অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার
তৃতীয় কিস্তি
আত্মানুসন্ধান ও উপলব্ধি: আক্কা মহাদেবীর নির্বাচিত ‘ভচনা’র অনুবাদ
আক্কা মহাদেবী দ্বাদশ খ্রিষ্টীয় শতাব্দীর কন্নড় ভাষার অন্যতম প্রধান কবি এবং ‘ভীরশৈববাদের’ অন্যতম প্রবক্তা । ‘ভচনা’ নামে যে কবিতা ধারা সংস্কৃত কবিতা ও কাব্যরীতিকে প্রতিস্পর্ধা দেখিয়ে অষ্টম শতাব্দী থেকে কল্যাণের গড়ে উঠছিল তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে দশম শতাব্দী থেকে দশিমায়ার কবিতায়। সংস্কৃত কাব্যরীতির অলঙ্কার , ছন্দ সবকিছুকে নস্যাৎ করে ‘ভচনা’ কবিতা ধারা জোর দিতে থাকে কল্যাণের ভূমিজাত ভাষা কন্নড়ের রোজকার কথা দিয়ে কবিতা বুনতে। সচেতন ভাবে এই প্রয়াসের অন্যতম প্রধান কারন ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে পুনরায় জেগে ওঠা ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রতিরোধ করতে চাওয়া। প্রায় পাঁচশো থেকে সাতশ বছর ধরে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার যখন ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রাহ্মণ্য বর্ণবাদকে এবং পিতৃতান্ত্রিকতাকে অনেকাংশে দূর করে দিয়েছে ,তখনই শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব। শঙ্করাচার্যের বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তিকাঠামো দার্শনিক তত্ত্বাদি নতুন করে অক্সিজেন দেয় মৃতপ্রায় ব্রাহ্মণ্যবাদকে এবং তারই জোরে প্রায় অজেয় হয়ে ফিরে আসে আবার বর্ণবাদ ও সীমাহীন পিতৃতান্ত্রিকতা। এই বীজতলাতেই ভক্তিবাদী আন্দোলনের শুরু যারই একটি ধারা ‘ভচনা’ কবিতার ভিতর দিয়ে বয়ে যায় ।
দশিমায়া থেকেই ‘ভীরশৈববাদের’ ‘ভচনা’ ধারা স্পষ্ট ভাবেই লিঙ্গ রাজনীতি বিষয়ে সংবেদনশীল। দশিমায়ার একটি ‘ভচন’ পড়লেই আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারব:
“যদি দেখে লম্বা চুল আর স্তন, তারা বলে ওঠে ‘নারী’,
যদি দেখে গোঁফ আর দাড়ি, তারা বলে ওঠে ‘পুরুষ’,
সত্তার গভীর , নারী না পুরুষ, হে রামনাথ?”
এই সংবেদনশীলতা আমারা দ্বাদশ শতাব্দীর ‘ভচনা’ ধারার অপর দুই প্রধান কবি প্রভু আলাম্মা আর বাসবান্নার ভিতরেও দেখতে পাই। তাঁরা কেউই শিবের ব্রাহ্মণ্যবাদী রূপকে গ্রহন করেন নি, এমনকী বৈদিক শিবকেও তাঁরা নিজেদের সাধনার অন্তরায় মনে করেছেন। প্রাক-বৈদিক যুগের শিব যার নাম ‘অকূল’, যিনি ‘পরিবার’ এবং ‘বর্ণ’ নামক ধারণামুক্ত এক দেবতা তাকে উপাস্য করেছেন ‘ভীরশৈববাদীরা’। তাই ‘ভচনা’ ধারা তার উপাস্য দেবতা দিয়েই প্রাথমিক ভাবে ভেঙে ফেলে পিতৃতন্ত্রের দুটি বড় স্তম্ভঃ ‘পরিবার’ এবং ‘বর্ণ’। তাই এই ধারায় নারীর ঋতুস্রাবকে ‘অপবিত্র’ মনেই করা হয় নি। ঋতুস্রাব চলাকালীন ‘ভচনা’ বলতে এবং লিখতে, কিংবা