রাজনৈতিক সচেতনতা, সসস্ত্র প্রতিরোধ ও সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন: অর্ধশতবর্ষে নক্সালবাড়ি আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা – রাজীব নন্দী
১। আমার স্মৃতিতে নক্সালবাড়ী
“… না দিলে জোতদারের গলা কাটা যাবে…”
নক্সাল আন্দোলন কথাটা শুনলেই সাদা দেওয়ালে আলকাতরা দিয়ে লেখা এই কথাটা আমার চোখের সামনে আজও ভেসে ওঠে। কত বয়স ছিল তখন আমার? বছর দুয়েক হবে হয়ত। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে বারান্দায় এসে দেখলাম কারা যেন রাতে এসে আমাদের বারান্দার সমস্ত দেওয়াল জুড়ে বড় বড় কালো অক্ষরে কি সব লিখে রেখে গেছে। অক্ষর জ্ঞান হয়নি তখনও আমার। শুনলাম বড়রা বলাবলি করছে, নক্সালরা রাতে এসে হুমকি দিয়ে গেছে। ক’দিনের মধ্যেই ওই দেওয়াল আবার সাদা রঙ করে ফেলা হল। কিন্তু সাদা রঙের পরতের ভেতর থেকে কাল ওই অক্ষর গুলো যেন ফেটে বেড়িয়ে আসত। মনে আছে, একটু বড় হওয়ার পর যখন আমার অক্ষর জ্ঞান হল, ওই একটা লাইন তখনও পড়া যেত। প্রসঙ্গত বলি, ষাটের দশকের শেষের দিকে নক্সালবাড়ীতে যখন আমার জন্ম হয়েছিল, নক্সালবাড়ী আন্দোলন ছিল তখন তুঙ্গে। আজকে, পৃথিবীর যেকোনো দেশে দাঁড়িয়ে বলতে গর্ব বোধ করি যে আমি নক্সালবাড়ীতে জন্মেছিলাম। আন্দোলনের তত্ব ভুল বা ঠিক যাই হোকনা কেন, আমার কাছে নক্সালবাড়ী কোনো আতঙ্কের নাম নয়। নক্সালবাড়ী এখনো আমার কাছে একটা স্বপ্নের নাম, যা দেখেছিল একদল ভূমিহীন কৃষক ও প্রান্তিক মানুষেরা। সঙ্গে ছিল এক ঝাঁক বিপ্লবী ছাত্র-যুবক।
১৯৭০ এর দশকের প্রথম দিকের অনেক স্মৄতি এখনো আমার ঝাপসা মনে আছে। সত্তরের গোড়ার দিকে, এক শীতের সন্ধ্যেয় রাস্তার ওপর বারান্দায় বসে একাএকা খেলছিলাম, হঠাৎ কোলাহল শুনে দৌড়ে বেরিয়ে এসে দেখি এক বিশাল মিছিল আমাদের বাড়ীর দিকেই এগিয়ে আসছে। মিছিলকারীদের হাতে, লাল পতাকা, তীর-ধনুক, বরশা, কাস্তে আর মশাল। হাতমুঠো করে আকাশের দিকে ছুড়ে দিতে দিতে তারা স্লোগান দিচ্ছিল, ইনকিলাব জিন্দাবাদ…নক্সালবাড়ী জিন্দাবাদ। ছোট হলেও, সেদিন ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন একটা জিনিস বুঝেছিলাম। বুঝেছিলাম, কিছু মানুষের মধ্যে কোথায় যেন একটা ক্ষোভ লুকিয়ে আছে। সবাই একসাথে মিলিত হয়ে, দলবদ্ধ ভাবে, হাত মুঠো করে আকাশের দিকে ছোড়াটা শুধু সেই ক্ষোভের বহিপ্রকাশই নয়, এটা সেই মানুষদের সমাজ বদলানোর ইচ্ছের একটা প্রকাশ। এটা এক শ্রেনীর মানুষের সমাজ কাঠামো ভাঙ্গার এক সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সেই ক্ষোভ একটা আনন্দে পরিণত হয়। সমাজ বদলানোর আনন্দ। কিন্তু,কি কারন সেই ক্ষোভের? তা বুঝতে পারিনি সেদিন। সেটা বুঝতে লেগে গেছিল অনেক সময়। কিন্তু পরে আবার মনে এপ্রশ্নও বার বার জেগেছে যে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে এই সংগ্রাম ও এক বিশেষ প্রদ্ধতিতে সমাজ বদলানোর রাজনৈতিক ইচ্ছেটা মানুষের মধ্যে কতটা স্থায়ী হয়? সে ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ এখনো রয়েছে। সেই সন্দেহ সম্ভবত সেসময়েও ছিল নক্সালবাড়ী আন্দোলনের নেতৃবর্গের মধ্যে।
