গল্প : ইশরাত তানিয়া


যার যা কিছু অথবা ধুলোমাখা ব্যক্তিগত চাঁদ


ভেতর আর বাইরেটা বুঝি কখনোই মেলে না। ভেতরটা যদি মায়াবী আলো, বাইরেটা খসখসে অন্ধকার। বাইরেটা লাবণ্য ধরে তো ভেতরটা রুক্ষ ঊষর। ভেতর আর বাইরের তাপমাত্রাও ঠিক যেন তেমনি। বিস্তর ফারাক নিয়ে পরস্পর বিরোধী। তাই গরম হলকার ঝাপটায় এক মুহূর্তেই চশমার ঠাণ্ডা কাঁচ দুটো ঘোলাটে।  

ফোন হাতে বেরিয়ে দেখি চোখের সামনে কুয়াশা।

-হ্যালো! হ্যালো! কি হয়েছে? কতবার বলছি যখন কল কেটে দেই আর ফোন করবে না। কল রিসিভ না করলে ফোন করতেই থাকো, করতেই থাকো।

– সাধে ফোন করি? কর্নফ্লেক্স শেষ। আর টুশি’র স্কুলের বেতন নিয়ে আসবা। দুই মাসের বেতন একসাথে দিতে হবে।

– ঠিক আছে। ক্লাস নিচ্ছি। এখন রাখি।

-আজকেই টাকা তুলবা।ভুলে যেও না। কালকের পর দুই মাস ছুটি। আবার যাবে কে? সব আমাকেই দেখতে হয়।

এ কথা শুনেই ম্যাট লিপস্টিকের শুকনো ঠোঁট নরম হয়ে ওঠে-হ্যাঁ হ্যাঁ। আজকেই টাকা তুলব।

স্কুলে লাইন ধরে বেতন দেয়া খুব বিচ্ছিরি আর লম্বা সময়ের ব্যাপার। তিন বছর ধরে আম্মু এই ডিউটি পালন করছে।এই কাজটা যে করতে হচ্ছে না, সেটা ভেবে ঠোঁটের নরম না হয়ে উপায় নেই।

-ক্লাস শেষ করে কথা বলি?

সাদা বোর্ডের ওপর ডিম্যান্ড আর  সাপ্লাই থিয়োরির রেখা চিত্র ফুটে ওঠে। পণ্যের দাম বাড়লে ক্রেতার চাহিদার পরিমাণ কমে। দাম কমলে চাহিদা বাড়ে। দামের সাথে চাহিদার বিপরীত সম্পর্ক। এদিকে দাম বাড়লে বিক্রেতা সরবরাহ বাড়ায়। দাম কমলে সরবরাহ কমায়। দামের সাথে যোগানের সম্পর্ক সমমুখী। ক্রমশ মার্কারের লাল নীল রঙের ঝটপট আঁচড় পড়ে বোর্ডের ওপর। একের পর এক এক্স আর ওয়াই অ্যাক্সিসে বোর্ডের ডান থেকে বাম পুরোটাই ভরে যায় আর বাজার অর্থনীতির একটি ভারসাম্য বিন্দুতে চাহিদা আর যোগান রেখা নিজেদের ছেদ করে। জটিল বিষয় সরল হয়ে যায় ছাত্রদের কাছে।

লেকচার দিয়ে গলা শুকিয়ে আসে। টিচার্স রুমে এসেই গলা ভেজাই। বোতলের পানি কুসুম গরম। এসি ঠিকমতো কাজ করছেনা। বদ্ধ রুমে হাঁফ ধরে যায়। টিস্যু পেপার কপাল আর ঠোঁটের ওপরে স্বেদ বিন্দু শুষে নেয়। এখন অফ। লাঞ্চ করেই পরের ক্লাস। আজ বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসিনি। খাবারের জোগাড়যন্ত্র করতে গেলে আর গোসল করে বেরোতে হতো না। এদিকে যা গরম পড়েছে। বরফপানি গায়ে ঢাললে হয়তো শান্তি। সারাদিনে ওই পানিটাই তাপহরা।

চোখ চলে যায় হাতে  ধরা টু ডু লিস্টে –

১.মেডিকেল লিভ।

২. এক প্যাকেট খাতা।

৩. ক্লাস টেস্টের প্রশ্ন ফটোকপি।

৪.এনওসির জন্য এইচআরডিতে কল।

৫. ছায়ানট।

৬. ক্লাস লেকচার।

৭. ছবি প্রিন্ট।

৮. বাজার (টক দই, মাল্টা, ডিম, লাল শাক, এঁচোড়, শ্যাম্পু, লুফা)

তারপর মাঝখানটা ফাঁকা। অনেকটা নিচে ছোট করে লেখা-

শহীদুল জহিরের চিঠি আর অগ্রন্থিত দুটো গল্প পড়া।

গল্পের খসড়া ঠিক করা।

তালিকার শেষ দুটি আইটেম পড়ে মন খারাপ হয়। গত এক মাস ধরে এই দুটো কাজ করা হচ্ছে না। টু ডু লিস্টের বাকী কাজগুলো ঠিকই করা হয়। শুধু এ দুটি কাজ ‘ক্যারি ফরোয়ার্ড’ হয়ে যায়। যেটুকু মিলল না সেই ব্যালেন্সটা পরের দিনের হিসাবে টেনে নিতে হবে। এই তো জীবন। হাহ! গুরুত্বহীন দুটি কাজের কোনো নাম্বার নেই। তালিকায় থেকেও এরা নাম্বারহীন। সংখ্যাওয়ালা কাজের সাথে এরা ঠিক যায় না। গোত্রহীন দুটো কাজ। পড়া আর লেখা। বাউকুড়ানীতে চক্রাকারে ঘুরতে থাকা পাতার মতো এরা উড়তেই থাকে। ধরা দেয় না। সম্পাদককে লেখার কথা দিয়ে একটা অক্ষরও লিখিনি। না না এভাবে আর চলছে না। আজ বসতেই হবে।

