সম্পাদকীয়

Aparjan June 2019, Coverভাঙ্গা স্বপ্ন জুড়তে জুড়তে মানুষ কবি হয়। … তাই যখন ‘জয় শ্রীরাম’ না বলায় চলন্ত ট্রেন থেকে সহনাগরিককে আমরা মানুষের পৃথিবীতে ছুঁড়ে ফেলে দিই, পিটিয়ে মেরে ফেলায় ভাইরাল হয় ঝাড়খন্ডের কোন ‘সোনু’—আমাদের দীর্ঘশ্বাস কেবল প্রলম্বিত হয় ঐ কবরনগরীর দেওয়ালে দেওয়ালে। আমাদের ‘সক্রিয়তা’ আজও আত্মানুসন্ধান দিল না। প্রকৃতিকে ধারণ করতে গিয়ে স্থবির হল বৃক্ষসমাজ…

স্বপ্ন ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একা হচ্ছিল… পাশেরটা যেদিন হঠাৎ পড়ল খেয়ালই করতে পারেনি। একটু আগেই গল্প করেছে দু’জনে। ও প্রেমিকার কথা বলছিল। বলছিল, আকাশের বিকেল হলে প্রেমিকার কথা মনে পড়ে। এই যেন, মেঘ করবে, বৃষ্টি পড় পড় হবে, দৌড়ে বাড়ি ঢুকবে আর ওর প্রেমিকা ধীরেসুস্থে দরজা খুলে বলবে, বলেছিলাম এমন বিকেল-বিকেলে বাইরে যেও না … শুনলে না তো …

সেই প্রেমিকার গল্প করতে করতেই ও চলে গেল…

জায়গাটা এমনিতেই শুনশান, বড় বড় বাড়ি প্লটের পর প্লটে সাজানো, মাঝে কালো পিচ রাস্তা। লোকগুলো সকালে বেরোয়, রাতে ঢোকে। দূর থেকে বেনেবৌ’রা যখন আসে, ওরা ঘাবড়ে যায়—এ তোমাদের কেমন জায়গা গো? আমাদের কবরস্থানে তাও তো দুটো লোক আসে। কেউ ফুল নিয়ে আসে, কেউ দেখতে আসে … তোমাদের এই বাড়িগুলো দেখে আমাদের কবরস্থানের ক্রুশের কথা মনে পড়ে … কিন্তু কেউ আসেও না, ফুলও ফোটে না।

সেদিন সারাদিনই বিকেল-বিকেল ছিল। পাশের কৃষ্ণ খুব খুশি। দেখলে মনে হবে যেন বাড়িতে প্রেমিকা এসেছে, দরজা খুলছে ধীরে ধীরে, এখনি বলবে—শুনলে না তো …

কিন্তু আমাদের সমাজে তো সে জিনিস হয় না। আমরা দূর থেকেই প্রেমিকাকে দেখে যাই সারাজীবন। দূর থেকেই কথা, দূর থেকেই ছোঁয়া..কেউ আলোয় খেলে ওঠে, কেউ বিকেলে, কেউ অন্ধকারে।

সেদিন তেমনই ওর উচ্ছ্বাস দেখে কে …

সন্ধ্যার দিকে ঝড় উঠল, ভাবলাম বেনেবৌ বোধহয় আসবে। পাশে ঘুরে কৃষ্ণকে বললাম, সাবধানে থাক, ঝড় উঠেছে। কিন্তু তখন এতোই ডগমগ, আমাকে পাত্তাই দিল না, কথা বলছিল প্রেমিকার সাথে। দোষই বা দেই কীভাবে বল, এমন দিনেই তো কথা হয় … হাওয়াতে হারানো শব্দ খুঁজতে খুঁজতে কতদূর সে কথা… আমারও একদিন ছিল ওমন। ঝড়ে পাতার মতো কথা উড়ত আর সেই উড়ন্ত পাতার আড়ালে আলোর ওঠানামা দেখতে দেখতে আমরা ভালোবাসতাম। ওকে আর বিরক্ত করলাম না। ঝড়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দূরের ঐ কবরনগরীর দিকে তাকিয়ে থাকলাম..যদি উড়িয়ে নিয়ে যায় তো যাক…

কিছুক্ষণ পরে ঝড় দমকা দিয়ে উঠলো। আমি চোখ বুজলাম শান্তিতে…

তখনই আচমকা কৃষ্ণ পড়ল মাটিতে। আহা রে! এখনও লো শাটার স্পীডে ও আমার সামনে পড়ে যাচ্ছে … কিছু বলতে অবধি পারেনি।

তোমরা হয়ত ছুটে যেতে, লোক জড় করতে ডেকে, তারপর এ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তার, টাকা না দিতে পারায় মৃতদেহ আটকানো, হাসপাতাল ভাঙ্গচুর … তোমাদের সক্রিয়তাকে ভাষা দেব বলেই তো আমরা স্থবির হলাম। মাটিতে পা পুঁতে তোমাদের চলার পথ দিলাম। এখন নাও শেষবিকেলের কৃষ্ণচূড়াটাও আমার বন্ধু মাটিকেই দিয়ে গেল। ওর প্রেমিকাও দেখছিল দূরের দু’রাস্তা পরের মোড় থেকে।

ভাঙ্গা স্বপ্ন জুড়তে জুড়তে মানুষ কবি হয়। আর অপরের স্বপ্ন নেয় দার্শনিক। তাই যখন ‘জয় শ্রীরাম’ না বলায় চলন্ত ট্রেন থেকে সহনাগরিককে আমরা মানুষের পৃথিবীতে ছুঁড়ে ফেলে দিই, পিটিয়ে মেরে ফেলায় ভাইরাল হয় ঝাড়খন্ডের কোন ‘সোনু’—আমাদের দীর্ঘশ্বাস কেবল প্রলম্বিত হয় ঐ কবরনগরীর দেওয়ালে দেওয়ালে। আমাদের ‘সক্রিয়তা’ আজও আত্মানুসন্ধান দিল না। প্রকৃতিকে ধারণ করতে গিয়ে স্থবির হল বৃক্ষসমাজ, আর আমরা উদারতাকে আকাশের দোহাই দিয়ে ছেড়ে রাখলাম! আজ তাই বৃক্ষসমাজের স্থবিরতা আমাদের পরিহাস করে।

এহেন ঝড়ের মুখে, ভাবুক যখন স্তব্ধ হয়েছে, আমাদের আশ্রয়, উপশম হল নব সৃজন—কবিতা। সেভাবেই—‘হে কবিতা, হে উপশম’। গাছের পাতায় ঝড় খেলা করে, সে শুধু আন্দোলিত হয় না, ভাষা দেয় বর্ষাকে।

অপরজন
জুন, ২০১৯
Facebook Comments

Posted in: Editorial, June 2019

Tagged as:

Leave a Reply