বারে ব্যাটনের সহাস্য চুম্বন ও খাদ্যনালি দিয়ে অন্যের মুত খেতে-খেতে এই মোলায়েম, স্বপ্ন দেখা, থ্যাতলানো, ভাজা-ভাজা, আটারলি-বাটারলি ভীষণ ডিলিশাস আমাদের লাট শরীরদুটো একটু স্বস্তি তবু পেল জেলে এসে।”

তুমি শুধু ব্যাটনের বাড়ি খাওনি শরীরে আর ঝোলানো দেহের পায়ের তলায়। ব্যাটন ঢুকেছে তোমার গুহ্যদ্বারে। তুমি শুধু ‘শিবাম্বু’ পান করনি, অন্যের মুত্রথলি হালকা হয়েছে তোমার পাকস্থলিতে। বাইরে থেকে বড়জোর ব্যাটনের বাড়ি খাওয়া কিছু মানুষ ইস্‌ উস্‌ করে কিছুটা বুঝবে, কিন্তু অনুভব করতে পারবে না। এই নির্যাতন আর মুখে কুলুপ, শরীর ছাপিয়ে মনের নরমে যে ক্ষতচিহ্ন তৈরি করে তার নিরাময় কিভাবে সে সম্পর্কেও আমাদের কোনো ধারণা থাকতে পারে না। আমরা বিহ্বল হতে পারি, যা একজন স্বপ্নখোঁড়ের কতটা প্রয়োজন আমি জানি না। শুধুমাত্র কৈশোরোত্তীর্ণ যন্ত্রণার নামাবলি চাপিয়ে একে বোঝানো যাবে না। বিপ্লব ভাবনাটির সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হওয়া প্রতিবিপ্লবী ভাবনাটির (অন্যদের) বিশাল বিস্তার আর আক্রোশ তার দূর-না-হওয়া দাগ রেখে যায় শরীরে মানসে, ভবিতব্য বলে সহজেই আমরা যাকে চিহ্নিত করে ফেলি।

“’৭১র শুরুতে ধরা পড়ে শরীরের আদ্যোপান্ত রূপসী চামউকুন সমেত আমি জেল থেকে বেরিয়ে এলাম ‘৭২র শেষে।” না, খুব দীর্ঘতর হয়নি তোমার জেলবাস। বলা যাবে না, নাজিম হিকমতের মতো—‘এবার জেলখানায় এসে অনেকটা দিন কাটল’। বরং বলা ভালো— মাত্র দু-বছর। অর্থাৎ ৩৬৫x ২= ৬৭০ দিন। মানে, ৬৭০x২৪= ১৬০৮০ ঘণ্টা। না আর এগোতে চাই না। আমি শুধু একজন বিপ্লবী ভাবাদর্শে স্বপ্নাকাঙ্খি এক শুরু-যৌবন তরূণের মুহূর্তগুলো কল্পনা করতে পারি মাত্র, যাতে বাস্তবের ছোঁয়া থাকতেও পারে আবার নাও পারে। আবার সেই তরুণের কাছে, চলমান সময়খণ্ডে একখণ্ড সময়কাল থমকে থাকার মধ্যে ভাবনাকাশে আরও বিস্তৃত পরিসর খুলে একদিকে নতুন চিন্তা-চেতনা অংকুরিত হয়ে সংযোজিত হতে পারে, আবার অন্যদিকে এই চালু চলমানতায় নানা বিচার, তথা নানা প্রশ্ন উঠে পড়তে পারে। আমরা পরে লক্ষ্য করব এই তরুণের মধ্যে দুটোই হয়েছিল।

ভাবতে গেলে পড়তে হবে। প্রশ্ন তুলতে গেলেও পড়তে হবে। “ওই অত অল্প আর ভাসাভাসা জ্ঞানে জীবনের কোনো দরোজাই খুলবে না বুঝতে পারছি। আমাকে পড়তে হবে, ভাবতে হবে, আরো, আরো, আরো।” চারুবাবুর ‘যে যত পড়ে সে তত মুর্খ হয়’ এই আপ্তবাক্য ততটা পাত্তা না দিয়ে ‘মার্কস, লেনিন, ও মাওয়ের গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক লেখাগুলো পড়া দূরে থাক চোখেই দেখেনি জেল-ফেরৎ চমৎকার কিশোর মার্কসবাদীটি’, সে তো তখন গোগ্রাসে পড়বেই এবং না-জানার যন্ত্রণায় ভোগা কিশোর জানার যন্ত্রণায় ভুগবে ততোধিক। ‘৭৩এ যোগাযোগ একইরকম প্রায় বিভ্রান্ত দুই কমরেডের সঙ্গে। পরে একে একে যোগাযোগ হবে বিচ্ছিন্ন অনেকের সঙ্গেই, এবং দেখা যাবে সবার ভাবনাবৃত্তটি প্রায় এক।

ঠিক এখানে এসেই একবার একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক, আমার বাইরে থেকে দেখা, শোনা, চিন্তা-চেতনায় ঘা-মারা ঘটনাগুলোর সামান্যকিছু, যা আমাদের মতো কিশোর বা তরুণদের, জানি না ‘সো-কলড’ বলব কিনা, যন্ত্রণাসহ একধরণের দহনে পৃক্ত হওয়া। ইতিমধ্যেই জেনে গেছি, স্কুলের দেয়ালে আলকাতরার ছোপ টেনেছিল পন্তুদা, সঙ্গি কালু। প্রত্যন্ত না হলেও সে ছিল এক অভাব পীড়িত ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের জেলা শহর ঘেঁষা নির্বিবাদী নিরীহ গ্রাম। সেখানেও চার্জড হয়েছিল তারা বুঝে বা না-বুঝে। ’৭০-এই জেনেছি পন্তুদা কলকাতায় এক এনকাউন্টারে কারো বাড়ির টালির চালে পুলিশের রাইফেলের গুলিতে নিহত হয়েছে। হা পন্তুদা, বাবা-মার একমাত্র সন্তান, আমার মেজদার ক্লোজ বন্ধু, বেশি কথা না-বলা অনেকটাই মিনমিনে, খুব বেশি মেশামেশি না-করা তাজা প্রথম যৌবন হারালো তার বাকিটুকু, অধরাটুকু। পাড়ার মনখারাপ, মেজদা অসম্ভব চুপচাপ, আমি কেন আড়ালে কেঁদেছিলাম? হৃদয় কেঁদেছিল বলে? তাঁকে শহীদ ভেবেছিলাম বলে? জানি না, জানি না। আজও জানি না। কিন্তু পন্তুদার মুখটা আজও তো অনেক অনুষঙ্গে মনে পড়ে, যেমন এখন, এই বইয়ের কল্যানে। ’৭১। তুমি তখন জেলে। আমি বসেছি হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায়, সিট পড়েছে শহরের আই-সি-আই স্কুলে, প্রায় সবাই বই দেখে টুকছে, হতভম্ব আমরা হাতে গোনা ক-জনের দরকার পড়ছে না, গার্ড দিচ্ছে স্কুল-পাড়ারই কোনো যুবক, হঠাৎ স্কুল চত্বরেই তীব্র আওয়াজ, সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়া, ধোঁয়া ঢুকছে ঘরে, নিশ্চয়ই বোমা ফাটল, পরীক্ষা নষ্টের চেষ্টা, কেঁপে ওঠা বুক, আর চোখে ধোঁয়ার ঝাঁজ, নিমেষে দেখলাম যে গার্ড দিচ্ছিল, সে হলে নেই, কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশের গাড়ি, হুইসল, আরও সব। দেখলাম গার্ড-যুবকটি ফিরে এসেছে, চোখ লাল জবা, হঠাৎ, হঠাৎই আমার মনে হলো এই গার্ড-দাদাটাই বাইরে বেরিয়ে বোম চার্জ করে আসেনি তো! কেন এমন ধারণা মনে তাঁবু ফেলেছিল তা জানি না। রহস্যময় ধারণা। সে বছরই পরীক্ষা শেষে যাব মোগলসরাইয়ে দিদির বাড়ি। কাশিমবাজার থেকে ট্রেনে কলকাতা, সেখানে এক রাত মানিকতলা অঞ্চলে আরেক দিদির বাড়ি থেকে, পরদিন মোগলসরাই উদ্দেশ্যে। আমার প্রথম কলকাতা দর্শন। তাকে একটু তোল্লা দিতে সন্ধ্যায় মোগলসরাই-জামাইবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়া গেল, হাঁটতে হাঁটতে, কিছুটা ঘুরে যখন ফিরব, হঠাৎই বৃষ্টি, দৌড়ে দুজনেই কাছাকাছি এক বড় বিল্ডিং-এর হলঘর মতো একটা জায়গায় আর অনেকের সঙ্গে আশ্রয় নেওয়া। বুঝলাম এটা কলেজ, নাম সিটি কলেজ বা বিদ্যাসাগর কলেজ। ভাবলাম, আমাকেও এর পর থেকে কলেজে পড়তে হবে। বৃষ্টি দেখছি, আর দাঁড়িয়ে আছি আরও অনেকের মতো। জামাইবাবু এদিক-সেদিক ঘুরছে, নোটিসবোর্ড পড়ছে। হঠাৎই এক দাদা, কলেজেরই ছাত্র অনুমান, মোটাসোটা, আমার জামার ওপরের বোতামদুটো খিচড়ে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল এক দঙ্গল সদ্যযুবকের মাঝখানে। (একটা আবক্ষ স্ট্যাচু ছিল, হতে পারে বিদ্যাসাগরের) কিছু বোঝার আগেই ঘটে যাওয়া ঘটনায় আমি অবাক, হতভম্ব, এবং ভয় পেয়েছি। একজন— এই যে কোথায় থাকা হয়? আমি— কাশিমবাজারে। আরেকজন— কচিটি, পোঙায় পাইপগান ঠেকালে ঠিক বেরিয়ে যাবে কাশিমবাজার না কাশিপুর। আমি— না না, কাশিমবাজারেই বাড়ি, এখানে কল… প্রথমজন— কী করা হয়? আমি—(গলা শুকনো কাঠ) হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়েছি। বেড়াতে যাচ্ছি। প্রথমজন— কোথায়? আমি— মোগলসরাই, দিদির বাড়ি। আরেকজন— তবে এ তল্লাটে কেন বে? মালটা সুবিধের মনে হচ্ছে না …দা। মিনমিনে। আরেক আরেকজন— দাও ঠেঙানিঘরে নিয়ে যাই। বলতে না-বলতেই জামাইবাবুর উদয়, আমার হাতে প্রাণ ফিরে পাওয়া, কিছু কথাবার্তা জামাইবাবুর সঙ্গে, শেষে ছাড়। পড়িমড়ি আমাদের স্থানত্যাগ। রাতে কলকাতার জামাইবাবু গোটাটা শুনে— ‘জোর বাঁচা গেছে। এ হলো এলাকা দখলের লড়াই। ভেবেছে কাশিপুর। একটু এদিক-ওদিক হলেই হয়তো সন্দেহের জেরে ওরা হাপিস করে দিত। এসবই চলছে এখন কলকাতায়। মানুষ গুম হচ্ছে।’ রাতে শুয়ে ভেবে আরেকবার ভয় পেলাম ঠিকই, কিন্তু ওদের ঘৃণা করতে পারলাম না। কেন যে!