টুশিয়ার দুমাসের বেতন একসাথে দিতে হলে সেটা চাপই। সেভিংস সার্টিফিকেট কেনার জন্য টাকা রেখেছিলাম। ট্যাক্সের ফাঁশ গলায় এমন চেপে ধরেছিল গতবছর। অ্যাকাউন্টে বেতন ঢুকতে না ঢুকতেই একগাদা টাকা বেরিয়ে গেল। ট্যাক্সে কিছু ছাড় পেতে হলে সঞ্চয়পত্র কিনতেই হবে।

ডানপাশে বিশাল কাঁচের দেয়াল। নীলচে কাঁচ দিয়ে বাইরেটা দেখা যায়।রোদেলা আকাশ ধূসর হয়ে এসেছে। দূরে কোথাও হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার আইল্যান্ডের ওপর কৃষ্ণচূড়া দাঁড়িয়ে আছে। এবার যেন ফুলের বান ডেকেছে। সবুজ পাতা ঢাকা পড়েছে ফুলে ফুলে। লালের তুমুল হাসিতে সঞ্চয়পত্রের ভাবনাটা উড়ে গেল। মনে হলো পাশে একটা রাধাচূড়া থাকলে বেশ হতো।

এসিটা একদমই গেছে। জানলাটার স্লাইডিং গ্লাস সরিয়ে দিতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস টিচার’স রুমে ঢুকে পড়ল। সাথে ভেসে এলো- ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে…

তাই তো! আগামী কাল ৭ মার্চ। ৭১ এর এই দিনে কী ধীরস্থির ভাবে মঞ্চে উঠে এলেন বঙ্গবন্ধু! উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন সেই কথা, যা শোনার জন্য লক্ষ লক্ষ বিক্ষুব্ধ মানুষ ছুটে এসেছে। বঙ্গবন্ধু অতীত আর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বলছেন। জনগণ ভাবছে, নেতা আজ কী দিক নির্দেশনা দেবেন। 

আমার এই ভাবনার মাঝেই তালিকার নাম্বার আর নাম্বারহীন কাজের মাঝখানে দুটো আইটেম ঢুকে গেল-

৯. টাকাতোলা।

১০. কর্নফ্লেক্স কেনা।

প্লেটে স্যান্ডুইচ রেখে গেছে অ্যাটেনডেন্ট। প্লেটের নিচে বিলের স্লিপ। পাশে পাঁচশ এম এল ঠাণ্ডা পানির বোতল। রুম টেম্পারেচারে গায়ের ঘোলাটে ভাব ঝরিয়ে দিয়েছে বোতল। কয়েক ফোঁটা পানি বোতল চুইয়ে টেবিলে জমেছে। স্যান্ডুইচে কামড় দিয়ে ফোনে সময় দেখি। কফি খাওয়া যেতে পারে।

নাজনীন এসে মিডটার্ম পরীক্ষার স্ক্রিপ্ট লকারে তুলে রাখে। টিচার্স রুমে ঢুকেই সে বিরক্ত। গরম থেকে এসে ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রত্যাশা খুব বেশি কিছু না। বেচারি একটা রিসার্চ পেপারের কাজ করছিল। এক বছর ধরে সব কাজ বন্ধ। শ্বশুর স্ট্রোক করে প্যারালাইজড। শাশুড়ি নেই। চাকরী, সংসার, ছেলে, রোগী এক হাতে সব সামলিয়ে নাজেহাল। মাঝখানে রিসার্চের কাজটা অবহেলার ধুলোয় ঢাকা পড়ে গেছে।

-সিএসআর এর কাজটা আবার শুরু করো নাজনীন। ওর ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে এ কথাটাই আমি বলি। মনে হলো এটাই বলা দরকার।

মৃদু হাসি নাজনীনের ঠোঁটের কোণে। হতাশ মানুষ কারো নির্বুদ্ধিতায় যেমন করে হাসে।

-আর আমার পেপার হবে না ম্যাডাম! কর্পোরেট সোশাল রেস্পন্সিবিলিটি নিয়ে কী লিখব? জব আর ফ্যামিলি রেস্পন্সিবিলিটি নিয়েই পাগল হয়ে যাচ্ছি।

-এই ফ্রাইডেতে অ্যাডমিশান টেস্ট। ইনভিজিলেটর লিস্টে তোমার নামও দেখলাম।

-হু। স্যাটারডেতেও ডিউটি আছে। ভাইভা নিতে হবে।আপনার আর্টিকেলের খবর কি?

-তোমারটার মতোই। দুই বছর ধরে পাবলিকেশন নাই।

কোকিলের ডাকে হঠাৎ স্নিগ্ধ হয়ে যায় গুমোট রুম। হোক না রিংটোন। ফোনের দিকে তাকিয়ে লাইনটা কেটে দেই। কল ব্যাক করে শান্ত গলায় বলি- হ্যাঁ, শেষ তিনটা ওষুধ কিনবা দুই পাতা করে। বাসায় দিয়ে আসবা। আমি কিন্তু কলেজে।

-বাসার সিকিউরিটি গার্ডকে টাকা দিয়ে এসেছি ওষুধ কিনতে। আম্মুর ওষুধ শেষ।

-আমারও ওষুধ কিনতে হবে। শ্বশুরের জন্য। ভুলেই গেছি! শ্বশুরের ছেলের কিন্তু এসব দেখার টাইম নাই। অফিস আর বাজার করেই সে টায়ার্ড।

-এ মাসের স্যালারি  হয়েছে?

