সম্পাদকীয়
“আর এভাবেই জন্ম নিল – রবীন্দ্রনাথ লাইভ। আজকের শিল্পীর প্রতিক্রিয়া আজকের ঘটনার নিরিখে আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে – একে মিলিয়ে দ্যাখা এক-দেড়শ’ বছর আগে ঘ’টে যাওয়া রবীন্দ্রনাথের টাইমলাইনের সাথে।”
“বাঁচিয়া থাকিলে বংশের মুখ উজ্জ্বল করিবে”…
“পন্ডিত হইবে”, “জ্ঞানী হইবে”, “বিশাল সম্পত্তির মালিক হইবে”, “দানী হইবে” এমনকি “রাজাধিরাজ হইবে” অবদি শোনা যায়। কিন্তু কোনোদিনই শুনিনি কেউ বলছে — মহাশয়, আপনার পুত্রটি বড় হইয়া রবীন্দ্রনাথ হইবে।
এহেন আজব আশীর্বাদ বা অভিশাপ হয়ত কারো কষ্টকল্পনাতেও আসবে না। তবু একদিন এমনটাই শোনা গেল আমাদের অঙ্ক কোচিং-এ। বেশ কয়েকজন উত্তেজিত ছাত্র ও তাদের সামনে বসা ভরত স্যার, উভয়পক্ষের বাদানুবাদ — বিষয়, বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথ হওয়া। স্যার দৃঢ়ভাবে ঘাড় নেড়ে চলেছেন, নাহ্ তোমরা কেউই রবীন্দ্রনাথ হতে পারবে না। তাঁর মুখ গম্ভীর, চোখ মাটিতে নিবদ্ধ, আর সামনে আশাহত উদ্ধত ছাত্রের দল, মানে কী, পারব না, কেন পারব না?
না, আমরা কেউই রবীন্দ্রনাথ হওয়ার ক্রাশ কোর্স করতে সেখানে ঢুকিনি, এমনও নয় যে সপ্তা’য় সপ্তা’য় আমরা কতটা রবি ঠাকুর হলাম তার টেস্ট হত কোচিং-এ, আর তাতে খারাপ ফল আসায় এসব শুনতে হচ্ছে, তুমি এবছর আর রবীন্দ্রনাথ হতে পারলে না আবার সামনের বছর… কিম্বা, এভাবে চললে তুমি কিন্তু চল্লিশ পারসেন্টের বেশি রবি ঠাকুর হওয়ার আশা রেখো না…
সত্যি বলতে কী, আমাদের মধ্যে কারো আদপেও রবীন্দ্রনাথ হওয়ার কোনো সাধ ছিল না, এমন এক হওয়ার চিন্তাটিও মাথায় আসেনি কোনোদিন তার আগে, কিন্তু ওই যে স্যার গন্ডি টানলেন, হতে পারবে না, কক্ষণও না, ব্যাস… যেন কেউ দড়াম ক’রে একটা শেষ কথা বসিয়ে দিল, একটা সম্ভাবনাকে জোর ক’রে আমাদের নাগালের বাইরে নিয়ে গেল, আমাদের অধিকারকে ঠুকে ঠুকে একটা অন্যায় রকমের ছোট বাক্সের মধ্যে ভ’রে দিল। আমরা গর্জে উঠলাম।
বান্টির ওপর এই ঘটনার প্রভাব দীর্ঘকাল থেকে গিয়েছিল — ও ছিল আমাদের টপার, ভীষণ আত্মপ্রত্যয়ী — এই ঘটনায় সে রবীন্দ্রনাথকে একজন কম্পিটিটরের মতই হিংসে করত। বাঙালির রবীন্দ্রপ্রেমকে আদিখ্যেতা মনে ক’রে তীব্র সমালোচনা করত। আর এভাবেই তার সারাক্ষণের সঙ্গী হয়ে উঠতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। ওই ঘটনার তিন চার মাস পর, একবার হতাশভাবে তাকে বলতে শুনেছিলাম, “তবে আর বেঁচে কী লাভ ভাই, যদি আগে থেকেই তোমার লিমিট সেট হয়ে গিয়ে থাকে, কোন জিনিসকে জীবনে ক্রশ করতেই পারব না, এটা ভাবলে আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না।”