১৯৭২ সালের জুলাই আগস্ট। পড়ি কে-এন-কলেজ, সাম্মানিক, পদার্থবিদ্যা বিভাগ। পার্ট ওয়ানের প্রথম বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। চার-পাঁচদিন বাকি। একদিন সকালে উঠে শোনা গেল খাগড়া অঞ্চলের কুঞ্জঘাটা পুলিশফাঁড়ির কাছে দুজন কনস্টেবলের মুণ্ড বিচ্ছিন্ন ধড় পাওয়া গেছে। রাইফেল আর থ্রি-নট-থ্রি নিয়ে কেউ বা কারা উধাও। অঞ্চলে চলছে চিরুনি তল্লাসী, ধরপাকড় হচ্ছে নির্বিচারে। প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু হওয়া বহরমপুরে এ এক নতুন সংযোজন। হঠাৎ বিকেলের দিকে দীপক (বন্ধু, একই ইয়ারে কলেজে পড়ি) আমাদের মণীন্দ্রনগরস্থ বাড়িতে এসে হাজির। কী ব্যাপার! ব্যাপার গুরুতর। ওর বাড়ি ওই কুঞ্জঘাটা পুলিশফাঁড়ির কাছেই। পাড়ায় প্রতিটি বাড়ি ঢুঁরে ফেলছে সি-আর-পি-এফ। ইয়ং বয়সী যাকে পাচ্ছে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, আর থানায় নিয়ে উলটো ঝুলিয়ে মার, আর অত্যাচার। দীপক কোনোক্রমে পালিয়ে এসেছে, এখন কটা দিন এখানেই থাকতে চায়, আর পরীক্ষাটা দিতে চায়। বাবা রাজি হয়ে গেলেন। দীপক প্রায় টানা সাতদিন আমাদের আম-জাম-লিচুগাছ ঘেরা বাড়িতে চুপটি করে থেকে গিয়েছিল। বলা যায় পালিয়ে বেঁচেছিল। ’৭৩ এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি হবে। কলেজের পাশেই ‘বহরমপুর সেন্ট্রাল জেল’। পদার্থবিদ্যা ভবনের ওপর তলাতেই কলেজ-লাইব্রেরি। সামনে ঘেরা অনেকটা ফাঁকা জায়গা। লাইব্রেরি যাতায়াতের পথে রাস্তার ওপাশে জেলের উঁচু পাচিল টপকে ভেতরের কিছু অংশ দেখা যেত। আমরা মাঝেমধ্যে নজর করতাম। একদিন হঠাৎ দুপুরে বেজে উঠল প্রথমে টানা সাইরেন, পরে যোগ হলো পাগলাঘন্টি। কিছু গুলির আওয়াজ। অনেকেই ছুটে উঠে এল লাইব্রেরির সামনের ফাঁকাটায়। কিছু নানা ধরণের শব্দ ছাড়া কিছুই দেখা গেল না। পাগলাঘন্টির মধ্যে বিপদের চিহ্নগুলো রয়ে গেল। পরে জেলখানা থেকে লাশ পাচারের গপ্পো চাউর হয়ে গেল। পালানোর নামে দু-চারজনের মৃত্যুর কথা সরকারি মত, বেসরকারি মতে সারি সারি লাশ। সে লাশ যে নকশালপন্থীদের তা বলে দেবার আর প্রয়োজন ছিল না। রাতে ভাত খেতে পারিনি। কাউকে কিছু বলতেও পারিনি। পরের দিন কলেজেও যাইনি, তন্ন তন্ন করে খবরের কাগজে খুঁজেছি। না, কিচ্ছু পাওয়া যায়নি। হা রাষ্ট্রব্যবস্থা!

এসব আমি কেন বলছি তোমাকে আজ। কোথাও কোথাও টুকরো-টাকরা লিখেছি, তা ঠিক। কিন্তু তোমাকে শোনাচ্ছি কেন, আমি নিজে তা জানি না। তবে কি এই বইটা আমার অনেক অর্গল খুলে দিল? হতে পারে। হতে পারে বাইরে থেকে দেখা-শোনা-বোঝাটা তোমার সঙ্গে কিছুটা শেয়ার করে নেওয়ার ইচ্ছে। আবার এও হতে পারে সেই বয়সেই স্বপ্নটার প্রতি একটা টান অনুভব করতাম। কিন্তু অনেক কারণেই (ব্যক্তি-ভাবনার তফাৎ, সামাজিক চিন্তার বিরোধী দিক, পারিবারিক সমীকরণ, ভয়, দ্বিধা, অন্যের চেয়ে নিজেকে অধিক ভালোবাসা ইত্যাদি) স্বপ্নটা (আমূল বদলের) সেভাবে লালন-পালন করতে পারতাম না, পারিনি।