মুহূর্তেই ওর গলা গম্ভীর হয়ে যায়- না। হয় নাই।

-কী দিনকাল এসে পড়ল রে নাজনীন! একটা এক হাজার টাকার নোট ভাঙালে তিনদিন চলে না।

-হুম…

এবার নাজনীনের ফোন ডেকে ওঠে। ‘এক্সকিউজ মি ’, বলে সে কল রিসিভ করে।

আমি চিলি সসের প্যাকেট খুলি। মিনি প্যাক। স্যান্ডুইচের স্বাদ বাড়িয়ে দিয়েছে লাল সসের প্রলেপ অথবা খিদে-বোধটাই সসের হয়ে কাজ করছে জিভের ওপর।  

জানলা দিয়ে আসা বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো সাথে মিশে যাচ্ছে গাড়ি আর বাসের লাগাতার হর্নের শব্দে। …শোনেন, মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান বাঙালি অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়…

আশ্চর্য হলাম। আগে কখনও মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনিনি। পাকবাহিনীর সাথে এদেশীয় দোসররা মিলে যাবে তাঁর এমন আশঙ্কা সত্য হয়েছে। এই সতর্কবাণী বাস্তবে ফলেছে একাত্তরের ২৫ মার্চের পর।সেই পলাশীর প্রান্তরের বিশ্বাসঘাতকরা রাজাকারের বেশে সত্যিই আবার ফিরে এসেছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধূলিসাৎ করতে। এখন মনে হচ্ছে, পাকিস্তানীরা ধর্মীয় অনুভূতিকে অস্ত্র বানিয়ে হিন্দু-মুসলমানে বিভেদ তৈরি করবে, আগেই তিনি এটা আঁচ করতে পেরেছিলেন।

চাপা গলায় নাজনীন ফোনে কথা বলে- এই বয়সে এতো রাগ করা ঠিক না, চাচী… আপনারই ছেলের বউ। দুএকটা শব্দ কানে বাড়ি খেয়ে ফিরে যায়। মস্তিষ্কের ভেতরে ঢুকতে পারে না। সেখানে এখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। …মনে রাখবেন রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনেন, তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নিবার পারে। কিন্তু পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে চালাবেন। কিন্তু যদি এদেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে শুনে কাজ করবেন…

কি করতে হবে সেই নির্দেশ তিনি জারি করছেন। অবাক লাগে, সারা পূর্ব পাকিস্তান কোনো রাষ্ট্রনায়ক নয়, একজন নেতার কথায় তখন চলছে। সম্মোহিত হয়ে শুনছে নেতার নির্দেশ। অফিস-আদালত, মিল-ফ্যাকট্রী, ব্যাংক-বীমা, রেডিও-টিভি, পোস্ট অফিস, ইটখোলা, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা জেনে নিচ্ছে কার কি করণীয়।

নাজনীন লাঞ্চবক্স খুলে বলল, শুঁটকীভুনা এনেছি। খাবেন, ম্যাডাম? শুকনা মরিচ দেয়া।

-ইশ! মাত্র দুটা স্যান্ডুইচ খেলাম। গরম ভাত আর শুঁটকীভুনা হাতছাড়া করার বান্দা আমি না।

-আহা রে! খেয়াল করলাম না। ফোনে কথা বলতে বলতে। 

আমি হেসে ফেলি- আরেকদিন খাবো। তুমি লাঞ্চ শেষ করো।

পছন্দের বইগুলো কেনা হয় না। সামনের মাসেও হবে না। রুনা খালার ছেলের বিয়ে। নিপুণ হাতে আঁকা নীল চীনা ফুলদানীটা যেদিন কিনলাম, হাতে নিয়ে মনে হয়েছিল সুন্দর জিনিসগুলো দোকানে আসেই অন্যের জন্য কেনা উপহার হয়ে যেতে। নিজের বদ্ধ গুমোট ঘরটা আর সাজানো গোছানো হয় না। বিশাল একটা বুকশেলফ এই জন্মে আর হবে না। দেয়ালে একটা পেইন্টিং শুধু কল্পনাতেই। জানলায় মানিপ্ল্যান্ট রাখব ভেবেছিলাম। জানলাই খুলতে ইচ্ছে করে না। পাশের বিল্ডিং-এর রান্নাঘর আর রান্নাঘরের বারান্দায় ঝোলা ন্যাতা দেখতে বিশ্রী লাগে। দীর্ঘশ্বাস বুক থেকে বেরিয়ে এসে বাতাসে মিশে যায়।

মোবাইল ডেটা অন করতেই নানা রকম শব্দ ঝাঁপিয়ে এলো। ইমেইল আসছে। হোয়াটস অ্যাপ নোটিফাই করছে। ম্যাসেজ ঢুকছে ইনবক্সে।

তুমি গল্পকার। ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা বুঝবে। তোমার গল্প তোমার মতোই সুন্দর হোক। আমি এক সাধারণ খোঁড়া বেলুনওয়ালা। আপাতত ছুটি। ইচ্ছে হলে ব্লক কর। এত খারাপ বলার কী দরকার?

প্রিয় শিল্পানুরাগী, নিশ্চয়ই ভালো আছেন। ২০ মার্চ বিকাল সাড়ে চারটায় সাহিত্য আড্ডা ও পাঠ। এবার কবিতা পড়বেন কবি আদনান আজাদ, মিলন চৌধুরী, আঁখি বড়ুয়া। বাড়ি- ৬, রোড- ৯/এ, সাত মসজিদ রোড, ঢাকা। এ আয়োজনে আপনার স্বতঃস্ফুর্ত উপস্থিতি কামনা করি।

আজ আর কেউ মিস করে না। এই বোধটাই এখন স্বস্তিতে রাখে। এই কথাটা কোথায় লিখব বুঝে পাই না। তাই আপনাকে লিখলাম।

আমার নাম্বারটা লোড করো তো। হোয়াটস অ্যাপে তোমার নাম্বারটা রং বলছে। এইমাত্র কল করেছিলাম। প্রোগ্রাম কেমন হলো?