উপাসনা করতে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। “ব্লিড হ্যাপিলি” আন্দোলনের বীজতলা খুঁজতে ভারতীয় উপমহাদেশের তাই ১৯৭০ এর দশকের এংলো-আমেরিকান নারীবাদের ধারাটির কাছে ঋণী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এমনই এক প্রেক্ষিতে আক্কা মহাদেবীর কবিতা পড়তে গিয়ে আমাদের মনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে যে এমন অনুকূল একটি ধারায় তাঁর নারীবাদের পরিসরটি ঠিক কী? এর উত্তর খোঁজার আগে আমরা আক্কা মহাদেবীর ব্যক্তিগত জীবনে খানিক উঁকি দেব। ‘আক্কা’ শব্দের অর্থ ‘আদিম বোন’। ব্যুৎপত্তিগত ভাবেই যে নামটি নারীবাদের পরিচায়ক হয়ে ওঠে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আক্কার বিয়ে হয় কৌশিক নামে এক রাজার সাথে। রাজা জৈন ধর্মাবলম্বী। আক্কা বিয়ে করেন নিজের কিছু শর্তে এবং শর্তগুলি হল, আক্কার ‘ভচন’ থেকে উদ্ধৃত করছি:
“ আমার দেবতার সাথে আমার যতক্ষণ ইচ্ছে সময় কাটাব,
সাধনার জন্য আমার যতক্ষণ ইচ্ছে সময় কাটাব,
গুরুকে সময় দেব যেকোনো প্রহরেই”
শর্তগুলি থেকেই একজন স্বাধীনচেতা নারীর পরিচয় পাওয়া যায় । কৌশিক রাজি হন। কিন্তু বিয়ের কিছু বছরের ভিতরেই কৌশিক সমস্ত শর্ত লঙ্ঘন করেন পিতৃতান্ত্রিকতার ‘স্বাভাবিক’ নিয়মেই। আক্কা পিতৃতান্ত্রিক ‘পরিবার’ নামক পরিসরটি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং ত্যাগ করেন পরিবারের শেষ চিহ্ন নিজের পোষাকও। দিগম্বরী হয়ে আত্মানুসন্ধানে ব্যাপ্ত হন ।
‘ভীরশৈববাদের’ মত একটি লিঙ্গ সংবেদনশীল পরিসরেও নিজেকে খুঁজতে গিয়ে আক্কা দেখেন দশিমায়া, প্রভু আলাম্মা, বাসবান্না প্রত্যেকে শিবকে ডেকেছেন হয় রামনাথ, নইলে শঙ্কর, অথবা হর নামে। আক্কা নিজের ‘ভচনা’র জন্য শিবের যে নামটি বেছে নেন তা হল ‘মল্লিকার্জুন’। এবং এই বেছে নেওয়াই আক্কাকে নারীবাদের একটি শক্তিশালী স্বর করে তুলেছে। ‘মল্লিকার্জুন’ নামটি যে দুটি নামের সংশ্লেষ তা হল ‘মল্লিকা’ এবং ‘অর্জুন’। ‘মল্লিকা’ অর্থাৎ জুঁই ফুল একটি নরম পেলব সত্তা এবং অর্জুন তর্কাতীত ভাবে ভারতীয় উপমহাদেশীয় মিথের সবচেয়ে শক্তিশালী যোদ্ধাদের একজন। একই দেহে দুটি বিপরীতমুখী সত্তার ধারণ একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গ প্রাবল্যের ধারণাকে নস্যাৎ করে। মজার ব্যাপার হল শিব এই নামটি পান যে ঘটনা থেকে সেখানেও নারীর সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। অর্জুন যখন শিবের কাছ থেকে দিব্যাস্ত্র সংগ্রহে যান , শিব ধ্যানমগ্ন ছিলেন। অপেক্ষা করতে করতে হতাশ হয়ে পড়লে অর্জুন শিবের ধ্যান ভাঙানোর জন্য তীর ছোঁড়ার সিধান্ত নেন। অর্জুন একের পর এক তীর ছুঁড়তে থাকেন শিবকে লক্ষ্য করে। শিবের যাতে আঘাত না লাগে এবং অর্জুন যেন শিবের ক্রোধের শিকার না হন, সেইকারণে দেবী পার্বতী প্রতিটি তীরকে মল্লিকা ফুলে রূপান্তরিত করেন শিবের গায়ে আঘাতের ঠিক আগের মূহুর্তে। একসময় মল্লিকায় শিব প্রায় ঢাকা পড়েন এবং সুগন্ধে তার ধ্যান ভঙ্গ হয়। প্রবল ‘পৌরুষ’কে এইভাবে প্রশমিত করে দেওয়া নিঃসন্দেহে নারীবাদী মোটিফ।
