ধারাবাহিক উপন্যাস : নীলাব্জ চক্রবর্তী
যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে
দ্বিতীয় পর্ব
৪
- অ্যাঁ ! এটা আবার কী বললে ? ফরাসী নাকি ?
বিস্ময়টা একদম অরিজিনাল মনে হোলো।
- ওই আর কী ! যা হয় একটা কিছু হবে… ছাড়ো… এমনি বললাম…
- উঁহু উঁহু… এমনি বললাম আবার কী ? কেমন যেন ফরাসী ফরাসী ভাব… তুমি ফ্রেঞ্চ জানো ?
- আরে না না… মোটেও জানি না। জাস্ট দু-একটা বাক্য অতিচালাকের মতো মুখস্থ করে রেখেছি। মাঝেমাঝে আওড়াই কায়দা করে… ব্যস এইটুকু… কিস্যু জানি না আসলে… হা হা…
- ওটা কী বললে আরেকবার বলো তো। ফ্রেঞ্চ কিন্তু শুনতে ব্যাপক লাগে…
- হা হা… বলছি বলছি… কামো ভ্যুজ আপেলে ভ্যু মাদমোয়াজেল?
- বেশ বেশ… এরকম আর কী কী জানো শুনি একটু এবার…
- আরে ধুরর… বলছি তো… ছাড়ো… দাঁড়াও… একবার এই ফ্রেঞ্চ নিয়ে একটা মজা হয়েছিল… মনে পড়ল হঠাৎ… সেটা বরং বলি তোমায়…
- অ। আচ্ছা… বেশ… বলো… শুনি…
- অর্জুন নামে একটা গাছ আছে। তুমি চিনবে না। যাই হোক, সেই অর্জুনগাছ একবার কেন জানি ভেবেছে আমি বোধহয় ফরাসীটা ভালোই জানি। কেন যে ভেবেছিল সেটা একটা রহস্য। কখনও জিগ্যেস করা হয়নি ওকে। ইনফ্যাক্ট তখন আমি এই মুখস্থ করা বাক্যগুলোও বোধহয় জানতাম না। কয়েক বছর আগের কথা… ও হঠাৎ করে আমার ইনবক্সে এসে ফরাসীতে আলাপ শুরু করে। প্রথমে আমি অবাক হয়েছিলাম, তবে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে এটা ফরাসী। আমি সঙ্গে সঙ্গে গুগলে ওটার ইংরাজি মানে দেখে নিই… তারপর তার উত্তরে কী বলা যায় সেটা আবার গুগলে লিখে তাকে ফরাসীতে কী বলে জেনে নিয়ে রিপ্লাই দিচ্ছিলাম… হা হা… এটা অনেকক্ষণ চলেছিল… তারপর ওকে বলে দিয়েছিলাম আসল ব্যাপার… ও, সম্ভবতঃ, অবাক হয়েছিল…
# * # * #
উপরের এই কথোপকথন আরেকবার পড়ুন। তারপর নিম্নলিখিত অপশনগুলির মধ্যে থেকে ঠিকটি বেছে নিয়ে ‘টিক’ চিহ্ন দিন আর জিতে নিন আপনার প্রিয় ঔপন্যাসিক নীলাব্জ চক্রবর্তীর সাথে একদিন বিস্কুট খাওয়ার সুযোগ…
১) এই কথোপকথন সম্পূর্ণ কল্পিত। প্রতিটি সংলাপ বানানো।
২) এই কথোপকথন সত্যি। প্রতিটি শব্দ সত্যিই কখনও আদানপ্রদান হয়েছিল। সামনাসামনি।
৩) এই কথোপকথন সত্যি। প্রতিটি শব্দ সত্যিই কখনও আদানপ্রদান হয়েছিল। টেলিফোনে।
৪) এই কথোপকথন সত্যি। প্রতিটি শব্দ সত্যিই কখনও আদানপ্রদান হয়েছিল। ফেসবুক ইনবক্সে।
৫) নোটা (নান অব দ্য অ্যাবোভ)।
৫
A deep-focus shot includes foreground, middle-ground, and extreme-background objects, all in focus …