মাহফুজ সেন্ট আ ফোটো। রমজানুল মোবারক। খোশ আমদেদ মাহে রমজান। পবিত্র রমজান মাসের সেহরী ও ইফতারের সময়সূচী।

ড. নামিরা আপনার পিএইচডি কোন বিষয়ে? এমনি জানতে চাইলাম।

মা, আই বেকড দিস কেক। গ্র্যানি ইজ ইন আ রাশ বিকজ শি ওয়ান্টস টু টেস্ট ইট।

আদি মানবীর মতো আমিও গুহায় ফিরি। দিনশেষে ক্লান্ত বল্লম হাতে নিয়ে। চাহিদা মেটানো আর যোগান দিতে দিতেই জীবন কেটে গেল। কোথাও মনের জায়গা নেই। চায়ের পানি বসিয়ে শাড়ি ছেড়ে টিশার্ট আর ট্রাউজার পরি। পানি ফুটতে থাকার সময়টুকুও কাজে লাগাই।

ফুটন্ত পানিতে চাপাতা ছেড়ে তাকিয়ে থাকি। এদিক সেদিক গুঁড়ো গুঁড়ো পাতার ঘুরপাকের কতরকম টেক্সচার। সময়টাকে কয়েক হাজার বছর পেছনে টেনে একটা গল্প লেখাই যায়। সেই গুহাচিত্র, আদিমাতা, গল্প ভাবতে ভাবতে মুখে পানির ঝাপটা দিই। আরাম লাগে।প্রতিটি রোমকূপ জলের বিন্দু শুষে সতেজ সজীব হয়ে যায়। ডিম আর টকদই তুলে রাখি ফ্রিজে। পায়ে পায়ে টুশিয়া ঘুরছে বিড়ালের মতো। ততক্ষণে পানির রঙ গাঢ় বাদামী হয়ে চায়ের সুবাস ছড়িয়েছে।

কেকের দিকে তাকিয়ে মনে হলো কত বিচিত্র ভাবেই না আনন্দ এসে ধরা দেয়। দেখতে দেখতে টুশিয়াটা বড় হয়ে গেল। কোমর ছাপানো চুল। এখনও নিজে শ্যাম্পু করে ধুতে পারে না। ফেনাই হয় না ঠিক মতো। চুল ধুয়ে দিতে হয়। ওর ঘুম কাতুরে নরম চোখ দুটো দেখলে মায়া লাগে। প্রায় রাতেই ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দেই। সেই মেয়ে কিনা ইউটিউব দেখে কেক বানিয়ে ফেলল!

ধোঁয়া ওঠা কড়া চা পড়ার টেবিলে রাখা। বিছানায় সবে গা এলিয়েছি, তখনই ঝাঁপিয়ে বুকের কাছে শুয়ে পড়ে টুশিয়া। আট বছরের নরম চুলে নাকমুখ ডুবিয়ে দিই। মিষ্টি গন্ধে মন ভরে যায়।

-তুমি বলেছিলে আমার সাথে স্টেফানি’জ হাউজ বানাবে!

-কাল বানাবো।

-কাল বলেছ আজ!

– আজ ম্যাথস করবে।

-করেছি। নিন্নির কাছে।

মেয়ের মুখের ওপর মেঘের পরত জমে-মা, আজকে তুমি খাইয়ে দেবে।

-আচ্ছা, দিব।

ক্লান্তিটুকু মেয়ের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখি। টুশিয়া হাসে। ওর বাঁ গালের টোলে নাক ঘষে দেইই। আধশোয়া হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনে হয় চিনিটা এবার ছাড়াই উচিত।

আম্মু’র ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি সাদা বিছানার ওপর শুয়ে আছে। নতুন চাদর পাতা হয়েছে। সাদার ওপর ছোট ছোট বেগুনি ফুলের মোটিফ। আমাকে দেখেই বলল- নূরবানুর জ্বর। কয়েকদিন আসতে পারবে না। রান্নার কি হবে?

-কি আর হবে? কিছু একটা হবে।

-দ্যাখ্‌ তোর মেয়ে সারাদিন কি করে। সাদা চাদর বিছানোই মুশকিল।

খাটের এক পাশে উপচে উঠছে প্যাস্টেল রংপেন্সিল আর লেগু সেটের অজস্র টুকরোতে। কিছু এতোই ছোট যে একবার এঁটে গেলে আর খোলা যায় না। আলাদা লিভার দিয়ে খুলতে হয়।

-এসব তুমি তুলে রাখবে না। আমিও না। টুশিকে শেখাতে হবে।

 ডান হাতে আমার চুলগুলো মাথার পেছনে ঠেলে দিতে থাকি অজান্তে- রুটি খেয়েছ? 

– নাহ। জাউ ভাত খাব। সারা গা ঝিমঝিম করে।

আবারও অ্যাসিডিটি হয়েছে আম্মুর। এলসিডি টিভিতে আলোচনা চলছে ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে। এই ভাষণ কেন বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ। সাথে ভিডিও ক্লিপিংস চলছে।…কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তেইশ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। তেইশ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস; বাঙলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস…

-৪৭এ স্বাধীন হলো পাকিস্তান। ৫২তেইবাংলা ভাষার উপর অ্যাটাক করল। হার্মাদের দল।

-তোমার বয়স তখন কত?

-আমি তো হলামই ৫৪তে।

-ওহ! তাই তো!

-আমরা স্কুল থেকে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যেতাম। ৮ই ফাল্গুন। একবার, ক্লাস ফোরে পড়ি মনে হয়, একদল ছেলে গাছ তলায় নিয়ে গেল। আমাদের কী কী যেন বলল। ১১ দফা দাবী বা এ রকম কিছু হবে। এখন আর মনে নাই।

-আচ্ছা। তোমার জাউভাত দিয়ে যাব?

