আলোচনা | ‘ঘুম নেই’ : জ্বলন্ত সময়ে স্পর্ধার কথা বলে – সৌরভ দত্ত

উৎপল দত্তের নাটক তাঁর সময়ে দাঁড়িয়ে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেকথা জেনেছি সেই সময়ের মানুষদের কাছ থেকে আর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে। তাঁর মৃত্যুর পর দু’দশক উত্তীর্ণ হয়ে আজও তাঁর নাটক কতটা প্রাসঙ্গিক তা নতুন করে উপলব্ধি করবেন কলকাতার মানুষ। ২০১৮’র সেপ্টেম্বরে ‘ইচ্ছেমতো’ তাদের নতুন নাটকের জার্নি শুরু করার সময় বলেছিল– এমন একটা দেশ, যার ম্যাপ কোথায় নেই জানা, হাত বাড়ালেই বুক ভরা বাতাস মাটি খুঁড়লেই সোনা; সব কিছুই নয় শেষ, দুঃখে কেঁদোনা কেউ, যেতেই হবে কমরেড যেথায় চোখ তুললেই ঢেউ… ঠিক সাত মাস বাদে এমন একটা মারাত্মক ঢেউয়ের মুখে তারাই নিয়ে এসে ফেলবে, ভাবিনি। না, ওরা দুঃখে কাঁদছেনা কেউ। ইচ্ছেমতো বুঝিয়ে দিল সেই ঠিকানা বিহীন দেশের ম্যাপ খোঁজার জার্নিতে ওদের ঘুম নেই। এটা কোনো রিভিউ নয়। প্রযোজনা দেখার পর অনুভভুতি বিনিময়ের জন্য এই লেখা। আমার যতটুকু নাটক দেখা, খোঁজ-খবর রাখা বা জানা, তাতে থিয়েটারে মঞ্চ থেকে শ্রেনীর কথা বলা হচ্ছে এমন নাটকের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। হাতে গোনা কয়েকজন নির্দেশক–দল এ’কাজ করে যাচ্ছে। ‘ইচ্ছেমতো’ তাদের মধ্যে অন্যতম। থিয়েটার সঠিক রাজনীতির কথা বলার মেরুদণ্ডটাই যেন কোথায় হারিয়ে ফেলেছে। অথচ গোটা দেশ জুড়ে যখন ফ্যাসিবাদের পায়ের আওয়াজ যখন ক্রমশ বাড়ছে তখন বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নাটক শ্রেণী বিভক্ত সমাজে প্রান্তিক মানুষের লড়াইকে সমৃদ্ধ করতে পারে, এটাই সত্য। উৎপল দত্ত’র “ঘুম নেই” দেখে উৎপল বাবুরই একটা কথা বার বার মনে আসছে “যে নাটকের রাজনীতি ভুল তার সবটাই ভুল।”
‘ইচ্ছেমতো’ এই দুঃসময়ে দাঁড়িয়ে ভীষণ জরুরী একটা কাজ করল। একটা নাটক দেখলাম যা ডিজাইন নির্ভর নয়। একটা নাটক দেখলাম যেখানে আরোপিত কিছু নেই। একটা নাটক দেখলাম যাতে বিরাট বিরাট ফাঁক-ফোঁকর রঙ দিয়ে গান দিয়ে প্রপস দিয়ে পোশাক দিয়ে ঢাকতে হয়না। একটা নাটক দেখলাম যে নাটকে ব্যাক স্টেজের এমন ব্যবহার খুব কম দেখেছি। একটা নাটক দেখলাম যাতে আলো কোনো আলো নয়, সংলাপের আড়ালে আরও অনেক গভীর সংলাপ। একটা নাটক দেখলাম যেখানে জ্বলন্ত বাস্তবের মত “শূন্যের পাশে শূন্য” ঘুরতে ঘুরতে প্রতিরোধ হয়ে যায়। একটা নাটক দেখলাম যা বলে গেল প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে প্রান্তিক মানুষের ভাগ হয়ে যাওয়ার মত কোনো “ধর্ম” জন্মায়নি আজও। একটা নাটক দেখলাম যেখানে কোলাহলে কথা হারিয়ে যাওয়ার অসুখ তীব্র