রুশ বিপ্লব ও রবীন্দ্রনাথ : দেবজ্যোতি রায়
পৃথিবীতে প্রত্যেকটি যুগই সম্ভবত মানুষকে স্বপ্ন দ্যাখায়, স্বপ্ন দ্যাখায় এমন এক নতুন পৃথিবীর যেখানে মনুষের বিচরণ হবে স্বাধীন ও মুক্ত এবং একই সঙ্গে সেই যুগ তার নিজেরই ভেতর বহন করে নিয়ে চলে স্বপ্নভঙ্গের বেদনাকেও, মানুষ দ্যাখে তার স্বপ্ন টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে, গড়াগড়ি খাচ্ছে নালা ও নর্দমায়, যে জীবন সে যাপন করছে আর যে জীবন তার যাপন করা উচিত, এ-দুইয়ের মধ্যে এক অটুট সীমান্ত প্রাচীর যাকে সে ভাঙতে পারেনি শেষপর্যন্ত। আরও পরিষ্কার করে বললে, সেসব স্বপ্নের মধ্যেই থাকে স্বপ্নভঙ্গের উপাদানসমূহ। ফলে এক অসম্ভব বেদনারই যেন সন্তান সে, কুঁজো হয়ে হাঁটে তখন মানুষ যে নিজেকে স্বাধীন ও মুক্ত করতে চেয়েছিল সমস্ত রকম প্রাধিকার থেকে,শাসন-শোষণ-অত্যাচার ও নিপীড়নের এই সুবিস্তৃত ব্যবস্থা থেকে। তারপরেও নতুন যুগ আসে এবং মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনার পরম্পরা চলতে থাকে, চলতেই থাকে।
আজ থেকে ২০০ বছর আগে এক তরুণ জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স
জানালেন যে শুধু জগৎকে ব্যাখ্যা করাই তাঁর কাজ নয়, বস্তুর মধ্যেকার দ্বান্দ্বিকতার সূত্র অনুযায়ী জগৎকে পাল্টাতেও
চান তিনি। তাঁর দর্শনভাবনা খ্যাত হলো মার্ক্সীয় দর্শন বা মার্ক্সবাদ
নামে। মানবেতিহাসকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে ব্যাখ্যার
মধ্য দিয়ে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, যা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নামে খ্যাত, ইতিহাসের গতি সাম্যবাদের দিকে এবং মানুষ পৌঁছবে তাঁর
আকাঙ্খিত স্বাধীন ও মুক্ত জীবনে।
মার্ক্সীয় দর্শনভাবনা সমগ্র পৃথিবীতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। রুশ দেশে ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভের যিনি পরবর্তীতে পরিচিত
হবেন লেনিন নামে, নেতৃত্বে
গড়ে উঠেছিল বলশেভিক পার্টি এবং যে পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যা নভেম্বর
বিপ্লব নামে খ্যাত, ১৯১৭ সালে
প্রতিষ্ঠিত হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। গোটা পৃথিবী
সেদিন অবাক বিস্ময়ে বিস্ফারিত নেত্রে দেখল জন্ম এক শ্রমিকশ্রেণিনেতৃত্বে পরিচালিত রাষ্ট্রের। এক অনাস্বাদিত, অভূত, অদৃষ্টপূর্ব
নতুন পৃথিবীর জন্ম হলো যেন। এইনভেম্বর
বিপ্লবকে নিয়ে পরবর্তীতে জন রিডের লেখা ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ পড়েননি এমন পাঠকের সংখ্যা বিংশ শতাব্দীর ‘৭০-এর
দশকেও হাতে গোনা হয়তো।
১৯৩০-এ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর রাশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখছেন এভাবে,”রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনো দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলেছে।”
কেমন সেই জাগানো ? রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,”চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাতলোক থাকে, তাদেরই সংখ্যা বেশি, তারাই বাহন; তাদের মানুষ হবার সময় নেই; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সবচেয়ে কম খেয়ে, কম প’রে, কম শিখে, বাকি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। … তারা সভ্যতার