-নাহ। উঠে খাব। নামাজ পড়ব। টিভি অফ করে দিয়ে যাও।  

ভাত খাইয়ে টুশিয়াকে ‘টুয়েফলথ নাইট’ এর বাংলা অনুবাদ পড়ে শোনাই। শিশুকিশোরদের জন্য সহজ করে লেখা। সচিত্র শেক্সপিয়ার নাট্যকাহিনী। সেবাস্টিয়ান, ভায়োলা, ওর্সিনো আর অলিভিয়ার গল্প। পাতায় পাতায় মেয়ে ছবি দেখে, গল্প শোনে আর বলে- এই লাইনটা কই লেখা?

আঙুল দিয়ে লাইনটা দেখিয়ে দিই- এই যে।

রাজা, রানী আর ডিউকের মহা প্যাঁচ লাগা কাহিনী এক সময় শেষ হয়। টুশিয়া বই হাতে নিয়ে পাতা উল্টায়, ছবি দ্যাখে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে- এই গল্পটার নাম কি শেক্সপিয়ার দিয়েছে?

-আর কে? শেক্সপিয়ারই।

-গল্পটার নাম টুয়েলফথ নাইট কেনো? বারো রাত মানে কি, মা?

মেয়ের কথায় তন্দ্রা কেটে যায়। নিজেও ভাবি টুয়েলফথ নাইট কেন?

– তাহলে কী নাম হবে? 

– জানি না। টু কাপলস হতে পারত।

-তা পারত।

আমার প্রায় বন্ধ চোখের দিকে একবার তাকিয়ে টুশিয়া ট্যাবে গুগল করে- What is the meaning of 12th night?

– মা, মা, টুয়েলফথ নাইট হলো ক্রিসমাসের পর বারোতম দিনের রাত। ইপিফ্যানি। সেই রাতে তিনজন ওয়াইজ লোক জেসাসকে দেখতে গিয়েছিল। গিফট নিয়ে।

– হুঁ। ওরা মেজাই। জ্ঞানী ব্যক্তি। তুমি যে প্রশ্ন করেছ আমি খুশি হয়েছি। সব সময় এমন প্রশ্ন করবে।

ততক্ষণে আমার গলায় ঘুম মিশে গেছে। বই বালিশের কাছে সরিয়ে রেখে দেই।

-আরেকটা প্রশ্ন। এই গল্পে তো জেসাস নেই?! 

-যীশু না। এখানে সেলিব্রেশান বোঝাতে… পরে বলব…

তিন জ্ঞানীর গল্প মেয়েকে বলার শক্তি আর ধৈর্য কিছুই বাকি নেই। টুয়েলফথ নাইট শুধুই উদযাপনের না। এ তো সেই ‘ইপিফ্যানি’ও। ‘মোমেন্ট অফ সাডেন অ্যান্ড গ্রেট রিয়েলাইজেশান’। পরম উপলব্ধি। সদ্যজাত যীশুর জন্য মেজাইরা লাগসই উপহার নিয়ে যাননি। এই অসঙ্গতি বলা ভালো অনুপযুক্ততার অনুভব আট বছরের মেয়েকে কীভাবে বোঝাবো সেটা ভাবার আগেই চোখ জড়িয়ে আসে। কী যেন পড়ার ছিল, লেখার ছিল মনে থাকে না।

পরম উপলব্ধি আসলে হঠাৎ চোখের ভেতর আকাশ ঢুকে যাওয়া। সেই আকাশ একবার চোখে ঢুকে গেলে আর বেরোতে পারে না। তখন অন্ধকার দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে যায় এক অদৃশ্য, অব্যাখ্যেয় আলোয়। দাম্পত্যের দিনগুলোয় বিষাদের রঙ লাগা শুরু হয়েছে কেবল। তানিম টেবিল টেনিস খেলে আর টিভি দেখে। আমি তখন ফিরে গিয়ে বই পড়ি। ডিপ্রেশানে ভুগি। কখনও নুডুলস খাই অথবা ছবি আঁকি। তানিম এসব দেখে ফিরে যায়। কখনও নুডলসের কাঁচের বাটি আছড়ে ভেঙে ফেলে। আমার ছবিতে ওর বিরক্তির ছায়া পড়ে। মেঝেতে ছড়িয়ে পরা নুডলস থেকে পা বাঁচিয়ে তানিম বারান্দায় যায়। সিগারেট খায় বেলি গাছের পাশে। বিষণ্ণ হয়।

টুশিয়া মা-বাবার সম্পর্কের কিংবা টেবিল টেনিস, টিভি, নুডলস, বই, ছবি আর বেলি ফুলের জটিলতা বুঝতে পারে না।সব গুলিয়ে ফেলে এদিক ওদিক তাকায়। একের পর এক ব্লক জুড়ে নিঃশব্দে বাড়ি বানায়। রোবট বানায়। পেন্সিল হাতে নিয়ে লেখার চেষ্টা করে। হিজিবিজি আঁকিবুঁকিতে নোটবুকের পাতা ভরে ওঠে।

ওর মিষ্টি হাসিতে ঘরে এক ফালি রোদ নামে। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর বাড়ি দেখি, রোবট দেখি। হাসিতে, আঁকিবুঁকিতে কিছুটা বেঁচে উঠি। সিগারেট আর বেলির গন্ধে তানিম ক্রমাগত ডুবে যায়। আমার ছবিতে রঙের প্রবল উপস্থিতি। আয়নায় লাল, বর্ষায় সবুজ, সন্ধ্যায় আরও ডাস্কি নীল উপচে পড়ে।