নিজেকে ‘মল্লিকার্জুন’ এর সত্তার কাছে সমর্পিত করে যে ‘ভচনা’গুলি দিয়ে আক্কা নিজেকে খুঁজেছেন সেখানে বারবার এই নারী/পুরুষ বৈপরীত্যকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এমনকী গাছকে নিজ অঙ্গ দিয়ে গাছের থেকে লিঙ্গ নেওয়ার ‘ইকো-ফেমিনিস্ট’ উচ্চারণও খুবই স্পষ্ট ভাবে রয়েছে। এমনকি খোঁজ শেষে শিবকেও আক্কা জানাতে পিছপা হন না যে সব খোঁজের পর তার মনে হচ্ছে ব্রহ্মাণ্ড আদিতে নারীই।
অনুবাদের ক্ষেত্রে ‘ভচনা’ রীতি মেনেই কাব্যগুণের চেয়েও জোর দেওয়া হয়েছে রাজনীতিতে। সোর্স টেক্সট হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে ভিনয় চৈতন্যের “Songs for Siva: Vacanas of Akka Mahadevi” এবং এ কে রামানুজনের “ Speaking of Siva” ।
***
পৃথিবী যেমন লুকিয়ে রাখে রত্ন,
ফল লুকোয় তার স্বাদ,
পাথর লুকিয়ে রাখে সোনা,
তেল লুকিয়ে থাকে বীজে,
যেমন জঙ্গল লুকোয় দাবানল,
প্রিয় মল্লিকার্জু্ন,
তেমনি লুকায় নিজ সত্য সত্তার আড়ালে;
কেউ পায় না তার খোঁজ।
***
যখন নিজেকে জানতাম না
কোথায় ছিলে তুমি?
ছিলে আমারই ভিতর;
সোনায় যেমন সোনালি রঙ,
আমার ভিতর তেমনই পৃথক তুমি,
প্রিয় মল্লিকার্জু্ন!
***
মহিষের চিন্তা এক,
চর্মকারের আরেক;
সৎ করে এক চিন্তা,
শঠ করে আরেক;
আমি জ্বলি নিজ জ্বালায়,
তুই জ্বলিস কামে!
মূর্খ! আমার আঁচল ছাড়,
আমি চিন্তিত;
প্রিয় মল্লিকার্জু্ন
রুষ্ট হবেন!
[ আক্কা তাঁর স্বামী কৌশিককে বললেন ]
***
যদি শ্বাসই সুগন্ধি হয়, ফুলের কি দরকার?
ধৈর্য, সংযম , সহিষ্ণুতা থাকলে
সমাধির শান্তির কীইবা প্রয়োজন?
যদি কেউ নিজেই হয়ে যায় পৃথিবী,
তার নির্জনতার আর কী প্রয়োজন
প্রিয় মল্লিকার্জু্ন?
***
শরীর থাকে না সংবেদন ছাড়া,
সংবেদন নেই শরীর বিনে;
কী করে বলি আমি কাম, দোষ মুক্ত?
তবু তোমার আনন্দেই, আনন্দ আমার;
তোমার শোকেই, শোক,
প্রিয় মল্লিকার্জু্ন।
***
লিঙ্গ কাটিয়েছে দেহের দ্বিধা,
মনের দ্বিধা কেটেছে জ্ঞানে,
শিবকে জেনেছি, কেটেছে খণ্ডিত সত্তাদের দ্বিধা,
আলোর চাদরে ঢেকেছি প্রত্যঙ্গের অন্ধকার।
যৌবন ছটায় চোখে আসে
কেবলেই কামের অঙ্গপোড়া ছাই;
প্রিয় মল্লিকার্জু্ন,
তুমি তো কামকে হত্যা করেছিলে,
তবু অনঙ্গ করে রেখেছো তারে;
আমি শিকড় মুছেছি তার।
***
উন্মুক্ত, সুগোল স্তন দেখে
তুমি এসেছো, পুরুষ!
পূর্ণ যৌবন ছটা দেখে এসেছো!
কিন্তু আমি নারী নই,
বেশ্যাও নই;
বারবার আমায় দেখে,
কিছুই কি বোঝো নি তুমি?