ওই গাড়িটা দ্যাখো… ওই যে কালচে রঙ… না না রাস্তার ওইদিকে না, সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে… দ্যাখো… হ্যাঁ, ওইটা, ওই লম্বামতোটা। ওই গাড়িটার দাম জানো ? মাত্র ৭৬ লক্ষ টাকা। প্রতিবছর ওর বীমাবাবদ দিতে হয় প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। হা হা… শুধু ওই বীমার টাকাতেই একটা মোটামুটি গাড়ি কিনে নেওয়া যায়। বাই দ্য ওয়ে, তোমার কোনও গাড়ি নেই, না ? যাকগে, তারপর শোনো, ওই গাড়িটার গায়ে একটা আঁচড় লাগলে, একটা সামান্য ছুটকো-ছাটকা কোনও কাজ করাতে গ্যারাজে দিলে মিনিমাম বিল ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। একটা লাইট খারাপ হলে সারাতে খরচা ৩০-৩৫ হাজার। আহ, গাড়িও সেরকম। সব অটোমেটিক। ২০০ মিটার দূর থেকে আপনাআপনি পার্কিং হয়ে যায়… রাস্তার উঁচুনীচু কিছু টেরই পাওয়া যায় না চলতে শুরু করলে… জানো, ৩ সেকেণ্ডে ৯০ কিমি পার আওয়ার স্পিড উঠে যায় ? হায়েস্ট স্পিড ২৮০ কিমি… তবে এখানে আর তেমন রাস্তা কই? ওই ১১০-১২০-র বেশী স্পিড ওঠানো যায় না… আজকাল এইসব গাড়ির ভালোই বিক্রি… আরে ভাই, তুমি জানো না আশেপাশে অনেক লোক এইসব গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ায়…
# * # * #
আর… চাষীরা হাঁটছেন… মহারাষ্ট্র থেকে… কেরালা থেকে… তেলঙ্গানা থেকে… ধুলো ধুলো… মাটির রাস্তা… গ্রামের রাস্তা… হাইওয়ে… শহর… হাঁটছেন… মানচিত্র… রক্তের দাগ… পা ফেটে যাচ্ছে… জমি ফেটে যাচ্ছে… মানচিত্র ফেটে যাচ্ছে এবার… মিছিল আরও একটু বড় হচ্ছে… হাঁটছেন… আপনি খুব ঠাণ্ডা মাথায়… এসি চালিয়ে ভাবছেন… হুঁ, রাস্তাই একমাত্র রাস্তা… আর… ওঁরা হাঁটছেন… ওই লাইনটা জেনে, বা, না জেনে… ঋণে একটু একটু করে অনেকটা ডুবে গ্যাছেন… ভেসে থাকাটুকুর জন্য হাঁটছেন… রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছতেই হবে… আরও একটু হেঁটে যেতেই হবে এইসব রক্তাক্ত পা-গুলোকে… এখন ক্লান্তির সময় নেই… আরও একটু… তুলোচাষী তাঁর পিতার আত্মহত্যার ভারী ইতিহাস মাথায় নিয়ে হাঁটছেন… তেতো একটা হৃদয় নিয়ে হাঁটছেন আখচাষী… একদিন একটা মানচিত্র সেরে উঠবে… ভাতের স্বপ্ন দেখতে দেখতে হাঁটছেন ধানচাষী… একটা গোটা ভারতরাষ্ট্র হাঁটছে… যে আলোয় একটার পর একটা ক্রিয়াপদ পিছলে যাচ্ছে শুধু… লজ্জা পাচ্ছে… ফেসবুকে পোস্ট করছে… আবার ভুলেও যাচ্ছে এইসব লং মার্চের ইতিহাস-ভূগোল-অর্থনীতি-রাজনীতি… কয়েকদিন পর আবার মেতে উঠছে অন্য কিছু নিয়ে… গণভোটে বিজয়ী করছে ফ্যাসিবাদকে… লংশট… ফ্রিজ… ডিপ ফোকাস… ধারালো পতাকায় কেটে যাচ্ছে বোধের অগম্য প্রতিটি ঋতু… ক্যামেরা যে কোথায় বসতে চাইবে আজ…
# * # * #
- তুমি ভোট দাও নীলুদা !
- (ম্লান হাসি) হ্যাঁ, দিই।
- কেন ? কী পাও ভোট দিয়ে ?
- তা বলে আমি তোমায় পালটা প্রশ্ন করবনা যে তুমি ভোট না দিয়ে কী পাও… (হাসি)
- যাকগে, নোটা-য় দাও নিশ্চয়ই ? ভারতবর্ষের মূলধারার প্রত্যেকটা পার্টি খারাপ। খুব খারাপ। তোমাকে আর নতুন করে কীই বা বলব…
- দ্যাখো, আমি কখনও নোটায় ভোট দিইনি। শুধু চেষ্টা করেছি ইস্যুটা বুঝতে… শত্রুকে চিনতে… ফ্রণ্টটা বুঝতে… যুদ্ধ তো নানারকম, বলো !
(চলবে)