অন্তঃসারশূন্যতার পরম উপলব্ধি সেই প্রথম। ‘ গিফট অফ দ্যা মেজাই’ এর গল্পটা অন্যরকম মানে হয়ে উড়াল দিয়ে যায়। তারপর সে এক বিশেষ মুহূর্ত। নিজের ইচ্ছার জায়গাটিকে চিনে নেয়া। বেসরকারি কলেজে গ্র্যাচুইটি নেই, প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই। জীবিকায় সম্পন্ন ভাবটুকুই যা আছে। সামনে ঘোর অন্ধকার। তবু আত্মমর্যাদার প্রশ্নে একদিন আমি দ্বিধাহীন। নিজের পা দুটোকে প্রশ্ন করেছিলাম- একলা হাঁটতে পারবে তো? ততদিনে পৃথিবী তিনবার সূর্যকে ঘুরে এসেছে। পৃথিবীর সাথে আমিও।

হাঁটতে হাঁটতে কতটা পথ চলে এলাম, মনে করতে পারি না। অবাক হয়ে পেছনে তাকাই। ধু ধু বিরান প্রান্তরে চোখে ধাঁধাঁ লাগে। যাত্রার শুরুটা কোত্থেকে ছিল, শেষটাই বা কোথায়?কেন যেন মনে হয় ধুলোবালি উড়িয়ে পথই হেঁটেছে। আমি হয়তো স্থির ছিলাম।

ম্যাসেঞ্জারের শব্দটা অদ্ভুত এখন। কোনো কিছু পানিতে পড়লে এমন শব্দ হয়। চ্ছলাৎ ধরণের শব্দটা শুনে চমকে উঠলাম। এক মুহূর্তে তেপান্তরের মাঠ থেকে তাজমহল রোডের ঘরটিতে ফিরে আসি। হাতের ওপর স্থির হয়ে আছে ওড়না। ভাঁজ আর করা হয়নি। লন্ড্রির বাস্কেট পায়ের কাছে। খাটের ওপর এক স্তূপ কাপড় ঠেলে সরিয়ে ফোন খুঁজে বের করি। 

তুমি খুব অতীতভোলা লোক। ভুলে গেছো, প্রথাবিরোধী লেখার পক্ষে কথা বলি সবসময়। এর বিনিময়ে কেউ আমার লেখা ভালো বলবে এমন প্রত্যাশা নেই। এটা হয়তো বোকামি। তা আমি তো হাবাগোবাই। তুমি জানো সেটা।

টুশিয়ার জন্য কয়েক মাস টাকা দিতে পারব না। এক জায়গায় ইনভেস্ট করেছিলাম। লস প্রোজেক্ট। লসের টাকা ফেরত পাওয়া কঠিন। তুমি চালিয়ে নাও। পরে আমি দিয়ে দিব।

আতাউল আলম সেন্ট আ ফোটো। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন।

পিরিওড চলাকালীন সময়ে নিচের চারটি কাজ অবশ্যই বর্জন করুন।

১। ঠাণ্ডাপানি, কোমল পানীয় ও নারকেল খাবেন না। কারণ…

২। এসময় মাথায় শ্যাম্পু ব্যবহার করবেন না। করলে…

৩। এসময় শসা খাবেন না। যেহেতু…

৪। পিরিয়ডের সময় শরীরে যেন শক্ত কিছুর আঘাত না লাগে, বিশেষ করে পেটে… দয়া করে এ তথ্যটুকু শেয়ার করে আপনার স্ত্রী, মা, কন্যা সকলের কাছে পৌঁছে দিন।

সপ্তর্ষি ওয়েব পোর্টাল ইউ আর নাও কানেক্টেড উইথ ম্যাসেঞ্জার।

স্করপিও ম্যাজিক হরোস্কোপ। উইল দিস বি ইয়োর উইক, নামিরা? লাভ… হেলথ… মানি…  

রিকশার চেইন ঠিক করছে রিকশাওয়ালী। মনযোগ দিয়ে ঝুঁকে কাজটা করছে। কলেজ থেকে বেরিয়ে এই দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগল। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর এলো- মিনারা বেগম। একশ টাকা দিতে চাইলাম। নিল না। হেসে বলল-কই যাইবেন? উইঠ্যা বসেন।

-যাওয়ার জায়গা তো একটাই মিনারা বেগম!

রিকশায় উঠে বসি। এই দার্শনিক কথা ভাত পায় না মিনারার কাছে। মাথার ক্যাপটা ঠিকঠাক করে সে। ক্যাপের নিচে এক বেণী। রিকশার হ্যান্ডেল ধরে টেনে আগে বাড়ে। প্যাডেল মারে।

-প্যান্ট শার্টে তোমার অসুবিধা হয় না?

-ওদের মতো ছেলের বেশেই চলতে হইব। নিজেরে মেয়ে মনে কইরা রোডে নামলে চলবে না।

-তুমি রিকশা চালাও। কেউ কিছু বলে না?

-বলে। আমি কিভাবে চলব সেইটা আমার বিষয়। জামাই, মনে করেন, নেশা করত। মইরা গেছে। আমি চিন্তা করি কি… আমি বাদ হইলে আমার মেয়েডাও বাদ হইয়া যাইব। আর এইডা কোনো খারাপ কাজ না আপা।

-মেয়ে আছে তোমার?

-হ। এক মেয়ে। আট বছর বয়স। আমার মায়ের সাথে দ্যাশে থাকে। মনে করেন, ওরে তো লেখাপড়া শিক্ষা দিতে হইব।

-দেখা হয় মেয়ের সাথে?

-হয়, মনে করেন, আট-নয় মাসে একবার। মোবাইল করি।

-আয়রুজি কেমন হয়?

