ধারাবাহিক উপন্যাস : নীলাব্জ চক্রবর্তী

যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে

তৃতীয় পর্ব

প্রিয় শেখর দা,

আপনাকে এখনও ভালবাসি। হ্যাঁ, এটাই এই চিঠির প্রথম বাক্য। প্রথমে ভাবলাম ‘আপনাকে এটাই আমার শেষ চিঠি’, এরকম একটা বাক্য দিয়ে এটা শুরু করি। পরে, ভেবে দেখলাম, সে ব্যাপারটা বরং ব্যাপকতর ন্যাকা-ন্যাকা হয়ে যায়। কোনও মানে হয় না এসবের। অনেক বয়েস হল, দুজনেরই, এই অগাস্টে আমার ৪২ হবে, আর, যতদূর মনে পড়ে, আপনার হবে ৫৫, অ্যাঁ, কী বলেন ? বরং, এই জিজ্ঞাসাচিহ্নটার পরে, এখানে, একটা স্মাইলি বসাতে পারলে কিন্তু বেশ লাগত শেখর দা…

আপনার / আপনাদের ‘প্রান্তিক’ পত্রিকায় আর হয়তো কখনও আমার লেখা ছাপা হবে না। ঠিক আছে। সবকিছুরই একটা সময় থাকে। অনেক অনেক লিখেছি প্রান্তিকে। অন্যরা লিখুক। এটা কোনও মান অভিমানের কথা না। অত্যন্ত সিরিয়াসলিই লিখলাম। আরেকটু লিখি ? কবিমাত্রেই সংখ্যালঘু। এবং আপন গোষ্ঠীর অন্তর্গত লোকদের দ্বারাই সবথেকে বেশী আঘাতপ্রাপ্ত, ক্ষতবিক্ষত। কাকে কাকের মাংস খায় না, ডাক্তারে ডাক্তারের মাংস খায় না… কিন্তু, কবি কবি-র মাংস চেটেপুটে খায়। আমি তো বরাবরই, সর্বত্র, সব বৃত্তেই বহিরাগত এবং সংখ্যালঘু। মজায় থাকার কথা। অল্প বিরক্ত লাগে আজকাল। প্রান্তিক ভাবে আমি ফলিত কবিতার লোক, আর ফলিত কবিতা ভাবে আমি প্রান্তিকের। স্কুলের বন্ধু, যাদবপুরের বন্ধু, অফিসকলিগদের মধ্যে, আত্মীয়দের মধ্যে, সামান্য লেখালেখির টুকরো কবিতাভুবনে… সর্বত্র। নীলাব্জ বাইরের লোক।

কিছু এসে যায় না আসলে। লেখালেখির ব্যাপারে কিছু হারাবার নেই, পাওয়ারও নেই। কোনও লাইনে দাঁড়াইনি বস। বিখ্যাত লোকদের দরজায় দরজায় নিজের বই হাতে নিয়ে ঠকঠক করিনি কখনও। কেউ যেতে বললেও যাইনি। নিজের পড়তে যেন ভাল লাগে, ব্যস, নিজের লেখালেখি নিয়ে এর চেয়ে বেশী কিছু দাবিদাওয়া নেই আর। তবে, জানেন, আজকাল, কবিতা ছাড়া কিছু লিখতে ইচ্ছা করে না শেখর দা। আর, গদ্য ছাড়া কিছু পড়তে ইচ্ছা করে না। ফ্যালাসি, না ? ওই ফ্যালাসিটুকুই সততা, এরকম মনে হয়। জনসংযোগ বরাবরই খুব খারাপ আমার। কেউ লেখা না চাইলে যেচে দিতে ইচ্ছে করে না। তাও এখনও কেউ কেউ লেখা চায় বলে এদিক ওদিক ছাপা হয়। এরপর তাও হবে না আর। তাতেই বা কী ? আবার একটা স্মাইলি বসাতে ইচ্ছে করছে এখানে…

অ্যাজ ইফ, এই চিঠিটা আপনাকে লিখছি না। নিজেকেই লিখছি বোধহয়। হা হা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আপনার সাথে ঝগড়া করছি মনে হচ্ছে। করতেই পারি, কি বলেন ? আপনাকে আমার মত করে আর কেই বা পড়েছে ? পড়তে পড়তে অনেক শিখেছি, অনেক ভালোলাগার মুহূর্ত এসেছে বারবার। আপনার বইগুলো থেকে অনেক পেয়েছি একসময়। আজকাল যদিও আর তেমন পড়া হয় না। তবুও, আপনি আমার সুপারস্টার। থাকবেন। তবে, জানেন, একটা সময় আমি বোধহয় আপনার বড় বেশীই কাছাকাছি চলে এসেছিলাম কোনোভাবে। সেটা অনেকের ভাল লাগেনি। আপনি অন্যদের কথা শুনে প্রভাবিত হতে ভালবাসেন। আর, ভালবাসেন ভুলে যেতে। ঠিক হ্যয়, ব্যাপার না। কতজন কতভাবে চেয়েছে আমার লেখা বন্ধ করে দিতে। পরোক্ষে তাতে ইন্ধনও দিয়ে গেছে কতজন। যাই হোক, এখন আর কোনওকিছুতেই তেমন অবাক হই না। আমি কি দেখিনি অন্যধারার কবিতা লিখতে চাওয়া বিপ্লবী জনগণ ভেতরে ভেতরে কতটা ধান্দাবাজ ও লোভী… আমি কি লক্ষ করিনি বিশিষ্ট জ্ঞানী ও আগামী দিনের কবিতা ও কবিতাতত্ত্ব নিয়ে তুলকালাম করা লোক কীভাবে বহুদিন ধরে ফেসবুকে নোট বাতিল সমর্থন করে একের পর এক পোস্ট দিয়ে গ্যাছে… বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষদের প্রতি চরমবিদ্বেষমূলক মন্তব্য করে গ্যাছে, উস্কানি দিয়ে গ্যাছে দিনের পর দিন…