ফিরি। “কানুদারা হাত ধুয়ে ফেললেন” এই শিরোনামেই পরিস্কার হয়ে ওঠে তুমি যে দলে ছিলে ’৭৪ এ এসে সেখানে মত ও চিন্তার ফারাক ও ফাটল ধরেছে। তোমরা যখন উঃবঙ্গে গ্রামে শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জনা পনের কমরেড, পুলিশের তাড়া বাঁচিয়ে একত্রিত হচ্ছ, তখন একটা চিঠি (খোকনদাকে লেখা কানু সান্যালের চিঠি) যে বার্তা নিয়ে এল, তা মৃত সর্বাধিনায়কের ওপর এক অনাস্থারই সামিল। আশু কর্তব্যের কথার চেয়ে দলের তাবৎ সিদ্ধান্তের প্রতি, যার শরিক তিনি নিজেও ছিলেন, সন্দেহ, ভিন্নমত, এমনকি বিরোধিতাই প্রধান হয়ে উঠল, যা তোমাদের যতটা না ভাবালো তারও চেয়ে বেশি, অবাক, আশাহত ও উদভ্রান্ত করল। কিন্তু তোমরা দমলে না। পার্টি পুনর্গঠন, তার আশু কর্মসূচী আর গঠনতন্ত্র বড়ো জরুরি হয়ে পড়ল। রাষ্ট্রের পীড়নশক্তিকে সহ্য করে কোনোক্রমে নানাকারণে যারা জেল বা হাজতের বাইরে আছে এ-তো তাদেরই কাজ। উঃ বঙ্গ আঞ্চলিক কমিটি গঠন যদি প্রাথমিক কাজ হয়ে থাকে, আর যদি সেখানে সিদ্ধান্ত হয় ‘যুযুধান বড় গোষ্ঠীগুলিতে যোগ দেব না’, তাহলে পূর্বোক্ত কাজটি আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়ে। তুমি ও আরেকজন এই কাজের দায়িত্ব পাও। তোমরা কৃষিভিত্তিক গ্রামীন অবস্থান থেকে উঠে আসা কর্মী, শহর তথা শিল্পাঞ্চলে কাজ করা কর্মীদের সঙ্গে একত্রে কাজ করলে তা একটা বিশেষ মাত্রা পেতে পারে। তাই তোমাদের সিদ্ধান্ত সেই মোতাবেকই হয়। দায়িত্ব পেয়ে তুমি ও বাবুন চললে কলকাতা, যখন দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়ে গেছে। তিন মাসে বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি, ভাবনা-চিন্তার মিথস্ক্রিয়ায়, তর্ক-বিতর্ক, অভিজ্ঞতার শেয়ারিং ইত্যাদির মাধ্যমে ‘আমরা রচনা করলাম ভারতীয় বিপ্লবের নতুন খসড়া কর্মসূচী ও পার্টির গঠনতন্ত্র একখানা।’ ফিরে এলে স্বপ্নের সুর্মা লাগিয়ে চোখে। কিন্তু দেখলে ধাঁধস। একি! এই তিনমাসে গোটা উঃবঙ্গ আঞ্চলিক কমিটিটাই যে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে ‘সত্যনারায়ণ সিং পরিচালিত অগস্ত্যপন্থী পিসিসি সিপিআই (এম-এল) গোষ্ঠীর পেটের ভিতর’। বা উলটে বড়ো সাপ হয়ে তারা গিলে নিয়েছে ছোট সাপকে ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা’র নামে। হতাশ হয়েছিলে নিশ্চয়ই। এই অন্তর্ভূক্তির সিদ্ধান্ত প্রথমত তোমাদের পূর্ব সিদ্ধান্তের একদম বিপরীত, দ্বিতীয়ত তোমাদের মত প্রকাশ ব্যতিরেকেই। তিনমাস যারা তোমাদের সঙ্গে সমানতালে শ্রম করলেন, ঘাম ঝরালেন, জানালো হলো না তাদেরও। কেউ ছুঁয়েও দেখল না ঘাম রক্তে ভেজা এক গোছা কাগজকে। সোনার পাথর বাটির ক্ষমতা এহেন অপরিসীম। অগত্যা, “এখনতো কত লেখা লিখে ছিঁড়ে ফেলি ধ্যুস, বাল কিৎসু হয়নি বলে। তবে এগুলো ছিঁড়ি নিজেরই আজ্ঞায়, সে সময় ছিঁড়েছিলাম কেন্দ্রিকতার নির্দেশে।’ রাগ, দুঃখ, অভিমান হয়েছিল নিশ্চয়ই। যাকে আমি যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানো বলে চিহ্নিত করব। একে জরুরি অবস্থা, তায় ছিন্নভিন্ন নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা বিপ্লবী দল, তায় পরস্পর যুযুধানে ব্যস্ত নতুন তৈরি হওয়া গোষ্ঠীগুলি, তায় পরিচিত কমরেডদের একে একে হয় রোগ-আক্রমণ, নয় মৃত্যু, নয় প্রবল আত্মগোপন। এভাবেই তুমি আরও একলা হতে থাকো।

’৭৩ থেকে ৭৬ তোমার জীবনে এমন এক অধ্যায় যেখানে তুমি খুঁজে পেয়েছ এমন কিছু বন্ধু, যারা তথাকথিত সমাজব্যবস্থায় ‘হিন্দি সিনেমার নায়ক, ভিলেন-বধী’, ‘স্কুলের পড়ার পাট চুকিয়ে দেওয়া’, ‘ধর্মের ষাঁড়’, ‘সিনেমা হলে টিকিট ব্ল্যাক মুখ্য জীবিকা’, ‘মারপিট চুরিচামারিও ছোটখাট’। এক কথায় ‘অসভ্য’। একটু ফিরে দেখেছ শৈশব কবি সান্নিধ্যে—‘স্কুল পালিয়ে সিনেমা’, ‘ন্যাংটা হয়ে উত্তাল তোরসায় ঝাঁপানো’, ‘চুরি করা নৌকায় বা ভেলায় স্রোতের অনুকূলে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া’, ‘লোকের বাগান ফাঁক করা’ ইত্যাদি। এসব সহায়ক হয়েছিল ওই বন্ধুদের সঙ্গে মিশে যাওয়ায়।  যাদের সঙ্গে শিখেছিলে ‘গাঁজার কল্কিতে শিবনেত্র হওয়া’, পেয়েছিলে ‘সস্তা মদের স্বাদ, ও গন্ধ’, বা ‘তাড়ি খাওয়ার প্রকৃত হুল্লোড়’, শিখেছিলে ‘খিস্তির স্বাদ, গন্ধ, মজা’ অর্থাৎ ‘সভ্যদের গুহ্যদ্বার সদৃশ মুখ’ থেকে ভিন্ন ও আলাদা। ওরা নষ্ট ছিল, কিন্তু নিজেদের কাছে ছিল সৎ। অকপটে স্বীকার করেছ এরাই তোমাকে টানত। তুমি ‘জেলখানাতেও মিশেছি খুনী, চোর, ডাকাত, লম্পটদের সঙ্গে।’ তোমার একটা বিশ্বাস ছিল— ‘অপরাধীদের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাওয়াদের মধ্যেই বিশ্বের সেরা সৌন্দর্যটি সৃষ্টি হতে পারে।’ জীবনের এই পিঠের পাঠ না থাকলে প্রকৃত জীবনের আকাঙ্খা জাগতে পারে না। ‘পুলিশের ভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে আমার এইসব বন্ধুরাই আমাকে সঙ্গ দিয়েছিল’। কারণ, ‘পুরানো অনেক কমরেড ঘুরেও দেখত না আমাকে পাছে মধ্যরাতে তাদের গৃহেও কড়া নড়ে ওঠে’। এভাবেই তোমার জীবনে ধরা পড়েছে ‘বন্ধু’ আর ‘কমরেড’ এই শব্দ দুটির ভাবনাগত আর প্রকৃত অবস্থানের রূপটি। এই বন্ধুদেরই কেউ কেউ যখন হারিয়ে যায়, মারা যায় তখন তুমি আরও একা হয়ে পড়।

