জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে লেখা চিঠি – স্বপন রায়

রবীন্দ্রনাথ লাইভ সংখ্যায় স্বপন রায়
রবীন্দ্রনাথ লাইভ সংখ্যায় স্বপন রায়

প্রেক্ষাপট : ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল ছিল নববর্ষ, বৈশাখী মেলার দিন। সেদিন রাউলাট আইনে ড: সইফুদ্দিন কিচলু ও ড: সত্যপাল-এর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে জালিয়ানওয়ালাবাগে এক জনসভা ছিল। প্রায় বিশ হাজার মানুষের জমায়েতের উপর সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ পুলিশ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে ১৬০০ রাউন্ড গুলি চালায়। ইংরেজ সরকারের হিসেবে ৪০০ জন, বেসরকারি মতে ১০০০ জন নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এই দুঃসংবাদ পেয়ে ব্যথিত, ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগ যেতে চেয়েছিলেন। যেতে পারেননি। তবে নিশ্চুপ বসে থাকতে পারেননি কবি। বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডকে ৩০শে মে এক চিঠি লিখে বৃটিশরাজের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। সেদিন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অমানবিক, নির্মম হত্যাকাণ্ড রবীন্দ্রনাথকে আলোড়িত করেছিল, তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন।

আমাদের স্বাধীন দেশে আজও মানবতা লুন্ঠিত হয় মব লিঞ্চিং, গোরক্ষা, সাম্প্রদায়িক আধিপত্যবাদের নামে। কয়েকজন মাত্র আখলাক খবরে আসেন, গৌরী লঙ্কেশ-গোবিন্দ পানসারে-কালবুর্গির মতো কয়েকজন প্রতিবাদীর মৃত্যু জাতির গোচরে আসে, বাকিরা সংবাদপত্রের কোন এক পাতার অজানা কোনে বেখবর থেকে যান। আমরা সে’ কারণে রবীন্দ্রনাথের চেমসফোর্ডকে দেওয়া চিঠিটি প্রতিস্থাপন করতে অনুরোধ করেছিলাম। সমসাময়িক পরিস্থিতিতে বর্তমানের কোন কবির প্রতিবাদপত্র কেমন হতে পারে সেটাই দেখতে চেয়েছিলাম কবি স্বপন রায়ের কাছে। 