ঘটনাক্রমে, সেদিনের নক্সালবাড়ীর সেই সংগ্রামের সাথে জড়িয়ে ছিলেন আমার বাবা-ও। তখন তা জানতাম না। জেনেছিলাম অনেক পরে। মায়ের কাছে শুনেছি, ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে যখন নক্সালবাড়ীর কৃষক আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছিল, সে সময় থেকেই চারু মজুমদার আর কানু সান্যালের সাথে বাবার যোগাযোগ তৈরী হয়। যোগাযোগ ছিল হাতিঘিষার জঙ্গল সাঁওতাল, নক্সালবাড়ীর একদল তরুন যুবক আর নর্থ বেঙ্গল উনিভারসিটির বিপ্লবী ছাত্র নেতাদের সাথে। উনিভারসিটির বিপ্লবী ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিল কিষানলাল চ্যাটার্জী। ১৯৬৭ সালের মে মাসের সেই ভয়াবহ ঘটনার পর থেকে অজস্র মিটিং হয়েছে আমাদের বাড়ীতে। মিটিং এ আসত নক্সালবাড়ীর একদল তরুন যুবক ও উনিভার্সিটির ছাত্র বন্ধুরা। আমার বাবার বিশেষ জ্ঞান ছিল ছোট ছোট গেরিলা যুদ্ধের কৌশলের ওপর। স্থানীয় মানুষের সাহায্যে কিভাবে প্রথমে গড়ে তোলা হয় পরিকল্পিত হামলা। আর তারপর নকল পশ্চাদপসরণ ও সুযোগ বুঝে চালানো হয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় অতর্কিত হামলা। গেরিলা আক্রমণের কলাকৌশল আলোচনা হত সেই সব মিটিং গুলোতে। এ যেন সেই ১৯৪৫ এর চীন বিপ্লবের আদলে গড়ে তোলা আন্দোলনের প্রস্তুতি। তবে, এসব কিছুই খুব বেশীদিন করতে হয়নি। কারন নক্সালবাড়ী এলাকার তথাকথিত এই বসন্ত বজ্রধ্বনি বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। আমরা সকলেই জানি নক্সালবাড়ীর সেই স্ফুলিঙ্গ, দাবানল হয়ে উঠতে পারেনি কোনদিনই।
২। বিতর্কিত আন্দোলন ও পুলিশী জুলুম
তাত্বিক নক্সাল নেতারা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অর্থনীতিকে ব্যাখ্যা করল পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন প্রদ্ধতির ক্রম হিসেবে। আর এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল তাদের বিপ্লবী কলা কৌশল, যার সূত্র ছিল চীনের নতুন গণতান্ত্রিক বিপ্লব। সেই সময়ের নক্সাল মতাদর্শ অনুযায়ী ভারত শুধুমাত্র প্রাক বিপ্লবী চীনের (বুর্জোয়া নেতৃত্ব দ্বারা সমর্থিত ক্ষুদ্র-সামন্ত জমিদারদের দ্বারা শাসিত) তুলনীয় ছিল না, কিন্তু এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছিল যেখানে একটি সফল বিপ্লব পরিচালনা করা সম্ভব ছিল। এই বিপ্লবের একটি মূল উপাদান ছিল শহরে ক্যাডার গোষ্ঠীর গঠন ও গ্রামে জঙ্গি সংগ্রামের জন্য কৃষকদের একত্রিত করা। নক্সাল আন্দোলন শুরু হওয়ার দু বছরের মাথায় ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে তৈরী হল নতুন দল সিপিআই(এমএল)। পরবর্তী কালে, নক্সাল আন্দোলনের তাত্বিক ব্যাখ্যা কিন্তু ভারতবর্ষের সংসদীয় গনতন্ত্রের ভূমিকাকে অবজ্ঞা করার ভুল স্বীকার করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, পার্টি লাইন, বিপ্লবের প্রস্তুতি ও কলা কৌশল এবং ভারতীয় সমাজ ও অর্থনীতির বিশ্লেষণ নিয়ে। নক্সাল নেতারা কি বিপ্লবী আন্দোলনের কৌশল নির্ধারনের সময় ভারতবর্ষের জাতি ভিত্তিক শ্রম বিভাজন ও তার ভূমিকা বিবেচনা করে দেখেছিল? ভারতের মত এক বিশাল ও ভিন্নতায় ভরা দেশে শুধুমাত্র, “লাঙ্গল যার জমি তার” ধরনের স্লোগান কি শ্রেনী শত্রুদের সঠিক ভাবে চিহ্নিত করতে সমর্থ হবে?