চিঠি শেষ করব শেখর দা… আপনি খুব সুন্দর চিঠি লেখেন, তবু, এই চিঠিটার উত্তর দেবেন না প্লিজ… ভাল থাকবেন… আমার মনটা নানা কারণে ভাল নেই ইদানীং… যাই হোক…

নীলাব্জ

পুনশ্চঃ

ভাল কথা শেখর দা, এর আগে, কোনও একটা চিঠিতে, আপনি জানতে চেয়েছিলেন গত এক-দুই বছরে পড়ে ওঠা কয়েকটি প্রিয় বইয়ের নাম। নীচে একটা ছোট লিস্ট করে দিলাম।

১) জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা – শহীদুল জহির

২) মুখের দিকে দেখি – শহীদুল জহির

৩) সে রাতে পূর্ণিমা ছিল – শহীদুল জহির

৪) ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প – শহীদুল জহির

৫) ফ্রাইডে আইল্যাণ্ড অথবা নরমাংস ভক্ষণ এবং তাহার পর – অমিয়ভূষণ মজুমদার

৬) যদ্যপি আমার গুরু – আহমদ ছফা

৭) খেলনা নগর – নবারুণ ভট্টাচার্য

৮) যুদ্ধ পরিস্থিতি –  নবারুণ ভট্টাচার্য

৯) ক্যাপ্টেন দুপুরে ভাত খেতে গেছে আর নাবিকেরা দখল নিয়েছে জাহাজের – বুকাওস্কি (অনুবাদঃ শুভঙ্কর দাশ)

লিস্ট ছোটই রাখলাম। দশেরও কম। তবে, শেষে একটাই কথা বলব, এই বইগুলি ‘পড়ে’ আর ‘ওঠা’ যায় না, এইটুকু।

# * # * #

= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =

এখানে নানারকম কবিতা লেখা শেখানো হয়

বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ট্রেনারদের দ্বারা

কোর্স শেষে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়

পরীক্ষা প্রার্থনীয়

= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =

অথচ পালক অবধি এই ভেজা ঘ্রাণ। এই মিথ্যে টেক্সচার সত্যি। ফলো করতে করতে আঙুলের শাদা পোশাক। স্মৃতি এক অসমাপিকা হয়ে। খুব লজিক্যাল কিছু। ক্রমে, এক মগজ। ঢালু হয়ে আসা অস্থির সব হরফ। ঝরে পড়ছে। অথচ পালক অবধি এই ভেজা উচ্চারণগুলো এক একজন লঘু পাথর। প্রতিটি ওষুধের গায়ে একটা একটা বরাদ্দ করে রাখা তারিখ। হাতে লিখে রাখা চাবি। একটা সাজানো সতর্কতাবার্তা – ভেজা গান বাঁধতে নেই… অথচ দাঁতে দাঁত চেপে আমি খুব সাদাকালো কবিতা কবিতা… সরে যেতে যেতে তোমরা কি লক্ষ করনি কীভাবে ভালবাসতে বাসতে একজন চরিত্র হয়ে ওঠে ?

এখন দ্বিধা বলতে টানেলের ভেতর যেটুকু রোদ। অন্য কারো ডুয়াল সিমে তোমার বেলা পড়ে আসছে কোথাও। পছন্দ করছে বুনো পাথরের গায়ে পার্পল ছোপ ধরতে থাকা কম্যুনিকেশন। পছন্দ করছে আলগা যৌনতা। ভাষার সবটায় তখন কাঁচ ছড়ানো। স্থিতির ভেতর খুব ছুটতে ছুটতে ভাবছি প্রাপ্তি শব্দটার মানেটা ঠিক কী। লক্ষ করো, কেমন ফুলে উঠছে রাস্তাটার গ্রীষ্মকালীন নাম। তোমার কবিতাকে জীবাণুমুক্ত রাখো। ভাবো, উদ্ভিন্ন একটি বিশেষ অঞ্চলের নাম। তার ছোটবড়ো ছায়ারা শব্দ করে ‘তদনুরূপ, তদনুরূপ’। এভাবে স্তনকে দুপুর লিখি আর খুলে রাখি স্নায়ুদের জলপথ। বিশ্বাস করতে থাকি, সিনট্যাক্স ছিঁড়ে ফ্যালাও আরেকটা সিনট্যাক্স…