চেমসফোর্ডকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি

“কয়েকটি স্থানীয় হাঙ্গামা শান্ত করিবার উপলক্ষে পাঞ্জাব গবর্ণমেন্ট যে সকল উপায় অবলম্বন করিয়াছেন তাহার প্রচণ্ডতায় আজ আমাদের মন কঠিন আঘাত পাইয়া ভারতীয় প্রজাবৃন্দের নিরুপায় অবস্থার কথা স্পষ্ট উপলব্ধি করিয়াছে। হতভাগ্য পাঞ্জাবীদিগকে যে রাজদণ্ডে দণ্ডিত করা হইয়াছে, তাহার অপরিমিত কঠোরতা ও সেই দণ্ডপ্রয়োগবিধির বিশেষত্ব, আমাদের মতে কয়েকটি আধুনিক ও পূর্বতন দৃষ্টান্ত বাদে সকল সভ্য শাসনতন্ত্রের ইতিহাসে তুলনাহীন। যে প্রজাদের প্রতি এইরূপ বিধান করা হইয়াছে, যখন চিন্তা করিয়া দেখা যায়, তাহারা কিরূপ নিরস্ত্র ও নিঃসম্বল, এবং যাঁহারা এইরূপ বিধান করিয়াছেন, তাঁহাদের লোকহন-ব্যবস্থা কিরূপ নিদারুণ নৈপুণ্যশালী, তখন একথা আমাদিগকে জোর করিয়াই বলিতে হইবে যে, এরূপ বিধান পোলিটিক্যাল প্রয়োজন বা ধর্মবিচারের দোহাই দিয়া নিজের সাফাই করিতে পারে না। পাঞ্জাবী নেতারা যে অপমান ও দুঃখ ভোগ করিয়াছেন, নিষেধরুদ্ধ কঠোর বাধা ভেদ করিয়াও তাহার বিষয় ভারতবর্ষের দূরদূরান্তে ব্যাপ্ত হইয়াছে। তদুপলক্ষে সর্বত্র জনসাধারণের মনে যে বেদনাপূর্ণ ধিক্কার জাগ্রত হইল আমাদের কর্তৃপক্ষ তাহাকে উপেক্ষা করিয়াছেন এবং সম্ভবতঃ এই কল্পনা করিয়া তাঁহারা আত্মশ্লাঘা বোধ করিতেছেন যে, ইহাতে আমাদিগের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হইল। এখানকার ইংরেজচালিত অধিকাংশ সংবাদপত্র এই নির্মমতার প্রশংসা করিয়াছে এবং কোনও কোনও কাগজে পাশব নৈষ্ঠুর্যের সহিত আমাদের দুঃখ লইয়া পরিহাস করা হইয়াছে, অথচ যে সকল শাসনকর্তা পীড়িতপক্ষের সংবাদপত্রে ব্যথিতের আর্তধ্বনি বা শাসননীতির ঔচিত্য আলোচনা বলপূর্বক অবরুদ্ধ করিবার জন্য নিদারুণ তৎপরতা প্রকাশ করিয়াছেন তাঁহারই উক্ত ইংরাজচালিত সংবাদপত্রের কোন চাঞ্চল্যকে কিছুমাত্র নিবারণ করেন নাই। যখন জানিলাম যে আমাদের সকল দরবার ব্যর্থ হইল, যখন দেখা গেল, প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তিতে আমাদের গবর্ণমেন্টের রাজধর্মদৃষ্টি অন্ধ করিয়াছে, অথচ যখন নিশ্চয় জানি, নিজের প্রভূত বাহুবল ও চিরাগত ধর্ম নিয়মের অনুয়ায়িক মহদাশয়তা অবলম্বন করা এই গবর্ণমেন্টের পক্ষে কত সহজ কার্য ছিল, তখন স্বদেশের কল্যাণকামনায় আমি এইটুকুমাত্র করিবার সঙ্কল্প করিয়াছি যে, আমাদের বহুকোটি যে ভারতীয় প্রজা অদ্য আকস্মিক আতঙ্কে নির্বাক হইয়াছে, তাহাদের আপত্তিকে বাণীদান করিবার সমস্ত দায়িত্ব পত্রযোগে আমি নিজে গ্রহণ করিব। অদ্যকার দিনে আমার ব্যক্তিগত সম্মানের পদবীগুলি চতুর্দিকবর্তী জাতিগত অবমাননার অসামঞ্জস্যের মধ্যে নিজের লজ্জাকেই স্পষ্টতর করিয়া প্রকাশ করিতেছে। অন্ততঃ আমি নিজের সম্বন্ধে এই কথা বলিতে পারি যে, আমার যে সকল স্বদেশবাসী তাহাদের অকিঞ্চিৎকরতার লাঞ্ছনায় মনুষ্যের অযোগ্য সম্মান সহ্য করিবার অধিকারী বলিয়া গণ্য হয়, নিজের সমস্ত বিশেষ সম্মান-চিহ্ন বর্জন করিয়া আমি তাহাদেরই পার্শ্বে নামিয়া দাঁড়াইতে ইচ্ছা করি। রাজাধিরাজ ভারতেশ্বর আমাকে ‘নাইট’ উপাধি দিয়া সম্মানিত করিয়াছেন, সেই উপাধি পূর্বতন যে রাজপ্রতিনিধির হস্ত হইতে গ্রহণ করিয়াছিলাম তাঁহার উদার-চিত্ততার প্রতি চিরদিন আমার পরম শ্রদ্ধা আছে। উপরে বিবৃত কারণবশতঃ বড় দুঃখেই আমি যথোচিত বিনয়ের সহিত শ্রীলশ্রীযুক্তের নিকট অদ্য এই উপরোধ উপস্থাপিত করিতে বাধ্য হইয়াছি যে, সেই ‘নাইট’ পদবী হইতে আমাকে নিস্কৃতিদান করিবার ব্যবস্থা করা হয়।” [রবীন্দ্রনাথের করা বাংলা অনুবাদ]