আন্দোলন শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই এই তুলনামূলকভাবে সাধারণ বিক্ষোভের রীতি ‘বিনষ্টকরণ লাইন’ দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করে। সে সময় ঘোষণা করা হয়েছিল যে শ্রেণী শত্রুদের নিধনের মাধ্যমে বিপ্লবের অগ্রগতি হবে। চীনের রেড গার্ডসের উদাহরণ অনুসরণ করে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বারা এবং বিভিন্ন কমিটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এই কার্যক্রমগুলি পরিচালিত করা হত। অপরদিকে, অপ্রত্যাশিতভাবে প্রতিবিপ্লব ব্যবস্থাগুলির ক্রমবর্ধমান চাপ নক্সালপন্থী বিপ্লবী সংগঠন গুলিকে কঠোর না করে বরং ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করে করে দিল।
১৯৬০ এর দশকের একদম শেষের দিকে, কোনো এক মধ্যরাতে, যখন আমি গভীর ঘুমে আচ্ছাদিত, নক্সালবাড়ী থানায় এক বোমা আক্রমণ করা হয়েছিল। আর, তারপর আমাদের নক্সালবাড়ীর ভাড়াবাড়ী তে মধ্যরাতের অন্ধকারে হানা দিয়ে ছিল একদল সসস্ত্র পুলিশ। তারা সেদিন হানা দিয়েছিল, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রমান ধরতে। তবে প্রমানের অভাবে, সেদিন তারা আমার বাবাকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
ভূমিহীন কৃষক ও চা-শ্রমিক আন্দোলন দিয়ে শুরু হলেও নক্সালবাড়ী আন্দোলনকারীদের মনের মধ্যে ছিল জনগনতান্ত্রিক বিপ্লবের বাসনা। কৃষক আন্দোলনের ধারাটি দার্জিলিঙের তরাই ছেড়ে দক্ষিন বঙ্গের আরো দু’একটি জেলায় ছড়িয়ে পড়ল দু এক বছরের মধ্যেই। কিন্তু অচিরেই, ষাট ও সত্তরের দশকের নক্সাল আন্দোলন গ্রাম ছেড়ে শহর ভিত্তিক এক লক্ষ্যহীন এবং বেপরোয়া এক হিংসাত্মক ছাত্র যুব আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭০ এর এপ্রিল মাস থেকে আন্দোলনের একটি ধারা আক্রমণ হানতে শুরু করল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাঙ্গালী মহাপুরুষদের মূর্তির ওপর। যদিও আন্দোলন থেমে যাবার পরে, নক্সাল নেতারা সেই মূর্তি ভাঙার রাজনীতির সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। সেদিনের সেই যুবকদের অনেকেই ছিল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। গ্রাম বা কৃষিকাজের সাথে কোন সম্পর্কই হয়ত তাদের ছিল না। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২-এ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং হিন্দু হোস্টেল নক্সাল রাজনীতির স্নায়ু কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। প্রেসিডেন্সি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ ছাত্র তাদের একাডেমিক ক্যারিয়ার ত্যাগ করে মেদিনীপুরের বিভিন্ন এলাকার কৃষক আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। সেসময়ে, নক্সাল জঙ্গি হানায় মৃত্যু হয়েছে বহু জোতদার। অস্ত্র লুটের জন্য হামলা চালানো হয়েছে একাধিক পুলিশ স্টেশনে। সেদিন সংবাদের শিরোনামে এক দিকে যেমন ছিল তাদের সেই উগ্র খুনোখুনির ঘটনা তেমনি অন্যদিকে ছিল পাল্টা পুলিশী জুলুম ও অত্যাচার, যার অনেক গল্পই এখনো অজানা। ব্যাপক প্রতিবিপ্লব ব্যবস্থা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর চাপের মুখে, নক্সাল আন্দোলন দ্রুততর হ্রাস পায় এবং ১৯৭২ সালে পুলিশ হেফাজতে চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই (এমএল)এর রাজনৈতিক শক্তি দ্রুত অদৃশ্য হতে শুরু করল। সরকার হাজার হাজার নক্সালপন্থীকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করল। তাদের কয়েকজন ছিলেন আমাদের পরিচিত ও আমাদের পারিবারিক বন্ধু। আমার এক মাতুলস্থানীয় ভদ্রলোকের সারা শরীরে অজস্র পোড়া দাগ দেখে ছোটবেলায় আতঙ্কে শিউরে উঠেছিলাম। শুনেছিলাম, কি ভাবে পুলিশ কারাগারে তাঁর সারা শরীরে সিগারাটের ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছিল জবানবন্দী আদায় করার জন্য।
সেসময়ে, নক্সালবাড়ীতে অল্পবয়স্ক যুবকদের সম্বন্ধে একটা কথা প্রায়সই শুনতাম যে তারা আসামে বা নেপালে পালিয়ে গেছে। বেশ কিছু বছর পরে ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস সরকারের পতনের পর তারা আবার ধীরে ধীরে উদয় হতে শুরু করল। অনেকে অবশ্য, তার আগেই রাজনৈতিক মুচলেকাতে সই করে সরকারী চাকুরী জোগাড় করতে সমর্থ হয়ে ছিল। ১৯৭৭ এর পরে, প্রাক্তন নক্সালীদের অনেকেই মুচলেকা লিখে নত স্বীকার করেছিল নতুন বামফ্রন্ট সরকারের কাছে। অনেকে পারিবারিক চাপে স্থানান্তরিত হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন শহরে এমনকি প্রধান সাম্রাজ্য বিস্তারকারী দেশ আমেরিকায় পর্যন্ত।