প্রিয় মল্লিকার্জু্ন
ছাড়া কোনো পুরুষই
আমাদের জন্য নয়।
***
দেহের ব্যাধি সারাতে গিয়েছিলাম বনে,
প্রতিটি গাছের কাছে তাদের লিঙ্গ চেয়েছি,
এই মানব অঙ্গের বিনিময়ে।
গাছেরা বিলিয়ে দিল নিজেদের,
ভিক্ষুক আমি আটকা পড়লাম জন্ম-মৃত্যু চক্রে।
দান গাছেদের সাধিকা করল,
আর ভিক্ষা নয়;
প্রিয় মল্লিকার্জু্ন; কথা দিলাম।
***
ফল খাওয়ার সময় জানতে চাও,
কে গাছ পুঁতেছে?
যে নারীকে ছেড়ে গেছ,
সে কার সাথে শোয়
কী যায় আসে তা’তে আর?
জমি বেচে দেওয়ার পর,
কে চষল, তাতে কী?
প্রিয় মল্লিকার্জু্নকে জানার পর
এ দেহ কুকুরে খেল, না জলে পচলো,
কী যায় আসে তা’তে?
***
বেদের পাঠ, পুনঃপাঠ
শূণ্যগর্ভ তর্কের জন্ম দেয়।
পুঁথি শুনে বারবার
গভীর দ্বিধা জন্মায়।
আমি জানি, আমি ধ্রুপদীকে জানি;
এই উচ্চারণ পাথর কঠিন হয়ে ওঠে।
আমার কর্ম সম্পূর্ণ, এই সুপ্রাচীন উচ্চারণ
অতলে হারায়।
আমি কোথায়, সে কোথায়?
পরমই বিশুদ্ধ সেই স্থান,
প্রিয় মল্লিকার্জু্ন।
***
আমি দেখেছি পরমাণু, আমি দেখেছি ব্রহ্ম।
ছুঁয়েছি হঠাৎ পাওয়া আনন্দ,
প্রচেষ্টা ও উপলব্ধি;
জেনেছি জ্ঞান
আর ভুলেছি বিস্মরণ।
কামার্ত স্মৃতিদের মুছে ফেলে
জেনেছি তোমায়!
হয়েছি অসীম,
প্রিয় মল্লিকার্জু্ন।
***
অনিঃশেষ আগুনে পুড়েছি, মা গো,
পুষে রেখেছি গোপন ক্ষত।
সুখ খুঁজেছি পথে পথে,
প্রিয় মল্লিকার্জু্নের প্রেমে
পেয়েছি যা পাওয়ারই নয়;
বারবার বেঁচেছি আগুন এক জীবন।
***
এই হিংস্র সংসার আমার পিতার।
জ্ঞাতিরা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে আমায়ঃ
শিকার করবে বলে।
আশ্রয় দাও,
প্রিয় মল্লিকার্জু্ন।
***
আমার জন্মের সাথেই জন্মেছে সংসার;
সংসার থেকে জন্মেছে অজ্ঞানতা;
অজ্ঞানতা থেকে কামনা;
কাম থেকে জন্মেছে ক্রোধ।
ক্রোধাগ্নির ধোঁয়ায় অন্ধ হয়ে ভুলেছি তোমায়,
হয়েছি জাগতিক দুঃখের শিকার।
দূর করো এই বিস্মরণ;
প্রিয় মল্লিকার্জু্ন;
শরণে নাও।
***
তুমি ভাবো তুমি জানো,
অথচ জানো না।
অসীম অধরাই থেকে যায়,
যদি প্রিয় মল্লিকার্জু্নকে
না জানো!
***
গাছের সাথে গাছের ঘষায়
আগুন জ্বলে, গাছকে পোড়ায়।
মনের সাথে মনের ঘষায়
জ্ঞান উপজে, কামনা পোড়ায়।
আমাকে সেই জ্ঞান দাও;
প্রিয় মল্লিকার্জু্ন।
***
নারী যদি শুধুই নারী, পুরুষ থেকে পৃথক সে;
পুরুষ যদি শুধুই পুরুষ, নারীর থেকে পৃথক সে;
মনের গভীর যদি পার্থক্য না করে,
শরীরে কি আর পৃথক হয়?
পুরো দুনিয়া ডুবে আছে এই ভেদাভেদে,
আদিতে নেই যা ।
আমার উপাস্য প্রিয় মল্লিকার্জু্নকে জানাইঃ
পুরো ব্রহ্মাণ্ডই তো নারী।
————————————————
Related posts:
Posted in: June 2019, Translation
This is a subject that needs to be discussed in, “Out in the Open”