পিল্সুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে
থাকে—
উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।”
রবীন্দ্রনাথও যে এদের কথা অনেকদিন ভেবেছেন তা জানিয়ে স্বীকার করেছেন,”মনে হয়েছে এর কোনো উপায় নেই। একদল তলায় না থাকলে আর-একদল উপরে থাকতেই পারেনা, অথচ উপরে থাকার দরকার আছে।”
তিনি বলছেন, “উপরে না থাকলে নিতান্ত কাছের সীমার বাইরে কিছু দেখা যায় না। কেবলমাত্র জীবিকা নির্বাহ করার জন্যে তো মানুষের মনুষ্যত্ব নয়। … সভ্যতার সমস্ত শ্রেষ্ঠ ফসল অবকাশের ক্ষেত্রে ফলেছে। মানুষের সভ্যতায় এক অংশে অবকাশ রক্ষা করার দরকার আছে।”
রবীন্দ্রনাথের এই যে পর্যবেক্ষণ মানব সভ্যতাকে ঘিরে তাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না যদি সভ্যতার শ্রেষ্ঠ ফসলগুলিকে যা আমাদের নান্দনিক চেতনাকে পরিপুষ্ট ও বিকশিত করে তোলে, আমাদের আত্মার খিদে মেটায়, হিসেবের মধ্যে রেখে বিবেচনা করি। মানুষের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিগুলি অবকাশের মধ্য দিয়েই জন্মেছে। কিন্তু তা বলে কি একদল মানুষ, সংখ্যার দিক থেকে যারা অনেক বেশি, আরও অধিক কথা সভ্যতাকে যারা বহন করে নিয়ে চলেছে, চিরকাল উপেক্ষিত ও অবহেলিত থেকেযাবে? প্রদীপের আলো এদের জীবনকেও কিছুমাত্র আলোকিত করে তুলবে না?
রবীন্দ্রনাথের মতো এত বড় মাপের একজন বিশ্বভাবুক সেকথা যে ভাববেন এবং ভেবেছেন তা আমরা জানতে পারছি এবারে যখন তিনি লিখছেন,”…
অথচ অধিকাংশ মানুষকে তলিয়ে রেখে,অমানুষ করে রেখে, তবেই সভ্যতা সমুচ্চে থাকবে একথা অনিবার্য বলে মেনে নিতে গেলে মনে ধিক্কার আসে।”
তিনি ‘রাশিয়ার চিঠি’তে তাই লিখছেন, “প্রত্যেক সমাজের নিজের ভিতরেও এই একই কথা। যে মানুষকে মানুষ সম্মান করতে পারেনা সে মানুষকে মানুষ উপকার করতে অক্ষম। অন্তত যখনই নিজের স্বার্থে এসে ঠেকে তখনই মারামারি কাটাকাটি বেধে যায়। রাশিয়ায় একেবারে গোড়া ঘেঁষে এই সমস্যা সমাধান করবার চেষ্টা চলছে।”
আর সে দেখেই তাঁর আশ্চর্য ঠেকছে। তিনি আগেই জানিয়েছেন, অন্য কোনো দেশের মতো নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ।
আর কী সেই দেখা অন্যদেশের থেকে যার এক্কেবারে মূলে প্রভেদ ? তিনি ওই চিঠিতেই জানাচ্ছেন, “আমাদের সকল সমস্যার সবচেয়ে বড়ো রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত —ভারতবর্ষতো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত। এখানে সেই শিক্ষা যে কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয়, তার সম্পূর্ণতায়, তার প্রবলতায়। কোনো মানুষই যাতে নিঃসহায় ও নিষ্কর্মা হয়ে না থাকে এজন্যে কী প্রচুর আয়োজন ও কী বিপুল উদ্যম। শুধুশ্বেত-রাশিয়ার জন্যে নয়, মধ্য-এশিয়ার অর্ধসভ্যজাতের মধ্যেও এরা বন্যার মতো বেগে শিক্ষা বিস্তার করে চলেছে; সায়েন্সের শেষ-ফসল পর্যন্ত যাতে তারা পায় এই জন্যে প্রয়াসের অন্ত নেই।” তিনি আরও লিখছেন, “এখানে থিয়েটারে ভালো ভালো অপেরা ও বড়ো নাটকের অভিনয়ে বিষম ভিড়, কিন্তু যারা দেখছে তারা কৃষি ও কর্মীদের দলের। কোথাও এদের অপমান নেই। … সর্বত্রই লক্ষ করেছি এদের চিত্তের