৩। কেতাবী আলোচনায় নক্সালবাড়ী
আজকে, নক্সালবাড়ী আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পর, তার প্রাসঙ্গিকতা বিচার করতে গিয়ে, শুরুতেই একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন মনে করছি। নক্সালবাড়ী আন্দোলনের তাত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া, বা তার সাফল্য ও ব্যার্থতা বিচার করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং এদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে নক্সাল আন্দোলনের প্রভাব ও তার প্রসার নিয়ে আলোচনা করব।
সত্যি কথা বলতে কি, ষাট ও সত্তরের দশকের নক্সাল আন্দোলন একটি বহু আলোচিত বিষয়। স্বাধীন ভারতবর্ষের আর কোন বাম আন্দোলন নিয়ে এত কেতাবি আলোচনা হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে সেদিনের সেই নক্সাল আন্দোলন কি সত্যিই এত বড় ছিল? নক্সালবাড়ী আন্দোলন কি সত্যি এত আলোচনার অপেক্ষা রাখে? সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলেছেন নক্সাল আন্দোলন কে যেন একটু বেশী মাত্রায় মহিমান্বিত করা হয়েছে। সেটা হয়েই থাকতে পারে। তবে সেটা কেন হল, তাও সমাজ বিজ্ঞানীদের কাছে একটা আলোচনার বিষয় হতে পারে।
একজন সমাজ বিজ্ঞানী ও উত্তরবঙ্গ চর্চাকারী হিসেবে, আমি নক্সালবাড়ী আন্দোলন কে দেখি অন্য আরেকটি ভাবে। আমি মনে করি নক্সালবাড়ী আন্দোলন, তার বিস্তার ও তাকে ঘিরে সব আলোচনা উত্তরবঙ্গের নিজের প্রাসঙ্গিকতাকে নতুন করে প্রমাণ করতে পরেছে। এই আন্দোলনের পূর্বশর্ত, উৎস এবং কর্মকান্ড সবই উত্তরবঙ্গ। নক্সালবাড়ী আন্দোলন উত্তরবঙ্গকে এক নতুন পরিচয় প্রদান করেছে। নক্সালবাড়ী, বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষের মানুষের কাছে উত্তরবঙ্গের এক অন্য রূপ তুলে ধরতে পেরেছিল। নক্সালবাড়ী উত্তরবঙ্গের প্রথম কৃষক আন্দোলন নয়। ১৯৪০ এর দশকের তেভাগা আন্দোলন, উত্তরবঙ্গে সারা জাগিয়েছিল ব্যাপক ভাবে। একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে তেভাগা আন্দোলনের মাটিতেই সংগঠিত হয়েছিল নক্সালবাড়ী। এই নক্সাল আন্দোলনের স্বপ্ন দেখেছিলেন উত্তরবঙ্গের কয়েকজন রাজনীতিবিদ। এই আন্দোলন পরিচালনা ও তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন উত্তরবঙ্গের মানুষ। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে এই আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পরেছিল এখান থেকেই। ১৯৭০ এর দশকে নক্সালবাড়ী আন্দোলন বা নক্সালবাড়ী জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ একটি অপ্রত্যাশিত উচ্চতায় পৌঁছেছিল। পরবর্তীকালে, ১৯৭০ এর সেই রাজনৈতিক সহিংসতার অভূতপুর্ব ছবি এখনও প্রায় সকল গণতন্ত্র এবং রাজনীতির আলোচনার মধ্যে বিদ্যমান। যদিও নক্সালবাড়ীকে মনে করা হয় সন্ত্রাসের যুগ বা রাষ্ট্র দমনের উপলক্ষণ, কিন্তু বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণী আজও সমসাময়িক রাজনীতি এই নক্সাল অভিজ্ঞতার আতস কাচ দিয়ে দেখতে ও বিশ্লেষণ করতে পছন্দ করে। উল্লেখযোগ্য ভাবে, নক্সালবাড়ী ও নক্সাল আন্দোলনের উল্লেখ বাংলার মধ্যবিত্তদের কল্পনায় এখনো এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। নক্সালবাড়ী তাদের কাছে রয়ে গেছে রাজনৈতিক সহিংসতা, মেধাবী ছাত্রদের উন্মাদনা এবং রাষ্ট্র নিপীড়নের একটি রূপক হিসেবে। নক্সালবাড়ী ছিল একটি মতাদর্শগত রোমান্টিকতা যা সেসময়ের যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করেছিল। সেসময় স্লগান উঠেছিল, “সত্তরের দশক – মুক্তির দশক”। বাঙ্গালীর সেই রোমান্টিকতা কিন্তু আজও অনেকটাই বজায় আছে। আজকে নক্সালবাড়ীর বেশীরভাগটাই টিঁকে আছে নক্সালবাড়ীর ওপর লেখা গুলির মধ্য দিয়ে, যা বাংলায় নক্সাল সাহিত্য নামে খ্যাত। এছাড়া রয়েছে, নক্সাল আন্দোলনের উত্থান, প্রাসঙ্গিকতা ও কৌশল নিয়ে বিভিন্ন পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা। নক্সাল আন্দোলনের উত্থানের পূর্বশর্তের চুলচেড়া ব্যাখ্যা করেছেন লেখক সুমন্ত ব্যানার্জী। লেখক ভাস্কর নন্দী আলোচনা করেছেন আন্দোলনের পতন ও পরিণতি নিয়ে। অমর ভট্টাচার্য তার বইটিতে অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব, বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং উড়িষ্যা সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নক্সাল আন্দোলনের যে বিস্তার ঘটেছিল তার ব্যাপক বিবরণ দিয়েছেন। বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকগুলির মধ্যে কিছু রয়েছে পার্টির অন্তর্বর্তীকালীন সংগ্রাম এবং দ্বন্দ্ব, যা শেষ পর্যন্ত ১৯৭০ এর সিপিআই (এমএল)পার্টি কংগ্রেসে মাথা চারা দিয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে, সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদরাও মাওবাদী নামে পরিচিত বিভিন্ন আন্দোলনে কীভাবে চলছে তা নিয়ে লিখে চলেছেন। দশরথি ভুঁইয়া, তার বইতে ভারতের রেড করিডর ও নক্সালবাদী আন্দোলন নিয়ে আলোকপাত করেছেন। সুমিত কুমার তার বইতে, অন্ধ্রপ্রদেশের নক্সাল আন্দোলন ও পরে আজকের দণ্ডকারণ্য অঞ্চলে জমিদার ও নক্সালপন্থীদের সংঘর্ষের কথা বলেছেন।
৪। আপার্তবৈপরীত বাম জাগরণ, নক্সাল সাহিত্য ও তার প্রাসঙ্গিকতা
এক অর্থে, এই সত্তরের সময়টা ছিল একটা চরমপন্থী দশক। আরেক অর্থে তা ছিল গণতন্ত্রবাদ ও সাম্যবাদী আওয়াজ তোলার সময়। “আমার বাড়ী, তোমার বাড়ী, নাক্সাল্বাড়ী, নক্সালবাড়ী” বা “জনতা যখনই চায় বস্ত্র ও খাদ্য, সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য” – নক্সালবাড়ীর এই স্লোগান গুলির মধ্যে ছিল একটা অদ্ভুত আহ্বান যা একদিকে যেমন ভেঙ্গে ফেলে দিতে চেয়েছিল সব পুরাতন সংস্কার আবার অন্যদিকে আকৃষ্ট করেছিল শহর-গ্রাম ও জাত-পাত নির্বিশেষে এক যুব মানসকে। উল্লেখযোগ্যভাবে ধারণা করা হয় যে, নক্সাল আন্দোলন বাংলার প্রগতিশীল সাহিত্য, সংগীত, নাটক, চিত্রকলা এবং চলচ্চিত্র কে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছে। নক্সাল আন্দোলন জন্ম দিয়েছে এক নতুন শিল্পকর্ম। কোনো সন্দেহ নেই যে উৎপল দত্তের মতো থিয়েটার ব্যক্তিত্ব, বরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কমলেশ সেন এর মতো কবি, প্রমোদ সেনগুপ্ত, আমিয় চক্রবর্তীর মতো প্রবন্ধকার আর মহাশ্বেতা দেবী, সমর সেন এবং ভবানী রায় চৌধুরীর মতো ঔপন্যাসিক ও লেখক তৈরী হয়ে ছিল এই আন্দোলনের হাত ধরেই। কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা যে সেই সময়ের সাংস্কৃতিক প্রযোজনাগুলি আজকের বাংলায় চিরস্থায়ী উত্তরাধিকারের অংশ হয়ে উঠেছে। নক্সাল আন্দোলনের আরেক অবদান ছিল একগুচ্ছ সমান্তরাল জার্নাল। সে সময়ে প্রকাশ হতে শুরু করেছিল নাও, ফ্রন্টিয়ার, অনুষ্টুপ, কালপুরুষ – এছাড়াও আরো অনেক পত্র ও পত্রিকা। কৃষক, শ্রমিক এবং বস্তিবাসীদের মধ্যে সাক্ষরতার একটা প্রচার অভিযান শুরু হয়েছিল ঐ সময়েই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রনবীর সমাদ্দারের মতে, পশ্চিমবঙ্গের জেলখানা গুলি হয়ে উঠেছিল এক সমান্তরাল শিক্ষার স্থান। আর সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, এসবের প্রান কেন্দ্র কিন্তু কলকাতা নয়। বাংলার এই বামজাগরণের কেন্দ্র ছিল রাজ্যের মফস্বল শহরগুলি। তবে রাজনীতি ও সাহিত্য একসাথে চলা অত সহজ হয়ত ছিলনা। রাজনীতি ছিল তখন তুঙ্গে, এবং অনেক সময়ই একটু দিশাহীন। রাজনীতি যখন তার তুঙ্গে থাকে, সাংস্কৃতিক নৈপুণ্য তখন প্রস্ফুটিত হয়না। তাই, এক্ষেত্রেও শিল্পকর্মের যুগটা শুরু হয়েছিল তার একটু পরে, যখন আন্দোলন অনেকটা ঠান্ডা। কিন্তু একথা বলা বাহুল্য হবেনা যে, নক্সাল পরবর্তী ঐ সকল সাংস্কৃতিক নথিগুলি না থাকলে নক্সালবাড়ী আন্দোলনটি তার এই মহিমা অর্জন করতে পারতনা। এখানে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনকে ঘিরে যে সাহিত্য রচনা, তার সাথে নক্সাল সাহিত্যের একটা ফারাক রয়েছে। নক্সাল আন্দোলনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নাগরিকই প্রধান আখ্যানকারী। রাজনৈতিক নাগরিকই তার ইতিহাসের রচয়িতা। এই ‘এক্টর – ন্যরেটর’ (অভিনেতা ও আখ্যায়ক) দৈত ভূমিকা নক্সাল শিল্প সাহিত্য ও ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাই এই শিল্পকর্ম গুলি মানুষের এত কাছের, এত আপনার। মানুষ অতি সহজেই এই আখ্যান গুলির সাথে নিজেকে মেলাতে পারে। কোনো সন্দেহ নেই, উত্তর-সত্তর যুগে এই সাংস্কৃতিক নৈপুণ্য এক বিশাল ভূমিকা পালন করেছে বাংলা তথা ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপরেখা নির্মানে। ইগুয়ার্তা এবং পাইজ স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের রেফারেন্স দিয়ে দেখিয়েছেন, সমকালীন শিল্পকর্ম একটি সহিংস রাজনৈতিক অতীতের প্রতীকী পুনর্নির্মাণের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এই শিল্পকর্মগুলি অতীতের সামাজিক ঘটনা ও ক্ষত গুলিকে যাতে সহজেই উপলব্ধি করা যায় তারজন্য এক যৌথ স্মৃতিচারনার ভূমি প্রদান করে। অনুরূপ ভাবে, নক্সালবাড়ী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থগুলি নক্সালবাড়ী নির্মাণে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বলাহয় যে, এই শিল্পকর্মগুলির মাধ্যমেই বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষ একটি বিশেষ সময়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাখ্যা করে ও তার পুনর্নিমাণ করে। এই শিল্পকর্মগুলি কতগুলি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উপমা চিরস্থায়ী করতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, সেসময়ের বহু নক্সাল যুবক ছিলেন অভিজাত শ্রেনীর অন্তর্গত, এবং ওই নক্সাল শিল্প সাহিত্য গুলি অনেকাংশেই নক্সাল আন্দোলন সম্পর্কে একটি অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। তবে একথাও ঠিক যে, নক্সালবাড়ী রাজনৈতিক ঘটনাসমূহের স্মৃতিগুলি কেবলমাত্র সাহিত্য, চলচ্চিত্র বা সামাজ বিজ্ঞানীদের বাকবিতন্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই আন্দোলনের অনেক স্মৃতি রয়ে গেছে পারিবারিক ইতিহাসের অংশ হিসেবে এবং সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার অলিখিত স্মৃতিচারণার মধ্যে। এর মধ্যে রয়েছে প্রাক্তন নক্সালকর্মী, তাদের পরিবার এবং প্রতিবেশী, যাদের ব্যক্তিগত ইতিহাস, রাজনীতির অভিজ্ঞতা এবং তাদের পরিবেশের মানচিত্রগুলি যা নকশালবাড়ীর স্মৃতিচিহ্নের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। তারা এখনো এগুলো নিয়ে আলোচনা করে এবং তাদের জীবনের উপর নক্সালবাড়ীর প্রভাবের মূল্যায়ন করে।তাদের সুস্পষ্ট এবং বৈধ বিবৃতিগুলি কিছু বিশেষ ধরনের স্মৃতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে সাহায্য করে। বিশ্বের অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন এই স্মৃতিআখ্যান গুলি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পুনর্বিবেচনা করার জন্য বিশেষ কার্যকারী। মনে করা হয় যে, যদিও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নক্সাল সংগঠনের আদর্শ এবং আত্মত্যাগের আদর্শ প্রদান করে, কিন্তু আন্তর্জাতিকতাবাদ ও রাষ্ট্র বিরোধী কার্যকলাপ তাদের রাষ্ট্র বিরোধী অবস্থান প্রদর্শিত করে। আরবান অ্যানথ্রোপোলোজিস্ট হেন্রিক ডোনার (২০০৪) নক্সাল আন্দোলনের ওপর গবেষণা ও প্রাক্তন নক্সালদের সঙ্গে আলোচনা করে দেখেছেন যে, জাতীয়তাবাদী কল্পনা, পূর্ববর্তী সংগ্রামের সাথে সম্পর্কিত মতাদর্শ এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ব্যবহার, আসলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্যের উপর বিতর্কের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ডোনারের মতে, সাবেক নক্সাল আন্দোলনকারীরা নক্সাল আন্দোলনকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা হিসাবেই দেখে। তারা তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত গুলি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূল্যায়ন এবং তার সমালোচনার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে তোলে। অপরদিকে, অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী ও সুদিপ্ত কবিরাজ তাদের ব্যাখায় বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকেই পরবর্তী বাম আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে দেখিয়েছেন। ১৯৭০ এর দশক বাংলার ইতিহাসের এমন একটি সময়কাল, যখন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের বিভাজনই রাজনৈতিক সংঘর্ষের ভিত্তি প্রদান করেছিল। আর সঙ্গে ছিল ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক দল গঠন ও পার্টি রাজনীতি। করব্রিজ ও হ্যারিসের মতে একদিকে যেমন আদর্শবাদী রাজনীতির প্রতি গভীর অনাস্থা নক্সালবাড়ীর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের অংশ, তেমনি নতুন রাজনৈতিক স্থান গঠন এবং অংশীদারিত্ব, এক