– ঠিক নাই। মনে করেন, চাক্কা ঘুরুলেই ট্যাকা। তিনশ টাকা জমা দিয়া হাতে একশ দুইশ ট্যাকা থাকে। কোনোদিন শূন্য পকেট।

শূন্য পকেট শুনে চমকে উঠি। তিন চাকা নিয়ে রাস্তায় নেমে যাওয়া এই মিনারা আর অধ্যাপক নামিরা। মিনারা আর নামিরা যেন একই। শুধু তিনটি অক্ষরের এদিকওদিক জায়গা বদলে নেয়া।

হাওয়ার বেগে রিকশা চালায় মিনারা। মাথার ওপর ঝাঁ ঝাঁ করছে মে মাসের রোদ। ঘামে তেলে মুখ চটচট করছে রাস্তার লোকজনের। পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে আছে জনা পঞ্চাশেক লোক। লালরঙা পোস্টারে শাদা হরফগুলো উজ্জ্বল। সেখানে লেখা-

ধান এক কেজি ১২ টাকা।

মিনারেল ওয়াটার আধা কেজি ১৫ টাকা।

লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকি যতক্ষণ না চোখের আড়াল হয়। মনে মনে অঙ্ক করি। সস্তা বোঝাতে মানুষ ‘জলের দরে’ বলে। এখন দেখি আক্ষরিক অর্থেই ধান পাওয়া যায় পানির চেয়েও কম দামে। গতকালও ভিড় দেখেছি প্রেসক্লাবের সামনে। রাস্তায় ধান ছিটিয়েছে কৃষকরা।কেউ দুহাতে ধান ঘাঁটছে। কেউ দুহাতের পাতায় ধান নিয়ে তাকিয়ে আছে ধানের দিকে। মলিন লুঙ্গি, শার্ট আর মাথায় গামছা বাঁধা। সারা দেশে ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের দাবীতে এই মানব বন্ধন।

মিনারার কথায় চিন্তাটা থেমে যায়।

-দুই চাইরটা ফেলাইওভার করলেই উন্নতি হইব?

-না মনে হয়।

-ধানের কেজি ১২ট্যাকা। চাউলের কেজি ৪০ ট্যাকা।

মিনারার কথায় চমকে উঠি। চারপাশে এতো লোকজন। কেউ তো এসব নিয়ে কথা বলে না। ছাত্র, শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, দোকানদার, ড্রাইভার, বুয়া… তালিকা দীর্ঘ হয়। কিন্তু সে তালিকায় কোথাও একজন মানুষ পাই না যে কৃষকের কথা বলে।

-ধানের দাম কমে কিন্তু চাউলের দাম কমে না।

-ধান কিনে কল মালিকরা। দাম বাড়ায় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।

-মনে করেন, সারের দাম বেশি, লেবারের দাম বেশি। গিরস্তের চলে না তো।

-আড়তদাররা কত রকম কারসাজি করে।তাই কৃষক ন্যায্য দাম পায় না।

– সবের দামই বেশি।ধানের দাম কম। গিরস্ত বাঁচবো?

চাহিদা-যোগান তত্ত্ব, শ্রম, বিনিয়োগ, উৎপাদন, বাজার আর ভোক্তা আচরণ সব আমার গুলিয়ে যায়। বই আর বাস্তবের সংঘর্ষে মাথার ভেতর গল্পের স্ফুলিঙ্গ ঝলসে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথা মনে হয়… আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলবো, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে…

আসলেই, কী পেলাম আমরা? সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই শুনছি ‘হয় ধান নয় প্রাণ’। মনে মনে লিখতে থাকি টাংগাইলের এক কৃষকের কথা। ধানের দাম না পেয়ে ধানিজমিতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানে এক মন চালের দাম ছিল ৫০ টাকা। একই চালের দাম পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল মনপ্রতি ২৫ টাকা। একই দেশে দুই দাম। স্বাধীনতার পরও চাষী ন্যায্য দাম পায় না।

ধান সস্তা অথচ চাল কেন এত দামে কিনতে হবে? শোষণ আর বঞ্চনার শেষ কোথায় কে জানে? আজ বাসায় ফিরেই বসব ল্যাপটপে।লিখতে হবে কৃষকের কথা। মিনারার লড়াইয়ের কথা। এরই মধ্যে পাশ দিয়ে একটা রিকশা চাকায় ঘষা দিয়ে চলে গেল।

জোরে হাঁক ছাড়ে মিনারা-ওই মিয়া! দেইখ্যা চালাইতে পারো না?

পেছন ফিরে আমার দিকে না তাকিয়েই বলল- দ্যাহেন দ্যাহেন, ইচ্ছা কইরা মাইরা দিল।

-হুম… ডান দিকে এতো জায়গা তবু চাপায় দিল।

মিনারার রিকশা স্পীড ব্রেকারে উঠে নেমে যায়।

পাখিস্বরে ফোন বাজে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে হাতে নেই। আম্মু কলিং। ফোন ধরতেই রিনরিনে গলা- মা, নিন্নির জ্বর। কখন বাসায় ফিরবে?

-এই তো আর পাঁচ মিনিট।

রাস্তার পাশে লাউড স্পীকার থেকে গমগমে কণ্ঠ ভেসে আসছে…আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল,প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল…

-তুমি নিন্নির কাছে বসে থাকো। দুষ্টুমি করবে না।

-আচ্ছা।

…তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো…

ফোনের ওপারে শেখ মুজীবের গলা চিনে ফেলে টুশিয়া।

-মা, বঙ্গবন্ধু কি বলেছে জানো?

-জানি রে বাবা!