প্রতিস্থাপন :: স্বপনরায়

মাননীয় মন্ত্রী

মানব সংসাধন বিকাশ মন্ত্রালয়

আমি, শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাধ্য হয়ে এই চিঠি লিখছি আপনাকে।

মাননীয় মন্ত্রী, আমি কিভাবে বেঁচে আছি আপনাকে জানানো প্রয়োজন। তার আগে আমার এই লেখাটা আপনাকে পড়তে অনুরোধ করি:

চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবস শর্ব্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়,

যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালু রাশি
বিচারের স্রোতঃ পথ ফেলে নাই গ্রাসি,
পৌরুষেরে করেনি শতধা; নিত্য যেথা
তুমি সর্ব্ব কর্ম্ম চিন্তা আনন্দের নেতা, —
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ
আমাদে্র সেই স্বর্গে করো জাগরিত।

আমি বেঁচে থাকার জন্য একটি দেশে যা চেয়েছিলাম, এই কবিতায় আছে। স্বাধীন ভারতে যখন ২৫ শে বৈশাখে আমার গলায় মালা পরানো হয়, আমার ভারী লাগে। পাথরের গলা, তবু। আমি চেয়েছিলাম, ভয়শূন্য হৃদয়ের স্পন্দনে মাথা উঁচু করা একটা দেশ দেখবো। যেখানে আচার আর বিচারের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাবেনা ভালবাসার ভরকেন্দ্র মনুষ্যত্ব। মানুষ অমানুষ হয়ে যায় যখন, একটা জালিয়ানওয়ালাবাগ হয়। আমি, সেই ঘটনার প্রতিবাদে নাইটহুড ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কবি, শুধু লেখেই না। কল্পলোকের আনাগোনা তার মর্ত্যলোকের মুসাফিরি করেই। শাসক যখন অমানবিক হয়ে ওঠে, কবি মনে করিয়ে দেয় তার মনুষ্যত্বকে। কবি আর কী করতে পারে, প্রতিবাদ ছাড়া। আমি বেঁচে নেই, আপনি জানেন। আবার নানাভাবে বেঁচে আছি, তাও জানেন। আজ যখন দেখি শাসক গোষ্ঠিবদ্ধভাবে বিজ্ঞান আর যুক্তিকে হেয় প্রতিপন্ন করে চলেছে ‘হিন্দু ধর্মে’র ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে, সমাজকে ভাগ করে দিচ্ছে ধর্মের নামে, হত্যা করছে যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের, সরকারের বিরোধীতা করলেই যে কোন বিদগ্ধ সৃজনশীল ব্যক্তিকে দেগে দেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের দালাল হিসেবে, প্রতিটি মানুষ ভক্তিতে নয়, ভয়ে মেনে নিচ্ছে সবকিছু, আমি চুপ করে থাকতে পারিনা। দেশ স্বাধীন হয়েছে, চিন্তা ভাবনার স্বাধীনতা কই? সংবিধানে যা লেখা আছে তা আপনারাই মানেন না। সংবিধান মানলে, এই দেশ স্বাধীনতার পীঠস্থান হয়ে উঠত। বিগত একাত্তর বছর ধরে দেশটা শুধু ভাগ হয়েছে। আর যারা এই ভাগাভাগির বিরুদ্ধতা করেছে তাদের হত্যা করা হয়েছে। আপনাদের কোন কিছুই করার নেই, সংবিধান কী বলে?

আমার কাছে স্বাধীন ভারতের কোনও পুরস্কার নেই। তাই ফেরাবার প্রশ্নও নেই। আমি শুধু বলবো, আমার মূর্তিগুলো সরিয়ে নিন। আমি মূর্তি পুজোয় বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু মানুষ আমায় বাঁচিয়ে রাখতে চায়, মূর্তির ভেতরে। আর আমি চুপ করে সব দেখি। মানুষের চোখ, মুখ। মানুষের হাত, পা। মাথা। মানুষের বয়ে যাওয়া রক্ত। আর পারছি না। আমায় সরিয়ে দিন, সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লাব, রাস্তার মোড় থেকে। আমি এভাবে বাঁচতে চাই না।

বিনীত,

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

Facebook Comments

Leave a Reply