বড় অংশের মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীকে দলীয় রাজনীতিতে টেনে আনতে সমর্থ হয়েছে। অনেকে মনে করেন, এই আন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সাহিত্যিক সংবেদনশীলতা। নক্সাল আন্দোলন অতীতের শিল্প ও সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় হাজির করে জনগনের স্বার্থে তার পুণর্মূল্যায়ণ করেছে। শুধু তাই নয়, জনগনের স্বার্থে ঐ সকল সাহিত্যের কি অবদান, সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বার বার। কিন্তু আবার প্রশ্ন উঠতে পারে, নক্সাল সাহিত্য কি নিজেই সংস্কৃতি চর্চায় আরেকটি অভিজাত্যের মাত্রা বয়ে নিয়ে আসেনি? নক্সাল আন্দোলন নিয়ে এত কথা ও আলোচনা শেষপর্যন্ত বাঙ্গালী ভদ্রলোক, বুদ্ধিজীবি ও মধ্যবিত্ত সমাজের রোমান্টিক স্বপ্ন হয়েই কি রয়ে গেল না? আর অপরদিকে প্রান্তিক কৃষকেরা রয়ে গেল শুধু মাত্র সরকারী বদান্যতায় পরিচালিত কিছু উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের অংশীদার হিসেবে ও সময়ের সাথে বেড়ে ওঠা ব্যাক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার ঘেড়াটোপের মধ্যে। যারা রাজনীতির ভাগ্য ও ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী, নক্সালবাড়ী তাদের জন্য সত্যি একটি আকর্ষণপূর্ণ বিষয়। একটি ক্ষনস্থায়ী আন্দোলন কিভাবে একটি ঔপনেবাশিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভাঙ্গতে সক্ষম হয়েছিল বা উদ্দ্যত হয়েছিল তা অধ্যয়ন করার মত বিষয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার, কোন অবস্থার অধীনে কোন আন্দোলন নতুন ভিত্তি তৈরি হয়? বা কোন পরিস্থিতিতে একটি সসস্ত্র আন্দোলন ও একটি বিতর্কিত রাজনীতি মানুষের মনে এমন আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে? তা নিয়ে গবেষণার জন্য নক্সালবাড়ী বরাবরের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এই রাজনীতি আগামী প্রজন্মের রাজনীতিতে কি অবদান রেখে যায়, তা অবশ্যই গবেষণার দাবী রাখে। সবশেষে বলব, নক্সাল আন্দোলন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিস্তৃত করেছে। তাই নক্সাল আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রভাবগুলি কেবল রাজনৈতিক সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করলে তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। একথা অস্বীকার করলে চলবে না যে নক্সালবাড়ী এদেশে সর্বজনীন আলাপালোচনার এক প্রসস্থ পথ তৈরী করেছে তা সে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রশ্নই হোক বা হোক সংগঠনের প্রকার ও তার রাজনৈতিক অবদান, বা রাজনৈতিক বক্তৃতা, কর্তৃত্ব এবং স্থানীয় রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সঞ্জয় সেঠ মনে করেন যে ভারতবর্ষের সাবাল্টারন স্টাডিজ এবং উত্তর ঔপনিবেশিক তত্বের গড়ন অনেকটাই ঠিক করে দিয়েছে ঊনিশশো ষাট ও সত্তরের নক্সাল আন্দোলন। ভারতে আধুনিকত্বের সমালোচনা, জাতীয়তাবাদ ও জাতি রাষ্ট্রের সমালোচনা, এবং সমগোত্রীয় অগ্রগতির ধারার বর্ণনার সমালোচনার সূত্রপাত হয়েছে নক্সাল আন্দোলনের হাত ধরে। সঞ্জয় সেঠ তাঁর গবেষণায় এর উত্তর খুঁজে পেয়েছেন নক্সাল আন্দোলনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও আন্দোলন কে ঘিরে গড়ে ওঠা তৎপরবর্তী কেতাবী লেখাঝোখার মধ্যে।
৫। শেষ কথা
১৯৮০ র দশকের শেষের দিকে, যখন এক এক করে সমাজতান্তিক দেশ গুলোর পতন হতে শুরু হল, মার্ক্সবাদ ও সমাজতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতার ওপর নতুন সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল। তবে সমাজতন্ত্রের পতন এবং ইউরোপে সমাজতন্ত্রের কুফল ওর তার আলোচনা তৎকালীন সমাজ বিজ্ঞান কে আরো সমৃদ্ধ করেছে। নতুন ইতিহাসবাদ ও নৃতত্ত্ববিদ্যা সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় নিয়ে এল নতুন নতুন অবস্থান ও বিশ্লেষণ বিভাগ। পুরোনো মার্ক্সবাদী সমাজবিজ্ঞানীদের একাংশ জুড়ে গেল, সমাজবিজ্ঞানের নতুন ভাবধারাগুলির সঙ্গে তা সে নারীবাদই হোক বা হোক মানব অধিকারবাদ বা প্রান্তিকতাবাদ বা উত্তরাধুনিকতাবাদ। নতুন ভাবধারা গুলি নিয়ে এলো নতুন ব্যাখ্যা, নতুন ইন্টারপ্রিটেশন। একদল মার্ক্সবাদী – উত্তরাধুনিকতাবাদী অর্থনৈতিক উৎপাদন-সম্পর্ক গুলির উৎস খুজে পেল সমাজের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের মধ্যে যা আদতে ক্লাসিক্যাল মার্ক্সবাদের বিরোধী। দক্ষিন আমেরিকার রাজনৈতিক বাস্তব্যবিদ্যা ও তাকে ঘিরে আন্দোলন এমন একটি ধারার একটি বড় উদাহরণ। দক্ষিণ আমেরিকার সংহতি অর্থনীতি ও সংহতি আন্দোলন খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বোলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের সংহতি আন্দোলন উৎপাদন পদ্ধতি কে পুরোপুরি না বদলে, পুঁজিবাদী সংকটের সময় সমান্তরাল সমাধানের উপায় খুঁজে বের করে। সংহতি অর্থনীতি মানব অধিকার ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে হাতিয়ার করে গনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করে। নতুন ধারার রাজনীতি এখানেও তৈরী করছে বিশ্লেষনের নতুন উপাদান। সম্প্রতি, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা সহ বহু দেশে যখন উগ্র জাতিয়তাবাদ ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে, তখন ইউরোপে মার্ক্সবাদী পন্ডিতদের এক নব উত্থান নতুন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এর সূত্রপাত ঘটাতে পারে বলে মনে আশা করা হচ্ছে। আমাদের দেশের উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের সূত্রপাত হয়েছে নক্সাল আন্দোলনের হাত ধরে। আগামীদিনের সমাজ গঠনে ও সমাজ বিশ্লেষণে, নক্সালভাবধারা কি নতুন মাত্রা যোগ করে তা দেখার অপেক্ষায় থাকব।
গ্রন্থবিবরণী/তথ্যসূত্রঃ
Amar Bhattacharya, 2007. Revolution Unleashed: A History of Naxalbari Movement in India 1964-72. Kolkata: Sampark
Dasarathi Bhuyan, 2010. Naxalism: Issues and Concerns, Delhi: Discovery
Deepankar Basu and Debarshi Das, 2013. “The Maoist Movement in India: Some Political Economy Considerations”, Journal of Agrarian Change, Vol. 13, No. 3.
Dipesh Chakraborty, 1999. “Adda, Calcutta: Dwelling in modernity”. Public Culture, Vol. 11, No. 1
Henrike Donner, 2004. “The Significance of Naxalbari: accounts of personal involvement and politics in West Bengal”, Occasional paper, London School of Economics and Political Science.
J. Iguarta and Dario Paez, 1997. “Art and Remembering Traumatic Collective Events: the Case of Spanish Civil War”, in Pennebaker et. Al (eds) Collective Memory of Political Events. New Jersey: Lawrence.
Nina Martyris, 2014. “The Naxal Novel”, Dissent, Fall 2014
Ranabir Samaddar, 2017. “50 years of Naxalbari: why the new milieu it spawned is still relevant today”, Catch News.
S. Corbridge and John Harris, 2000. Reinventing India: Liberalization, Hindu Nationalism and Democracy, Cambridge: Blackwell.
S. Kabiraj, 1997. “Filth and Public Spheree: Concepts and Practices about Spaces in Calcutta”, Public Culture, Vol. 10, no. 1.
Sanjay Seth, 2006. “From Maoism to Postcolonialism? The Indian Sixties and Beyond”, Inter-Asia Cultural Studies, Vol 7, No. 4.
Santosh Rana, 2007. “Naxalbari Peasant Uprising, 1967”, in S. Barma (eds.) Socio-Political Movements in North Bengal. Delhi: Global Vision.
Sudipta Bhattacharyya, 2007. “Class and the Politics of Participatory Rural Transformation in West Bengal: An Alternative to World Bank Orthodoxy”, Journal of Agrarian Change, Vol. 7, No.3.
Sumanta Banerjee, 2006. “Beyond Naxalbari”, Economic and Political Weekly, Vol 41. No. 29.
Sumanta Banerjee, 1980. In the wake of Naxalbari: a history of the Naxalite movement in India. Kolkata: Subarnarekha.
Sumit Kumar, 2015. Amar Bari Tomar Bari NaxalBari, Horizon Books.
Vaskar Nandy, 2007. “The Naxalite movement: An Ethnic Divide,” in S. Barma (eds.) Socio-Political Movements in North Bengal. Delhi: Global Vision.
[লেখক :- সামাজিক নৃতত্ববিদ, গবেষক ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান, ইনস্টিট্যুট অফ সোসাল স্টাডিস ট্রাস্ট, নয়া দিল্লী; পরামর্শদাতা, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন; এবং বোর্ড সদস্য, কমুউনিটি অফ ইভেলুয়েটরস – দক্ষিণ এশিয়া]