সেদিনের সেই ঘটনা পরে যতবারই ভাবি, হাসি পায়। ভরত স্যারের কথাগুলো থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা যত না প্রকাশ হয়, তার চেয়ে বেশি প্রকাশ হয় এক অবুঝ আস্থা। ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু এক সভ্যতার সেই নাগরিক যে আশ্রয় খুঁজে পায় জাতির নস্টালজিয়ায়। তাঁর কাছে তাঁর ছাত্রের আগামী জীবনের সমস্ত সম্ভাবনার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে এক ঘ’টে যাওয়া অতীত। তিনি বোঝেন না আসলে ‘রবীন্দ্রনাথ হওয়া’ ব’লে কোনো কিছুই হয় না, হ’তে পারে না। কোনো মানুষই অন্য কারো মত হয় কী? প্রত্যেকেই বিশেষ হয়, অপূর্ব হয়, নতুন হয়। সেই নতুনকে সেই সম্ভাবনাকেই অভিনন্দন জানাতে আমরা মানুষের জন্মে খুশি হই। তাছাড়াও একজন ব্যক্তিবিশেষের সমস্ত কর্মকান্ড, তথাকথিত সাফল্য/অসাফল্যর মধ্যে শুধু সে একা থাকে না, মিশে থাকে তার সময়, সমাজ, পরিবেশ। যখন আমরা রবীন্দ্রনাথ বা অন্য কোন মহান ব্যক্তিত্বের জীবন বা কাজের দিকে তাকাই, তখন সেই পরিসরের ভাঁজে মিশে থাকা কত অজানা অচেনা মানুষ, কত ঘটনা আমরা জানতেও পারি না কোনোদিন।
আজকের কোনো কবি শিল্পী সাহিত্যিক ঠিক একইভাবে এই সময় সমাজ পরিস্থিতির সম্মিলিত ফসল। এসব কিছুকে বাদ দিয়ে তাকে দেখা যায় না। আমরা তাই জানতে চাইলাম, কেমন হবে যদি তাঁদের সাথে প্রতিস্থাপন ঘটে রবীন্দ্রনাথের, প্রতিস্থাপন ঘটে দুটো শতাব্দীর… কীরকম? কী এই প্রতিস্থাপন? ধরা যাক, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড – রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধি ত্যাগ করার জন্য চিঠি লিখতে বসলেন বড়লাটকে… ঠিক সেরকমই আজকের কোনো ম্যাসাকারের প্রতিক্রিয়ায় যখন কোনো শিল্পী উপাধি/পুরষ্কার ত্যাগ করতে চাইবেন, চিঠি লিখবেন, কেমন হবে সেই চিঠি? আমরা দেখতে চাইলাম রবীন্দ্রনাথের চিঠির সাপেক্ষে এই নতুন সময়ের চিঠিকে, তাদের মিল-অমিলের সম্পর্কগুলো। তেমনই কোনো ব্যক্তিগত ঘটনা, যেমন স্ত্রীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ স্মরণের কবিতা লিখছেন, আজ সেরকম ব্যক্তিগত কোনো মোড়ে এসে কী লিখবেন, কীভাবে নিজেকে প্রকাশ করবেন কোনো কবি?
আর এভাবেই জন্ম নিল – রবীন্দ্রনাথ লাইভ। আজকের শিল্পীর প্রতিক্রিয়া আজকের ঘটনার নিরিখে আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে – একে মিলিয়ে দ্যাখা এক/দেড়শ’ বছর আগে ঘ’টে যাওয়া রবীন্দ্রনাথের টাইমলাইনের সাথে।
পত্রিকার এই প্রোজেক্টে অংশ নিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞ করেছেন সমসাময়িক বিভিন্ন কবি ও সাহিত্যিক।
পত্রিকার কাজ চলাকালীন একদিন বান্টিকে ফোনে ধরি, ও তখন মুম্বাই, রবীন্দ্রনাথকে ছেড়ে নিজের কাজেকর্মে মন দিয়েছে। কোচিং-এর সেই কথা ওঠায় হাসতে হাসতে বলল, তোর মনে আছে ও’দিন ভরত স্যার সিচুয়েশন সামলাতে শেষে একটা উইন-উইন দিয়েছিল – মানে, তোমরা চেষ্টা করলে হয়ত পিকাসো হতে পারবে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ… উমহু – আর আমরাও নাছোড়বান্দা, ভাঙা মেলায় না-বেচতে পারা পিকাসো কম দামে ছাড়ছ, বুঝি না ভেবেছ? একদম নয়। নেবো তো রবি ঠাকুরের কেরিয়ারই নেব।
— আচ্ছা, ওই ব্যাচেরই কেউ নোবেল হটায়নি তো?
মে, ২০১৯