আর আমি? ৭১ এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। গণহত্যা, গণকবর। রাজাকার। মৃত্যু। মুক্তিযোদ্ধা। ভারত রাষ্ট্রের যোগদান। যুদ্ধ। বাড়ির পাশেই এম-আই-টি তে সেনা-ছাউনি, রাত ভেদ করে কলাইকুণ্ডা থেকে উড়ে যাওয়া যুদ্ধবিমান, ঠিক যেন ছাতের উপর দিয়ে। উপচে পড়া উদ্বাস্তু। পথে নেমে পড়া বন্ধুদের সঙ্গে, অত্যাচারিত পীড়িতদের জন্য স্কোয়াড করে সাহায্য সংগ্রহ। সাহায্য পাঠানো, অবশ্যই স্থানীয় নেতার মাধ্যমে। আজও জানি না সেই সাহায্য আদৌ পৌঁছেছিল তো আঘাতপ্রাপ্তদের কাছে? নিয়াজির আত্মসমর্পণ। স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। এদিকেও একদিকে গণহত্যা, গণকবর, অন্যদিকে ব্যক্তিহত্যা, শুনলাম প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয়েছে কনকবাবুকে (মাষ্টারমশাই, সি-পি-এম), শুনলাম হত্যা করা হয়েছে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে (মুর্শিদাবাদে সি-পি-এম প্রতিষ্ঠাকারীদের একজন, শিক্ষক নেতা), জানলাম, আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রভাত চৌধুরীকে (সি-পি-এম নেতা) ফতোয়া দেওয়া হয়েছে, জান বাঁচাতে তিনি সপরিবারে আমাদের গ্রামে। প্রতিদিন মূর্তি ভাঙার আর কালি লেপার খবর পাচ্ছি, কিছু দেখতেও পাচ্ছি নিজে। কেউ বাদ যাচ্ছেন না। মাঝেমধ্যে গুমখুন।  ’৭২-এ রাজ্যে নির্বাচন। উপলক্ষ্য মাত্র। সিদ্ধার্থশংকর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার গদিতে। কোথা থেকে কী হয়ে গেল। জন্ম নিল কংশাল বলে এক মাস্তান গ্রুপ। চলল অত্যাচার। সব মিলেমিশে একাকার। চেনা যাচ্ছে না কিছুই। বোঝাও যাচ্ছে না। ’৭৪-এ বিকেলে মাঠে ভলিবল খেলা শেষে (তখন কে-এন-কলেজ ফেরত শহরেরই আরেক প্রান্তে রুপালি সংঘের মাঠে ভলিবল খেলতাম)  এক সন্ধ্যায় আধো-অন্ধকারে জগদম্বার গলিতে বিশ্রামরত আমাদের কিছুটা দূরেই দেখলাম একজনের হাতের চকচকে বড়ো ড্যাগার পরপর নেমে আসছে আরেকজনের বুকে পেটে পেলভিসে। চোখকে বিশ্বাস করতেই হলো। উন্মুক্ত ড্যাগার নিয়ে লোকটা ছুটে যাচ্ছে নদীর দিকে। আমরা লাশ, আর্তনাদ, লোক জমতে থাকা সমস্তকিছু উপেক্ষা করে প্রমোদদার তাড়ায় সাইকেল নিয়ে ঘরমুখো। রাতে বমি, জল চা আর বিস্কুট, যা খেয়েছিলাম খেলা শেষে। মৃত্যু হত্যা মৃত্যু। ’৭৫ এ জরুরি অবস্থা। নেমে এল করাল আঘাত। কলেজের প্রফেসর দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করে চলল মানসিক ও শারিরীক অত্যাচার আরেক প্রফেসর শক্তিনাথ ঝাঁ এর পেছনে পড়ে থাকল পুলিশ। মুর্শিদাবাদে সি-পি-এম ভাঙল। গোপনে প্রভাত চৌধুরী, প্রাণরঞ্জন চৌধুরী, জেরাত আলি রা গড়লেন ‘মার্কসবাদী কর্মী সংস্থা’। মিটিং, মিছিল, এমনকি আড্ডা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হলো বিতর্কসভা, সেমিনার, অপুর্বকল্পিত ভাষন, এসবে আমি অংশগ্রহণ করতাম। জরুরি অবস্থার ঢক্কানিনাদ— সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে, ট্রেন-বাস চলছে সময়ে, অফিস-কাছারি চলছে নিরুপদ্রবে, দেশ এগিয়ে চলেছে। দেশ তো এগিয়েই চলেছে, কিন্তু আমাদের বি-এস-সির ফাইন্যাল পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ’৭৪ এর জুলাইয়ে, হলো ‘৭৫ এর আগস্টে, রেজাল্ট বেরোলো ’৭৬ এর জুনে। স্রেফ দুটো বছর আমাদের জীবন থেকে খসে পড়ল। পড়ুকগে। কী হবে দুটো বছর দিয়ে? আবার ফিরি তোমার কথায়।       

’৭৭ এল জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। ক্ষমতার হস্তান্তর হলো দেশে ও রাজ্যে। আর তুমি কি করছিলে তখন? নানা আঘাত অপমান সহ্য করে, অতৃপ্তি বাড়াকে ততটা পাত্তা না দিয়ে নির্বাচন-পূর্বে নতুন ভূমিকায়। ‘মঞ্চের ওপরে; জনসভাগুলিতে। কামুক মাইক্রোফোনের সামনে সত্যনারায়ণ সিং, সন্তোষ রানা, ভাস্কর নন্দীদের সঙ্গে পরিপাট দাঁড়ানো এই উঃ বাংলার বহু গ্রাম, গঞ্জ ও শহরে, গাইছি উদ্বোধনী সঙ্গীতের মত প্রাণপণ হাঁটু কাঁপানো বক্তৃতা।’ কিন্তু অতৃপ্তি চরমে, সার বোঝাও শেষ পর্বে। ‘বুঝতে পারছি এই নির্বোধ রাজনীতির পথ আমার নয়। আমাকে হাঁটতে হবে কবির সঙ্গে।’ অংকুরিত ভাবনা পূর্ণতা পেল। ‘আমি দীর্ঘদিনের নানা সুখ-দুঃখের সাথিদের ছেড়ে চলে এলাম ৮২-তে।’ হয়তো বুকফাটা কষ্টের মধ্যে, যন্ত্রণার মধ্যে। কিন্তু তোমার মধ্যে জেগে উঠেছে আরেকটি সত্ত্বা, তাকে তুমি এড়াবে কীভাবে?

এই পর্যন্তই তোমার আত্মকথন এই বইয়ে। বাকিটা তোমার চিন্তা-চেতনা, ভাব-ভাবনা, আত্মদর্শন থেকে আত্মপোলব্ধির কথা, তোমার কবিতাযাত্রার কথা। এসব আগেও মিশে ছিল প্রতিটি অধ্যায়ে আত্মকথনের ফাঁকে ফাঁকে। না, ভুল বললাম। আত্মকথনই এসেছে ফাঁকে ফাঁকে, ছেঁড়া-খোড়া, টুকরো-টাকরা, গ্যাপ রেখে, কোথাও অসমাপ্ত রেখে। সেইসব অধ্যায়েও দর্শন, কবিতা, আত্মজিজ্ঞাসা আর আত্মপোলব্ধির জাবেদা নয়, দলিল সম্বলিত হয়েছে। যা নিয়ে আমি একটু পরেই ঢুকব অন্দর পর্যন্ত যতটা আমার কুলোয়। দেখলে তো তোমার আত্মকথনের মধ্যে মাঝে মধ্যেই আমি কেমন গুঁজে দিলাম আত্মদর্শন (দেখা)! কোনো দর্শন (অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান) বা বোধানুভূতিকে ব্যক্ত না করেই। কেন এসব এল, তা আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এটা এই বইয়ের গুণ। বলিয়ে নেয়, ফিরে দেখায়, ফিরে ভাবায় অন্তত আমাদের বয়সীদের। আর এই যে তোমার নিজের কথা টুকরো করে বলা, ছেড়ে ছেড়ে বলা, সামান্যই বলা, এতে প্রাণবন্ত হয়েছে চলনটা, পাঠক স্পেস পেয়েছে তোমার সেইসময়ের ভাবনাচিন্তা আর পরবর্তীকালের ভাবনাচিন্তা, যা অনেকটাই জড়িয়ে-মড়িয়ে রয়েছে, নিয়ে নিজে কিছুটা ভাবতে আর নিজের মতো করে মিলিয়ে নিতে। সাবাশ।