জানো, আজও সাদা বললেই ভাত মনে আসে… সে এক রিয়্যালিটি বটে… আর গানে লিরিক ব্যাপারটা অতো জরুরী কিছু না বুঝলে… আসলে সুরটাই গান… নাও মানতে পারো অবশ্য… কোথাও পড়েছিলাম… একদম আমার মনের মতো কথা… লিরিক হচ্ছে গানটার ভার, চেপে ধরে রেখেছে, উড়তে দিচ্ছে না, শরীরও বলতে পারো… আর সুর… সুর হচ্ছে গানটার আত্মা-প্রাণ-জীবন… এইরকম কিছু একটা… মোদ্দা কথাটা হোলো এই যে, সুরটাই আসলে গান… ব্যস…

দাঁড়াও দাঁড়াও… এক মিনিট… হতে পারে তোমার তরফ থেকে ইটস আ বিইইইগ নোওওও… তবু, আমার কথাটা তো বলতে দাও… এটা তোমার ওপর ইমপোজ করার কোনও ব্যাপার না… কিন্তু… শোনো তো একবার…

এইটুকু কথাবার্তা ওভারল্যাপিং হওয়ার পর আমরা লক্ষ করি, ম্যাগির দোকান পর্যন্ত চাঁদ উঠে আবার নেমে আসছে। অল্প শোকের মত ছায়া। স্পর্শ একটা অনুমতি। নীল তেমন কিছু গাঢ় নয়। নগ্নতা বদল করছে কেউ। শরীর কি একটা ব্যবহার তবে ? অহং কি একটা স্পাইরাল বাইণ্ডিং করা কমলা রঙের রুলটানা খাতা ? ভাষা একটা সম্পর্ককে জড়াতে জড়াতে যতদূর…

# * # * #

রেইলওয়ে লেভেল-ক্রসিং-এর গেট, ক্রমে, জ্যামিতিকভাবে উত্থিত ও অর্ধোত্থিত দশা হইতে ধীরে ও অপরিহার্যভাবে শায়িত দশায় উপনীত হইতে থাকে এবং অনতিদূরে কামানের নিশ্চিত গর্জ্জন মুহুর্মুহু সম্ভব হয়। এমতাবস্থায়, আমরা ঈষৎ অবনত হইয়া আসি, প্রতিনিবিষ্ট হই এবং প্রত্যক্ষ করি যে ক্যারেকটার এক্সওয়াই ক্যারেকটার এক্সএক্স-কে উদ্দেশ্য করিয়া কোনরূপ প্ররোচনা ব্যতিরেকেই বলিতে থাকেন…

ভদ্রে, লক্ষ করিবে, পূর্বনির্দ্ধারিত সে তারিখ, বস্তুতঃ, মুখর এক অর্জ্জনমাত্র, যাহা, ক্রমে, ব্যর্থ, অথচ তুমি এইরূপে আমার ডিসেম্বর, কতই না অবহেলায়, ভাঙিয়া ফেলিলেঅন্যথায়, কেননা, ঋতুহীন এই দশা, যাহা উত্তরোত্তর সান্দ্র, মাত্র তদবধিই আমাদের সঙ্গীত এক পরিমাপবিশেষ। এই সেই ব্যাকুলতা!

অয়ি কমললোচনে, বিস্মরণ হইয়ো না, পশু, কত দ্রুতই না সে, তথাপি আপনার শরীরের অধিক ধাবিত হইতে অক্ষম। তদনুরূপে, পক্ষী, নিজ শরীরের অধিক উচ্চতায় উড্ডয়ন করিতে সমর্থ নহে। ফলতঃ, ইহা অনুমেয়, তাহাদের যৌনতা তথা সঙ্গমও তদ্রূপ। দেহ এক সীমা!

এতদ্ব্যতীত, হে পরমাদৃতা, অধিক কী কহিব, ধারণ করিতে স্বীকার্য হও, কেন না, কেবল মনুষ্যজাতিই আপন শরীরের বাহিরে, আপন শরীরের ঊর্ধ্বে, স্পষ্টতায় বিচরণক্ষম। তথাপি, এক্ষণে ইহা লিপিবদ্ধ করিবার আকাঙ্ক্ষা বোধ করিতেছি যে, দর্শনাভিলাষ ও স্পর্শাভিলাষ, উভয়েই, ্রকৃতপক্ষে, কিঞ্চিদধিক অভিমানী এক এক দ্রুত বিবরণমাত্র অর্থাৎ শুদ্ধতা এক পতনশীল ও সংরক্ষিত সূত্র ব্যতীত আর কিছুমাত্র নহে

(চলবে)

Facebook Comments

Posted in: June 2019, Novel

Tagged as: ,

Leave a Reply