আলজেরীয়-ফরাসী কবিতার অনুবাদ : স্বপন রায়
হাবিব তেঙ্গুরের কবিতা

ফরাসী ভাষায় আলজেরিয়ান লেখক, কবিদের অবদান অনস্বীকার্য। অ্যালবেয়ার কাম্যু তো আছেনই। রয়েছেন জঁ সেনাক, যাঁকে আলজেরিয়া্র বিপ্লবের কবি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফরাসী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জঁ সেনাকের কবিতা আলজেরিয়ার বিপ্লবীদের কাছে ছিল উজ্জীবন-মন্ত্রের মত। জঁ সেনাককে নিয়ে পরে কখনো লিখবো। তবে তিনি একা নন, কাতেব ইয়াসিন, মোহঃ বাওদিয়া, আন্না গ্রেকি, লায়লা জাবেলির মত প্রথিতযশা কবি, লেখকরা আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদের জেলে পোরা হয়েছিল, শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছিল। ১৯৪৫ থেকে শুরু হওয়া স্বাধীনতা সংগ্রাম ১৯৬২ তে আলজেরিয়ার স্বাধীনতাপ্রাপ্তি পর্যন্ত চলেছিল। এই সময়েই আলজেরিয়ার কবিতায় আমূল পরিবর্তন আসে। আলজেরিয়ার সাহিত্য উনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসী ঔপনিবেশিক দখলদারি শুরু হওয়ার আগে ‘আরবী’ ভাষাতেই লেখা হত।‘অটোমান’ সাম্রাজ্যের প্রভাবেই ‘আরবী’ ভাষার বিস্তার ঘটেছিল আলজেরিয়ায় এবং সাহিত্যসৃষ্টির ভাষাও ছিল ‘আরবী’। আলজেরিয়ার সাহিত্যশিকড় কিন্তু ‘নামিডিয়ান’ সময় অব্দি ছড়ানো। ‘এপেলিয়াস’ (১২৪ খৃঃ-১৭০খৃঃ) যাঁর উপন্যাস ‘গোল্ডেন অ্যাস’ ল্যাটিন সাহিত্যের উজ্বল সম্পদ আলজেরিয়ার ‘মাদারোউস’ অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। যাইহোক ‘আরবী’ ভাষার প্রাধান্য আলজেরিয়ায় শেষ হয়ে যায় ফরাসীদের ঔপনিবেশিক উত্থানের পরে। আলজেরিয়ার সাহিত্য ক্রমশই ‘ফরাসী’ ভাষায় লিখিত হতে থাকে। এরফলে আলজেরিয়ার লেখক, কবিদের ওপরে ফরাসী সাহিত্যের কালজয়ী আন্দোলনগুলোর প্রভাব পড়তে থাকে। প্রতীকবাদ, ডাডাবাদ, পরাবাস্তবতা, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা আলোড়িত করে তোলে আলজেরিয়ার কবি, লেখক, নাট্যকার এবং শিল্পীদের।
আলজেরিয়ার স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু বছর স্বাধীনতার আবেগ, দেশপ্রেম ইত্যাদি কবিদের আলোড়িত করলেও ধীরে ধীরে নতুন স্বাধীন সমাজের বিভিন্ন দিকগুলো কখনো সরাসরি বা কখনো তির্যক ভাবে সাহিত্যে আসতে থাকে। ব্যক্তি মানুষের বিচ্ছিন্নতা, যৌনতা, অপসরণ এবং উত্তরাধুনিক চিন্তা ভাবনাও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে থাকে। রশিদ বোউদজেদ্রা, রশিদ মিমৌনি, লায়লা সেব্বার ইত্যাদি কবিরা আলজেরিয়ানজাত ফরাসী ভাষার সাহিত্যকে ষাট, সত্তর দশকে বিভিন্নতা দিতে সক্ষম হন। ‘আলজেরিয়ানিজম’ ধারার লেখক, কবিদের রাজনৈতিক উচ্চারণ এবং আলজেরীয়-ফরাসী মানুষের অস্তিত্বের সঙ্কট নিয়ে লেখালিখিতেও বহু উল্লেখযোগ্য গল্প, উপন্যাস, কবিতা সৃষ্ট হয়।
কবি হাবিব তেঙ্গুরের জন্ম ১৯৪৭ সালে আলজেরিয়ায়, তবে তিনি রাজনৈতিক কারণে ১৯৫৯ সালে ফ্রান্সে তাঁর পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে দুটি দেশেই তিনি শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। তেঙ্গুরের কবিতা প্রথমদিকে পরাবাস্তবিক থাকলেও (তেঙ্গুর মাঘবেরিয়ান সুর-রিয়ালিস্ট মেনিফেস্টোরও প্রকাশক) তিনি এর সঙ্গে আলজেরিয়ায়র ‘মাঘরেব’ অঞ্চলের কথকতার এবং গল্প বলার টেকনিককে তাঁর কাবিতাধারায় মিশিয়ে দেন, বাদ যায়নি উত্তরাধুনিকতাও। এই মিশ্রণেই তেঙ্গুরের কবিতাভাষা অনন্য হয়ে ওঠে এবং অত্যন্ত শক্তিশালী কবি হিসেবে তিনি চিহ্নিত হতে থাকেন। ইংরেজিতে অনুদিত দুটি গ্রন্থ হল, ‘এক্সাইল ইজ মাই ট্রেড’, ‘ এম্পেডোক্লেসে’স স্যান্ডাল’। পড়া যাক হাবিব তেঙ্গুরের কয়েকটি কবিতার (ইংরেজি থেকে) অনুবাদ:
খিচুড়ি
প্রথম দেখায় মনে হবে খেলা, অসংলগ্ন। অদ্ভুত সব মিল। হ য ব র ল। মামুলি পিঠ চাপড়ানো। একজন বুদ্ধিজীবির খুশির বিভিন্নতা। আয়ু বাড়ানোর ওষুধ। এখন দর্শক নাটকে টেকনিকের প্রাবল্যে বিরক্ত হয়। পাঠক ভাষা নিয়ে এই পরীক্ষা নিরীক্ষারও কিছু বোঝেনা। সংবাদপত্র তাদের একটা ভাষা দেয়, কথা বলার ভাষা। প্রতিদিন নতুন কোনও সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে যা তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে, আতঙ্কে রাখে। বিশেষ সংবাদদাতা রক্তে চোবানো খবরের গল্প দেয়। অদৃশ্য ‘উফ’ আর ‘আহ’র উচ্চারণে ঢাকা পড়ে যায় এমব্রোয়ডারি, সোনালি সুতোর কাজগুলো
আত্মার পাঁচটি চাল
ধূসর করো এই উচ্চারণ
যায় পৃথিবীতে
ভীত
ওহ
গেয়েছিল গান
নিয়েছিল
আহবানিকা শরীর
নীরবতায়
সীমায়
ক্ষতিতে
টেনে লম্বা করার
পাথর নদী
একটা দরজা
পরিষ্কার যে
হয়নি
গুজব
অন্ধকারে
ওর উচ্চারণ
নিজেই নিজেকে ফাঁকা করে দিচ্ছে
অ্যাম্পিথিয়েটার
কষ্ট দিচ্ছে
নরম শ্রাব্যতাকে
দিচ্ছে, যেখানে কোনও
প্রতিধ্বনি ফেরেনা
ফেরা
চোখ আবার ফিরে পায় নিজেকে
আয়না
প্রতিযোগিতার
যায়, যেতে বলে
তাৎক্ষণিক ভাগ্য নির্দ্ধারণে
দিন শেষ হতেই
ফুরিয়ে যায়
এই আত্মা
দিনের শেষে জোরে টান দায়
একা
স্টোর রুমে
তার স্মৃতিতে
ছায়া প্রায়ই অভিযুক্ত করে
হিমশীতল
আর ‘ঠিক’ তখনই চলে যায়
দূরে
তোমার থেকে
সেজিউরা (লাইনের মাঝামাঝি নেয়া বিরতি)
১.
যদি সে এই আধপোড়া সূত্র নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসে, ধরে নিও এটা তার চেপে রাখা বংশগত ঝোঁক অথবা ঈর্ষাপ্রসূত একটা কায়দা। সে কবিতাটা বুনেছে, গোপনে। মরুভূমিতে অপসরণের সময়ে, হাওয়ার দাক্ষিন্যে, যেন ঐতিহ্যের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াই এইসব। এই চাবুক আর চামড়ার ক্ষত। প্রতিধ্বনির কর্কশতায় গলাও খসখসে, ফুটিফাটা। দূরত্ব রক্ত হাল্কা করে দেয়। তখনই তাল আর ছন্দের ভঙ্গুরতা আবিষ্কৃত হয় ভয় আনা অস্পষ্টতার সঙ্গে। সে কাঁপা কাঁপা শোনার ব্যাপারে অথবা আশ্চর্যজনক দেখার ব্যাপারে কিছুই বলবে না। শব্দের ছবিগুলো ঝটকা খাবে
সে দাঁড়িয়ে আছে, অপেক্ষা করছে বসবাসের ইচ্ছে জাগিয়ে তোলার জন্য
তবে এই পুরো পরিস্থিতিটাই তুচ্ছ সেই শব্দগুলোর তুলনায়, যে শব্দগুলো এই ঘটনাবলীর বর্ণনা দেবে
২.
তেমন কিছু নয়, আরেকবার হয়ে যাক! হেরে যাওয়ার দুঃখ, বাস্তব। ক্যাম্প ভাঙার সময়ে, মন তো ভারী হবেই। চোখে চোখ রাখা ফুরিয়ে যায়। ফাঁকা দিগন্তও।
এ্টা কোনও সমস্যাই নয়। শরীরের আনন্দ বৃথা যায়না। আত্মায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে একান্তে থাকা আলোর মত। ‘ইউফ্রেটিস’ নদীর ওপরে বইতে থাকা ঝোড়ো হাওয়ার প্রকোপ তোমায় মনে করিয়ে দেয় সেই পবিত্র রাতটির আতঙ্কের কথা আর পালিয়ে যাওয়ার সময় হতে থাকা চমকে ওঠাগুলো।
এই মনে পড়াগুলো কিছু আচ্ছাদিত দৃশ্যের কথা বলছে আর ঝড় তুলছে অনির্দিষ্ট স্মৃতির প্রবাহে। তুমি সাবধানে শব্দগুলোকে নামিয়ে তাদেরই দায়িত্ব দিচ্ছ কবিতার আবরণ সরিয়ে নিশ্বাসের ব্যবস্থা করে দিতে। কী যায় আসে যদি সেই জংলী পশুরা তাদের জায়গা ছেড়ে না আসে তোমার সঙ্গী হতে!
Posted in: June 2019, Translation