কবিতা-জীবন-বোধ-বোধোদয়-দর্শন এইসব

মানুষ মানেই চিন্তা-ভাবনার খনি, যতক্ষণ সে ক্রিয়াশীল থাকে, যতক্ষণ ভবিষ্যত আর সম্ভাবনা তাকে দোলায়, যতক্ষণ স্বপ্ন (জেগে) তার কাজলটুকু শুকিয়ে না ফেলে। এই বইয়ে আত্মকথনের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে জড়িয়ে আছে তোমার নানা অনুসন্ধিৎসা তথা প্রশ্ন, মিশেছে তোমার পাঠের অনেক কবির বোধ ও চেতনা, একদম অঙ্গাঙ্গি হয়েছে পৃথিবীর নানা দার্শনিক ও ভুয়োদর্শীর ভাবনানির্যাস, তুমি মিলিয়ে নিয়েছ তোমাকে, আর আঘাতে সংঘাতে মিথস্ক্রিয়ায় লব্ধ অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে তুলে ধরেছ আত্মোপলব্ধির ও অনুভূতির কথা। বস্তুত, অভিজ্ঞতার নির্যাস হচ্ছে জ্ঞান। আমি এখানে জ্ঞান শব্দটি এড়িয়ে গেলাম। বরং দার্শনিকতাই বলব। কবিতার সঙ্গে দর্শনের আড়াআড়ি না সমান্তরাল সম্পর্ক, তা নিয়ে এখানে আমি বিতর্কে যাব না। আমি শুধু বলব, এই বইয়ে তোমার চিন্তা-চেতনা প্রসারের ক্ষেত্রে কবিতার ভূমিকা এবং দর্শনের ভূমিকা ব্যবচ্ছেদে থাকেনি, মিলেমিশে একাকার হয়েছে। একে আমি একধরণের মুন্সিয়ানা বলেই বিবেচনা করি।

কবিতার ক্ষেত্রে কবি জীবনানন্দ তোমার প্রথম প্রেম, যে তোমাকে শিখিয়েছিল—‘মাথার ভিতরে/ স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।’ স্বপ্ন তোমার ছিল, বিপ্লবের স্বপ্ন। এখনও আছে, হয়তো অন্যভাবে। স্বপ্নছাড়া সৃষ্টিশীল মানুষ নিরেট হয়। প্রেম তোমার ছিল, নিপীড়িত-শোষিত মানুষের জন্য, কমরেডের জন্য। প্রেম আজও আছে, হয়তো ভিন্ন মাত্রায় ভিন্ন ভাবনায়। প্রেমহীন মানুষ ব্রুট হয়। তবু এটুকুই তোমার আত্মোপলব্ধি এসব মুখ্য নয়, মুখ্য হলো বোধ, যা তার চালিকা শক্তি, বোধ কাজ না করলে ভাবনার প্রসার ঘটে না, নিজেকে জানা হয় না, চেনা হয় না নিজের প্রেক্ষিতে জগৎকে। আর এই বোধকে অন্তরে গভীরভাবে স্থান দিতে গেলে, মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে সঞ্চারিত করতে গেলে প্রয়োজন নিজের প্রাণ, তথা অস্তিত্বের কাছে প্রণত হওয়া। তাই তুমি উদ্ধৃত কর— ‘আমি সব দেবতারে ছেড়ে/ আমার প্রাণের কাছে চলে আসি’। এই প্রাণের কাছে আসতে পারা যে কী অসাধারণ এক অনুভব, যে যেতে না পারে সে বোঝে না। তোমার জন্মান্তর পরবর্তী অনুভব এটা। ১৮ পৃষ্ঠায় যেখানে জীবনানন্দকে উদ্ধৃত করেছ, সেখানে লিখছ, “জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটিকে যে পাঠক খুব ভিতর থেকে ধরতে চেষ্টা করেন তার বোধে এই সত্য ধরা না দিয়ে পারে না যেঃ” এরপর উদ্ধৃত করছ “যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি………… এইসব ভয়াবহ আরতি।” এখানে তোমার একটা সামান্য প্রমাদ ঘটেছে। এই কবিতাংশটি জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের ‘অন্ধকার’ কবিতার। এর আগে এক লাইনের যে উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করেছ, সেটাও এই ‘অন্ধকার’ কবিতা থেকেই। আবার এই উদ্ধৃতিটির পরে (যেটা আমি উল্লেখ করলাম) যে তিনটে উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছ, যথাক্রমে ‘তবুও ত পেঁচা…… মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে’, ‘রক্ত ক্লেদ বসা…… উড়ে যায় মাঝি’ এবং ‘ঘনিষ্ট আকাশ যেন………… সাথে লড়িয়াছে;’ ইত্যাদি, এগুলি সবই কবির ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার অন্তর্গত। আসলে আমার চোখে হঠাৎ লাগল কেন? কেননা এ দুটো কবিতাই আমি কৈশোরে ও প্রথম যৌবনে বারবার আবৃত্তি করেছি। যাক এতে বেদ অশুদ্ধ হয়ে যায় নি, বা তোমার অনুভবের ও ভাবনার জায়গাটাও বদলে যায়নি। কথা হচ্ছে, বাংলাভাষায় প্রথম সাররিয়ালিস্ট কবি জীবনান্দের কবিতায় জেগে ওঠে– প্রাণ ও জ়ীবন সম্পর্কিত এক বিস্ময়বোধ, জীবনরঙ্গমঞ্চের বিপন্নতা, সমাজের কলুষ কালো অন্ধকারদিকের ভয়াভয়তা, বাঁচার অস্থিরতার মধ্যে মৃত্যুচেতনা, সমগ্র মানবজাতির গভীরতম অসুখের মধ্যে আত্মমুক্তির নিরাময় খোঁজার বেদনা ও বিষণ্ণতা, ইতিহাস চেতনার সঙ্গে অন্তর্লীন হয়ে থাকা রাজনৈতিক চেতনার কথা। এতে তো তুমি মজবেই, একাত্ম হবেই। তুমি শুনেছ কোটি কোটি শুয়রের আর্তনাদ, তুমি দেখেছ শুকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর, তোমারই চোখের সামনে ঘটে গেছে সব ভয়াভয় আরতি। তুমি খুব ভোর থেকেই স্পন্দনে ছিলে, গতিতে ছিলে, উদ্যম-চিন্তা-কাজে ছিলে, আর ছিলে সংঘর্ষে আর সংসর্গে। তারপর সমস্ত অবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করে, নিজের উদ্যম স্বপ্ন আর কাজকে বিশ্লেষণ ও বিচার করার মতো মানসিকতা জাগার একটু ফুরসত পেয়ে, (সৃষ্টিশীলেরা সাধারনত একবগ্‌গা হয় না। বারবার নিজেকে তুলাদণ্ডে বসায়) দেখলে নিজে আত্মত্যাগী অথচ আত্মদগ্ধ, বুঝলে সৃষ্ট ক্ষতের দায় তোমার নিজেরও কম নয়, জানলে যে বিশাল পাথরটা নড়াতে চেয়েছিলে তা নড়েনি, অথচ রেখে গেছে বিষণ্ণতা, মনে প্রশ্ন জেগেছে, তবে কি তুমি ও তোমার বিপ্লবী দল খুব তাড়াহুড়ায় হঠাৎ জেগে উঠে মুর্খ পৃথিবীকে দেখেছিলে? ধীরে ধীরে জাগোনি বা জাগেনি? আত্মস্থতা নয় হঠকারিতা? নিরাময় খুঁজছিলে, দগ্ধতার নিরাময়, ক্ষতের নিরাময়, বিষণ্ণতার নিরামায়। কিন্তু জেনেছ, নিরাময় হয় না, তখন বোধে জেগেছে— ‘অস্তিত্বের মূলে যে গাঢ় অন্ধকার তাকে অতিক্রম করা যাবে না জেনেও একটি কম্পমান শিখা জ্বালিয়ে রাখতে হবে তাকে নিজের সাড়ে তিনহাত জীবনের মধ্যে কোনখানে ওই অন্ধকারের স্বরূপকে আরো স্পষ্ট করে বুঝবার জন্য; তাকে যাত্রিক হতে হবে।’ অবশ্যই যে যাত্রা অন্তহীন। কবিতা নিরাময় খোঁজার চেষ্টা করে, পারে না। কিন্তু কবিতা আবিষ্কারের প্রলেপ দিতে পারে, যা তোমার তখন খুব প্রয়োজন ছিল।

আন্তোনিও জাসিনটোর কবিতানুবাদ এনেছ। অ্যাঙ্গোলান এই কবি ও রাজনীতিবিদের কবিতা তুমি নিশ্চয়ই ১৬-২৫ পড়োনি (আমার অনুমান), হয়তো পরে পড়েছ। কিন্তু যে প্রয়োগটি এখানে ঘটিয়েছ তা একদিকে সে-সময়ের প্রেক্ষিতে যেমন মানানসই, পরবর্তীকালে তোমার দুখঃ-বেদনায় হতাশায় এইসব পঙক্তি সেই সময়ের কাজকে যে সমর্থন দেয়, তা সামান্য হলেও নিরাময়ের প্রলেপ। আমার তো এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে আমেরিকান কবি ল্যাঙস্টন হিউজের কথা, যিনিও শুধু কবি ছিলেন না, ছিলেন সোস্যাল একটিভিস্ট। একাধারে এইসব কবি যে দ্বৈত্ব সত্ত্বার অধিকারি ছিলেন, তাঁরা প্রথম যৌবনটাকে জাগিয়ে দিতে পারেন। স্বপ্ন, যার সুর্মা লাগিয়েছিলে চোখে, স্বপ্ন, যার সন্ধান ছিল আমূল বদলে, যতই ভেঙে পড়ুক বা অসম্পূর্ণ থাকুক, সে তো মিথ্যে ছিল না। সেদিনও যেমন সত্য ছিল আজও তেমনই সত্য। পার্থক্য টাইম এণ্ড স্পেসে। তরিকায়, এবং ভাবনাগত কিছু অবস্থানের। তাই হিউজের ড্রিমস তাঁর সময়েও যেমন সত্য, তোমার স্বপ্ন আঁকা চোখের জন্যও সত্য, আবার সুর্মা ল্যাপটানো এই সময়েও সত্য। “Hold fast to dreams/ For if dreams die/ Life is a broken-winged bird/ That cannot fly./ #/ Hold fast to dreams/ For when dreams go/ life is a barren field/ Frozen with snow.”