জাগরণ এবং আত্মমর্যাদার আনন্দ। আমাদের দেশের জনসাধারণের তো কথাই নেই, ইংলন্ডের মজুর-শ্রেণীর সঙ্গে তুলনা করলে আকাশপাতাল তফাত দেখা যায়।” তিনি যে শ্রীনিকেতনেও এরূপ করতে চেয়েছেন তার উল্লেখ করে আমাদের জানিয়েছেন “এরা সমস্ত দেশ জুড়ে প্রকৃষ্ট ভাবে তাই করছে” । “… কয়েক বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষের অবস্থার সঙ্গে এদের জনসাধারণের অবস্থার সম্পূর্ণ সাদৃশ্য ছিল—এই অল্পকালের মধ্যে দ্রুত বেগে বদলে গেছে—আমরা পড়ে আছি জড়তার পাঁকের মধ্যে আকণ্ঠ নিমগ্ন”, তিনি জানাচ্ছেন।
কিন্তু এই আলোচনার শুরুতেই আমি জানিয়েছি, প্রত্যেকটি যুগের মধ্যে যেমন স্বপ্ন থাকে, থাকে স্বপ্নভঙ্গের বেদনাও। স্বপ্নের মধ্যেই থাকে স্বপ্নভঙ্গের উপাদানগুলি। স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ যেনবা হাত ধরাধরি করে হাঁটে। আজ আমাদের চোখের সামনে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের আর কোনও অস্তিত্ব নেই, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে সে দেশ, এবং এই ভাঙনের প্রস্তুতির ইতিহাসও এত দিনে আমরা জেনে গেছি, জানি ঠিক কীভাবে ঘটেছিল সেসব ঘটনা এবং কেন, যে জন্যে স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের কথা একই সঙ্গে বলছি, বিস্তার করবার অবকাশ এখানে নেই, মার্ক্স নিজেও তাঁর শেষজীবনে এসে হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর তত্ত্বকে কোথায় আটকে দেবেন তাঁর ভবিষ্য শিষ্যরা, যে শিষ্যরা নির্বোধ, যাত্রাহীন, সৃষ্টিক্ষমতাহীন, যারা অগণিত, যারা নিবিড় যুথাচারে বিশ্বাসী, যারা ভীরু, যারা নগ্ন সত্যকে ভয় পায়, যারা বিগ্রহ বানায় বিগ্রহ-ভঙ্গকারীর, বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতের মধ্যে বাঁচে, যারা সর্বগ্রাসী দল ও রাষ্ট্রতন্ত্রের উপাসক, তাদের হাত ধরেই শতাব্দী শেষে বুর্জোয়াদের মার্ক্সকে খুন করে ফেলবার চক্রান্তটাই সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে, মার্ক্স এখনো বন্দী তাঁর নিজের মধ্যেও তাঁর অসার এই শিষ্যমন্ডলীর হাতে, রাশিয়ায় এসে রবীন্দ্রনাথ ওই অত আগে ১৯৩০-এ, রাশিয়ার ওই তুমুল ও আশ্চর্য কর্মোদ্যম দেখে বিস্মিত হয়েও কিন্তু একথা উল্লেখ করতে ভোলেননি রাশিয়ার চিঠিতে যে, “এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই তা বলিনে; গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে—কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না—সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তাহলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিংবা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।” এবং আমরা জানি ঠিক এটাই ঘটেছিল। আর এখানেই রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন আমাদের কাছে ও আজকের
দিনে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যখন ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ তার
দাঁত-নখ মেলে ধরতে শুরু করেছে এদেশেও। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথও তো বন্দী মার্ক্সেরই
মতো তাঁর মূর্খ,অসার শিষ্যদের হাতে ! মার্ক্সের মতো সেখান থেকে তাঁকেও উদ্ধার করবে কে? সময়?