অ্যাপার্টমেন্টের নিচে পৌঁছে যায় রিকশা। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে কপালে জমে ওঠা ঘাম ঝেড়ে ফ্যালে মিনারা। ক্যাপ খুলে হাতপাখার মতো নেড়ে বাতাস খায়।

একশ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলি- বাকি টাকা ফেরত দিতে হবে না। যা গরম! স্যালাইন খাবে।

মিনারা টাকা হাতে নিয়ে কপালে ছোঁয়ায়। হেসে রিকশা ঘোরায়।

আম্মু আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে আছে। বেগুনি ফুলের বিছানায়। জ্বর নেই। হয়তো সুগার আর প্রেশারের পারমুটেশান-কম্বিনেশানের গড়বড়। হতেও পারে নিওরোলজির ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। নিচু শব্দে টিভি চলছে-

… প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্…

টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকাই। রেসকোর্স ময়দানে সমবেত অগুনতি মানুষ। ব্রিটিশদের হাতে নির্যাতিত বাঙালি, পাকিস্তানী শাসকদের হাতেও নির্যাতিত। জনতার প্রাণের দাবি নেতা আজ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করুক।

…এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। জয় বাংলা।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের পরিসমাপ্তি টানলেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। জানিয়ে দিলেন মুক্তির জন্য লড়াই করতে হয়। সংগ্রামেই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয়। একটি জাতি জেগে উঠেছে। কী সেই উত্তাল সময়! বাঙালি মরতে যখন শিখেছে, তখন কেউ আর দাবায়ে রাখতে পারবে না। 

মাথাটা হঠাৎ ঝিমঝিম করে। আম্মু বেশি অসুস্থ হয়ে গেলে হাসপাতালে নিতে হবে। টুশিয়া কই থাকবে তখন? ছুটি প্রায় শেষ। এবার উইদাউট পে ছুটি নিতে হবে। গুঁড়ো চাপাতার ঘুরপাকের টেক্সচার আর দেখা হয় না। জিরা, ধনিয়া, নুন, তেলের কাজ শুরু হয়। আলু-তেলাপিয়া আর মুরগির মাংস রান্না করি। রাঁধতে গেলেই এক সিঙ্ক বাসন-পেয়ালা আর হাঁড়ি-পাতিল জমে যায়। ধুয়ে মুছে রাখি। ফিল্টারে পানি দেই। লন্ড্রি ফেরত কাপড় তুলি আলমারিতে। বোতলে, জগে পানি ভরি। নতুন শ্যাম্পু রাখি বাথরুমে।

মুরগীর ঝোল দিয়ে টুশিয়াকে ভাত খাওয়াই। ‘ওথেলো’ পড়ে শোনাই।

টুশিয়া ফের প্রশ্ন করে- সবাই একদিন মরে যাব। তাই না, মা? 

উত্তর দিলাম না। প্রতিদিনের লড়াই শেষে যেমন জয়-পরাজয় থাকে, থাকে ক্লান্তিও। অবসাদে গলার স্বরটুকু পর্যন্ত বুজে আসে।

-ওই যে আয়ু শেষ হলে বলেছিলে… আয়ু কি?

-তুমি বলো।

-উম… আয়ু মানে টাইম।

পরীক্ষার খাতা জমে পাহাড় হয়ে আছে। তিনদিন পর রেজাল্ট জমা দিতে হবে। লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম জমা দেয়ার শেষ দিন চলে গেছে গত সপ্তায়। চশমার পাওয়ারটা চেক করানো দরকার। আম্মু আর টুশিয়া ঘুমিয়েছে। ব্যস্ত দিন শেষে বাড়িটা নিঝুম। এই আমার একফালি মাঝরাত!কত কী যে লেখার বাকি! অথচ শরীর ক্লান্ত। মনে স্থিরতা নেই। তবু ল্যাপটপে ফাইল ওপেন করি। কী লিখব আমি? কত লেখা যে মাথা থেকে হারিয়ে গেছে। হারিয়েই যায়। কিছু টুকরো টুকরো লেখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এ ফোল্ডার সে ফোল্ডারে। সেসব লেখার ঘুম কবে ভাঙবে কে জানে?

সাদা স্ক্রিনের সামনে বসে থাকি। সিদ্ধির জন্য অবিরাম কাতর মিনতি। মৌনতায়, ভাবনায়, প্রচেষ্টায়। সেও তো এক সাধনা যদি একাগ্রতার কথা বলি। সময় শুধু চলে যায়। সাধন হয় না। হয় না আস্বাদন। পড়া হয় না। লেখা দূরে সরে যায়। ধরা দেয় না। তবু ল্যাপটপের মেলে রাখা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি। এতো সব কিছুর মাঝে নিয়মিত লিখে যাওয়া। সেও এক অসম লড়াই লড়ে যাওয়া। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত যে লড়াই। হাজার বছরের সংগ্রামের ধারা আর স্বাধীনতার স্বপ্ন থেকেই সে লড়াই জাগ্রত।লিখতে হবে। সেই যে রেসকোর্সের মাঠে, একাত্তরের ৭ মার্চ, বজ্রকন্ঠে উনি কবেই বলে গেছেন-যা কিছু আছে তাই নিয়ে… মোকাবেলা… 

আজকেও এক ৭ মার্চের দিনগত রাত। যা কিছু অক্ষর নিয়েই আমার লড়াই করে যাওয়া। অক্ষর জুড়ে জুড়ে শব্দ বানানো। সেই শব্দের কারুকাজে অজস্র বাক্যের সৃষ্টি। বাক্যগুলোতে ভাবনার বিস্তার। কল্পনার প্রকাশ।হঠাৎ টাঙ্গাইলের কৃষক আর মিনারা এসে ভর করে আমার আঙুলের ডগায়, কীবোর্ডে। সাদা স্ক্রিন কালো অক্ষরে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায়।

একটা শান্ত চাঁদ উঠে আসে আকাশে। আরেক ইপিফ্যানি। পরম উপলব্ধির এই মুহূর্তে তাকিয়ে দেখি, ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে একটি লেখার অবয়ব। চাঁদ নাকি লেখাটাই, কে জানে, মায়াময় আলো ছড়িয়ে দেয় সমস্ত চরাচরে।

Facebook Comments

Posted in: June 2019, Story

Tagged as: ,

Leave a Reply