প্রথমদিকে আর শেষদিকে বারবার এনেছ জ্যঁ নিকোলা আর্তুর র‍্যাঁবোর কবিতার কথা। ইনিও ফরাসি দেশের সৈনিক কবি। তাঁর জীবনের করুণ অথচ মহিমময় কথা বেশ কিছুটা তুলে ধরেছ তুমি। বেশ কয়েকবার উদ্ধৃত করেছ তাঁকে। বারবার উল্লেখ করেছ ‘দ্রষ্টা র‍্যাঁবো’ শব্দটি। সেখান থেকে একটা বোধে নিজেকে উত্তরিতও করেছ। “আদিম বর্বরতায় পৌঁছতে হবে সত্তার আদিম পবিত্রতাকে সেখান থেকে তুলে আনবার জন্য; দেখতে হবে আদিম বর্বরতার উৎসটিকে; সেখানেই ভাঙতে হবে তাকে”। বড়ো গভীরে ডুব দিতে পেরেছ। মার্কসের ‘ক্যাপিটাল’ প্রসঙ্গে একবার তুমি শার্ল বোদলেয়ারকেও এনেছ। মাত্র ৪৬ বছর বেঁচে থাকা ফ্রান্সের এই কবি বিশ্বসাহিত্যে প্রতীকীবাদ ও আধুনিকতার মূল স্থপতি। ঠিকই বলেছেন ‘আধুনিক আত্মার পরিত্রাণহীন যাত্রা’ই তাঁর কবিতার মূলে ও আত্মায়। তিনি কবির কবি। অবক্ষয়, প্রেমের প্রতি ঘৃণা, ঈশ্বরনিন্দা ও স্যাটানিক প্রকৃতির কবিতাই তিনি লিখেছেন, শেষদিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন নৈরাশ্যর দিকে। স্বাভাবিকভাবেই আমি বুঝতে পারছি অস্থির তোমাকে, যে খুঁজে ফিরছে কেন এমনটা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে বারেবারে। কেন স্বপ্ন ভাঙে, কেন বিপ্লব আঁতুড় ঘরেই মুখ থুবড়ে পড়ে, কেন বিপ্লব সম্পন্ন হলেও মানুষের স্বাধীনতা মেলে না, মেলে না প্রকৃত মুক্তি।

‘অমৃতের পুত্রদের এইসব (২) অধ্যায়ে যে কবিতাটি (মনেহয় গোটাটাই) তুলে এনেছ, তা আমি আগে কোনোদিন পড়িনি। অন্তত মনে করতে পারছি না। আগে-পরে লেখা দেখে মনে হলো কবিতাটা তোমার লেখা। আমার ভাবনা যদি ভুল না-হয় তাহলে এটুকু বলতে পারি, এক) এ-কবিতায় তোমার পরবর্তী ভাবনাজগতের স্ফুরণ আমি অনুভব করছি। দুই) একদম সাররিয়ালিস্ট চিন্তা-চেতনার কবিতা এটি। তিন) কবি জীবনানন্দ দাশের প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে। মোটামুটি এই গেল কবিতার কথা। কবিতা তোমাকে মোটা থেকে সূক্ষ্ম করেছে। কবিতার কাছে তুমি ঋণী।