ভাবে দাগ কেটে যায়। গোটা দেশ জুড়ে কোলাহল চলে কোলাহল তৈরি হয় প্রান্তিক মানুষকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রান্তিক মানুষই তো বিপ্লব করে। আর যারা বিপ্লব করে তাদের ঘুম থাকেনা। তাই ওদের ‘ঘুম নেই’। আখলাক ঘুমোয়না। ইন্দ্র ঘুমোয়না। সোনা ঘুমোয়না। রাধা নকুল কেষ্ট উদ্ধব এরা কেউ ঘুমোয়না। এদের সবাইকে সামলাতে সামলাতে এককড়ির সূর্য কখন পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায় আর কখন পশ্চিম থেকে পুর্বে হিসেব রাখতে পারেনা। কয়েকটা চরিত্রের নাম বললাম। গল্পটা বললাম না। কেন ওরা ঘুমোয়না তা প্রযোজনাটি দেখে জানতে হবে, বুঝতে হবে। কৌশিক কর আমার ভীষণ প্রিয় অভিনেতা। হাঁ করে দেখি, গোগ্রাসে গিলি কৌশিকের অভিনয়। কারণ কৌশিকের অভিনয় কোনো অভিনয় নয়। একজন চরিত্রকে কৌশিক নির্মাণ করেন ভেতর থেকে। কৌশিকের নির্মাণ বার বার নতজানু করে দেয়। কিন্তু প্রাপ্তি অন্য জায়গায়, কৌশিকের পাশে দাঁড়িয়ে অপ্রতিম কৃষ্ণেন্দু ভিকি মুদাস্সার সহ অন্যরা এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে কৌশিককেই যেন বলে গেল “ব্যাটিংটা আমরাও করতে জানি বস।”
সৌরভ পালোধি কৌশিক কর এরা যেমন ক্রিয়েটার, এরা মঞ্চ মঞ্চের বাইরে ছড়িয়ে দিয়েছে আরো এক ঝাঁক ক্রিয়েটার। যারা দারুন একটা টিম গেম উপহার দিল। আলো মঞ্চ সঙ্গীত অভিনয় সবটাই এক তারে বাঁধা। যারা কাজ করেছেন তারা জানেন কোনো একজনেরও সামান্য ভুল গোটা প্রযোজনাকে নষ্ট করে দিতে পারে। এই জায়গায় তারা সবাই সচেতন। ইচ্ছেমতোর প্রায় সব নাটকেই সঙ্গীত একটা বড় জায়গা জুড়ে থাকে। এ নাটকও তার ব্যতিক্রম নয়। আরও একটা বিষয় দেখেছি, মঞ্চের প্রপ্স এবং রিক্যুইজিশনকে ব্যবহার করে সঙ্গীত সৃষ্টি ইচ্ছেমতোর একটা নিজস্ব স্টাইল। দেবদীপের কথা আলাদা করে বলার কিছু নেই। সংগীতের মধ্যে দিয়েই ও চিনিয়ে দিয়েছে নিজেকে। একই কথা আলো’র সৌমেন এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নাটকটা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। আসলে প্রাপ্ত মনস্কদের জন্য। লড়াইটা যেখানে ওপরতলার সাথে নিচের তলার, ওপরতলা থেকে শোষণ যখন নীচে নামে তখন নীচের তলা যদি চিৎকার করে বলে “আমাদের বাল ছেঁড়া যায়, রাজায় রাজায় তাল পাকায়…” সেই কথা শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই বিচার করতে হয়। কারন ওদের “ঘুম নেই ঘাম আছে আর তাই চোখ এত লাল, ওস্তাদ ঢেউয়েতে উঠেছে আছড়ালো সওয়াল জবাব, দুরে দাঁড়িয়ে দেখছে একজন তারও ঘুম নেই আছে তরোয়াল।”
“ঘুম নেই”
নাটক- উৎপল দত্ত
সম্পাদনা নির্দেশনা- সৌরভ পালোধি
প্রযোজনা- ‘ইচ্ছেমতো’