আসি দর্শনের কথায়, তার রেফারেন্স, তোমার ভাবনায় তার ভুল-ত্রুটি সত্যতা আর কখনো আত্মবোধে নিজেই দার্শনিক হয়ে যাওয়া। এই কাজটা করা আমার পক্ষে খুবই কঠিন। কতটুকুই বা আমি পড়েছি বা জানি, কিছু পড়লেও, জানলেও কতটা এ-সময় আবার মনে করতে পারব! তবু ছোট্ট একটা চেষ্টা থাক। এখানে বই অনুসারে ধারাবাহিক না হয়ে যাঁদের তুমি তোমার লেখায় তুলে এনেছ, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের সৃষ্টি, কথা, জ্ঞান, চিন্তা-দর্শনের প্রেক্ষিতে তোমার বক্তব্য এবং কখনো কখনো আত্মবোধকে ঝালিয়ে নেওয়া। প্রথমেই কার্ল মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও— নকশালবাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে (যার সঙ্গে তুমি যুক্ত ছিলে ’৬৯ থেকে ৮১-৮২ পর্যন্ত) মার্কসবাদের তাত্ত্বিক দিকটি কতটা প্রত্যক্ষত জড়িয়ে ছিল তা আমি জানি না। কিন্তু তোমার এই বই পড়ে আমি যতটুকু বুঝেছি, তাতে ঘাটতি অনেক ছিল। প্রয়োগের ক্ষেত্রে লেনিনের প্রয়োগপন্থা কতটুকু এর সঙ্গে ওতপ্রোত হয়েছিল, জানিনা না তাও। বাইরে থেকে এসব বোঝা যায় না তেমন। কিন্তু দলটার নাম ছিল এম-এল তথা, মার্কসবাদী-লেলিনবাদী। লেনিনবাদটা আমি আজও ঠিক বুঝি না, যতটা বুঝি এঙ্গেলসবাদ। আবার মাও ছিলেন মধ্যমণি। অথচ দলের নামের সঙ্গে যে কোনো কারণেই হোক তাঁকে যুক্ত করা যায়নি, অন্তত সেই সময়ে। এসব বিষয়ের উত্তর তুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো জানো বা বোঝো। এবারে বলি ৪০-৪১ পৃষ্ঠায় তুমি (যখন কিছুটা পড়াশুনায় তুমি ব্রতী হয়েছ, এবং কিছু নিজস্ব ভাবনা ও বোধে নিজেকে আপডেট করেছ) উল্লেখ করেছ এঙ্গেলস-এর কথা যেখানে তিনি স্পষ্ট বলছেন— ‘চকিত আক্রমণের, অচেতন জনতার শীর্ষে সচেতন একটা ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লবের দিন শেষ হয়ে গেছে।” এই তো যথেষ্ট চেতাগ্নি ’৬৯-এ বিপ্লব সংগঠকদের কাছে। লিখছ, “মার্কস ধারণা করেছিলেন মূলত অর্থনীতিই মানুষের চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কথাটা সত্যের একপিঠ। অন্যপিঠ হল মানুষের চেতনা (বা চেতনাহীনতা) প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাগুলির ক্রমাগত জন্ম দেয় এবং লালন করে।” একদিকে কথাটা সত্য। কিন্তু এও তো ঠিক ১৯৫২-৫৩ থেকে বিশ্বজুড়েই প্রকৃত মার্কসবাদ চর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মার্কসবাদের যা লিমিটেশন তা নিয়ে চর্চা ও নয়াচিন্তার ক্ষেত্রে কজন চিন্তাবিদ মানুষ অগ্রসর হয়ে এসেছিলেন, আবার এলেও বিপ্লবীরা সব ততদিনে রাষ্ট্রনায়ক হয়ে যাওয়ায় চর্চার বদলে ভজনা শুরু হয়েছিল, এটাই সত্য। তুমি ঠিকই ইনটারপ্রেট করেছ—“মার্কসীয় তত্ত্ব দুনিয়াজুড়ে ধন্য আপামরের কাছে প্রচারিত, প্রসারিত হতে গিয়ে শিষ্য-প্রশিষ্যদের হাতে মেটামরফসিস প্রক্রিয়ায় ক্রমশ পরিণত হবে কয়েকটিমাত্র আপ্তবাক্য ও স্লোগানে।” এই বোঝাটা যে তোমার মতো একজন মার্কসবাদী রিয়েলাইজ় করেছ, সে বড়ো কম কথা নয়। মার্কস তো ভেবেছিলেন অন্য কথা, স্বাধীন মানুষ তৈরির কথা। কিন্তু ঐ যে দার্শনিকের কথা প্রয়োগকারীরা অনেকেই সাময়িক স্বার্থে ভিন্ন-খাতে বইয়েছেন। ৭৬ পৃষ্ঠায় তুমি লিখছ – “ভুল করেছেন, ভুল ভেবেছেন, তাঁর ভুলগুলোকে নিয়েই পরবর্তীতে মহামতি লেনিন গড়ে তুলবেন এক মার্কসবাদ যা শেষে মার্কসকেই আটকে দেবে এক বদ্ধ গলিতে,”। এখানে তাঁর ভুলগুলোকে, মানে মার্কসের ভুলগুলো। তুমি মার্কসের ভাবনার একটা ভুলের কথা আগে লিখেছ, যা নিয়ে আমি সামান্য মন্তব্যও করেছি। আরও কয়েকটা তত্ত্বগত ভুল যদি তুমি উল্লেখ করতে তাহলে ভালো হত। অন্তত, এইভাবে উদ্ধৃতিটি শুরু করার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি থাকত। তুমি লিখছ— “মাওয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের লক্ষ্যটা ছিল সম্পূর্ণ নতুন মানুষ গড়ে তুলবার যে থাকবে আজীবন বিপ্লবী,” সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন তুলেছ—“কিন্তু আজীবন বিপ্লবী থাকা মানে তো আজীবন সংশয়ী থাকা, আজীবন ক্ষমতার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া।” একদিকে কথাটা তুমি ঠিকই বলেছে, কিন্তু ভাবনার স্পিরিটটা যদি দেখো বা ভাবো, তাহলে এই চাওয়ার উদ্দেশ্য একটাই, নিরন্তর শুদ্ধ হওয়া ও থাকা, নিরন্তর লড়াই জারি রাখা, নতুন নতুন সমস্যার প্রতি, মানব সভ্যতার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ফলে অগ্রসরমানতাজনিত জটিলতার প্রতি, সর্বপোরি গেঁড়ে বসা ‘ক্ষমতার’ প্রতি লোভ সম্বরণ করার ক্ষমতা অর্জন, যা একজন বিপ্লবী বিপ্লবকালে করে থাকে। চারু মজুমদারের কথাও উঠবে, যিনি ছিলেন এই আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক, যাঁর আহ্বানে তুমি এবং তোমার মতো একটা প্রজন্মের অনেক তরুণই ঘর ছেড়েছিল। তাঁকে নিয়ে তোমার মূল্যায়ণ একসময় এসে কী দাঁড়ালো, না –“ আর পাশাপাশি এও সত্য যে তিনি, চারুবাবু ছিলেন অন্য কম্যুনিস্ট নেতাদের মতই আপাদমস্তক পুঁজিবাদীদের আতঙ্কে সন্দেহবাতিকগ্রস্থ, আনুগত্য-লোভী ও চূড়ান্তভাবে কতৃত্বপরায়ণ। নিজের চারপাশের ক্ষুদ্র, অনুগত, বশংবদ, আপাত ঘনিষ্টদের বাইরে কাউকে বিশ্বাস করতেন না”। ‘কানুদারা হাত ধুয়ে ফেললেন’ অধ্যায়ে আবার তুমি লিখছ—“চারুবাবুর মধ্যেকার হঠকারী, বেপোরোয়া, রোমান্টিক বিপ্লবীসত্তা, যা তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি ও সৃজনশীলতার যোগ্য সঙ্গতি থাকলে কাউকে উত্তীর্ণ করতে পারে স্বকালের এক মহৎ স্রষ্টায়, তাই তাঁকে ক্রমশ ঠেলে দিল ক্ষমতার পাঁকের মধ্যে।” দুটো জায়গাতেই মূল্যায়ণ তোমার। এ নিয়ে আমার কিছুই বলা সাজে না। শুধু এটুকু বুঝেই বা অনুভূতিতে এনেই ক্ষান্ত হই যে একজন প্রকৃত কমরেড কত দুঃখ, কষ্ট আর বেদনার সঙ্গে আত্মোপলব্ধির জায়গায় এসে তাঁর নেতা সম্পর্কে এমন বিশ্লেষণ আর মূল্যায়ণ করতে পারে!

জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎসের প্রসঙ্গ এসেছে, এবং তুমি যে তাঁকে মর্মে মর্মে জানার বোঝার ও অনুভূতিতে আনায় ভীষণই সচেষ্ট তা তোমার লেখা পড়লেই বোঝা যায়। মার্কসের কিছু পরে ভাবনাজগতে ঢোকা এই মানুষটি তাঁর ভাবনায় নানাভাবে তোমার ওই ’৮২ পরবর্তী আকাল সময়ে আলোর স্পন্দন দেখিয়েছে। তুমি তাঁর গণতান্ত্রিকদের হাতে নিপীড়ন ও পরিণতির কথাও উল্লেখ করেছ। জেনেছি নিৎসে কবিও ছিলেন। (আমি অবশ্য তাঁর কবিতা পড়িনি। আমার দুর্ভাগ্য)। সত্যাদর্শী এই মানুষটি একটি বিস্তৃত ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনাচিন্তার ফসল রেখে গেছেন। একজন স্রষ্টা মানুষের জন্মের কারণ যে এক সর্বব্যাপী শূন্যতা উল্লেখ করেছ তাও। মিথ্যাচারকে সরিয়ে তাঁকে প্রকৃত অনুধাবনের কথাও বলেছ। সঙ্গে এটাও ঠিক তাঁর লেখার অনুপ্রেরণা ও লেখায় প্রভাব আরেক দিকপাল দার্শনিক আর্থার সোফেনহাওয়ারের। একটা জিনিস কিন্তু খেয়াল করেছি বা করছি, যে এইসব চিন্তানায়কেরা শেষদিকে সবাই নৈরাশ্যের দিকে ধাবিত হয়েছেন, উন্মাদ হয়েছেন। হয়তো স্বপ্নভঙ্গের কারণেই। সত্য, নৈতিকতা, ভাষা, নন্দনত্তত্ব, সাংস্কৃতিক তত্ত্ব, ক্ষমতা, চেতনা, অস্তিত্বের অর্থ, বিশেষত ‘নিহিলিজম’ (সমস্ত ধর্মীয় ও নৈতিক তত্ত্ব ও সূত্রকে অস্বীকার করা, বাতিল করা) ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর যে উপলব্ধ জ্ঞান, যা তিনি শেয়ার করতে চেয়েছেন, তাতে মুগ্ধ তুমি। হয়তো কমবেশি আমরা অনেকেই। এছাড়াও এসেছে দস্তয়েভস্কি, বর্হেস প্রভৃতি কালজয়ী সাহিত্যকের কথা, খুব স্বাভাবিকভাবেই।

এসব থেকে, পড়ে, জেনে, অনুভব করে তুমি পৌঁছোনোর চেষ্টা করেছ একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে কয়েকটি উপলব্ধির দুয়ারে, আপাত সত্যের কাছে, যার সারাংশ করলে উঠে আসে এই বই থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি। ক) “মানুষের আত্মায় গভীর তলদেশ পর্যন্ত এইভাবে সভ্যতা ছড়িয়ে দেয় দূষণ।” (২৪ পৃঃ) খ) “এই ভুল সভ্যতা জুড়ে বেশিরভাগ সময়টাতেই মৃতরাই শাসন করতে চেয়েছে জীবনকে। তবুওতো জীবন বিদ্যুতের শাণিত তরবারির মত ঝিলিক দিয়ে উঠত। বড় মাপের মানুষরা ছিলেন চারপাশে। এখন মৃতরা শাসন করছে মৃতদের, মৃতরাই মারছে মৃতদেরকে, জয়ধ্বনি দিচ্ছে মৃতদের নামে, মৃতদের পুরস্কৃত করছে মৃতরাই।” ( ৩৪ পৃঃ) গ) “স্রষ্টা মানুষ যে হাত বাড়াতে চেয়েছিল জীবনবৃক্ষের দিকে প্রকৃতিতে স্বাভাবিক পশুর জীবন সে চায়নি বলে, ক্রমাগত ভুল পথে কেন সে চলে গেল? কেন সে যাপন করছে অশুদ্ধ, মৃত, বিকৃত, আত্মবিস্মৃত, অসৎ এই জীবন? এই প্রশ্নের উত্তর আমি এখন বুঝি মানুষকে বারবার খুঁজে দেখতে হবে। এখানেই তার মুক্তি। নিজের ভিতরের যে বিপুল অন্ধকার একমাত্র তাকে চেনা গেলেই বা চিনতে গেলে সেই অন্ধকারও একধরণের আলোর জন্ম দেয় যে আলোয় অন্ধকার কেটে পথ চলতে শেখে মানুষ।” (৩৮-৩৯ পৃঃ) ঘ) “তথাকথিত গণতন্ত্র ও গরীবের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে প্রতিদিন যা জন্ম নিচ্ছে তা হল হিংসা, আত্মকলহ, আত্মধ্বংস। সর্বব্যাপী অরাজক অবস্থা, দুর্ণীতি ও তোষামোদ। প্রগাঢ় মেরুদণ্ডহীনতা।” (৬০ পৃঃ) ঙ) “আমরা জানি এখন যে স্বপ্ন আর জীবনের মধ্যে ফারাক আসমান-জমিনের। মানুষ যেভাবে বাঁচে আর তার যেভাবে বাঁচা উচিৎ– দুইয়ের মধ্যে তফাৎ চিরকালের। এবং মার্কস, তবু আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে এই ছাগলচোদা বুর্জোয়া সভ্যতা ও তার বালোৎপাদক প্রগতি রাষ্ট্রের একজন অনমনীয় শত্রু রূপে।” (৭৬ পৃঃ) চ) “রূপ ও অরূপের মধ্যে, মূর্ত ও বিমূর্তের মধ্যে, সসীম ও অসীমের মধ্যে,……………………, মৃত্যু ও জীবনের মধ্যে, সৃষ্টিলিঙ্গ ও সৃষ্টিযোনির মধ্যে, সহজ চলাচলের সেতু নির্মাণ করতে চেয়েছিল একদা যে-মানব সে এখন খিন্ন পড়ে আছে। বস্তুত এই দড়ি টানাটানির মধ্যবর্তী অঞ্চলটিতেই বাস করেন প্রত্যেক যথার্থ কবি।” (৮১ পৃঃ) ইত্যাদি।

একদম শেষ অধ্যায়ে এসে নিজের কথা আরেকবার তুলেছ। শৈশব, নদী, আর মৃত্যুর কালো অন্ধকারময়তার সঙ্গে বাল্যকাল থেকে বারবার শৃঙ্গারসহ তোমার রমণ-ক্রিয়া। অদ্ভুত কিছু ঘটনা তো জীবনে ঘটেই। আমারও শৈশবে দু-বার অন্তত মৃত্যুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাও একবার ভাগিরথী গঙ্গাবক্ষে। সে-কথা এখন নয়, পরে কখনো।

আর দুটো বিষয়ে সামান্য না বললে কেমন অসুন্তষ্টিতে ভুগছি। এক, ভাষা। দুই, গালাগাল বা খিস্তি (ভাষাসন্ত্রাস বলব না)।

ভাষা 

তোমার গদ্যের ভাষা গতিময়, প্রাণময়, টেনে রাখার ক্ষমতাসম্পন্ন, সাধুভাষার সঙ্গে কথ্যভাষার মিশেলে তৈরি এই ভাষা কখনো কখনো গীতল হয়ে কবিতামাত্রা ছোঁয়ার প্রয়াসী। কিন্তু এটা সর্বাংশে ঠিক যে তুমি গদ্যই লিখেছ। আসলে ভাষা হলো ভাব-ভাবনা, চিন্তা-চেতনা, নিসর্গ-মানবপ্রকৃতি বর্ণনার মাধ্যম। তো, এই বইয়ের ক্ষেত্রে যে ছেঁড়া, টুকরো-টাকরা আত্মকথন, কবিতার দুয়ারে অনুসন্ধানসহ বারবার ছুটে যাওয়া ও বোধে সিক্ত হয়ে আত্মোপলব্ধির জারণ-বিজ়ারণ, দর্শনের আঙিনায় ইতিহাস ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের সম্মুখে স্থির হয়ে বসা আর একবার নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার প্রয়াস, আর উঠে আসা উপলব্ধি ও প্রত্যয়গুলোকে তুলে ধরা, এসব প্রকাশের জন্য যে-ভাষার প্রয়োজন তা তুমি আয়ত্ব করে মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করেছ। তত্ত্বগত কথার ক্ষেত্রে ভাষার যে বাঁধুনি দরকার, তা আছে। সর্বোপরি, এ-ভাষায় যথেষ্টই ব্যক্ত করতে পেরেছ নিজেকে। সাধু।

খিস্তি/গালাগাল

ইদানীং একটা কথা খুব চালু হয়েছে, ‘ভাষাসন্ত্রাস’। এখানে খিস্তিমূলক/ বা গালাগাল দেওয়ার যে ভাষা সাধারণত আমরা ব্যবহার করে থাকি, তাই এসেছে, এ কোনো ভাষাসন্ত্রাস নয়। আমি বুঝি, অন্তত বোঝার চেষ্টা করি, একজন সৃষ্টিশীল মানুষ কোন যন্ত্রণা আর বেদনায় কিসের প্রেক্ষিতে আর কী উদ্দেশ্যে এই তথাকথিত খিস্তি ও গাল, যা অনেক সময়ই সমাজের একটা স্তরের সাধারণ মুখের ভাষা, ব্যবহার করেন। একজন বিপ্লবীর যে দ্রোহ, স্বপ্নভঙ্গের কারণ বিশ্লেষনে উদ্ভুত রাগ, সৃষ্ট ক্ষত থেকে প্রতিমুহূর্তে বেরিয়ে আসা পুঁজ ও রক্তের যে স্রোত, তা তো আসলে আজ ব্যর্জ বলেই প্রতীয়মান হবে। এবং তা ঝরে পড়বে। তাই অনায়াসে আসে, ‘বাল’, ‘বোকাচোদা’, ‘ছাগলচোদা’, ‘চুদুরবুদুর’, ‘চুতিয়া’ ইত্যাদি। তালিকা না বাড়িয়ে যেটা বলতে চাই, এই শব্দের প্রয়োগ কখনই কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হয়নি। হয়েছে, এই তৎকালীন ধেদ্ধেরে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, কখনো তথাকথিত এলিট সমাজের প্রভুদের চিন্ত-ভাবনার বিরুদ্ধে, আবার কখনো নিজেরই অধিত জ্ঞান আর ক্ষমতার প্রেক্ষিতে। এসব না থাকলে গদ্যটা জমত না। আবার না-থাকলেও যে খুব ক্ষতি হয়ে যেত, তাও মনে করি না। এটা স্বীকার করতেই হবে এসব এসেছে স্বাভাবিকভাবে স্বাভাবিক রূপ ধরে।

প্রচুর বকলাম। তাই না! হয়তো ধৈর্য হারিয়েছ। কিন্তু আমার দোষ দেখি না। দোষ তোমার বইয়ের। আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিল, বকিয়ে নিল, ফিরে দেখতে বাধ্য করল, নতুন করে আবার বেশ কিছু অন্য গদ্য পড়তে বাধ্য করাল, একটা আলোড়ন তুলে দিয়ে। নিজেও ঢুকে পড়েছি, শুধু বাইরে থেকে দেখা কিছু টুকরো-টাকরা, কিছু ঘটনা ইত্যাদির মাধ্যমে বইয়ে বর্ণিত, চিত্রিত, অনুভবগত, চেতনাগত একটা বিশেষ কালখণ্ডকে স্থানিক একটা বড়ো পরিসরের মধ্যে ধরার চেষ্টায়। কিছু না হলে গাল দিও। রাগ করব না। খুব অন্তর থেকে ভালোবেসে নিজের প্রচুর কাজের দফারফা ঘটিয়ে এই লেখা। একবার অন্তত পড়ো। ভালো না লাগলে, আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিও। দুঃখ পাব না।

ভালো থেকো

ভালোবাসাসহ
উমাপদ
৭ মে, ২০১৯।

Facebook Comments

Leave a Reply